সূরা সাবা (আয়াত: 13)
হরকত ছাড়া:
يعملون له ما يشاء من محاريب وتماثيل وجفان كالجواب وقدور راسيات اعملوا آل داود شكرا وقليل من عبادي الشكور ﴿١٣﴾
হরকত সহ:
یَعْمَلُوْنَ لَهٗ مَا یَشَآءُ مِنْ مَّحَارِیْبَ وَ تَمَاثِیْلَ وَ جِفَانٍ کَالْجَوَابِ وَ قُدُوْرٍ رّٰسِیٰتٍ ؕ اِعْمَلُوْۤا اٰلَ دَاوٗدَ شُکْرًا ؕ وَ قَلِیْلٌ مِّنْ عِبَادِیَ الشَّکُوْرُ ﴿۱۳﴾
উচ্চারণ: ইয়া‘মালূনা লাহু মা-ইয়াশাউ মিম মাহা-রীবা ওয়া তামা-ছীলা ওয়া জিফা-নিন কাল জাওয়া-বি ওয়া কুদূ রির রা-ছিয়া-তিন ই‘মালূআ-লা দা-ঊদা শুকরাওঁ ওয়া কালীলুম মিন ‘ইবা-দিয়াশশাকূর।
আল বায়ান: তারা তৈরী করত সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী তার জন্য প্রাসাদ, ভাস্কর্য, সুবিশাল হাউযের মত বড় পাত্র ও স্থির হাড়ি। ‘হে দাঊদ পরিবার, তোমরা কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমল করে যাও এবং আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ’।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ১৩. তারা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী তার জন্য প্রাসাদ(১), ভাস্কর্য, হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সাথে তোমরা কাজ করতে থাক। আর আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ!
তাইসীরুল ক্বুরআন: তারা সুলাইমানের ইচ্ছে অনুযায়ী তার জন্য প্রাসাদ, ভাস্কর্য, হাউযের ন্যায় বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশালাকায় ডেগ নির্মাণ করত। (আমি বলেছিলাম) হে দাঊদের সন্তানগণ! তোমরা কৃতজ্ঞচিত্তে কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের অল্পই কৃতজ্ঞ।
আহসানুল বায়ান: (১৩) ওরা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, প্রতিমা, হওয-সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির ওপর স্থাপিত বৃহদাকার ডেগ নির্মাণ করত।[1] (আমি বলেছিলাম,) ‘হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তোমরা কাজ করতে থাক। আমার দাসদের মধ্যে কৃতজ্ঞ অতি অল্পই।’
মুজিবুর রহমান: তারা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, ভাস্কর্য, হাউয সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং সুদৃঢ় ভাবে চুল্লির উপর স্থাপিত বৃহদাকার ডেগ নির্মাণ করত। (আমি বলেছিলাম) হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সাথে তোমরা কাজ করতে থাক। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ।
ফযলুর রহমান: সোলায়মান যা চাইত জ্বিনেরা তার জন্য তাই তৈরী করে দিত। এসব জিনিসের মধ্যে রয়েছে: বড় বড় কোঠা, ভাস্কর্য, হাউজের মত বড় বড় গামলা ও মজবুত ডেগ। (আমি বলেছিলাম,) “হে দাউদের পরিবার! তোমরা কৃতজ্ঞতার সাথে কাজ কর।” তবে আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ।
মুহিউদ্দিন খান: তারা সোলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পসংখ্যকই কৃতজ্ঞ।
জহুরুল হক: তারা তাঁর জন্য তৈরি করত যা তিনি চাইতেন, যথা দুর্গপ্রাসাদ ও ভাস্কর্য-প্রতিমূর্তি, আর গামলার ন্যায় থালা, আর অনড়-হয়ে- বসা ডেগ। "হে দাউদের পরিবার! কৃতজ্ঞতার সাথে কাজ করে যাও।" আর আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পকয়জনই কৃতজ্ঞ।
Sahih International: They made for him what he willed of elevated chambers, statues, bowls like reservoirs, and stationary kettles. [We said], "Work, O family of David, in gratitude." And few of My servants are grateful.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ১৩. তারা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী তার জন্য প্রাসাদ(১), ভাস্কর্য, হাউজসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং সুদৃঢ়ভাবে স্থাপিত ডেগ নির্মাণ করত। হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সাথে তোমরা কাজ করতে থাক। আর আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ!
