আল কুরআন


সূরা ইউসুফ (আয়াত: 5)

সূরা ইউসুফ (আয়াত: 5)



হরকত ছাড়া:

قال يا بني لا تقصص رؤياك على إخوتك فيكيدوا لك كيدا إن الشيطان للإنسان عدو مبين ﴿٥﴾




হরকত সহ:

قَالَ یٰبُنَیَّ لَا تَقْصُصْ رُءْیَاکَ عَلٰۤی اِخْوَتِکَ فَیَکِیْدُوْا لَکَ کَیْدًا ؕ اِنَّ الشَّیْطٰنَ لِلْاِنْسَانِ عَدُوٌّ مُّبِیْنٌ ﴿۵﴾




উচ্চারণ: কা-লা ইয়া-বুনাইইয়া লা-তাকসুস রু’ইয়া-কা ‘আলা-ইখওয়াতিকা ফাইয়াকীদূলাকা কাইদান ইন্নাশশাইতা-না লিলইনছা-নি ‘আদুওউম মুবীন।




আল বায়ান: সে বলল, ‘হে আমার পুত্র, তুমি তোমার ভাইদের নিকট তোমার স্বপ্নের বর্ণনা দিও না, তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করবে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য দুশমন’।




আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ৫. তিনি বললেন, হে আমার বৎস! তোমার স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের কাছে বলো না(১); বললে তারা তোমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করবে(২)। শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।(৩)




তাইসীরুল ক্বুরআন: তার পিতা বললেন, ‘হে আমার পুত্র! তোমার স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের কাছে বর্ণনা করো না। যদি কর তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে। শাইত্বান তো মানুষের প্রকাশ্য দুশমন।




আহসানুল বায়ান: (৫) (পিতা ইয়াকূব) বলল, ‘হে আমার পুত্র! তোমার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত তোমার ভাইদের নিকট বর্ণনা করো না, করলে তারা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে।[1] শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।[2]



মুজিবুর রহমান: সে বললঃ হে আমার পুত্র! তোমার স্বপ্নের বৃত্তান্ত তোমার ভাইদের নিকট বর্ণনা করনা; করলে তারা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে; শাইতানতো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।



ফযলুর রহমান: সে বলল, “বৎস! তোমার এই স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদেরকে বলো না। তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে। শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।



মুহিউদ্দিন খান: তিনি বললেনঃ বৎস, তোমার ভাইদের সামনে এ স্বপ্ন বর্ণনা করো না। তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য।



জহুরুল হক: তিনি বললেন, "হে আমার পুত্র! তোমার স্বপ্ন তোমার ভাইদের কাছে বর্ণনা কর না পাছে তারা তোমার বিরুদ্ধে কোনো চক্রান্তের ফন্দি আঁটে। নিঃসন্দেহ শয়তান মানুষের জন্য প্রকাশ্য শত্রু।



Sahih International: He said, "O my son, do not relate your vision to your brothers or they will contrive against you a plan. Indeed Satan, to man, is a manifest enemy.



তাফসীরে যাকারিয়া

অনুবাদ: ৫. তিনি বললেন, হে আমার বৎস! তোমার স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের কাছে বলো না(১); বললে তারা তোমার বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করবে(২)। শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।(৩)


তাফসীর:

(১) আয়াতে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে স্বীয় স্বপ্ন ভাইদের কাছে বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন। এতে বোঝা যায় যে, হিতাকাংখী ও সহানুভূতিশীল নয়- এরূপ লোকের কাছে স্বপ্ন বর্ণনা করা উচিত নয়। এছাড়া স্বপ্নের ব্যাখ্যা সম্পর্কে পারদর্শী নয়- এমন ব্যক্তির কাছেও স্বপ্ন ব্যক্ত করা সঙ্গত নয়। এ আয়াত থেকে জানা যায় যে, কষ্টদায়ক বিপজ্জনক স্বপ্ন কারো কাছে বর্ণনা করতে নেই। এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘স্বপ্ন পাখির পায়ের সাথে থাকে যতক্ষণ না সেটার ব্যাখ্যা করা হয়। যখনই সেটার ব্যাখ্যা করা হয়, তখনই সেটা পড়ে যায়। তিনি আরও বলেন, স্বপ্ন হচ্ছে নবুওয়াতের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ। তিনি আরও বলেছেন, স্বপ্নকে যেন কোন বন্ধু বা বুদ্ধিমান ব্যক্তি ব্যতীত অন্য কারও কাছে বিবৃত করা না হয়। [ইবন মাজাহ ৩৯১৪; মুসনাদ: ৪/১০]

