আল কুরআন


সূরা লুকমান (আয়াত: 16)

সূরা লুকমান (আয়াত: 16)



হরকত ছাড়া:

يابني إنها إن تك مثقال حبة من خردل فتكن في صخرة أو في السماوات أو في الأرض يأت بها الله إن الله لطيف خبير ﴿١٦﴾




হরকত সহ:

یٰبُنَیَّ اِنَّهَاۤ اِنْ تَکُ مِثْقَالَ حَبَّۃٍ مِّنْ خَرْدَلٍ فَتَکُنْ فِیْ صَخْرَۃٍ اَوْ فِی السَّمٰوٰتِ اَوْ فِی الْاَرْضِ یَاْتِ بِهَا اللّٰهُ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَطِیْفٌ خَبِیْرٌ ﴿۱۶﴾




উচ্চারণ: ইয়া-বুনাইয়া ইন্নাহাইন তাকুমিছকা-লা হাব্বাতিম্মিন খারদালিন ফাতাকুন ফী সাখরাতিন আও ফিছছামা-ওয়া-তি আও ফিল আরদিইয়া’তি বিহাল্লা-হু ইন্নাল্লা-হা লাতীফুন খাবীর।




আল বায়ান: ‘হে আমার প্রিয় বৎস, নিশ্চয় তা (পাপ-পুণ্য) যদি সরিষা দানার পরিমাণ হয়, অতঃপর তা থাকে পাথরের মধ্যে কিংবা আসমানসমূহে বা যমীনের মধ্যে, আল্লাহ তাও নিয়ে আসবেন; নিশ্চয় আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সর্বজ্ঞ’।




আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ১৬. হে আমার প্রিয় বৎস! নিশ্চয় তা (পাপ-পুণ্য) যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, অতঃপর তা থাকে শিলাগর্ভে অথবা আসমানসমূহে কিংবা যমীনে, আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন।(১) নিশ্চয়ই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত।




তাইসীরুল ক্বুরআন: হে বৎস! কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় আর তা থাকে পাথরের ভিতরে অথবা আকাশে অথবা যমীনের নীচে, আল্লাহ তাকে এনে হাজির করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্ণদর্শী, সব কিছুর খবর রাখেন।




আহসানুল বায়ান: (১৬) ‘হে বৎস ! কোন (পাপ অথবা পুণ্য) যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়[1] এবং তা যদি কোন পাথরের ভিতরে অথবা আকাশমন্ডলীতে অথবা মাটির নীচে থাকে, তাহলে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সকল বিষয়ে অবগত।



মুজিবুর রহমান: হে বৎস! কোন কিছু যদি সরিষার দানা পরিমানও হয় এবং তা যদি থাকে শিলাগর্ভে অথবা আকাশে কিংবা মাটির নীচে, আল্লাহ ওটাও হাযির করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সর্ববিষয়ে খবর রাখেন।



ফযলুর রহমান: (লোকমান তার পুত্রকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছিল) “হে বৎস! কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও (ক্ষুদ্র) হয় এবং তা কোন পাথরের মধ্যে কিংবা আসমানে অথবা ভূগর্ভেও থাকে, আল্লাহ তা উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সর্বজ্ঞ।”



মুহিউদ্দিন খান: হে বৎস, কোন বস্তু যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় অতঃপর তা যদি থাকে প্রস্তর গর্ভে অথবা আকাশে অথবা ভূ-গর্ভে, তবে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ গোপন ভেদ জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।



জহুরুল হক: "হে আমার পুত্র, এটি নিশ্চিত যে যদি সরষের একটি দানার ওজন-পরিমাণও কোনো কিছু রয়ে থাকে আর এটি যদি থাকে কোনো শিলাগর্ভে অথবা মহাকাশমন্ডলের মধ্যে কিংবা পৃথিবীর অভ্যন্তরে, আল্লাহ্ এটিকে নিয়ে আসবেন। নিঃসন্দেহ আল্লাহ্ গুপ্ত বিষয়ে জ্ঞাতা, পূর্ণ ওয়াকিফহাল।



Sahih International: [And Luqman said], "O my son, indeed if wrong should be the weight of a mustard seed and should be within a rock or [anywhere] in the heavens or in the earth, Allah will bring it forth. Indeed, Allah is Subtle and Acquainted.



তাফসীরে যাকারিয়া

অনুবাদ: ১৬. হে আমার প্রিয় বৎস! নিশ্চয় তা (পাপ-পুণ্য) যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, অতঃপর তা থাকে শিলাগর্ভে অথবা আসমানসমূহে কিংবা যমীনে, আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন।(১) নিশ্চয়ই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত।


তাফসীর:

(১) এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, আসমান ও যমীন এবং এর মাঝে যা কিছু আছে, এর প্রতিটি বিন্দুকণা আল্লাহর অসীম জ্ঞানের আওতাধীন এবং সবকিছুর উপর তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা ও আধিপত্য রয়েছে। কোন বস্তু যত গভীর আঁধার বা যবনিকার অন্তরালেই থাক না কেন - মহান আল্লাহর জ্ঞান ও দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পারে না এবং তিনি যে কোন বস্তুকে যখন ও যেখানে ইচ্ছা উপস্থিত করতে পারেন। যাবতীয় বস্তু মহান আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার আওতাভুক্ত। আল্লাহর জ্ঞান ও তাঁর পাকড়াও এর বাইরে কেউ যেতে পারে না। পাথরের মধ্যে ছোট্ট একটি কণা তোমার দৃষ্টির অগোচরে থাকতে পারে। কিন্তু তাঁর কাছে তা সুস্পষ্ট। আকাশ মণ্ডলে একটি ক্ষুদ্রতম কণিকা তোমার থেকে বহু দূরবর্তী হতে পারে কিন্তু তা আল্লাহর বহু নিকটতর। ভূমির বহু নিম্ন স্তরে পতিত কোন জিনিস, তোমার কাছে কোথায়, কোন অবস্থায় ও কী অবস্থায় রয়েছে, তুমি যে কোন সৎ বা অসৎ কাজই করো না কেন, তা আল্লাহর অগোচরে নয়। তিনি কেবল তা জানেন তাই নয় বরং যখন হিসেব-নিকেশের সময় আসবে তখন তিনি তোমাদের প্রত্যেকটি কাজের ও নড়াচড়ার রেকর্ড সামনে নিয়ে আসবেন। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]


