সূরা আন-নিসা (আয়াত: 29)
হরকত ছাড়া:
يا أيها الذين آمنوا لا تأكلوا أموالكم بينكم بالباطل إلا أن تكون تجارة عن تراض منكم ولا تقتلوا أنفسكم إن الله كان بكم رحيما ﴿٢٩﴾
হরকত সহ:
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَاْکُلُوْۤا اَمْوَالَکُمْ بَیْنَکُمْ بِالْبَاطِلِ اِلَّاۤ اَنْ تَکُوْنَ تِجَارَۃً عَنْ تَرَاضٍ مِّنْکُمْ ۟ وَ لَا تَقْتُلُوْۤا اَنْفُسَکُمْ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ بِکُمْ رَحِیْمًا ﴿۲۹﴾
উচ্চারণ: ইয়াআইয়ূহাল্লাযীনা আ-মানূলা-তা’কুলূ আমওয়া-লুকুম বাইনাকুম বিলবা-তিলি ইল্লাআন তাকূনা তিজা-রাতান ‘আন তারা-দিম মিনকুম ওয়ালা-তাকতুলূআনফুছাকুম ইন্নাল্লা-হা কা-না বিকুম রাহীমা।
আল বায়ান: হে মুমিনগণ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা। আর তোমরা নিজেরা নিজদেরকে হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে পরম দয়ালু।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ২৯. হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি(১) অন্যায়ভাবে(২) গ্রাস করো না; কিন্তু তোমরা পরস্পর রাযী হয়ে(৩) ব্যবসা করা বৈধ(৪) এবং নিজেদেরকে হত্যা করো না(৫); নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।
তাইসীরুল ক্বুরআন: হে ঈমানদারগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসায় বৈধ এবং নিজেদের ধ্বংস ডেকে এনো না কিংবা তোমরা পরস্পরকে হত্যা করো না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি কৃপাময়।
আহসানুল বায়ান: (২৯) হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না। [1] তবে তোমাদের পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যবসার মাধ্যমে (গ্রহণ করলে তা বৈধ)।[2] আর নিজেদেরকে হত্যা করো না;[3] নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।
মুজিবুর রহমান: হে মু’মিনগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরের ধন-সম্পদ গ্রাস করনা; কেবলমাত্র পরস্পর সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা কর তা বৈধ এবং তোমরা নিজেদের হত্যা করনা; নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল।
ফযলুর রহমান: হে ঈমানদারগণ! তোমরা পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা ছাড়া একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। আর নিজেরা খুনোখুনি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াবান রয়েছেন।
মুহিউদ্দিন খান: হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ। আর তোমরা নিজেদের কাউকে হত্যা করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা’আলা তোমাদের প্রতি দয়ালু।
জহুরুল হক: ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমাদের সম্পত্তি জুচ্চুরি করে নিজেদের মধ্যে গ্রাস করো না, তবে যদি তোমাদের পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বারা এ হয়ে থাকে, আর নিজেদের লোকদের হত্যা করো না, যেহেতু আল্লাহ্ নিঃসন্দেহ তোমাদের প্রতি অফুরন্ত ফলদাতা।
Sahih International: O you who have believed, do not consume one another's wealth unjustly but only [in lawful] business by mutual consent. And do not kill yourselves [or one another]. Indeed, Allah is to you ever Merciful.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ২৯. হে মুমিনগণ! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি(১) অন্যায়ভাবে(২) গ্রাস করো না; কিন্তু তোমরা পরস্পর রাযী হয়ে(৩) ব্যবসা করা বৈধ(৪) এবং নিজেদেরকে হত্যা করো না(৫); নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।
তাফসীর:
(১) আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, পরস্পরের মধ্যে অন্যায় পন্থায় একের সম্পদ অন্যের পক্ষে ভোগ করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। অনুরূপভাবে আরও বুঝা যায় যে, নিজস্ব সম্পদও অন্যায় পথে ব্যয় করা কিংবা অপব্যয় করা নিষিদ্ধ।
(২) আয়াতে উল্লেখিত ‘বাতিল’ শব্দটির তরজমা করা হয়েছে ‘অন্যায়ভাবে। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং অন্যান্য সাহাবীগণের মতে শরীআতের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ এবং নাজায়েয সবগুলো পস্থাকেই বাতিল বলা হয়। যেমন, চুরি, ডাকাতি, আত্মসাৎ, বিশ্বাসভঙ্গ, ঘুষ, সুদ, জুয়া প্রভৃতি সকল প্রকার অন্যায় পন্থাই এ শব্দের অন্তর্ভুক্ত। [বাহরে মুহীত]
(৩) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বিক্রির জন্য সন্তুষ্টি অপরিহার্য। [ইবন মাজাহঃ ২১৮৫। এ সন্তুষ্টি সম্পূর্ণরূপে সম্পন্ন হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বেচাকেনার ক্ষেত্রে আরও কিছু দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন, যেমন, “বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়ে সওদা করার স্থান ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত (সওদা বাতিল করার) সুযোগের অধিকারী থাকবে। তবে- পৃথক হওয়ার পরও এ সুযোগ তাদের জন্য থাকবে-যারা খেয়ার বা সুযোগের অধিকার দেয়ার শর্তে সওদা করবে।” [বুখারী: ২১০৭]
(৪) এর দ্বারা বলে দেয়া হয়েছে যে, যেসব ক্ষেত্রে ব্যবসার নামে সুদ, জুয়া, ধোঁকা-প্রতারণা ইত্তাদির আশ্রয় নিয়ে অন্যের সম্পদ হস্তগত করা হয়, সেসব পন্থায় সম্পদ অর্জন করা বৈধ পন্থার অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং হারাম ও বাতিল পন্থা। তেমনি যদি স্বাভাবিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রেও লেনদেনের মধ্যে উভয় পক্ষের আন্তরিক সন্তুষ্টি না থাকে, তবে সেরূপ ক্রয়-বিক্রয়ও বাতিল ও হারাম। কাতাদা বলেন, ব্যবসা আল্লাহর রিযক ও আল্লাহর হালালকৃত বিষয়, তবে শর্ত হচ্ছে, এটাকে সত্যবাদিতা ও সততার সাথে পরিচালনা করতে হবে। [তাবারী]