অন্য হাদীসে এসেছে, তোমাদের কেউ যখন কোন পছন্দনীয় স্বপ্ন দেখে তখন সে যেন যাকে মহব্বত করে তার নিকট বলে। আর যখন কোন খারাপ স্বপ্ন দেখে তখন সে যেন তার অন্য পার্শ্বে শয়ন করে এবং বামদিকে তিনবার থুথু ফেলে, আল্লাহর কাছে এর অনিষ্ট হতে আশ্রয় চায়, কাউকে এ সম্পর্কে কিছু না বলে, ফলে এ স্বপ্ন তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। [মুসলিম: ২২৬২]

অন্যান্য হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী বুঝা যায় যে, এ নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র দয়া ও সহানুভূতির উপর ভিত্তিশীল- আইনগত হারাম নয়। সহীহ হাদীসসমূহে বলা হয়েছে, ওহুদ যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ আমি স্বপ্নে দেখেছি আমার তরবারী ‘যুলফিকার’ ভেঙ্গে গেছে এবং আরো কিছু গাভীকে জবাই হতে দেখেছি। এর ব্যাখ্যা ছিল হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহু-সহ অনেক মুসলিমের শাহাদাত বরণ। এটা একটা আশু মারাত্মক বিপর্যয় সম্পর্কিত ইঙ্গিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাহাবীদের কাছে এ স্বপ্ন বর্ণনা করেছিলেন। [মুস্তাদরাক হাকেমঃ ২৫৮৮, মুসনাদে আহমাদঃ ১/২৭১]


(২) এ আয়াত থেকে আরো জানা যায় যে, মুসলিমকে অপরের অনিষ্ট থেকে বাঁচানোর জন্য অপরের কোন মন্দ অভ্যাস কিংবা খারাপ উদ্দেশ্য প্রকাশ করা জায়েয। এটা গীবত কিংবা অসাক্ষাতে পরনিন্দার অন্তর্ভুক্ত নয়। এ আয়াতে ইয়াকুব আলাইহিস সালাম ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে বলে দিয়েছেন যে, ভাইদের পক্ষ থেকে তার প্রতি শক্রতার আশংকা রয়েছে। [কুরতুবী]


(৩) অর্থাৎ বৎস! তুমি এ স্বপ্ন ভাইদের কাছে বর্ণনা করো না। আল্লাহ না করুন, তারা এ স্বপ্ন শুনে তোমার মাহাত্ম্য সম্পর্কে অবগত হয়ে তোমাকে বিপর্যস্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে পারে। কেননা, শয়তান হল মানুষের প্রকাশ্য শক্র। সে পার্থিব প্রভাব প্রতিপত্তি ও অর্থকড়ির লোভ দেখিয়ে মানুষকে এহেন অপকর্মে লিপ্ত করে দেয়। নবীগণের সব স্বপ্ন ওহীর সমপর্যায়ভুক্ত। সাধারণ মুসলিমদের স্বপ্নে নানাবিধ সম্ভাবনা বিদ্যমান থাকে। তাই তা কারো জন্য প্রমাণ হয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ যখন সময় ঘনিয়ে আসবে (কেয়ামত নিকটবর্তী হবে) তখন মুমিন ব্যক্তির স্বপ্ন প্রায়ই সত্য হবে। আর মুমিনের স্বপ্ন নবুয়তের চল্লিশতম অংশ, আর যা নবুওয়াতের এ অংশের স্বপ্ন, তা মিথ্যা হবে না। বলা হয়ে থাকে, স্বপ্ন তিন প্রকার। এক প্রকার হচ্ছে মনের ভাষ্য, আরেক প্রকার হচ্ছে শয়তানের পক্ষ থেকে ভীতি জাগ্রত করে দেয়া। আর তৃতীয় প্রকার স্বপ্ন হচ্ছে- আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ অপছন্দনীয় কিছু দেখে তবে সে যেন তা কারো কাছে বিবৃত না করে; বরং উঠে এবং সালাত আদায় করে। [বুখারীঃ ৭০১৭]