তাফসীরে আহসানুল বায়ান

অনুবাদ: (১৬) ‘হে বৎস ! কোন (পাপ অথবা পুণ্য) যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়[1] এবং তা যদি কোন পাথরের ভিতরে অথবা আকাশমন্ডলীতে অথবা মাটির নীচে থাকে, তাহলে আল্লাহ তাও উপস্থিত করবেন। আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী, সকল বিষয়ে অবগত।


তাফসীর:

[1] هَا সর্বনামের ইঙ্গিত যদি خَطِيئَة এর দিকে হয়, তাহলে তার অর্থ হবে আল্লাহর অবাধ্যতা ও পাপকর্ম। আর যদি خَصلَة এর দিকে হয়, তাহলে তার অর্থ হবে ভাল অথবা মন্দের যে কোন অভ্যাস। উদ্দেশ্য এই যে, মানুষ ভাল অথবা মন্দ কর্ম যতই গোপনে করুক না কেন, তা আল্লাহর কাছে লুক্কায়িত থাকতে পারে না; কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তা উপস্থিত করে নেবেন। অর্থাৎ, তার যথাযথভাবে ভাল আমলের ভাল প্রতিদান ও মন্দ আমলের মন্দ প্রতিফল দেবেন। সরিষা দানার উদাহরণ এই জন্য দিয়েছেন যে,তা এত ছোট হয়, যার না ওজন বুঝা যায় আর না দাঁড়িপাল্লাকে ঝুঁকাতে পারে। অনুরূপ পাথর (সাধারণত বসবাসের স্থান থেকে দূরে জঙ্গল বা পাহাড়ে) একান্ত গুপ্ত ও সুরক্ষিত স্থান। এই অর্থ হাদীসেও বর্ণিত হয়েছে। মহানবী (সাঃ) বলেছেন, ‘‘যদি কোন ব্যক্তি এমন ছিদ্রহীন পাথরেও কোন আমল করে, যার কোন দরজা বা জানালা নেই, তাহলেও আল্লাহ্ তাআলা তাও মানুষের সামনে প্রকাশ করে দেবেন সে আমল যে ধরনেরই হোক না কেন।’’ (আহমদ ৩ /২৮) এই জন্য যে, আল্লাহ তাআলা সূক্ষ্মদর্শী; তিনি অতি সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখেন। নিতান্ত গুপ্ত বস্তুও তাঁর জ্ঞান বহির্ভূত নয় এবং তিনি সর্বজ্ঞ; রাতের অন্ধকারে পিঁপড়ের চলা-ফেরা করার খবরও তিনি রাখেন।


তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ


তাফসীর: ১৩-১৯ নং আয়াতের তাফসীর:



এখানে আল্লাহ তা‘আলা লুকমান হাকীমের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে একজন আদর্শ পিতার সন্তানের প্রতি কী করণীয় সে সম্পর্কে আলোচনা তুলে ধরেছেন। লুকমান (عليه السلام) তাঁর পুত্রকে যে নসীহত করেছিলেন ও উপদেশ দিয়েছিলেন সে সকল উপদেশ যদি প্রতিটি পিতা তার সন্তানকে প্রদান করেন তাহলে প্রত্যেক পরিবার, সমাজ ও দেশ আদর্শ পরিবার, সমাজ ও দেশে পরিণত হবে। লুকমান হাকীম তাঁর পুত্রকে যে নসীহত ও উপদেশ দিয়েছিলেন সেগুলো হলন



প্রথম উপদেশ:



তিনি তাঁর ছেলেকে সর্বপ্রথম আল্লাহ তা‘আলার হক সম্পর্কে সচেতন করে বললেন: একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে, কখনো আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করবে না। কেননা শির্ক একটি বড় ধরনের জুলুম। হাদীসে এসেছে, ইবনু মাসউদ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: যখন



(الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا وَلَمْ يَلْبِسُوْآ إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ)



-এ আয়াতটি নাযিল হয় তখন সাহাবীদের নিকট বিষয়টি খুবই কঠিন মনে হল। তারা বলল: আমাদের মধ্যে এমন কে আছে যে, তার ঈমানকে জুলুমের সাথে সংমিশ্রণ করেনি? তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, বিষয়টি এরূপ নয়। তোমরা লুকমান (عليه السلام)-এর কথা শুননি? সে তার সন্তানকে বলেছিলন



(إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ)



-নিশ্চয়ই শির্ক মহা জুলুম।।



অপর এক হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: সবচেয়ে বড় গুনাহ হল তিনটি, তার মধ্যে প্রথম হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করা। (সহীহ বুখারী হা: ৬৮৭০-৭১)



দ্বিতীয় উপদেশ:



আল্লাহ তা‘আলার হকের পর বান্দার মাঝে যারা বেশি হকদার তাদের হক সম্পর্কে সচেতন করছেন। তারা হলেন পিতা-মাতা। তিনি তাঁর ছেলেকে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্য নসীহত করলেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্য জোরালো আদেশ করেছেন। এমনকি কুরআনে প্রত্যেক জায়গায় আল্লাহ তা‘আলার অধিকারের পর পিতা-মাতার অধিকারের কথা বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী:



(وَقَضٰي رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوْآ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ط إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَآ أَوْ كِلَاهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَآ أُفٍّ وَّلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِيْمًا)



“তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ব্যতীত অন্য কারও ‘ইবাদত কর না ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর। তাদের একজন অথবা উভয়ে যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে তাদেরকে ‘উফ্’ বল না এবং তাদেরকে ধমক দিও না; তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বল।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২৩)



এখানে পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালন এবং তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকারের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এর হিকমত ও অন্তর্নিহিত রহস্য বর্ণনা করা হয়েছে যে, তার মা ধরাধামে তার আবির্ভাব ও অস্তিত্ব বজায় রাখার ক্ষেত্রে অসাধারণ ত্যাগ স্বীকার ও অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট বরদাশত করেছেন। নয় মাস গর্ভ ধারণ, প্রসব বেদনা, লালন-পালন, দুধ পান ইত্যাদি ক্ষেত্রে মাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে।