(৫) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথ করে বলে যে, আমি অন্য কোন ধর্মের উপর। তাহলে সে ঐ ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। বনী আদম যার মালিক নয় এমন মানত গ্রহণযোগ্য নয়। যে কেউ দুনিয়াতে নিজেকে কোন কিছু দিয়ে হত্যা করবে, এটা দিয়েই তাকে কেয়ামতের দিন শাস্তি দেয়া হবে। যে কোন মুমিনকে লা'নত করল সে যেন তাকে হত্যা করল। অনুরূপভাবে যে কেউ কোন মুমিনকে কুফরীর অপবাদ দিল, সেও যেন তাকে হত্যা করল। [বুখারীঃ ৬০৪৭, মুসলিমঃ ১৭৬]
অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে কেউ পাহাড় থেকে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনে চিরস্থায়ীভাবে পাহাড় থেকে পড়ার অনুরূপ শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি বিষ পানে আত্মহত্যা করবে, সে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের আগুনে বিষ পানের আযাব ভোগ করতে থাকবে। আর যে কেউ কোন ধারাল কিছু দিয়ে আত্মহত্যা করবে, সে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামের আগুনে তা দ্বারা শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। [বুখারীঃ ৫৭৭৮, মুসলিমঃ ১৭৫]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: (২৯) হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না। [1] তবে তোমাদের পরস্পর সম্মতিক্রমে ব্যবসার মাধ্যমে (গ্রহণ করলে তা বৈধ)।[2] আর নিজেদেরকে হত্যা করো না;[3] নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।
তাফসীর:
[1] بِالْبَاطِلِ (অন্যায়ভাবে)এর মধ্যে ধোঁকা-প্রতারণা এবং জাল-জুয়াচুরি, ছল-চাতুরী ও ভেজাল মিশ্রিত করা সহ এমন সব ব্যবসা ও অর্থ উপার্জনের পদ্ধতিও শামিল, যা শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ। যেমন, জুয়া, সুদ ইত্যাদি। অনুরূপ নিষিদ্ধ হারাম জিনিসের ব্যবসা করাও অন্যায়ভাবে পরের মাল ভক্ষণ করার শামিল। যেমন, বিনা প্রয়োজনের ছবি তোলা, গান-বাজনা বা ফিল্ম তথা অশ্লীল ছবির ক্যাসেট, সিডি বা তার প্লেয়ার যন্ত্র ইত্যাদি তৈরী করা, বিক্রি করা এবং মেরামত করা সব কিছুই নাজায়েয।
[2] এর জন্যও শর্ত হল, এই আদান-প্রদান হালাল জিনিসের হতে হবে। হারাম জিনিসের ব্যবসা আপোসে সম্মতিক্রমে হলেও তা হারাম হবে। তাছাড়া আপোসের সম্মতিতে ‘খিয়ারে মজলিস’-এর বিষয়ও এসে যায়। অর্থাৎ, যতক্ষণ তারা একে অপর থেকে পৃথক না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্রয়-বিক্রয় বানচাল করার অধিকার থাকবে। যেমন হাদীসে এসেছে, ((البَيْعَانِ بِالْخِيَارِ مَالَمْ يَتَفَرَّقاَ)) ‘‘ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের ততক্ষণ পর্যন্ত (ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপারে) এখতিয়ার থাকে, যতক্ষণ না তারা একে অপর থেকে পৃথক হয়।’’ (বুখারী, মুসলিম)
[3] এর অর্থ আত্মহত্যাও হতে পারে, যা মহাপাপ। আর পাপ করাও হতে পারে, কেননা তাও ধ্বংসের কারণ হয়। আবার কোন মুসলিমকে হত্যা করাও হতে পারে। কারণ, সকল মুসলিম একটি দেহের মত। কাজেই কোন মুসলিমকে হত্যা করা মানেই নিজেকে হত্যা করা।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: ২৯ ও ৩০ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা মু’মিন বান্দাদেরকে অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ গ্রাস করতে নিষেধ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের দিন বলেন,
فَإِنْ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ عَلَيْكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هٰذَا
(রাঃ) তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্মান আজকের দিনের মত হারাম। (সহীহ বুখারী হা: ৬৬৬৭) অর্থাৎ আজকের দিন যেমন রক্তপাত করা, যুদ্ধবিগ্রহ করা হারাম তেমনি অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, অন্যের সম্পদ খাওয়া ও সম্মানহানি করা হারাম।
এ অন্যায়ে সকল অন্যায় শামিল। যেমন চুরি, ডাকাতি ছিনতাই, সুদ ইত্যাদি।
তবে একে অপরের সম্পদ খেতে পারবে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে। শর্ত হল ক্রয়-বিক্রয় উভয়ের সন্তুষ্টিতে হালাল বস্তুতে হালাল পন্থায় হতে হবে।
তাই সকল হারাম বস্তু- যেমন বিড়ি, সিগারেট, নেশাজাতিয় দ্রব্য ও পণ্য এবং গানের সিডি, অশ্লীল ছবি ছাড়াও আরো যত হারাম বস্তু ও হারাম বস্তুর মাধ্যম রয়েছে সেগুলোকে জীবিকা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা, সেগুলো উৎপাদন করা, সরবরাহ করা এবং সেসব কাজে সহযোগিতা করা ও চাকুরী করা হারাম।
কেননা এগুলোতে নিজের কায়িক শ্রম হালাল থাকলেও মূল বস্তু হারাম। তাই ব্যবসায় হতে হবে হালাল বস্তুতে এবং হালাল পন্থায় এবং উভয়ের সন্তুষ্টিতে।
তারপর আল্লাহ তা‘আলা অন্যায়ভাবে নিজেদেরকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَا تُلْقُوْا بِأَيْدِيْكُمْ إِلَي التَّهْلُكَةِ)
“এবং নিজ হাতে নিজেকে ধ্বংসের দিকে প্রসারিত কর না”(সূরা বাকারাহ ২:১৯৫) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
(وَمَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ بِشَيْءٍ فِي الدُّنْيَا عُذِّبَ بِهِ يَوْمَ القِيَامَةِ)
দুনিয়াতে যে ব্যক্তি নিজেকে যে জিনিস দ্বারা হত্যা করবে কিয়ামাতের দিন তাকে সে জিনিস দ্বারা শাস্তি প্রদান করা হবে। (সহীহ বুখারী হা: ৬০৪৮)
সুতরাং ইসলাম মানবাধিকারের সর্ববিধ বিধান নিশ্চিত করেছে। মুসলিম জাতি যদি ইসলামকে সঠিকভাবে মেনে চলে তাহলে অন্য কোন মানবাধিক সংস্থার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে না। ইসলামই তাদের জন্য যথেষ্ট।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. অন্যায়ভাবে মুসলিম ভাইয়ের সম্পদ খাওয়া হারাম।
২. হালাল বস্তু ও পণ্যের ব্যবসায়-বাণিজ্য বৈধ।
৩. কোন মুসলিম ব্যক্তিকে বা নিজেকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হারাম।