অপর হাদীসে এসেছে, “যতক্ষন পর্যন্ত স্বপ্নের তা'বীর করা না হয় ততক্ষণ তা উড়ন্ত অবস্থায় থাকে, তারপর যখনি তা’বীর করা হয় তখনি তা পতিত হয় বা ঘটে যায়”। [মুসনাদে আহমাদ ৪/১০, আবু দাউদঃ ৫০২০, তিরমিযীঃ ২২৭৮, ইবনে মাজাহঃ ৩৯১৪]

এখানে এ বিষয়টি চিন্তাসাপেক্ষ যে, সত্য স্বপ্ন নবুয়তের অংশ-এর অর্থ কি? এর তাৎপর্য সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে তেইশ বৎসর পর্যন্ত ওহী আগমন করতে থাকে। তন্মধ্যে প্রথম ছ'মাস স্বপ্লের আকারে এ ওহী আগমন করে। অবশিষ্ট পয়তাল্লিশ ষান্মাসিকে জিবরীলের মধ্যস্থতায় ওহী আগমন করে। এ হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় যে, সত্য স্বপ্ন নুবয়তের ৪৬তম অংশ। [কুরতুবী] এখানে আরও জানা আবশ্যক যে, হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী সত্য স্বপ্ন অবশ্যই নবুয়তের অংশ, কিন্তু নবুওয়াত নয়। নবুওয়াত আখেরী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত এসে শেষ হয়ে গেছে। এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ ভবিষ্যতে মুবাশশিরাত ব্যতীত নবুয়তের কোন অংশ বাকী নেই। সাহাবায়ে কেরাম বললেনঃ ‘মুবাশশিরাত’ বলতে কি বুঝায়? উত্তর হলঃ সত্য স্বপ্ন। [বুখারীঃ ৬৯৯০]

এতে প্রমাণিত হয় যে, নবুওয়াত কোন প্রকারে অথবা কোন আকারেই অবশিষ্ট নেই। শুধুমাত্র এর একটি ক্ষুদ্রতম অংশ অবশিষ্ট আছে যাকে মুবাশশিরাত অথবা সত্য স্বপ্ন বলা হয়। তবে সত্য স্বপ্ন দেখা এবং তদনুরূপ ঘটনা সংঘটিত হওয়া এটুকু বিষয়ই কারো সৎ, দ্বীনী এমনকি মুসলিম হওয়ারও প্রমাণ নয়। তবে এটা ঠিক যে, সৎ ও নেক লোকদের স্বপ্ন সাধারণতঃ সত্য হবে -এটাই আল্লাহর সাধারণ রীতি। ফাসেক ও পাপাচারীদের সাধারণতঃ মনের সংলাপ ও শয়তানী প্ররোচনা ধরণের মিথ্যা স্বপ্ন হয়ে থাকে। কিন্তু মাঝে মাঝে এর বিপরীতও হওয়া সম্ভব। মোটকথা, সত্য স্বপ্ন সাধারণ মুসলিমদের জন্য হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী সুসংবাদ কিংবা হুশিয়ারীর চাইতে অধিক মর্যাদা রাখে না। এটা স্বয়ং তাদের জন্য কোন ব্যাপারে প্রমাণরূপে গণ্য নয় এবং অন্যের জন্যও নয়।


তাফসীরে আহসানুল বায়ান

অনুবাদ: (৫) (পিতা ইয়াকূব) বলল, ‘হে আমার পুত্র! তোমার স্বপ্ন-বৃত্তান্ত তোমার ভাইদের নিকট বর্ণনা করো না, করলে তারা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে।[1] শয়তান তো মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।[2]


তাফসীর:

[1] ইয়াকূব (আঃ) সপ্ন শুনে অনুমান করলেন যে, তাঁর এই পুত্র মহা সম্মানের অধিকারী হবে। ফলে তিনি ভয় করছিলেন যে, এই স্বপ্ন শুনে তাঁর অন্য ভাইরাও তাঁর মর্যাদার কথা বুঝতে পেরে তাঁর কোন ক্ষতি না করে বসে। তাই তিনি এই স্বপ্নের কথা বর্ণনা করতে নিষেধ করলেন।

[2] তিনি ভাইদের চক্রান্তের কারণও বলে দিলেন যে, শয়তান যেহেতু মানুষের চিরশত্রু সেহেতু সে মানুষকে ভ্রষ্ট ও হিংসা-বিদ্বেষে নিমজ্জিত করার সর্বদা সুযোগ খোঁজে। বলা বাহুল্য, এটা শয়তানের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ ছিল যে, ইউসুফ (আঃ)-এর বিরুদ্ধে ভাইদের মনে হিংসা ও বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। যেমন পরে সত্য সত্যই সে তাই করেছিল এবং ইয়াকূব (আঃ)-এর আশঙ্কা সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল।


তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ


তাফসীর: ৪-৬ নং আয়াতের তাফসীর:



ইউসুফ (عليه السلام) তাঁর পিতা ইয়া‘কূব (عليه السلام)-কে বললেন, হে আমার পিতা! আমি স্বপ্নে দেখেছি এগারটি তারকা আমাকে সিজদা করছে এবং চন্দ্র, সূর্যও সিজদা করছে।



ইবনু আব্বাস ও কাতাদাহ  বলেন: এগারটি নক্ষত্র দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউসুফ (عليه السلام) এর এগার ভাই এবং সূর্য ও চন্দ্র দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউসুফ (عليه السلام)-এর মাতা-পিতা। (কুরতুবী, তাফসীর সাদী, অত্র আয়াতের তাফসীর) বস্তুতঃ এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বাস্তবায়িত হয় যখন ইউসুফ (عليه السلام)-এর পিতা-মাতাসহ সব ভায়েরা মিসরে গিয়ে তাঁর সামনে সিজদাবনত হয়। যা অত্র সূরার ৯৯-১০০ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।



উল্লেখ্য যে, স্বপ্ন ব্যাখ্যা করা জ্ঞানের অন্যতম একটি শাখা। ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়া‘কূব (عليه السلام) সকলে এ বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। ইউসুফ (عليه السلام) কেও আল্লাহ তা‘আলা স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার জ্ঞান দান করেছিলেন। যা ৬ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে।



ইউসুফ (عليه السلام)-এর স্বপ্নের কথা শুনে ইয়া‘কূব (عليه السلام) বুঝতে পারলেন যে, তাঁর এই পুত্র মহা সম্মানের অধিকারী হবে এবং নবুওয়াতের ধারা তাঁর কাছে পৌঁছবে। তাই তিনি ইউসুফ (عليه السلام) কে এই স্বপ্নের কথা তাঁর ভাইদের কাছে প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন। কারণ তাঁর ভাইয়েরা যখন এ স্বপ্নের কথা শুনবে তখন তারা এ মর্যাদার কথা বুঝতে পারবে। আর এ মর্যাদার কথা বুঝতে পেরে ইউসুফ (عليه السلام) এর কোন ক্ষতি সাধন করতে পারে, যার ফলে তিনি এ স্বপ্ন প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন।



এ আয়াত প্রমাণ করে স্বপ্নের কথা সকলের কাছে বলা যাবে না, কেবল যাকে নিজের কল্যাণকামী বা একনিষ্ঠ মনে হবে তাদের কাছেই বলা উচিত। হাদীসে এসেছে: ভাল স্বপ্ন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে, যখন তোমাদের কেউ ভাল স্বপ্ন দেখবে তখন যেন তার প্রিয় ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো কাছে না বলে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, জ্ঞানী অথবা কল্যাণকামীর কাছে বলবে। আর যদি অপছন্দনীয় কিছু দেখে তাহলে তার অনিষ্ট থেকে আল্লাহ তা‘আলার কাছে আশ্রয় চাইবে, তিন বার থুথু ফেলবে। অন্য বর্ণনাতে পার্শ্ব পরিবর্তন করে বাম দিকে শয়নের কথা বলা হয়েছে। এবং তা কারো কাছে বর্ণনা করবে না, এতে তা সে ব্যক্তির ক্ষতি করবে না। (সহীহ বুখারী হা: ৭০৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ২২৬১)