তবে পিতা-মাতা যদি এমন কোন বিষয়ের নির্দেশ দেয় যা বাস্তবায়ন করলে আল্লাহ তা‘আলার সাথে শরীক করা হয় সেক্ষেত্রে তাদের কথা মানা যাবে না। তবে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। এমনকি তাদের জন্য মহান আল্লাহ তা‘আলার দরবারে দু‘আ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:



(وَقُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّيَانِيْ صَغِيْرًا)



“এবং বল:‎ ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া কর‎ যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন।’’ (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:২৩-২৪)



তৃতীয় উপদেশ:



তৃতীয় উপদেশ দানের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার সূক্ষ্মদর্শীতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন: হে বৎস! তুমি যে আমলই করা না কেন যদি তা সরিষার দানা পরিমাণও হয় আর তা যদি শিলাগর্ভে বা আকাশে কিংবা মৃত্তিকার নীচে থেকে থাকে তাহলেও তা হাযির করে তোমাকে তার প্রতিদান দেবেন। এর দ্বারা তিনি ছেলেকে সতর্ক করছেন যাতে কখনো আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্য ও পাপ কাজে লিপ্ত না হয়। আল্লাহ তা‘আলা কারো প্রতি কোন জুলুম করবেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:



(وَنَضَعُ الْمَوَازِيْنَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيٰمَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا ط وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا ط وَكَفٰي بِنَا حٰسِبِيْنَ)‏



“এবং কিয়ামত দিবসে আমি স্থাপন করব ন্যায়বিচারের মানদণ্ড। সুতরাং কারো প্রতি কোন অবিচার করা হবে না এবং কর্ম যদি সরিষার দানা পরিমাণ ওজনেরও হয় তবুও সেটা আমি উপস্থিত করব; হিসেব গ্রহণকারীরূপে আমিই যথেষ্ট।” (সূরা আম্বিয়াহ ২১:৪৭)



আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:



(فَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَّرَه۫ - وَمَنْ يَّعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَّرَه۫)



“অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা দেখতে পাবে, এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযালা ৯৯:৭-৮)



সুতরাং মানুষ গোপনে বা প্রকাশ্যে যত ভাল আর খারাপ কাজ করুক না কেন আল্লাহ তা‘আলা তা কিয়ামতের দিন অবশ্যই উপস্থিত করবেন।



কেউ কেউ বলেন: صَخْرَةٌ হল যা সাত জমিনের নীচে থাকে। তবে এগুলোর ব্যাপরে সঠিক কথা আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।



চতুর্থ উপদেশ:



চতুর্থ উপদেশ হল কর্ম পরিশুদ্ধতা সম্পর্কে। মানুষ যত আমল করে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হল সালাত। তাই তিনি তাঁর ছেলেকে বললেন, তুমি সালাত কায়েম কর। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:



مُرُوا أَوْلَادَكُمْ بِالصَّلَاةِ وَهُمْ أَبْنَاءُ سَبْعِ سِنِينَ، وَاضْرِبُوهُمْ عَلَيْهَا، وَهُمْ أَبْنَاءُ عَشْرٍ وَفَرِّقُوا بَيْنَهُمْ فِي الْمَضَاجِعِ



সাত বছর বয়সে উপনীত হলে তোমাদের সন্তানদেরকে সালাতের নির্দেশ দাও, আদায় না করা অবস্থায় দশ বছর বয়সে পৌঁছলে প্রহার কর এবং বিছানা আলাদা করে দাও। (আবূ দাঊদা হা: ৪৯৫, সহীহ)



পঞ্চম উপদেশ:



পঞ্চম উপদেশ হল চরিত্র সংশোধন। ইসলাম একটি সমষ্টিগত ধর্ম, ব্যক্তির সাথে সমষ্টির সংশোধন ও জীবনব্যবস্থার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ অংগ। এজন্য সালাতের ন্যায় অবশ্য পালনীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল সৎ কাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজ থেকে বাধা দেয়া। সে জন্য লুকমান (عليه السلام) বললেন: হে বৎস! তুমি সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বিরত থাকতে বলবে।



ষষ্ঠ উপদেশ:



ষষ্ঠ উপদেশ হল, যখন তুমি মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দিবে এবং অসৎ কাজে বাধা দিবে তখন মানুষের পক্ষ হতে অনেক কষ্ট, বিপদ তোমাকে আঘাত করবে। আর তখন তোমার কাজ হল তুমি বিচলিত না হয়ে ধৈর্যধারণ করবে। কেননা এটা দৃঢ় সঙ্কল্পের একটি কাজ।



সপ্তম উপদেশ:



তুমি অহঙ্কারের বশবর্তী হয়ে মানুষকে অবজ্ঞা কর না। এবং উদ্ধতভাবে জমিনে বিচরণ কর না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা উদ্ধত, অহঙ্কারীকে ভালবাসেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:



(وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا ج إِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْأَرْضَ وَلَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُوْلًا)



“ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে বিচরণ কর না; তুমি তো কখনই পদভরে ভূপৃষ্ঠ বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত সমান হতে পারবে না।” (সূরা বানী ইসরাঈল ১৭:৩৭)



হারিস বিন ওয়াহাব খুযা’য়ী (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতবাসীদের পরিচয় বলে দিব না? তারা কোমল স্বভাবের লোক, মানুষের কাছেও কোমল বলে পরিগণিত। যদি তারা কোন বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার নামে শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা তা অবশ্যই পূর্ণ করেন। আর আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামবাসীদের পরিচয় বলে দিব না? তারা কঠোর স্বভাবের লোক, দাম্ভিক ও অহংকারী। অপর সনদে আনাস বিন মালেক (رضي الله عنه) বলেন: মদীনাবাসীদের ক্রীতদাসীদের মধ্যে একজন ক্রীতদাসী ছিল। সে তার প্রয়োজনে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাত ধরে যেখানে চাইতো নিয়ে যেত। (অর্থাৎ তার উদ্দিষ্টস্থলে হাত ধরে নিয়ে যেত। আর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-ও তার সাথে সাথে চলে যেতেন এবং তার প্রয়োজনীয় কাজ করে দিতেন। এমনই কোমল স্বভাবের ছিলেন তারা। অথচ তিনি তখনও রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন।) (সহীহ বুখারী হা: ৬০৭০, সহীহ মুসলিম হা: ২৮৫৩)