৪. জান, মাল, সম্পদ ও সম্মান সকল অধিকার ইসলাম যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেছে।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: ২৯-৩১ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা তার ঈমানদার বান্দাদেরকে একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করতে নিষেধ করছেন। সে উপার্জনের দ্বারাই হোক যা শরীয়তে হারাম, যেমন-সুদ খাওয়া, জুয়া খেলা বা এরকমই প্রত্যেক প্রকারের কৌশলের দ্বারাই হোক, যদিও এটাকে শরীয়তে বৈধ রাখা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার আল্লাহ তাআলা খুব ভালই জানেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-কে প্রশ্ন করা হচ্ছে, একটি লোক কাপড় ক্রয় করছে এবং বলছে, আমার যদি পছন্দ হয় তবে রেখে দেব, নচেৎ কাপড় এবং একটি দিরহাম ফিরিয়ে দেব'। এর হুকুম কি? হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) আয়াতটি পাঠ করেন। অর্থাৎ তাকে অন্যায়ভাবে মাল ভক্ষণকারীর অন্তর্ভুক্ত করেন। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি ‘মুহাকাম’ অর্থাৎ রহিত নয়। এটা কিয়ামত পর্যন্ত রহিত হতে পারে না। হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হতেই বর্ণিত আছে যে, যখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন মুসলমানগণ একে অপরের মাল ভক্ষণ করা পরিত্যাগ করেন। যার ফলে (আরবী) (৪৮:১৭) আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। তিজারাতান শব্দটিকে তিজারাতুনও পড়া হয়েছে। এটি (আরবী) যেমন বলা হচ্ছে-‘অবৈধতাযুক্ত কারণসমূহ দ্বারা মাল জমা করো না। কিন্তু শরীয়তের পন্থায় ব্যবসা দ্বারা লাভ করা বৈধ, যা ক্রেতা ও বিক্রেতার সম্মতিক্রমে হয়ে থাকে। যেমন অন্য জায়গায় বলা হয়েছে-‘কোন নিস্পাপ প্রাণকে মেরো না। তবে হকের সঙ্গে হলে জায়েয আছে। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছে-‘তথায় তারা প্রথম মৃত্যু ছাড়া আর মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে না।
হযরত ইমাম শাফিঈ (রঃ) এ আয়াত হতে দলীল গ্রহণ করে বলেন, সম্মতি ছাড়া ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হয় না। কেননা, এটাই হচ্ছে সম্মতির পূর্ণ সনদ। শুধুমাত্র আদান-প্রদান কখনও সম্মতির উপর দলীল হতে পারে না।' জমহুর এর বিপরীত মতপোষণ করেন। অন্যান্য তিনজন ইমামের উক্তি এই যে, মৌখিক কথা বার্তা যেমন সম্মতির প্রমাণ, দ্রুপ আদান-প্রদানও সম্মতির দলীল। কোন কোন মনীষী বলেন যে, কম মূল্যবান সাধারণ জিনিসে শুধু লেন-দেনই যথেষ্ট এবং এরকমই ব্যবসার সে নিয়ম থাকে। সহীহ মাযহাবে তো সতর্কতামূলক দৃষ্টিতে কথা বার্তায় স্বীকৃতি থাকা অন্য কথা। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।
হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, ক্রয়-বিক্রয় হোক বা দান হোক, সব কিছুর মধ্যেই এ হুকুম রয়েছে। তাফসীর-ই-ইবনে জারীর (রঃ)-এর একটি মার’ হাদীসে রয়েছেঃ ব্যবসা হচ্ছে সম্মতি এবং ব্যবসার পরেই ইখতিয়ার রয়েছে। কোন মুসলমানের অন্য মুসলমানকে প্রতারিত করা বৈধ নয়।' এ হাদীসটি ‘মুরসাল'। মজলিসের শেষ পর্যন্তও পূর্ণ সম্মতির অধিকার রয়েছে।
সহীহ বুখারী ও মুসলিমে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘বিক্রেতা ও ক্রেতা উভয়েরই পৃথক না হওয়া পর্যন্ত ইখতিয়ার রয়েছে। এ হাদীস অনুসারেই ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম শাফিঈ (রঃ) এবং তার সহচরদের ফতওয়া রয়েছে। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী জমহুরেরও ফতওয়া এর উপরে ভিত্তি করেই। এ পূর্ণ সম্মতির মধ্যে ক্রয়-বিক্রয়ের তিন দিন পরে ইখতিয়ার দেয়াও জড়িত রয়েছে যদিও সে ইখতিয়ার পূর্ণ এক বছরের জন্যেও হয়, যেমন গ্রামবাসী প্রভৃতি লোকদের মধ্যে রয়েছে।
ইমাম মালিক (রঃ)-এর প্রসিদ্ধ মাযহাব এটাই, যদিও তাঁর মতে শুধুমাত্র আদান-প্রদান দ্বারাই ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হয়ে থাকে। শাফিঈ মাযহাবেরও একটা উক্তি এটাই এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেন যে, মানুষ ব্যবসায়ের জন্যে যে অল্প মূল্যের সাধারণ জিনিস রেখে থাকে তাতে শুধুমাত্র আদান-প্রদানই যথেষ্ট হবে। আসহাবের কারও কারও ইখতিয়ার এটাই, যেমন মুত্তাফাকুন আলাইহি।
এরপর বলা হচ্ছে-‘আল্লাহ তা'আলার হারাম কাজগুলো করে অবাধ্য হয়ে, আর অন্যায়ভাবে একে অপরের মাল ভক্ষণ করে তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংস করো না। আল্লাহ তা'আলা তোমাদের উপর অত্যন্ত দয়ালু। তাঁর প্রত্যেক আদেশ ও নিষেধ দয়ায় পরিপূর্ণ।
মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আমর ইবনে আল আস (রাঃ)-কে ‘যাতুস্সালাসিলের’ যুদ্ধের বছরে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি বলেন, একদা কঠিন শীতের রাত্রে আমার স্বপ্নদোষ হয়, এমনকি গোসল করাতে আমি আমার জীবনের উপর ভয় করি। সুতরাং আমি তায়াম্মুম করে নিয়ে আমার জামাআতকে ফজরের নামায পড়িয়ে দেই। অতঃপর ফিরে এসে আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হই। তাঁর নিকট আমি আমার এ ঘটনাটি বর্ণনা করি।
তিনি বলেনঃ তুমি কি তাহলে অপবিত্র অবস্থায় তোমার সঙ্গীদেরকে নামায পড়িয়েছ?' আমি বলি, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কঠিন ঠাণ্ডা ছিল এবং আমার প্রাণের ভয় ছিল। অতঃপর আমার মনে পড়ে গেল যে, আল্লাহ তা'আলা বলেছেন-“তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংস করো না।' একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হেসে উঠেন এবং আমাকে কিছুই বলেননি।
অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, লোকেরাই ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট বর্ণনা করেছিলেন এবং তিনি জিজ্ঞেস করায় হযরত আমর ইবনে আস (রাঃ) এ ওর পেশ করেছিলেন।
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফে রয়েছেঃ “যে ব্যক্তি কোন লোহা দ্বারা আত্মহত্যা করবে, সে কিয়ামত পর্যন্ত জাহান্নামের মধ্যে লোহা দ্বারা আত্মহত্যা করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি জেনে-শুনে জীবন দেয়ার উদ্দেশ্যে বিষপান করবে, সে সদা-সর্বদার জন্যে জাহান্নামে বিষপান করতে থাকবে।'