তাফসীর:
(১) মুজাহিদ বলেন, এগুলো ছিল প্রাসাদের চেয়ে ছোট আকৃতির ঘর-দোর বিশেষ। [আত-তাফসীরুস সহীহ] কাতাদাহ বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য বিল্ডিং ও মাসজিদ। [তাবারী]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: (১৩) ওরা সুলাইমানের ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, প্রতিমা, হওয-সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির ওপর স্থাপিত বৃহদাকার ডেগ নির্মাণ করত।[1] (আমি বলেছিলাম,) ‘হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তোমরা কাজ করতে থাক। আমার দাসদের মধ্যে কৃতজ্ঞ অতি অল্পই।”
তাফসীর:
[1] مَحَارِيْبَ শব্দটি مِحْرَابٌ এর বহুবচন। অর্থ হল উঁচু জায়গা অথবা সুন্দর অট্টালিকা, উদ্দেশ্য উঁচু উঁচু অট্টালিকা, বিশাল বিশাল বাসভবন বা মসজিদ ও উপাসনালয়। تَمَاثِيْلَ শব্দটি تِمْثاَلٌ এর বহুবচন। অর্থঃ প্রতিমা, মূর্তি। এ মূর্তি অপ্রাণীর হত। অনেকে বলেন, পূর্ববর্তী আম্বিয়া ও নেক লোকেদের মূর্তি মসজিদে নির্মাণ করা হত, যাতে তা দেখে মানুষ (আল্লাহর) ইবাদত করে। তবে এ অর্থ ঐ সময় নেওয়া সঠিক হবে, যখন এটা মেনে নেওয়া যাবে যে, সুলাইমান (আঃ)-এর শরীয়তে মূর্তি নির্মাণ বৈধ ছিল। আর এ কথা সঠিক নয়। পক্ষান্তরে ইসলাম মূর্তি নির্মাণ করতে কঠোরভাবে নিষেধ করে দিয়েছে। جِفَانٌ শব্দটি جَفْنَةٌ এর বহুবচন অর্থঃ বিরাট পাত্র, جَواَبٍ শব্দটি جَابِيَةٌ এর বহুবচন ,অর্থঃ হওয, ছোট চৌবাচ্চা, যাতে পানি জমা রাখা হয়। অর্থাৎ চৌবাচ্চার মত বড় বড় পাত্র قُدُوْرٌ ডেগ, رَاسِيَاتٌ অর্থ স্বস্থানে স্থাপিত। বলা হয় যে, এই সকল ডেগ পাথর খোদাই করে নির্মাণ করা হত, যা স্থানান্তর করার যোগ্য ছিল না। যাতে এক সাথে এক হাজার মানুষের খাবার রান্না হত। আর এ সকল কাজ জ্বিনরা করত।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: ১২-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:
পূর্বে দাঊদ (عليه السلام)-কে যে সকল নেয়ামত দেয়া হয়েছিল তার বর্ণনা দেয়ার পর পুত্র সুলাইমান (عليه السلام)-কে যে সকল নেয়ামত বা মু‘জিযাহ দান করা হয়েছিল তার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে।
আল্লাহ তা‘আলা সুলাইমান (عليه السلام)-কে অনেক বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন, তন্মধ্যে সূরা নামলের ১৫-৪৪ নং আয়াতের তাফসীরে দুটি উল্লেখ করা হয়েছে। বাকীগুলো সূরা সোয়াদে উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে অত্র আয়াতগুলোর সাথে সম্পৃক্তগুলো উল্লেখ করা হল।
(১) আল্লাহ তা‘আলা বায়ু প্রবাহকে সুলাইমান (عليه السلام)-এর অনুগত করে দিয়েছিলেন। তাঁর হুকুম মত বায়ু তাঁকে তাঁর ইচ্ছামত স্থানে বহন করে নিয়ে যেত। তিনি সদলবলে বায়ুর মাধ্যমে নিজ সিংহাসনে সওয়ার হয়ে দু‘মাসের পথ একদিনে পৌঁছে যেতেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلِسُلَیْمٰنَ الرِّیْحَ عَاصِفَةً تَجْرِیْ بِاَمْرِھ۪ٓ اِلَی الْاَرْضِ الَّتِیْ بٰرَکْنَا فِیْھَاﺚ وَکُنَّا بِکُلِّ شَیْءٍ عٰلِمِیْنَ)