অষ্টম উপদেশ:



তুমি সংগতভাবে জমিনে তোমার পা ফেলবে। খুব ধীরে ধীরেও নয় আবার দম্ভভরেও নয়। বরং মধ্যম পন্থায় চলবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলার বান্দারা জমিনে নম্রভাবে চলাফেরা করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:



(وَعِبَادُ الرَّحْمٰنِ الَّذِيْنَ يَمْشُوْنَ عَلَي الْأَرْضِ هَوْنًا وَّإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجٰهِلُوْنَ قَالُوْا سَلَامًا)‏



‘রাহমান’-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে, ‘সালাম’। (সূরা ফুরকান ২৫:৬৩)



নবম উপদেশ:



তুমি কথা বলার সময় নীচু স্বরে কথা বলবে। কেননা সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্বর হচ্ছে গাধার স্বর। তাই তুমি গাধার মত উচ্চ স্বরে কথা বল না। বরং তোমরা কথায় নম্রতা বজায় রাখবে। হাদীসে এসেছে, আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যখন তোমরা মোরগের ডাক শুনবে তখন আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ কামনা কর। আর যখন গাধার ডাক শুনবে তখন আল্লাহ তা‘আলার কাছে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর। (সহীহ বুখারী হা: ৩৩০৩, সহীহ মুসলিম হা: ৮২)



সুতরাং প্রত্যেক পিতা-মাতার উচিত তার সন্তানকে এ সকল উপদেশ প্রদান করা। ফলে সন্তান আদর্শবান হবে এবং পিতা-মাতার বৃদ্ধ অবস্থায় সেবাযত্ন করবে।



আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:



১. পিতা-মাতার উচিত তাদের সন্তানদেরকে লুকমান (عليه السلام)-এর মত উপদেশ প্রদান করা।

২. আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। কেননা শির্ক হল সবচেয়ে বড় গুনাহ।

৩. আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার পাশাপাশি পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে।

৪. কিয়ামতের মাঠে মানুষের সমস্ত আমল উপস্থিত করা হবে এবং সেই অনুপাতে তাকে প্রতিদান দেয়া হবে। কারো প্রতি কোন প্রকার জুলুম করা হবে না।

৫. প্রতিটি পিতা-মাতা সন্তানকে সালাত কায়েম করার, সৎ কাজের আদেশ করার, অসৎ কাজে বাধা এবং বিপদে ধৈর্য ধারণ করার উপদেশ দিবে।

৬. অহংকার পতনের মূল, তাই কোন প্রকার অহঙ্কার করা যাবে না।

৭. আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টিকে অবজ্ঞা করা যাবে না।

৮. সংযতভাবে চলা ফেরা করতে হবে।

৯. উচ্চকণ্ঠে নয় বরং নম্রভাবে কথা বলতে হবে।


তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)


তাফসীর: ১৬-১৯ নং আয়াতের তাফসীর

এগুলো হযরত লোকমানের অন্যান্য উপদেশ। যেহেতু এগুলো হিকমতে পরিপূর্ণ সেহেতু কুরআন কারীমে এগুলো বর্ণনা করা হয়েছে, যেন লোকেরা এর উপর আমল করতে পারে। বলা হচ্ছেঃ মন্দ কাজ, যুলুম, ভুল-ভ্রান্তি ইত্যাদি সরষের দানা পরিমাণই হালে না কেন এবং তা যতই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হালে না কেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা'আলা তা অবশ্যই উপস্থিত করবেন। মীযানে তা ওযন করা হবে এবং তার প্রতিফল দেয়া হবে। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ (আারবি)

অর্থাৎ “আমি (কিয়ামতের দিন) ইনসাফের তারাষ্য রেখে দিবো, সুতরাং কোন নফসের প্রতি বিন্দুমাত্র যুলুম করা হবে না।” (২১:৪৭) আর এক জায়গায় আছেঃ (আারবি)

অর্থাৎ “কেউ অণু পরিমাণ সৎ কাজ করলে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎ কাজ করলে তাও দেখবে।” (৯৯:৭-৮)

সেই নেকী অথবা বদী কোন বাড়ীতে, কোন অট্টালিকায়, কোন দূর্গে, কোন পাথরের ফাঁকে, আসমানের উপরে, মাটির নীচে, মোটকথা যেখানেই করা হালে কেন আল্লাহ তা'আলার কাছে তা গোপন থাকে না। আল্লাহ পাক তা পেশ করবেনই। তিনি সূক্ষ্মদর্শী, তিনি সকল বিষয়ের খবর রাখেন। ক্ষুদ্র হতে ক্ষুদ্রতম জিনিসও তাঁর কাছে অপ্রকাশিত থাকে না। অন্ধকার রাত্রে পীপিলিকা চলতে। থাকলেও তিনি ওর পায়ের শব্দ শুনতে পান।