আর একটি বর্ণনায় রয়েছেঃ ‘যে নিজেকে যে জিনিস দ্বারা হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন তাকে সে জিনিস দ্বারা শাস্তি দেয়া হবে।' রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঘোষণায় রয়েছেঃ তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে একটি লোক আহত হয়। সে ছুরি দিয়ে স্বীয় হাত কেটে দেয়। রক্ত বন্ধ হয় না এবং তাতেই সে মারা যায়। তখন আল্লাহ পাক বলেন-“আমার বান্দা নিজেকে ধ্বংস করার ব্যাপারে তাড়াতাড়ি করেছে, সুতরাং আমি তার উপর জান্নাত হারাম করে দিয়েছি।'
এজন্যেই আল্লাহ তা'আলা এখানে বলেন-“যে কেউ অত্যাচার ও সীমা অতিক্রম করে একাজ করবে, অর্থাৎ হারাম জেনেও স্বীয় বীরত্বপণা দেখিয়ে ঐ কাজ করবে, সে জাহান্নামী হবে। সুতরাং প্রত্যেকেরই এ কঠিন ভীতি প্রদর্শন ব্যাপারে ভয় করা উচিত। অন্তরের পর্দা খুলে আল্লাহ তা'আলার এ নির্দেশ শ্রবণ করতঃ হারাম কাজ হতে (মানুষের) বিরত থাকা উচিত।
অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেন-“তোমরা যদি বড় বড় পাপ হতে বেঁচে থাক তবে আমি তোমাদের ছোট ছোট পাপগুলো ক্ষমা করে দেবো এবং তোমাদেরকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করবো।'
হযরত আনাস (রাঃ) হতে মার’ রূপে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, 'আমরা ওর মত কিছুই দেখিনি যা আমাদের প্রভুর পক্ষ হতে আমাদের নিকট পৌছেছে, অতঃপর আমরা তাঁর জন্যে আমাদের পরিবার ও সম্পদ হতে পৃথক হবো না যে, তিনি আমাদের বড় বড় পাপগুলো ছাড়া ছোট ছোট পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন'। এরপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ করেন। এ আয়াত সম্পর্কে বহু হাদীসও রয়েছে। আমরা কিছু কিছু এখানে বর্ণনা করছি।
মুসনাদ-ই-আহমাদে হযরত সালমান ফারেসী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে বলেনঃ ‘জুমআর দিন কি, তা তুমি জান কি'? আমি উত্তরে বলি, ওটা ঐদিন যে দিনে আল্লাহ তা'আলা আমাদের পিতা হযরত আদম (আঃ)-এর সৃষ্টি জমা করেন।
তিনি বলেনঃ “আমি যা জানি তা শুন। যে ব্যক্তি এ দিন ভালভাবে পবিত্রতা লাভ করতঃ জুম'আর নামাযের জন্যে আগমন করে এবং নামায শেষ না হওয়া পর্যন্ত নীরবতা অবলম্বন করে, তার সে কাজ পরবর্তী জুম'আ পর্যন্ত সমস্ত পাপ মোচনের কারণ হয়ে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত সে হত্যা কাজ হতে বেঁচে থাকে।
তাফসীর-ই-ইবনে জারীরে রয়েছে, হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) ও হযরত সাঈদ (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাদেরকে ভাষণ দান কালে বলেনঃ “যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তাঁর শপথ! এ কথা তিনি তিনবার বলেন। অতঃপর তিনি মাথা নীচু করেন। আমরা সকলেই নীচু করি এবং জনগণ কাঁদতে আরম্ভ করে। আমাদের অন্তর কেঁপে উঠে যে, আল্লাহর রাসূল (সঃ) কোন্ জিনিসের উপরই বা শপথ করলেন এবং নীরবতাই বা অবলম্বন করলেন কেন? অল্পক্ষণ পরে তিনি মস্তক উত্তোলন করেন এবং তাঁর চেহারা প্রফুল্ল ছিল, যা দেখে আমরা এত খুশী হই যে, আমরা লাল রঙ্গের উট পেলেও এত খুশী হতাম না। তখন তিনি বলতে আরম্ভ করেনঃ “যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, রমযানের রোযা রাখে, যাকাত আদায় করে এবং সাতটি কাবীরা গুনাহ হতে বেঁচে থাকে, তার জন্যে জান্নাতের সমস্ত দরজা খুলে রাখা হবে এবং তাকে বলা হবে-‘নিরাপত্তার সাথে তথায় চলে যাও।'
তাতে যে সাতটি পাপের উল্লেখ আছে তার বিস্তারিত বিবরণ সহীহ বুখারী ও মুসলিমে নিম্নরূপ এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “ধ্বংসকারী সাতটি পাপ হতে তোমরা বেঁচে থাক।' জিজ্ঞেস করা হয়, “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ঐপাপগুলো কি?' তিনি বলেনঃ (১) আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করা। (২) যাকে হত্যা করা নিষিদ্ধ তাকে হত্যা করা, তবে শরীয়তের কোন কারণে যদি তার রক্ত হালাল হয় সেটা অন্য কথা। (৩) যাদু করা। (৪) সুদ ভক্ষণ করা। (৫) পৃতিহীনের মাল ভক্ষণ করা। (৬) কাফিরদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করা। (৭) সতীসাধ্বী পবিত্র মুসলমান নারীদেরকে অপবাদ দেয়া।
একটি বর্ণনায় যাদুর পরিবর্তে ‘হিজরত করার পর পুনরায় ফিরে এসে স্বদেশে অবস্থান’ এ উক্তিটি রয়েছে। এটা অবশ্যই স্মরণযোগ্য কথা যে, উল্লিখিত সাতটি পাপকে কাবীরা বলার ভাবার্থ এই নয় যে, শুধুমাত্র এগুলোই কাবীরা.. গুনাহ, যেমন কারও কারও এ ধারণা রয়েছে। কিন্তু এটা একেবারেই ভুল কথা, বিশেষ করে ঐ সময়, যখন ওর বিপরীত দলীল বিদ্যমান থাকে। আর এখানেতো পরিষ্কার ভাষায় অন্যান্য কাবীরা গুনাহগুলোরও বর্ণনা বিদ্যমান রয়েছে। নিম্নলিখিত হাদীসগুলো দ্রষ্টব্যঃ
মুসতাদরিক-ই-হাকিমে রয়েছে যে, বিদায় হজ্বে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “হে জনমণ্ডলী! জেনে রেখো যে, নামাযীরা হচ্ছে আল্লাহর বন্ধু, যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামায নিয়মিতভাবে আদায় করে, রমযানের রোযা রাখে, ফরয জেনে এবং পুণ্য লাভের নিয়ত করে খুশী মনে যাকাত আদায় করে, আর ঐ সমুদয় কাবীরা গুনাহ হতে বিরত থাকে যেগুলো হতে আল্লাহ্ দূরে থাকতে বলেছেন।”
এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করেন, 'হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ঐ কাবীরা গুনাহগুলো কি?' তিনি বলেনঃ ‘শিরুক, হত্যা, যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন, পিতৃহীনের মাল ভক্ষণ, পবিত্র নারীদেরকে অপবাদ দেয়া, পিতা- মাতার অবাধ্য হওয়া এবং তোমাদের জীবন ও মরণের কিবলাহ্ বায়তুল্লাহ শরীফের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা। জেনে রেখো যে ব্যক্তি মৃত্যু পর্যন্ত এ বড় বড় পাপগুলো হতে দূরে সরে থাকবে এবং নামায ও যাকাত নিয়মিতভাবে আদায় করবে, সে আল্লাহর নবী (সঃ)-এর সঙ্গে জান্নাতে সোনার অট্টালিকায় অবস্থান করবে।