“এবং সুলাইমানের বশীভূত করে দিয়েছিলাম প্রচণ্ড বায়ুকে; সে বায়ু তার আদেশক্রমে প্রবাহিত হত সে দেশের দিকে যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি; প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে আমি সম্যক অবগত।” (সূরা আম্বিয়া ২১:৮১)
(২) তামার ন্যায় শক্ত পদার্থকে আল্লাহ তা‘আলা সুলাইমান (عليه السلام)-এর জন্য তরল ধাতুতে পরিণত করেছিলেন। যেমন
(وَاَسَلْنَا لَھ۫ عَیْنَ الْقِطْرِ)
‘আমি তার জন্য গলিত তামার এক প্রস্রবন প্রবাহিত করে দিলাম।’ এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ঐ গলিত ধাতু উত্তপ্ত ছিল না। বরং তা দিয়ে অতি সহজে পাত্রাদি তৈরি করা যেত। সুলাইমান (عليه السلام)-এর পর থেকেই তামা গলিয়ে পাত্রাদি তৈরি করা শুরু হয় বলে ইমাম কুরতুবী বর্ণনা করেছেন। পিতা দাঊদের জন্য ছিল লোহা গলানোর মু‘জিযাহ আর পুত্র সুলাইমানের জন্য তামা গলানোর মু‘জিযাহ। এজন্যই আয়াতের শেষে বলা হয়েছে; ‘হে দাঊদের ক্বাওম! কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে কাজ করে যাও। আমার বান্দাদের মধ্যে খুব অল্পই কৃতজ্ঞ।’
(৩) জিন জাতিকে তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন। ফলে তিনি যখন কোন কাজের ইচ্ছা করতেন তখন সে কাজ তাঁর সামনে তাদের দ্বারা করিয়ে নিতেন। তারা সুলাইমান (عليه السلام)-এর ইচ্ছানুযায়ী প্রাসাদ, মূর্তি অর্থাৎ কাঁচের, তামার ইত্যাদির প্রতিচ্ছবি, বড় বড় পাত্র, ডেগ ইত্যাদি নির্মাণ করত এবং সাগরে ডুব দিয়ে তলদেশ থেকে মূল্যবান মণি-মুক্তা, হীরা তুলে আনত।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمِنَ الشَّیٰطِیْنِ مَنْ یَّغُوْصُوْنَ لَھ۫ وَیَعْمَلُوْنَ عَمَلًا دُوْنَ ذٰلِکَﺆ وَکُنَّا لَھُمْ حٰفِظِیْنَ)
“এবং শয়তানদের মধ্যে কতক সুলাইমানের জন্য ডুবুরীর কাজ করত, তা ব্যতীত অন্য কাজও করত; আমি তাদের রক্ষাকারী ছিলাম।” (সূরা আম্বিয়া ২১:৮২)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَالشَّیٰطِیْنَ کُلَّ بَنَّا۬ئٍ وَّغَوَّاصٍ ﭴﺫوَّاٰخَرِیْنَ مُقَرَّنِیْنَ فِی الْاَصْفَادِﭵ)
“এবং অধীন করেছিলাম শয়তানদেরকেও, যারা ছিল ইমারত নির্মাণকারী ও ডুবুরী। এবং আরও অনেককে, যারা শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকত।” (সূরা সোয়াদ ৩৮:৩৭-৩৮)
مَّحَارِيْب শব্দটি محراب -এর বহুবচন। অর্থ হলো, উঁচু জায়গা অথবা সুন্দর অট্টালিকা।
تَمَاثِيْل শব্দটি تماثيل-এর বহুবচন। অর্থ হলোন প্রতিমা, মূর্তি। তবে ইসলামে মূর্তি তৈরি করা নিষেধ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি কোন ছবি অংকন করবে (প্রাণী জাতীয়) আল্লাহ তা‘আলা তাকে শাস্তি দেবেন যতক্ষণ না সে তাতে রূহ দিতে পারবে। কিন্তু সে কোন দিন তাতে রূহ দিতে পারবে না। (সহীহ বুখারী হা: ২২২৫) جِفَان শব্দটি جفنة-এর বহুবচন। অর্থ হলো, বিরাট পাত্র।
الْجَوَاب শব্দটি جابية-এর বহুবচন। ঐ হাউজকে বলা হয় যাতে পানি আসতে থাকে।