কেউ কেউ বলেন যে, (আারবি) দ্বারা ঐ পাথরকে বুঝানো হয়েছে যা সাত তবক যমীনের নীচে থাকে। এর কিছু কিছু সনদও সুদ্দী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। যদি এটা সঠিক প্রমাণিত হয় তবে ভাল কথা। সাহাবীদের একটি জামাআত হতেও এটা বর্ণিত আছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। খুব সম্ভব যে, এটাও ইসরাঈলী বর্ণনা। কিন্তু তাদের কিতাবসমূহের কোন কথাকে আমরা সত্যও বলতে পারি না, মিথ্যাও না। এটা তো প্রকাশমান যে, ওটা সরিষার দানা পরিমাণ কোন তুচ্ছ ও নগণ্য আমল হালে এবং তা এতো গোপনীয় হালে যে, কোন পাথরের মধ্যে রয়েছে। যেমন হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যদি তোমাদের মধ্য হতে কোন লোক এমন পাথরের মধ্যেও কোন আমল করে যার কোন দর-জানালা নেই ও কোন ছিদ্রও নেই, তবুও আল্লাহ তা'আলা তা জনগণের সামনে প্রকাশ করে দিবেন, সেই আমল ভালই হালে আর মন্দই হালে। এরপর হযরত লোকমান তাঁর পুত্রকে বলেনঃ “হে আমার প্রিয় পুত্র! তুমি নামাযের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবে। ওর ফরয, ওয়াজিব, আরকান, সময় ইত্যাদির পূর্ণ হিফাযত করবে। সাধ্যানুযায়ী আল্লাহর কথা সকলের নিকট পৌছিয়ে দিবে। প্রত্যেক ভাল কাজের জন্যে সকলকে উৎসাহিত করবে। মন্দ কাজ থেকে তাদেরকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে। যেহেতু ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ হতে নিষেধ এমন একটি বিষয় যা প্রত্যেকের কাছে তিক্ত লাগে, সত্যভাষী লোকদের সাথে সবাই শত্রুতা রাখে, সেই হেতু আল্লাহ তাআলা তাদের দেয়া কষ্টের উপর ধৈর্যধারণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর পথে উন্মুক্ত তরবারীর নীচে নানা প্রকার কষ্ট সহ্য করার সময় অলস হয়ে বসে না পড়া খুব বড় বাহাদুরীর কাজ। হযরত লোকমান তাই স্বীয় পুত্রকে এ কাজের উপদেশই দিয়েছেন।

এরপর হযরত লোকমান স্বীয় পুত্রকে বলেনঃ অহংকারবশে তুমি মানুষের দিক হতে তোমার মুখখানা ফিরিয়ে নিয়ো না। তাদেরকে নিকৃষ্ট জ্ঞান ও নিজেকে বড় মনে করো না। বরং তাদের সাথে সদা সদ্ব্যবহার করবে এবং তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বলবে।

হাদীস শরীফে এসেছেঃ “তুমি সমস্ত মুসলিম ভাই-এর সাথে হাসিমুখে মেলামেশা করবে। এটাও তোমার জন্যে বড় একটা পুণ্যের কাজ।”

অতঃপর হযরত লোকমান বলেনঃ হে আমার প্রিয় বৎস! তুমি পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না। কারণ আল্লাহ কোন উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। এমন যেন না হয় যে, তুমি আল্লাহর বান্দাদেরকে নিকৃষ্ট মনে করবে, তাদের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নিবে এবং গরীব ও মিসকীনদের সাথে কথা বলতে ঘৃণা বোধ করবে। মুখ ঘুরিয়ে কথা বলাও অহংকার।

(আারবি) একটা অসুখের নাম। উটের ঘাড়ে ও মাথায় এ অসুখ বেশী প্রকাশ পায়। এ অসুখে ঘাড় বাঁকা হয়ে যায়। অহংকারী লোকদেরকে এ অসুখের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আরব দেশের লোক এই অহংকারের অবস্থাকে (আারবি) বলে থাকে। আর এ শব্দের ব্যবহার তাদের কবিতাতেও প্রকাশ পেয়েছে। এভাবে গর্বভরে চলা আল্লাহ তা'আলা পছন্দ করেন না। দাম্ভিক ও অহংকারীরা আল্লাহর ভালবাসা লাভ করতে পারে না। তাদের সম্পর্কে তিনি বলেনঃ (আারবি)

অর্থাৎ “তুমি দম্ভভরে চলাফেরা করো না, যেহেতু না তুমি যমীনকে ধ্বংস করতে পারবে, পাহাড়ের উচ্চতায় পৌঁছতে পারবে।” (১৭:৩৭) এ আয়াতের তাফসীরও যথাস্থানে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে একদা অহংকারের উল্লেখ করা হলে তিনি ওর খুবই নিন্দে করলেন এবং বললেন যে, এই রূপ আত্মম্ভরী ও অহংকারীর প্রতি আল্লাহ তা'আলা খুবই রাগান্বিত হন। তখন একজন সাহাবী (রাঃ) আরয করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি যখন কাপড় সাফ করি এবং তা খুব পরিষ্কার হয় তখন আমাকে খুব ভাল লাগে। অনুরূপভাবে ভাল চামড়ার জুতা পায়ে দিলে মন খুব আনন্দিত হয়। লাঠির সুন্দর আচ্ছাদনীও মনে আনন্দ দেয়। (তাহলে এটা কি অহংকার হবে)?” উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “না, এটা অহংকার নয়। বরং অহংকার ওরই নাম যে, তুমি সত্যকে ঘৃণা করবে ও লোকদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে।. এ রিওয়াইয়াতটি অন্য ধারায় খুব লম্বাভাবেও বর্ণিত আছে এবং তাতে হযরত সাবিত (রাঃ)-এর ইন্তেকাল ও তার অসিয়তের কথাও বর্ণিত হয়েছে।

মহান আল্লাহ হযরত লোকমানের উক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে আরো বলেনঃ তুমি মধ্যম চালে চলবে। খুব ধীরে ধীরেও না এবং খুব ডিং মেরে ও দম্ভভরেও না। আর কথা বলার সময় খুব বড়াবাড়ী করবে না। অযথা খুব চীষ্কার করে কথা বলবে না। জেনে রাখবে যে, স্বরের মধ্যে গর্দভের স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।

এই খারাপ দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, অকারণে চীৎকার করা ও উঁট-ডপট করা হারাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “মন্দ দৃষ্টান্তের যোগ্য আমরা নই। যে নিজের জিনিস দান করে ফিরিয়ে নেয় তার উপমা হলো ঐ কুকুর যে বমি করে ঐ বমি চাটতে থাকে।

এই আয়াতের তাফসীরে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “যখন তোমরা মোরগের ডাক শুনবে তখন আল্লাহ তা'আলার কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা করবে। আর যখন তোমরা গাধার ডাক শুনবে তখন শয়তান হতে আল্লাহ তাআলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে। কেননা, সে শয়তানকে দেখতে পায়। (এ হাদীসটি ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) অন্য একটি রিওয়াইয়াতে রাত্রির কথা উল্লেখ আছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