হযরত তায়লাস ইবনে মাইয়াস (রঃ) বলেন, আমি কয়েকটি পাপকার্য করে বসি যা আমার মতে কারীরা গুনাহই ছিল। আমি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে বলি যে, আমি কয়েকটি পাপকার্য। করেছি যেগুলোকে কাবীরা গুনাহ বলেই মনে করি। তিনি বলেন, ঐগুলো কি? আমি বলি যে, আমি এই এই কাজ করেছি। তিনি বলেন, এগুলো কাবীরা। গুনাহ্ নয়। আমি বলি যে, আমি আরও এই এই কাজ করেছি। তিনি বলেন, ‘এগুলোও কাবীরা গুনাহ নয়।' এসো, আমি তোমাকে কাবীরা গুনাহগুলো গণনা করে শুনিয়ে দেই। ঐগুলো হচ্ছে নয়টি। (১) আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে অংশী স্থাপন করা। (২) কাউকে বিনা কারণে হত্যা করা। (৩) যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের থেকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা। (৪) পবিত্রা নারীদেরকে অপবাদ দেয়া। (৫) সুদ ভক্ষণ করা। (৬) অন্যায়ভাবে ইয়াতিমের মাল ভক্ষণ করা। (৭) মসজিদ-ই-হারামে ধর্মদ্রোহীতা ছড়িয়ে দেয়া। (৮) যাদুকে বৈধ মনে করা। (৯) বিনা কারণে পিতা-মাতাকে কাঁদানো।
হযরত তায়লাস (রঃ) বলেন, এটা বর্ণনা করার পরেও হযরত ইবনে উমার (রাঃ) লক্ষ্য করেন যে, আমার ভয় তখনও কমেনি। কাজেই তিনি বলেন, তোমার কি জাহান্নামে প্রবেশের ভয় এবং জান্নাতে প্রবেশের আকাক্ষখা আছে? আমি বলি, হ্যাঁ! তিনি বলেন, “আচ্ছা, তোমার পিতা-মাতা বেঁচে আছেন কি? আমি বলি, শুধু মা বেঁচে আছেন। তিনি তখন বলেন, “আচ্ছা, তুমি তাকে নরম কথা বল, আহার করাতে থাক এবং এসব কাবারী গুনাহ থেকে বেঁচে থাক, তাহলেই তুমি অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে।'
অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত তায়তাসা ইবনে আলী হিন্দী (রঃ) হযরত ইবনে উমার (রাঃ)-এর সঙ্গে আরাফা প্রান্তরে আরাফার দিনে ‘পীলু' বৃক্ষের নীচে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তখন হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) স্বীয় মস্তক ও চেহারার উপর পানি ঢালছিলেন। তাতে এও রয়েছে যে, যখন হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) অপবাদ দেয়ার কথা উল্লেখ করেন, তখন আমি বলি, এটাও কি হত্যার মতই খুব বড় পাপ? তিনি বলেনঃ হ্যা, হ্যাঁ। ওর মধ্যে পাপসমূহের বর্ণনায় যাদুরও উল্লেখ রয়েছে।
আর একটি বর্ণনায় রয়েছে, তার সাথে আমার সাক্ষাৎ সন্ধ্যার সময় হয়েছিল এবং আমি তাঁকে কাবীরা গুনাহ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট শুনেছি যে, কাবীরা গুনাহ সাতটি।' আমি জিজ্ঞেস করি, কি কি? তিনি বলেনঃ ‘শিরক ও অপবাদ। আমি বলি, এ দু’টোও কি রক্তের মতই অন্যায়? তিনি বলেনঃ “হাঁ, হাঁ। আর কোন মুমিনকে বিনা কারণে হত্যা করা, যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করা, যাদু করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতিমের মাল ভক্ষণ করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং তোমাদের জীবন ও মৃত্যুর কিবলাহ বায়তুল্লাহ শরীফে ধর্মদ্রোহীতার কাজ করা।
মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর যে বান্দা। আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার করে না, নামায সু-প্রতিষ্ঠিত করে, যাকাত আদায় করে, রমযানের রোযা রাখে এবং কাবীরা গুনাহ হতে বেঁচে থাকে, সে জান্নাতী।' একটি লোক জিজ্ঞেস করেন, কাবীরা গুনাহগুলো কি?' তিনি বলেনঃ ‘আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থাপন করা, মুমিন প্রাণকে হত্যা করা এবং যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করা।
ইবনে মিরদুওয়াই স্বীয় তাফসীরে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইয়ামানবাসীর নিকট একটি পত্র লিখিয়ে পাঠিয়ে দেন। যাতে ফরযসমূহ, সুন্নাতসমূহ এবং দিয়্যাত অর্থাৎ জরিমানার নির্দেশসমূহ লিখিত ছিল এবং এ পত্রখানা তিনি হযরত আমর ইবনে হাযাম (রাঃ)-এর হাতে তাদের নিকট পাঠিয়েছিলেন। এ পত্রে নিম্নলিখিত কথাটিও ছিলঃ “কিয়ামতের দিন বড় বড় পাপসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাপ হবে এই যে, মানুষ আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থাপন করে, কোন মুমিন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, আল্লাহর পথে যুদ্ধের জন্যে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে যুদ্ধ করতে করতে প্রাণের ভয়ে পলায়ন করে, মা-বাপের অবাধ্য হয়, স্ত্রীলোকেরা যে পাপ করেনি তাদের প্রতি এরূপ পাপের অপবাদ দেয়, যাদু শিক্ষা করে, সুদ খায় এবং ইয়াতিমের মাল ধ্বংস করে।
অন্য বর্ণনায় কাবীরা গুনাহসমূহের মধ্যে মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার কথাও রয়েছে। আর একটি হাদীসে রয়েছে যে, কাবীরা গুনাহগুলো বর্ণনা করার সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) হেলান দিয়ে বসেছিলেন। কিন্তু যখন তিনি মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা কথার উল্লেখ করেন তখন তিনি সোজা হয়ে বসে পড়েন এবং বলেনঃ “সাবধান! তোমরা মিথ্যা সাক্ষ্য ও মিথ্যা কথা হতে দূরে থাকবে। তিনি একথা বার বার বলতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত সাহাবীগণ বলেন, যদি তিনি নীরব হতেন।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছে যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করি, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সবচেয়ে বড় গুনাহ কোন্টি? তিনি বলেনঃ ‘তা এই যে, তুমি অন্য কাউকে আল্লাহর অংশীদার কর, অথচ একমাত্র তিনিই তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি জিজ্ঞেস করি, তার পরে কোটি ? তিনি বলেনঃ তার পরে এই যে, তোমার সন্তান তোমার সাথে আহার করবে এ ভয়ে তুমি তাকে হত্যা করে ফেল। আমি জিজ্ঞেস করি, তারপর কোন্টি? তিনি বলেনঃ তারপরে এই যে, তুমি তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে পড়।' অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) (আরবী) (২৫:৬৮) হতে। (আরবী) (২৫:৭০) পর্যন্ত আয়াতগুলো পাঠ করেন।