قُدُوْرٍ অর্থ ডেগ আর راسيات অর্থ স্বস্থানে স্থাপিত। এ সকল ডেগ পাথর খোদাই করে নির্মাণ করা হত, যা স্থানান্তর করার যোগ্য ছিল না।
এ সকল নেয়ামতরাজির বিনিময়ে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে এ নির্দেশ প্রদান করেছেন যে, তারা যেন মহান আল্লাহ তা‘আলার শুকুরগুজারী হয়।
আবূ আব্দুর রহমান আল হুখুলী বলেন: সালাত আদায় করা একটি শুকরিয়া, সিয়াম পালন করা একটি শুকরিয়া, অনুরূপভাবে প্রত্যেক ভাল কাজ একটি শুকরিয়া। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার কাছে সর্বোত্তম সালাত হলো দাঊদ (عليه السلام)-এর সালাত, তিনি প্রথম অর্ধরাত ঘুমাতেন, এক তৃতীয়াংশ নফল সালাত পড়তেন, আর এক ষষ্ঠাংশ ঘুমাতেন। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪১৯)
বায়তুল মুক্বাদ্দাস নির্মাণ ও সুলাইমান (عليه السلام)-এর মৃত্যুর বিস্ময়কর ঘটনা:
সুলাইমান (عليه السلام)-এর তিন নং মু‘জিযায় উল্লেখ করা হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা জিন জাতিকে তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন। ফলে তিনি যখন কোন কাজের ইচ্ছা করতেন তখন সে কাজ তাঁর সামনে জিনের দ্বারা করিয়ে নিতেন। এ সুযোগে তিনি তাদের দ্বারা বাইতুল মুক্বাদ্দাস পুনঃনির্মাণের কাজ করিয়ে নিলেন। মূলত বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নির্মাণ সর্বপ্রথম ফেরেশতাদের মাধ্যমে অথবা আদম (عليه السلام)-এর কোন সন্তানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় কা‘বা গৃহের ৪০ বছর পর। অতঃপর স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ইয়া‘কূব (عليه السلام) তা পুননির্মাণ করেন। প্রায় হাজার বছর পর দাঊদ (عليه السلام) তার পুননির্মাণ শুরু করেন এবং সুলাইমান (عليه السلام)-এর হাতে তা সমাপ্ত হয়। কিন্তু মূল নির্মাণ কাজ শেষ হলেও আনুসঙ্গিক কিছু কাজ তখনও অবশিষ্ট থেকে যায়। এমন সময় সুলাইমান (عليه السلام)-এর মৃত্যুকাল ঘনিয়ে আসে। এ কাজগুলো অবাধ্যপ্রবণ জিনদের ওপর ন্যস্ত ছিল। তারা সুলাইমান (عليه السلام)-এর ভয়ে কাজ করত। তারা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারলে কাজ ফেলে পালাতো। ফলে নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তখন সুলাইমান (عليه السلام) আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে তাঁর কাঁচ নির্মিত মেহরাবে প্রবেশ করলেন। যাতে বাইরে থেকে ভেতরে সবকিছু দেখা যায়। তিনি বিধানানুযায়ী ইবাদতের উদ্দেশ্যে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে গেলেন, যাতে রূহ বেরিয়ে যাবার পরেও লাঠিতে ভর দিয়ে দেহ স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। সেটাই হল। আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে তাঁর দেহ উক্ত লাঠিতে ভর করে এক বছর দাঁড়িয়ে থাকল। দেহ পচলো না, খসলো না বা পড়েও গেল না। জিনেরা ভয়ে চলে যায়নি। ফলে তারা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কাজ শেষ করে ফেলল। এভাবে