হযরত লোকমান হাকীমের এ উপদেশগুলো অত্যন্ত উপকারী ও লাভজনক বলেই আল্লাহ তা'আলা কুরআনে কারীমে এগুলো বর্ণনা করেছেন। তার আরো বহু জ্ঞানগর্ব উক্তি ও উপদেশ বর্ণিত আছে। নমুনা ও নিয়ম-রীতি হিসেবে আমরাও অল্পকিছু বর্ণনা করছিঃ হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, লোকমান হাকীম বলেছেনঃ “যখন আল্লাহকে কোন জিনিস সপে দেয়া হয় তখন তিনি ওর হিফাযত করে থাকেন।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)

হযরত কাসিম ইবনে মুখাইমারাহ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত লোকমান হাকীম স্বীয় পুত্রকে বলেনঃ “হে আমার প্রিয় বৎস! তুমি (আরবি) হতে বেঁচে থাকো, কেননা এটা রাতের বেলায় ভীতিপ্রদ এবং দিনের বেলায় নিন্দনীয় জিনিসি।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত লোকমান হাকীম স্বীয় পুত্রকে আরো বলেনঃ “হে আমার প্রিয় পুত্র! নিশ্চয়ই হিকমত বা প্রজ্ঞা মিসকীনদেরকে বাদশাহ বানিয়ে দেয়।” (এটাও ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

আউন ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত লোকমান তাঁর ছেলেকে বলেনঃ “হে আমার প্রিয় বৎস! যখন তুমি কোন মজলিসে হাযির হবে তখন ইসলামী রীতি অনুযায়ী সালাম করবে। তারপর মজলিসের এক দিকে বসে পড়বে। অন্যেরা কিছু না বললে তুমিও কিছু বলবে না, বরং নীরব থাকবে। মজলিসের লোকেরা যদি আল্লাহর যিকরে মশগুল হয়ে যায় তবে তুমি তাতে সবচেয়ে বড় অংশ নেয়ার চেষ্টা করবে। আর যদি তারা বাজে গল্প শুরু করে দেয় তবে তুমি ঐ মজলিস ছেড়ে চলে আসবে।” এটাও মুসনাদে ইবনে আবি হাতিমে বর্ণিত হয়েছে।

হাফস ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত লোকমান একটি সরিষাপূর্ণ থলে নিজের পার্শ্বে রেখে তার ছেলেকে উপদেশ দিতে শুরু করেন। প্রত্যেকটি উপদেশের পর তিনি একটি করে সরিষা থলে হতে বের করতে থাকেন। অবশেষে থলে শূন্য হয়ে পড়ে। তখন তিনি তার ছেলেকে বলেনঃ “হে আমার প্রিয় পুত্র! যদি আমি এই উপদেশগুলো কোন পাহাড়কে করতাম তবে পাহাড় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যেতো।” শেষ পর্যন্ত তাঁর পুত্রেরও এ অবস্থাই হয়। (ইবনে আবি হাতিম (রঃ)-ই এটা বর্ণনা করেছেন)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা হাবশীদেরকে গ্রহণ করে নাও। কেননা, তাদের তিনজন জান্নাতবাসীদের নেতা। তারা হলো- লোকমান হাকীম (রঃ), নাজ্জাশী (রঃ)। এবং মুআযিন বিলাল (রাঃ)।” (এ হাদীসটি আবুল কাসিম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

বিনয় ও তার বর্ণনা

হযরত লোকমান (রঃ) স্বীয় পুত্রকে এর উপদেশ দিয়েছিলেন এবং ইবনে আবিদ দুনিয়া (রঃ) এই মাসআলার উপর একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমরা এখানে ওর মধ্য হতে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ উক্তি বর্ণনা করছি।

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেন : “বহু বিক্ষিপ্ত চুল বিশিষ্ট ও ময়লা কাপড় পরিহিত লোক রয়েছে যারা বড় লোকদের দ্বারে পৌঁছতে পারে না, আল্লাহ তাআলার কাছে তাদের এতো মর্যাদা রয়েছে যে, তারা যদি তার নামে কসম খেয়ে কোন কাজ করতে লাগে তবে আল্লাহ তা পূর্ণ করে থাকেন।”

অন্য হাদীসে আছে যে, হযরত বারা ইবনে আযিব (রাঃ) এ ধরনের লোকদের অন্তর্ভুক্ত।

একদা হযরত উমার (রাঃ) হযরত মুআয (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কবরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে কাঁদতে দেখে তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেন, এই কবরবাসী (সঃ) হতে আমি একটি হাদীস শুনেছিলাম যা স্মরণ করে আমি কাঁদছি। আমি তাঁকে বলতে শুনেছিঃ “সামান্য রিয়াকারীও শিরক। আল্লাহ তা'আলা ঐ লোকদেরকে ভালবাসেন যারা পরহেযগার। যারা লোকদের মধ্যে অপরিচিত অবস্থায় থাকে, যাদেরকে গণ্যমান্য মনে করা হয় না। যদি তারা কোন সমাবেশে না আসে তবে কেউ তাদের সম্পর্কে কোন জিজ্ঞাসাবাদ করে না। আর কোন সমাবেশে তারা হাযির হলে কেউ তাদেরকে স্বাগত জানায় না। তাদের অন্তর হিদায়াতের প্রদীপ স্বরূপ। তারা প্রত্যেক ধূলিময় অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থান হতে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে জ্যোতি আহরণ করে থাকে।”

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ময়লা কাপড় পরিহিত বহু লোক এমন রয়েছে যাদেরকে তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করা হয়, তারা। আল্লাহ্ তা'আলার কাছে এতো বেশী মর্যাদার অধিকারী যে, তারা আল্লাহর নামে কসম খেলে আল্লাহ তা পূর্ণ করে থাকেন। যদিও আল্লাহ তাদেরকে পার্থিব সুখ-সম্পদ প্রদান করেননি, কিন্তু তারা যদি বলেঃ “হে আল্লাহ! আমরা আপনার জান্নাত প্রার্থনা করছি।” তবে আল্লাহ অবশ্যই তাদেরকে তা প্রদান করেন।