মুসনাদ-ই-ইবনে হাতিমে রয়েছে যে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) মসজিদ-ই-হারামে হাতীমের মধ্যে বসে ছিলেন। তাঁকে এক ব্যক্তি মদ্য সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে। তখন তিনি বলেনঃ আমার মত বুড়ো বয়সের মানুষ কি এ স্থানে বসে আল্লাহর রাসূলের (সঃ) উপর মিথ্যা কথা বলতে পারে? অতঃপর তিনি বলেন, 'মদ্য পান হচ্ছে বড় পাপসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাপ। এ কাজ হচ্ছে সমস্ত দুশ্চরিত্রতার মূল। মদখোর ব্যক্তি নাম পরিত্যাগকারী হয়ে থাকে। সে স্বীয় মা, খালা এবং ফুফুর সাথে ব্যভিচার করতেও দ্বিধাবোধ করে না। এ হাদীসটি গারীব।
তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর মধ্যে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইন্তিকালের পর হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমার (রাঃ) এবং অন্যান্য আরও বহু সাহাবা-ই-কিরাম একবার একটি মজলিসে বসেছিলেন। তথায়। কাবীরা গুনাহগুলোর আলোচনা চলছিল যে, সবচেয়ে বড় গুনাহ কোনটি? কারও নিকট সর্বশেষ উত্তর ছিল না। তখন তারা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ)-কে পাঠান যে, তিনি যেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করে আসেন। তিনি তাঁর নিকট গমন করেন। তিনি উত্তরে বলেন যে, সবচেয়ে বড় পাপ হচ্ছে মদ্যপান। হযরত ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, ‘আমি ফিরে এসে উক্ত মজলিসে এ উত্তর শুনিয়ে দেই। কিন্তু মজলিসের লোক। সান্ত্বনা লাভ করলেন না। সুতরাং তারা সবাই উঠে গিয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ)-এর বাড়ী গমন করেন এবং তারা নিজেরাই তাঁকে জিজ্ঞেস করেন।
তখন তিনি বর্ণনা করেনঃ জনগণ নবী (সঃ)-এর সামনে একটি ঘটনা বর্ণনা করে যে, বানী ইসরাঈলের বাদশাহদের মধ্যে একজন বাদশাহ্ একটি লোককে গ্রেফতার করে। অতঃপর লোকটিকে বলে, হয় তুমি জীবনের আশা ত্যাগ কর না হয় এ কাজগুলোর মধ্যে কোন একটি কর, অর্থাৎ মদ্যপান কর বা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা কর কিংবা শূকরের মাংস ভক্ষণ কর। লোকটি কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনার পর হাল্কা জিনিস মনে করে মদ্যপান করতে সম্মত হয়। কিন্তু মদ্যপান করা মাত্রই সে নেশার অবস্থায় ঐ সমুদয় কাজও করে বসে যা হতে সে পূর্বে বিরত ছিল।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ ঘটনাটি শুনে আমাদেরকে বলেনঃ “যে ব্যক্তি মদ্যপান করে, আল্লাহ তা'আলা চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার নামায কবুল করেন না। আর যে ব্যক্তি মদ্যপানে অভ্যস্ত অবস্থাতেই মারা যায় এবং তার মূত্রস্থলীতে সামান্য পরিমাণও মদ্য থেকে যায়, আল্লাহ তা'আলা তার জন্যে জান্নাত হারাম করে দেন এবং যদি মদ্যপান করার পর চল্লিশ দিনের মধ্যেই মারা যায় তবে তার অজ্ঞতা যুগের মৃত্যু হয়ে থাকে। এ হাদীসটি দুর্বল। অন্য একটি হাদীসে মিথ্যা শপথকেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) কাবীরা গুনাহ বলে গণ্য করেছেন। (সহীহ বুখারী ইত্যাদি)
মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমে মিথ্যা শপথের পর নিম্নের উক্তিও রয়েছেঃ “যে ব্যক্তি আল্লাহর শপথ করে কোন কথা বলে এবং তাতে মশার সমানও বাড়িয়ে কিছু বলে, তার অন্তরে একটা কাল দাগ হয়ে যায়, যা কিয়ামত পর্যন্ত বাকী থেকে যায়। মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ মানুষের তার পিতা-মাতাকে গালি দেয়াও কাবীরা গুনাহ। জনগণ জিজ্ঞেস করে, “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! মানুষ তার পিতা-মাতাকে কিরূপে গালি দেবে?' তিনি বলেনঃ ‘এভাবে যে, সে অন্যের বাপকে গালি দেয়, অন্য লোকটি তখন তার বাপকে গালি দেয়, সে অন্যের মাকে গালি দেয়, অন্য লোকটি তখন তার মাকে গালি দেয়।
সহীহ বুখারী শরীফে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘সবচেয়ে বড় কাবীরা গুনাহ এই যে, মানুষ তার পিতা-মাতাকে অভিশাপ দেয়। জনগণ জিজ্ঞেস করে, “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এটা কিরূপে হতে পারে?' তিনি বলেনঃ ‘অন্যের মা-বাপকে বলে নিজের মা-বাপকে বলিয়ে নেয়া। সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ মুসলমানকে গালি প্রদান মানুষকে ফাসিক বানিয়ে দেয় এবং তাকে হত্যা করা হচ্ছে কুফরী।
মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘কাবীরা গুনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গুনাহ হচ্ছে কোন মুসলমানের মর্যাদা ক্ষুন্ন করা এবং একটা গালির পরিবর্তে দু'টো গালি দেয়া। জামেউত তিরমিযীতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি বিনা ওযরে দু’টি নামাযকে একত্রিত করে, সে কাবীরা গুনাহসমূহের দু'টি দরজার একটি দরজার মধ্যে প্রবেশ করে থাকে।'
মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমে হযরত আবু কাতাদাতুল আদাভী হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ)-এর যে পত্র আমাদের সামনে পাঠ করা হয় তাতে এও ছিল যে, বিনা ওযরে দু’ নামাযকে একত্রিত করা কাবীরা গুনাহ এবং যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করাও কাবীরা গুনাহ। মোটকথা, যোহর, আসর কিংবা মাগরিব ও ইশা সময়ের পূর্বে বা পরে শরীয়তের অবকাশ ছাড়া একত্রিত করে পড়া কাবীরা গুনাহ। তাহলে যারা মোটেই (নামায) পড়ে না তাদের পাপের তো কোন ঠিক ঠিকানাই নেই। যেমন, সহীহ মুসলিমে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ বান্দা ও শিরকের মধ্যেস্থলে রয়েছে নামাযকে ছেড়ে দেয়া।
সুনানের একটি হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমাদেরও কাফিরদের মধ্যে পৃথককারী জিনিস হচ্ছে নামাযকে ছেড়ে দেয়া। যে ব্যক্তি নামাযকে ছেড়ে দিল সে কুফরী করলো। অন্য একটি বর্ণনায় তাঁর এ উক্তিটিও নকল করা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি আসরের নামায ছেড়ে দিল তার কার্যাবলী বিনষ্ট হয়ে গেল। অন্য হাদীসে রয়েছে যে, যে ব্যক্তির আসরের নামায ছুটে গেল তার যেন মাল ও পরিবার পরিজন ধ্বংস হয়ে গেল।
মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, একটি লোক রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করে, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কাবীরা গুনাহ কি কি?' তিনি বলেনঃ “আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে অংশী স্থাপন করা, তাঁর নিয়ামত ও করুণা হতে নিরাশ হয়ে যাওয়া এবং আল্লাহর মকর হতে (মকর শব্দটি আল্লাহর ব্যাপারে ফন্দির প্রতিশোধ নেয়া বুঝায়) নির্ভয় থাকা এবং এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় গুনাহ।'
হযরত বাযযার (রঃ) হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, একটি লোক জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কাবীরা গুনাহগুলো কি?' তিনি বলেনঃ “আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, আল্লাহর নিয়ামত ও করুণা হতে নিরাশ হওয়া এবং আল্লাহর মকর থেকে নির্ভয় থাকা এবং এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় পাপ।' কিন্তু এর ইসনাদে সমালোচনা রয়েছে। সবচেয়ে সঠিক কথা এই যে, এ হাদীসটি মাওকুফ।
তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই এর মধ্যে রয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, সর্বাপেক্ষা বড় পাপ হচ্ছে মহা সম্মানিত আল্লাহ তাআলার প্রতি কু-ধারণা পোষণ করা।' এ বর্ণনাটি অত্যন্ত দুর্বল। ইতিপূর্বে ঐ হাদীসটিও বর্ণিত হয়েছে যার মধ্যে হিজরতের পর পুনরায় কাফিরদের দেশে বসতি স্থাপন করাকেও কাবীরা গুনাহ বলা হয়েছে। এ হাদীসটি তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াই-এর মধ্যে রয়েছে। সাতটি কাবীরা গুনাহর মধ্যে একটি এটিকে গণনা করা হয়েছে। কিন্তু এর ইসনাদের ব্যাপারে চিন্তার বিষয় রয়েছে এবং একে মারফু বলা সম্পূর্ণ ভুল। সঠিক কথা এটাই যা তাফসীরে ইবনে জারীরের মধ্যে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত আলী (রাঃ) কুফার মসজিদে মিম্বরে দাঁড়িয়ে খুৎবা দিচ্ছিলেন। তাতে তিনি বলেন, হে জনগণ! কবীরা গুনাহ সাতটি।' একথা শুনে লোকগুলো চীৎকার করে উঠে। তিনি তিনবার ওরই পুনরাবৃত্তি করেন।
অতঃপর তিনি বলেন, তোমরা আমাঁকে এর ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করছো না কেন? জনগণ তখন বলে, “হে আমীরুল মুমিনীন! বলুন, ওগুলো কি?' তিনি বলেন, আল্লাহর সঙ্গে অংশী স্থাপন করা, যে প্রাণ বধ করা আল্লাহ হারাম করেছেন তা বধ করা, পবিত্র স্ত্রীলোকদের প্রতি অপবাদ দেয়া, পিতৃহীনের মাল ভক্ষণ করা, সুদ খাওয়া, যুদ্ধের দিন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা এবং হিজরতের পর পুনরায় কাফিরদের দেশে এসে বসতি স্থাপন করা।' হাদীসটির বর্ণনাকারী হযরত সাহল (রঃ) তাঁর পিতা হযরত সাহল ইবনে খাইসুমার (রঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, ‘এটাকে কিভাবে কাবীরা গুনাহর অন্তর্ভুক্ত করলেন?' তিনি উত্তরে বললেন, হে প্রিয় বৎস! একটি লোক হিজরত করে মুসলমানদের সঙ্গে মিলিত হলো, গনীমতের মালে তার অংশ নির্ধারিত হলো, মুজাহিদদের নামের তালিকায় তার নাম এসে গেছে। অতঃপর সে সমস্ত জিনিস পরিত্যাগ করতঃ বেদুঈন হয়ে গিয়ে কাফিরদের দেশে ফিরে গেল এবং যেমন ছিল তেমনই হলো, এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কি হতে পারে?
মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর বিদায় হজ্বের খুৎবায় বলেনঃ সাবধান! আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না, অন্যায় হত্যা হতে বেঁচে থাক, তবে শরীয়তের অনুমতি অন্য জিনিস, ব্যভিচার করো না এবং চুরি করো না।' ঐ হাদীসটি পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে, অসিয়তের ব্যাপারে কারও ক্ষতি সাধন করাও একটি কাবীরা গুনাহ। তাফসীর-ই-ইবনে জারীরে রয়েছে যে, একদা সাহাবায়ে কেরাম কবীরা গুনাহসমূহের উল্লেখ করেন যে, আল্লাহর সঙ্গে অংশীদার স্থির করা, ইয়াতিমের মাল ভক্ষণ করা, ধর্মযুদ্ধ থেকে পলায়ন করা, পাক পবিত্র রমণীদের প্রতি অপবাদ দেয়া, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, মিথ্যা বলা, ধোকা দেয়া, খিয়ানত করা, যাদু করা, সুদ খাওয়া এগুলো সব কাবীরা গুনাহ। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ আর ঐ গুনাহকে কোথায় রাখছে যে, লোকেরা আল্লাহর ওয়াদা এবং নিজেদের কসমকে অল্প মূল্যে বিক্রি করে ফিরছে। আয়াতের শেষ পর্যন্ত তিনি তেলাওয়াত করেন। এর ইসনাদ স্পষ্ট এবং হাদীসটি হাসান।
তাফসীর-ই-ইবনে জারীরে রয়েছে যে, মিসরে কতগুলো লোক হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘আল্লাহ তা'আলার কিতাবের মধ্যে আমরা কতগুলো জিনিস এমন পাচ্ছি যেগুলোর উপর আমাদের আমল নেই। তাই, আমরা এ সম্বন্ধে আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করতে চাই।' হযরত ইবনে উমার (রাঃ) তাঁদেরকে নিয়ে মদীনায় আগমন করেন। তিনি তাঁর পিতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। হযরত উমার (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, কবে এসেছে? তিনি উত্তরে বলেন, এতদিন হলো।' পুনরায় জিজ্ঞেস করেন, অনুমতিক্রমে এসেছো কি? তারও উত্তর তিনি দেন। অতঃপর তিনি জনগণের কথা উল্লেখ করেন।
হযরত উমার (রাঃ) বলেন, তাদেরকে একত্রিত কর।' এরপর তিনি তাদের নিকট আগমন করেন এবং তাদের মধ্যে একজনকে জিজ্ঞেস করেন, তোমাকে আল্লাহ ও ইসলামের সত্যতার শপথ! তুমি কি সম্পূর্ণ কুরআন কারীম পাঠ করেছো?' লোকটি বলেন, হ্যা।' তিনি বলেন, “তুমি কি ওকে তোমার অন্তরে রক্ষিতও রেখেছো ?' তিনি বলেন , না।' তিনি যদি ‘হ্যা’ বলতেন তবে হযরত উমার (রাঃ) তাকে দলীল প্রমাণাদি দ্বারা অপারগ করে দিতেন।