ইউসুফ (عليه السلام) কে পিতা তাঁর ভাইদের ষড়যন্ত্রের কারণও বলে দিলেন যে, শয়তান যেহেতু মানুষের চিরশত্র“ সেহেতু সে মানুষকে ভ্রষ্ট ও হিংসা-বিদ্বেষে নিমজ্জিত করার সুযোগ খোঁজে। বলা বাহুল্য, এটা শয়তানের জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ ছিল যে, ইউসুফ (عليه السلام) এর বিরুদ্ধে ভাইদের মনে হিংসা বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়ে দেয়া। যেমন পরবর্তী জীবনে ইউসুফ (عليه السلام) তার ভাইদের চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন।



ইউসুফ (عليه السلام) এর স্বপ্নের মর্মার্থ বুঝতে পেরে ইয়া‘কূব (عليه السلام) আরো বললেন, তোমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়া‘কূবকে যেভাবে নবুওয়াতের জন্য মনোনীত করেছেন, স্বপ্ন ব্যাখ্যার জ্ঞান দান করেছেন এবং নেয়ামত দিয়েছেন সেভাবেই তোমার প্রতিপালক তোমাকে নবুওয়াতের জন্য মনোনীত করবেন, স্বপ্ন ব্যাখ্যার জ্ঞান দান করবেন এবং নেয়ামতকে পূর্ণ করবেন। মূলতঃ অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফ (عليه السلام) কে তিনটি নেয়ামতের সুসংবাদ দিয়েছেন (১) আল্লাহ তা‘আলা তাকে নাবী হিসেবে মনোনীত করবেন, (২) স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার জ্ঞান দান করবেন, (৩) তার প্রতি স্বীয় নেয়ামত পূর্ণ করবেন। ফলে ইউসুফ (عليه السلام) স্বপ্নের ব্যাখ্যায় পারদর্শী ছিলেন, যেমন মিসরের বাদশার স্বপ্নের ব্যাখ্যা করে দিয়েছিলেন যা অত্র সূরার ৪১ ও ৪৭-৪৯ নং আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আর এখানে যে নেয়ামতের কথা বলা হয়েছে তা দ্বারা দুটি উদ্দেশ্য হতে পারে (১) নবুওয়াত যা ইউসুফ (عليه السلام)-কে প্রদান করা হয়েছিল; যেমন আয়াতের পরের অংশ প্রমাণ করছে যে, ‘যেভাবে তিনি এটা পূর্বে পূর্ণ করেছিলেন তোমার পিতৃ-পুরুষ ইব্রাহীম ও ইস্হাকের প্রতি’ তাদের প্রতি যে নেয়ামত পরিপূর্ণ করে দেয়া হয়েছিল তা হল নবুওয়াত। (২) সেই নেয়ামতসমূহ যা ইউসুফ (عليه السلام)-কে মিসরে প্রদান করা হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলাই এ ব্যাপারে ভাল জানেন।



আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:



১. পিতা সন্তানদের লালন-পালন করবেন, সন্তানদের মধ্য হতে যার মাঝে জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা ও বুঝার যোগ্যতা অনুভব করবেন তার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করবেন।

২. সত্য স্বপ্ন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে। ইউসুফ (عليه السلام) সত্য স্বপ্ন দেখেছেন, ফলে তাঁর পিতা স্বপ্নের কথা ভাইদের কাছে বর্ণনা করতে নিষেধ করেছেন। ভাল স্বপ্ন প্রিয় মানুষের কাছে প্রকাশ করা যাবে, তবে মন্দ স্বপ্ন প্রকাশ করা ঠিক নয়।

৩. আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফ (عليه السلام)-কে স্বপ্নের সঠিক ব্যাখ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন।

৪. কল্যাণার্থে নেয়ামত প্রকাশ না করে গোপন রাখা বৈধ। এজন্য ইউসুফ (عليه السلام) এর পিতা স্বপ্নের কথা কাউকে বলতে নিষেধ করেছেন। অথচ এখানে স্বপ্ন একটি নেয়ামত ছিল।