কাজ সমাপ্ত হলে আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে কিছু উইপোকা লাঠি খেয়ে ফেলার কারণে তা ভেঙ্গে পড়লে তিনি দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে যান। তখন জিনেরা বুঝতে পারল সুলাইমান (عليه السلام) অনেক আগেই মারা গেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: জিনেরা যদি গায়েবের খবর জানত তাহলে তারা এ শাস্তিমূলক নির্মাণ কাজ করত না। অতএব জানা গেল জিনেরাও গায়েবের খবর জানে না। এ বিষয়ে জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই আছে। কোন নাবী-রাসূল, আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্যশীল ফেরেশতাদেরও এ জ্ঞান নেই।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সুলাইমান (عليه السلام)-এর প্রতি যে সকল নেয়ামত দান করা হয়েছিল সে সম্পর্কে জানা গেল।
২. কৃতজ্ঞ বান্দাদের সংখ্যা খুবই কম। আর অকৃতজ্ঞ লোকদের সংখ্যাই বেশি। সুতরাং দল বড় হলেই মনে করা যাবে না যে, এরাই সঠিক পথের অনুসারী।
৩. আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কেউ অদৃশ্যের খবর জানেন না, এমনকি নাবী রাসূলগণও নয় এবং জিনেরাও নয়।
৪. মৃত্যুর নির্ধারিত সময় উপস্থিত হলে নাবী-রাসূল যে-ই হোক না কেন এক মুহূর্তও সুযোগ থাকে না। যদিও নাবীদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হয়।
৫. আল্লাহ তা‘আলা কোন কাজ করতে চাইলে তা যে কোন উপায়ে করিয়ে নেন।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: ১২-১৩ নং আয়াতের তাফসীর:
হযরত দাউদ (আঃ)-এর উপর আল্লাহ তা'আলা যে নিয়ামতরাজি অবতীর্ণ। করেছিলেন সেগুলোর বর্ণনা দেয়ার পর তাঁর পুত্র হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর উপর যেসব নিয়ামত নাযিল করেছিলেন সেগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ “আমি বাতাসকে তার অধীন ও অনুগত করে দিয়েছিলাম। সে সকাল হতে হতেই এক মাসের পথ অতিক্রম করতো এবং এই পরিমাণ পথ সন্ধ্যায়ও অতিক্রম করতো। যেমন সিংহাসনে বসে দামেস্ক হতে লোক-লকর ও সাজ-সরঞ্জামসহ উড়ে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ইমতাখারে পৌঁছে যেতেন। দ্রুতগামী অশ্বারোহীর জন্যে এটা এক মাসের পথ ছিল। অনুরূপভাবে সিরিয়া হতে সন্ধ্যায় উড়ে সন্ধ্যাতেই তিনি কাবুলে পৌঁছে যেতেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর জন্যে তামাকে পানি করে দিয়ে এর নহর বইয়ে দিয়েছিলেন। যখন যে কাজে যে অবস্থায় লাগাতে ইচ্ছা করতেন, বিনা কষ্টে অতি সহজে সেই কাজে ওটাকে লাগাতে পারতেন। তাঁর সময় থেকেই তাম্র মানুষের কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সুদ্দী (রঃ) বলেছেন যে, তিনদিন পর্যন্ত এগুলো বয়ে চলেছিল। মহামহিমান্বিত আল্লাহ জ্বিনদেরকে তার অধীনস্থ ও অনুগত করে দিয়েছিলেন। তিনি যখন কোন কাজ করতে ইচ্ছা করতেন তখন সেই কাজ তাঁর সামনে তাদের দ্বারা করিয়ে নিতেন। কোন জ্বিন কাজে ফাকি দিলে সাথে সাথে তাকে তা জানিয়ে দেয়া হতো।
মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বলেছেনঃ “জ্বিনদের তিনটি শ্রেণী আছে। একটি হলো পরনির্ভরশীল, দ্বিতীয়টি সর্প এবং তৃতীয় শ্রেণীটি ওরাই যারা সওয়ারীর উপর আরোহণ করে, আবার হেঁটেও চলে।” হাদীসটি অত্যন্ত গারীব বা দুর্বল।
ইবনে নাআম (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, জ্বিনেরা তিন প্রকার। এক প্রকারের জন্যে আযাব ও সওয়াব আছে। দ্বিতীয়টি আকাশ ও পাতালে উড়ে বেড়ায় এবং তৃতীয় প্রকারের জ্বিনেরা হলো সাপ ও কুকুর। মানুষও তিন প্রকারের। এক প্রকারের মানুষকে আল্লাহ্ তা'আলা স্বীয় আরশের ছায়ায় স্থান দিবেন, যেদিন তার ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবে না। দ্বিতীয় প্রকারের মানুষ চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং ওদের চেয়েও নিকৃষ্ট। তৃতীয় শ্রেণীর মানুষ আকারে মানুষ বটে, কিন্তু তাদের অন্তর শয়তানীতে পরিপূর্ণ। অর্থাৎ তারা মানবরূপী শয়তান।
হযরত হাসান (রঃ) বলেছেন যে, জ্বিন ইবলীসের বংশধর এবং মানুষ হযরত আদম (আঃ)-এর বংশধর। উভয়ের মধ্যেই মুমিনও আছে, কাফিরও আছে। আযাব ও সওয়াব উভয়েই সমানভাবে প্রাপ্ত হবে। উভয়ের মধ্যেই ঈমানদার এবং লী-আল্লাহ্ও আছে আবার উভয়ের মধ্যেই বে-ঈমান এবং শয়তানও আছে।
(আরবী) বলা হয় উৎকৃষ্ট ইমারতকে, বাড়ীর উৎকৃষ্টতম অংশকে এবং কোন সমাবেশের সভাপতির আসনকে। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, (আরবী) হলো ঐ সব ইমারত যেগুলো মহল্লার মধ্যে নিম্নমানের। যহহাক (রঃ)-এর মতে মসজিদের গম্বুজকে (আরবী) বলা হয় এবং বড় বড় ইমারত ও মসজিদকেও বলা হয়। ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, বাড়ীর আসবাবপত্রকে (আরবী) বলা হয়।
মূর্তিগুলো শীশার তৈরী ছিল। কাতাদাহ (রঃ) বলেছেন যে, মূর্তিগুলো ছিল শীশা ও মাটি দ্বারা নির্মিত।
(আরবী) শব্দটি (আরবী) শব্দের বহুবচন। (আরবী) ঐ হাউজকে বলা হয় যাতে পানি আসতে থাকে। এগুলো পুকুরের মত ছিল। খুব বড় বড় লগন (খাদ্য রাখার বড় পাত্র) ছিল যাতে হযরত সুলাইমান (আঃ)-এর বিরাট বাহিনীর জন্যে এক সাথে। খাদ্য তৈরী করা সম্ভব হয়। আর তার দ্বারা তাদের সামনে খাদ্য হাযির করাও সম্ভব হতে পারে। ডেগগুলো খুব বড় ও ভারি হওয়ার কারণে ওগুলোকে এদিক ওদিক সরানো ও নড়াননা-চড়ানো সম্ভবপর হতো না।
তাদেরকে আল্লাহ তা'আলা বলে দিয়েছিলেনঃ হে দাউদ পরিবার! কৃতজ্ঞতার সাথে তোমরা কাজ করতে থাকো।
(আরবী) শব্দটি (আরবী) ছাড়াই (আরবী) রূপে ব্যবহৃত হয়েছে অথবা (আরবী) হয়েছে এবং দুটোই হয়েছে উহ্যরূপে। এতে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে, শোকর যেমন কথা ও নিয়ত দ্বারা হয়, তেমনি কাজ দ্বারাও হয়। যেমন কবি বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমার পক্ষ থেকে নিয়ামত তোমাদের তিন প্রকারের উপকার করতে পারে। (অর্থাৎ তিন প্রকারে আমি তোমাদের নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি)। হাতের দ্বারা, মুখের দ্বারা ও লুক্কায়িত অন্তর দ্বারা। এখানে কবিও আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া তিন প্রকারে প্রকাশ করার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন যে, শুকরিয়া তিন প্রকারে আদায় করা চলে। অর্থাৎ কর্মের মাধ্যমে, মৌখিক কথার মাধ্যমে ও অন্তরের মাধ্যমে।