এরপর তিনি বলেন, “তুমি ওকে স্বীয় চক্ষে, স্বীয় জিহবায় এবং স্বীয় চালচলনেও রক্ষিত রেখেছো কি?' তিনি বলেনঃ না। অতঃপর তিনি এক এক করে সবাইকেই এ প্রশ্নই করেন। তারপর তিনি বলেন, “তোমরা উমার (রাঃ)-কে এ কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করতে চাচ্ছ যে, তিনি যেন জনগণকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী সোজা করে দেন। আমার দোষত্রুটির কথা আমার এ পূর্ব হতেই জানতেন। অতঃপর তিনি (আরবী)-এ আয়াতটি শেষ পর্যন্ত পাঠ করেন। অর্থাৎ যদি তোমরা সেই মহাপাপসমূহ হতে বিরত হও যা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, তাহলেই আমি তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবো। এরপর তিনি বলেন, মদীনাবাসী তোমাদের আগমনের কারণ জানে কি? তাঁরা বলেন, 'না।' তিনি বলেন, তারাও যদি এটা জানতো তবে এ সম্বন্ধে আমার তাদেরকেও উপদেশ দিতে হতো। এর ইসনাদও হাসান এবং পঠনও হাসান। যদিও হযরত উমার (রাঃ) হতে হাসানের এ বর্ণনাটির মধ্যে ইনকিতা রয়েছে তথাপি এ ত্রুটি পূরণের পক্ষে এর পূর্ণ প্রসিদ্ধিই যথেষ্ট।
মুসনাদ-ই-ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে, হযরত আলী (রাঃ) বলেন, কাবীরা গুনাহ্ হচ্ছে, আল্লাহর সঙ্গে অংশী স্থাপন করা, কাউকে হত্যা করা, পিতৃহীনের মাল ভক্ষণ করা, পবিত্র স্ত্রীলোকদেরকে অপবাদ দেয়া, যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়ন করা, হিজরতের পর কাফিরদের দেশে অবস্থান করা, যাদু করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া, সুদ খাওয়া, জামাআত হতে পৃথক হওয়া এবং ক্রয়-বিক্রয় ভেঙ্গে দেয়া। পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, সবচেয়ে বড় পাপ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে অংশী স্থাপন করা, তাঁর প্রশস্ততা ও করুণা হতে নিরাশ হওয়া এবং তার মকর হতে নির্ভয় থাকা।
তাফসীর-ই-ইবনে জারীরে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতেই বর্ণিত আছে। যে, সূরা-ই-নিসার প্রথম তির্মটি আয়াতে কাবীরা গুনাহর বর্ণনা রয়েছে। অতঃপর তিনি (আরবী) এ আয়াতটি শেষ পর্যন্ত পাঠ করেন। হযরত বুরাইদা (রাঃ) বলেন, কাবীরা গুনাহ্ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে অংশী স্থাপন করা, বাপ-মাকে অসন্তুষ্ট করা, পরিতৃপ্তির পর অতিরক্তি পানি প্রয়োজন বোধকারীদেরকে না দেয়া এবং নিজের নরপশুকে কারও মাদী পশুর জন্যে কিছু নেয়া ছাড়া না দেয়া।
সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের একটি মারফু হাদীসে রয়েছে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ ‘প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি আটকিয়ে রাখা যাবে না এবং অতিরিক্ত ঘাস হতেও বাধা দেয়া যাবে না। অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, কিয়ামতের দিন তিন প্রকারের পাপীদের দিকে আল্লাহ তা'আলা করুণার দৃষ্টিতে দেখবেন না, তাদেরকে পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্যে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
মুসনাদ-ই-আহমাদে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি অতিরিক্ত পানি ও অতিরিক্ত ঘাসকে আটকিয়ে রাখে, কিয়ামতের দিন আলাহ তা'আলা তার প্রতি অনুগ্রহ করবেন না। হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, 'কাবীরা গুনাহ দু'টি যা নারীদের নিকট বায়আত নেয়ার বর্ণনায় বর্ণিত হয়েছে, অর্থাৎ (আরবী) (৬০:১২) -এ আয়াতটির মধ্যে। হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) এ আয়াতটিকে আল্লাহ তাআলার বিরাট ইহসানের মধ্যে বর্ণনা করেন এবং এর উপর বড় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। অর্থাৎ আয়াতটিকে।
একবার হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর সামনে জনগণ বলেন, কাবীরা গুনাহ হচ্ছে সাতটি।' তিনি বলেন, কোন কোন সময় সাতটি।' অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, তিনি বলেন, 'কমপক্ষে সাতটি নচেৎ সত্তরটি।' অন্য একটি লোকের কথায় তিনি বলেনঃ “ওটা হচ্ছে সাতশ পর্যন্ত এবং সাতশ হচ্ছে খুবই নিকটে। হ্যা, তবে জেনে রেখো যে, ক্ষমা প্রার্থনার পর কাবীরা আর কাবীরা থাকে না। আর সদা-সর্বদা করতে থাকলে সাগীরাও আর সাগীরা থাকে না।'
অন্য সনদে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, “যে পাপের উপর জাহান্নামের, আল্লাহর ক্রোধের, অভিসম্পাতের এবং শাস্তির ভীতি প্রদর্শন রয়েছে সেটাই কাবীরা গুনাহ।' আর একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, যা হতে আল্লাহ তা'আলা নিষেধ করেন সেটাই কাবীরা। যে কার্যে আল্লাহর অবাধ্যতা প্রকাশ পায় ওটাই বড় পাপ। এখন তাবেঈগণের উক্তি আলোচনা করা যাচ্ছেঃ
হযরত উবাইদাহ (রঃ) বলেন, 'কাবীরা গুনাহ্ হচ্ছে-আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে শিরক করা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, যুদ্ধক্ষেত্রে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করা, ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ করা, সুদ খাওয়া, সচ্চরিত্রা মেয়েদের (ব্যভিচারের) অপবাদ দেয়া ও হিজরতের পর স্বদেশ প্রিয়তা।' হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত ইবনে আউন (রঃ) স্বীয় শিক্ষক মুহাম্মাদ (রঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ ‘যাদু কাবীরা গুনাহ নয় কি?' তিনি বলেন, এটা অপবাদের মধ্যে এসে গেল। এ শব্দটির মধ্যে বহু জঘন্যতা জড়িত রয়েছে। হযরত উবায়েদ ইবনে উমায়ের (রঃ) কাবীরা গুনাহের উপর কুরআন কারীমের আয়াত পড়েও শুনিয়ে দেন। শিরকের উপর আয়াত পাঠ করেন (আরবী) অর্থাৎ “যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শিরক করলো সে যেন আকাশ হতে পড়ে গেল অতঃপর পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে অথবা বাতাস তাকে দূরে কোন অজানা জঘন্য স্থানে নিক্ষেপ করবে।' (২২:৩১) ইয়াতীমের মাল নষ্ট করার উপর আয়াত পেশ করেন (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই যারা অন্যায়ভাবে ইয়াতীমের মাল ভক্ষণ করে, নিশ্চয়ই তারা তাদের পেটের মধ্যে আগুন ভক্ষণ করে।' (৪:১০) সুদ খাওয়ার উপর পাঠ করেন (আরবী) অর্থাৎ যারা সুদ ভক্ষণ করে তারা কিয়ামতে
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।