৫. শয়তান সহোদর ভাইদের মাঝেও প্রবেশ করে তাদের অন্তরে পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে পারে, ফলে ভাইরা পরস্পরের প্রতি দয়াদ্র হওয়া সত্ত্বেও শত্র“তে পরিণত হয়।

৬. কেউ কারো কাছে স্বপ্নের কথা বললে উত্তম দিকনির্দেশনা দেয়া উচিত।

৭. পিতা সব সন্তানদের প্রতি ন্যায়-নীতি অবলম্বন করবেন, যদিও কোন সন্তানকে অধিক পরিমাণ গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে তা পিতা প্রকাশ করবেন না। কারণ ভাইদের মাঝে বিদ্বেষের কারণ হতে পারে।

৮. একটি উত্তম পরিবার থেকে উত্তম সন্তানের আশা করা যায়। যেমন পিতা ইয়া‘কূব তেমনি সন্তান ইউসুফ (عليه السلام)।


তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)


তাফসীর: হযরত ইয়াকুব (আঃ) স্বীয় পুত্র হযরত ইউসুফের (আঃ) স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনে তাঁকে যে কথা বলেছিলেন আল্লাহ তাআ’লা এখানে ঐ খবরই দিচ্ছেন। তিনি এই স্বপ্নের ব্যাখ্যাকে সামনে রেখে পুত্র ইউসুফকে (আঃ) সতর্ক করতে গিয়ে বলেনঃ “হে আমার প্রিয় পুত্র! তোমার এই স্বপ্নের কথা তুমি তোমার ভাইদের সামনে বর্ণনা করো না। কেননা এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা এই যে, তোমার ভ্রাতাগণ তোমার সামনে খাটো হয়ে যাবে। এমনকি তারা তোমার সম্মানার্থে তোমার সামনে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে মাথা নত করবে। সুতরাং খুব সম্ভব যে, তোমার এই স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনে এর ব্যাখ্যাকে সামনে রেখে তারা শয়তানের প্রতারণার ফাঁদে পড়ে যাবে এবং এখন থেকেই তোমার সাথে শত্রুতা শুরু করে দেবে। আর হিংসার বশবর্তী হয়ে ছলনা ও কৌশল করে তোমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে। রাসূলুল্লাহর (সঃ) শিক্ষাও এটাই তিনি বলেছেনঃ “ তোমাদের কেউ যদি ভাল স্বপ্ন দেখে তবে সে যেন তা বর্ণনা করে। আর কেউ যদি কোন খারাপ স্বপ্ন দেখে তবে সে যেন (শয়ন অবস্থায়) পার্শ্ব পরিবর্তন করে এবং বাম দিকে তিনবার থুথু ফেলে; আর এর অনিষ্টকারীতা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং কারো কাছে যেন তা বর্ণনা না করে, তাহলে ঐ স্বপ্ন তার কোনই ক্ষতি করতে পারবে না।”

মুআ’বিয়া ইবনু হায়দাহ্ আল-কুশায়বী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যে পর্যন্ত স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা না হয় সেই পর্যন্ত তা পাখীর পায়ের উপর থাকে (অর্থাৎ উড়ন্ত অবস্থায় থাকে), আর যখন ওর ব্যাখ্যা বর্ণিত হয় তখন তা সংঘটিত হয়ে যায়। (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) এবং কোন কোন আহলে সুনান বর্ণনা করেছেন)

একারণেই এ হুকুমও নেয়া যেতে পারে যে, নিয়ামতকে গোপন রাখা উচিত, যে পর্যন্ত না ওটা উত্তমরূপে লাভ করা যায় এবং প্রকাশিত হয়ে পড়ে। যেমন হাদীসে এসেছেঃ “প্রয়োজনসমূহ পুরো করার ব্যাপারে ওগুলি গোপন করার মাধ্যমে সাহায্য নাও, কেননা যে ব্যক্তি কোন নিয়ামত লাভ করে তার প্রতি হিংসা করা হয়ে থাকে।”





সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।