হযরত আবু আবদির রহমান (রঃ) বলেন যে, নামাযও শোকর, রোযাও শোকর এবং প্রত্যেক ভাল আমল যা মহিমান্বিত আল্লাহর জন্যে করা হয় সবই শোকর। অর্থাৎ এগুলো সবই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যম। আর সর্বোৎকৃষ্ট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হচ্ছে হামদ বা আল্লাহর প্রশংসা-কীর্তন করা।
মুহাম্মাদ ইবনে কা'ব কারাযী (রঃ) বলেন যে, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ হচ্ছে। তাকওয়া ও সৎ আমল। (এটা ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত দাউদ (আঃ)-এর পরিবার দুই প্রকারেই আল্লাহ তা'আলার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিলেন। অর্থাৎ কথার দ্বারাও এবং কাজের দ্বারাও।
হযরত সাবিত বানানী (রঃ) বলেনঃ হযরত দাউদ (আঃ) স্বীয় পরিবার, সন্তানাদি এবং নারীদের উপর সময়ের পাবন্দীর সাথে নফল নামায় এমনভাবে বন্টন করে দিয়েছিলেন যে, সর্বসময়ে কেউ না কেউ নামাযে রত থাকতেন।
রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা'আলার নিকট হযরত দাউদ (আঃ)-এর নামাযই ছিল সবেচেয়ে পছন্দনীয়। তিনি রাত্রির অর্ধাংশ শুইতেন, এক তৃতীয়াংশ দাড়িয়ে নামায পড়তেন এবং এক ষষ্ঠাংশ ঘুমাতেন। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা'আলার নিকট সবচেয়ে পছন্দনীয় রোযা ছিল হযরত দাউদ (আঃ)-এর রোষা। তিনি একদিন রোযা অবস্থায় থাকতেন এবং একদিন রোযাহীন বা বেরোযা অবস্থায় থাকতেন। তাঁর মধ্যে আর একটি উত্তম গুণ এই ছিল যে, তিনি ক্ষেত্র হতে কখনো পালাতেন না।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলছেন, (একদা) সুলাইমান ইবনে দাউদ (আঃ)-এর মাতা সুলাইমান (আঃ)-কে বলেনঃ “হে আমার প্রিয় বৎস! রাত্রে অধিক ঘুমাবে না। কেননা, রাত্রের অধিক ঘুম কিয়ামতের দিন মানুষকে দরিদ্র করে ছাড়বে।” (এ হাদীসটি আবু আবদিল্লাহ ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এখানে ইবনে আবি হাতিম (রঃ) হযরত দাউদ (আঃ) সম্পর্কে একটি অত্যন্ত দীর্ঘ ও বিস্ময়কর আসার বর্ণনা করেছেন। তাতে এও আছে যে, হযরত দাউদ (আঃ) আল্লাহ তা'আলার নিকট আরয করেনঃ
“হে আমার প্রতিপালক! কিরূপে আমি আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো? কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তো আপনার একটি নিয়ামত!” জবাবে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ যখন তুমি জানতে পারলে যে, সমস্ত নিয়ামত আমারই পক্ষ থেকে আসে তখনই তুমি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে।”
মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই কৃতজ্ঞ। একটি একটি সত্য ও বাস্তব ব্যাপার সম্পর্কে খবর দান।
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।