হযরত সালেম ইবনে আবিল জুদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের মধ্যে এমন লোকও আছে যে, সে যদি কারো দরযায় গিয়ে একটি দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) বা একটি দিরহাম (রৌপ্য মুদ্রা) অথবা একটি পয়সা চায় তবে সে তাকে তা দেয় না। কিন্তু সে আল্লাহ্র এতো প্রিয়পাত্র যে, সে তার কাছে যদি পূর্ণ জান্নাতও চেয়ে বসে তবুও তিনি তাকে তা দিয়ে থাকেন। কিন্তু তিনি তাকে দুনিয়া দেন না এবং তার থেকে বিরত রাখেন না। কেননা, এটা কোন উল্লেখযোগ্য জিনিস নয়। সে দু'টি ময়লাযুক্ত চাদর পরিহিত থাকে। যদি সে কোন ব্যাপারে কসম খেয়ে বসে তবে আল্লাহ তার কসম পুরো করে থাকেন।”

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “জান্নাতের বাদশাহ তারাই যাদের মাথার চুল বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো, ধূলিমলীন চেহারা বিশিষ্ট। তারা কোন ধনী ও আমীরের বাড়ী যেতে চাইলে তাদেরকে অনুমতি দেয়া হয় না। তারা কোন বড় বাড়ীতে বিয়ের প্রস্তাব দিলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। এই দরিদ্রদের প্রতি সুবিচার করা হয় না। তাদের প্রয়োজন এবং মনের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবার পূর্বেই তারা দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণ করে। কাজেই তাদের মনের আশা মনেই থেকে যায়। কিয়ামতের দিন তারা এতো বেশী জ্যোতি লাভ করবে যে, তা যদি বন্টন করে দেয়া হয় তবে তা সমগ্র দুনিয়াবাসীর জন্যে যথেষ্ট হবে।”

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক (রঃ) কবিতায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “বহু লোক এমন রয়েছে যাদেরকে দুনিয়ায় তুচ্ছ ও নিকৃষ্ট মনে করা হয়, তারাই কাল কিয়ামতের দিন সিংহাসন, মুকুট, রাজ্য ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হবে। বাগানে, নদীতে এবং সুখ-সাগরে তারা অবস্থান করবে।”

হযরত আবু উমামা (রাঃ) মারফু’রূপে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয় অলী হলো ঐ ব্যক্তি যে মুমিন, ধন-দৌলত যার কম, যে নামাযী, ইবাদতকারী, অনুগত, গোপনে ও প্রকাশ্যে আনুগত্য স্বীকারকারী, জনগণের মধ্যে যার কোন মান-সম্মান নেই, যাকে কেউ ইশারা ইঙ্গিতেও ডাকে না এবং এর উপর যে ধৈর্যধারণ করে থাকে। এরপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় হাত ঝেড়ে বলেনঃ “তার মৃত্যু তাড়াতাড়ী এসে থাকে এবং তার মীরাস খুব কম হয়। তার জন্যে ক্রন্দনকারীদের সংখ্যা অতি অল্প হয়।”

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেনঃ “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় বান্দা হচ্ছে দরিদ্র লোকেরা যারা নিজেদের দ্বীন নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তারা যেখানে তাদের দ্বীন দুর্বল হয়ে পড়ার আশংকা করে সেখান থেকে সরে পড়ে। এরা কিয়ামতের দিন হযরত ঈসা (আঃ)-এর সাথে একত্রিত হবে।”

হযরত ফুযাইল ইবনে আইয়ায (রাঃ) বলেন, আমার নিকট এ খবর পৌঁছেছে যে, আল্লাহ তা'আলা কিয়ামতের দিন স্বীয় বান্দাদেরকে বলবেনঃ “আমি কি তোমাকে ইনআম ও সম্মান প্রদান করিনি। আমি কি তোমাকে বহু কিছু দান করিনি? আমি কি তোমার দেহ আচ্ছাদিত করিনি? আমি কি এটা করিনি, ওটা করিনি? তোমাকে কি লোকদের মধ্যে সম্মানিত করিনি?” তাহলে তুমি যদি পার যে, তুমি জনগণের নিকট অপরিচিত থাকবে তবে তাই কর। জনগণ যদি তোমার প্রশংসা করে তবে এতে তোমার লাভ কি? আর যদি তারা তোমার দুর্নাম করে তবেই বা তোমার ক্ষতি কি? আমাদের কাছে তো ঐ ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা উত্তম যাকে লোকে মন্দ বলে এবং সে আল্লাহর নিকট উত্তম বলে বিবেচিত হয়।

ইবনে মুহাইরিয (রঃ) তো দু'আ করতেনঃ “হে আল্লাহ! আমার খ্যাতি যেন ছড়িয়ে না পড়ে।” খলীল ইবনে আহমাদ (রঃ) দুআয় বলতেনঃ “হে আল্লাহ! আমাকে আপনার কাছে মর্যাদাবান করে রাখুন, আমার নিজের দৃষ্টিতে আমাকে হেয় ও তুচ্ছ করে রাখুন এবং জনগণের মধ্যে আমাকে মধ্যম ধরনের মর্যাদা দান করুন।”

শুহরাত বা খ্যাতির ব্যাপারে যা এসেছে তার অনুচ্ছেদ

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মানুষের নিকৃষ্ট হওয়ার জন্যে এটাই যথেষ্ট যে, ললাকেরা তার দ্বীনদারী বা দুনিয়াদারীর খ্যাতি ছড়াতে শুরু করে দেয়, তার দিকে অঙ্গুলি উঠতে শুরু করে, তার দিকে ইশারা ইঙ্গিত করতে লাগে। এই পর্যায়ে এসে বহু লোক ধ্বংস হয়ে যায়, শুধু ঐ ব্যক্তিই রক্ষা পায় যাকে আল্লাহ রক্ষা করেন। জেনে রেখো যে, আল্লাহ তোমাদের আকৃতির দিকে দেখেন না, বরং দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমলের দিকে।”

হযরত হাসান বসরী (রঃ) হতেও এ রিওয়াইয়াতটি মুরসালরূপে বর্ণিত আছে। তিনি এটা রিওয়াইয়াত করলে কেউ তাঁকে প্রশ্ন করেঃ “আপনারদিকেও তো মর্যাদার অঙ্গুলি উঠানো হয়ে থাকে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “তুমি বুঝতে পারনি। এখানে অঙ্গুলি উঠানো দ্বারা দ্বীনী বিদআত ও পার্থিব পাপাচারকে বুঝানো হয়েছে।”

হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “তুমি প্রসিদ্ধি লাভ করতে চেয়ো না। তুমি নিজেকে উঁচু করে তুলো না যে, জনগণের মধ্যে তোমার সমালোচনা শুরু হয়ে যায়। তুমি বিদ্যা অর্জন কর, তবে নিজেকে গোপন রাখো এবং নীরব থাকো যাতে শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করতে পার। সকর্মশীলদেরকে সন্তুষ্ট রাখো এবং পাপাচারীদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করো।”

হযরত ইবরাহীম ইবনে আদহাম (রঃ) বলেছেনঃ “খ্যাতি বা প্রসিদ্ধি অন্বেষণকারী ব্যক্তি আল্লাহর অলী হতে পারে না।” হযরত আইয়ূব (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা'আলা যাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন সে তো নিজের মর্যাদা মানুষের নিকট গোপন রাখে।

মুহাম্মাদ ইবনে আ’লা (রঃ) বলেন যে, আল্লাহভক্ত মানুষ নিজেকে প্রকাশ করে না। হাম্মাক ইবনে সালমাহ (রঃ) বলেনঃ “সাধারণ লোকের সাথে মেলামেশা ও বন্দু-বান্ধবের আধিক্য হতে বেঁচে থাকো।”
হযরত আইয়াস ইবনে উসমান (রাঃ) বলেনঃ “যদি নিজের দ্বীনকে নিখুঁত রাখতে চাও তবে জনগণের সাথে খুব কম মেলামেশা করো।”

হযরত আবুল আলিয়া (রঃ)-এর নিয়ম ছিল এই যে, যখন তিনি তাঁর মজলিসে তিনজন লোককে একত্রিত হতে দেখতেন তখন নিজে সেখান হতে চলে যেতেন।

হযরত তালহা (রাঃ) যখন দেখতেন যে, তার কাছে ভীড় জমে গেছে তখন তিনি বলতেনঃ “এগুলো লোভের মাছি ও আগুনের পতঙ্গ।”

হযরত হানযালা (রাঃ)-কে জনগণ ঘিরে দাঁড়ালে হযরত উমার (রাঃ) চাবুক উঁচু করে ধরে বললেনঃ “এতে অনুসারীদের জন্যে রয়েছে অবমাননা এবং অনুসৃতের জন্যে রয়েছে ফিত্না।”

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর সাথে লোকেরা চলতে শুরু করলে তিনি বলেনঃ “আমার গোপনীয়তা যদি তোমাদের উপর প্রকাশ হয়ে পড়তো তবে সম্ভবতঃ তোমাদের দু’জন লোকও আমার পিছনে চলা পছন্দ করতো না।”

হযরত হাম্মাদ ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন, যখন আমরা কোন মজলিসের পার্শ্ব দিয়ে গমন করতাম এবং হযরত রঃ) আমাদের সাথে থাকতেন, তখন তিনি সালাম করতেন এবং তারা খুব আবেগের সাথে উত্তর দিতো। সুতরাং এটা একটা নিয়ামত ছিল। হযরত আইয়ূব (রঃ) খুব লম্বা জামা পরিধান করতেন। তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ “আগেকার দিনে লম্বা জামার খুব সম্মান ছিল। কিন্তু লম্বা জামা পরিধানকারীর সম্মান করা হতো তাকে বড় করার জন্যে।” একদা তিনি তাঁর একটা টুপি সুন্নাত পদ্ধতিতে রঙ করিয়ে নেন। কিছুদিন এ টুপিটি পরার পর তিনি আর ওটা ব্যবহার করলেন না। তিনি বলেনঃ “আমি লক্ষ্য করেছি যে, সাধারণ লোক এ ধরনের টুপি ব্যবহার করে না।”

হযরত ইবরাহীম নাখয়ী (রঃ) বলেনঃ “তোমরা এমন পোশাক পরিধান করবে যা দেখে লোকে ঘৃণা না করে।”

সাওরী (রঃ) বলেন যে, পূর্বযুগীয় মনীষীরা না খুব জাকজমকপূর্ণ পোশাক পরিধান করতেন, না অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর পোশাক পরতেন।

আবু কিলাবা (রঃ)-এর কাছে কোন একজন লোক অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও মূল্যবান পোশাক পরে আগমন করে। তখন তিনি বলেনঃ “এই চিৎকারকারী গাধা হতে বেঁচে থাকো।”

হযরত হাসান (রঃ) বলেন যে, কোন কোন ব্যক্তি অন্তরে অহংকার পোষণ করে, কিন্তু সে বিনয় প্রকাশ করে তার বাহ্যিক পোশাকে। যেন তার চাদর একটি বড় হাতুড়ী।

হযরত মূসা (আঃ)-এর উক্তি আছে যে, তিনি বানী ইসরাঈলকে বলেনঃ “তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আমার কাছে এসে থাকো দরবেশী পোশাকে, অথচ তোমাদের অন্তর তো নেকড়ে বাঘের অন্তরের ন্যায়? দেখো, তোমরা রাজা-বাদশাহদের পোশাক পরিধান করবে এবং অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখবে।”

উত্তম চরিত্রের বর্ণনা :

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, লোকদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ছিলেন সর্বাপেক্ষা উত্তম চরিত্রের অধিকারী।

হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সবচেয়ে উত্তম মুমিন কে?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম সেই সবচেয়ে উত্তম মুমিন।”

হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমল কম হওয়া সত্ত্বেও শুধু উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়ার কারণে মানুষ বড় বড় মর্যাদা ও জান্নাতের উত্তম মনযিল লাভ করে থাকে। পক্ষান্তরে, আমল অধিক হওয়া সত্ত্বেও শুধু দুশ্চরিত্র হওয়ার কারণে মানুষ জাহান্নামের নিম্নস্তরে চলে যায়।” তিনি আরো বলেছেনঃ “সৎ স্বভাবের মাঝেই দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিহিত আছে।”

হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “উত্তম চরিত্রের কারণে মানুষ এমন ব্যক্তির মর্যাদা লাভ করে যে রাত্রে দাড়িয়ে ইবাদত করে ও দিনে রোযা রাখে।”

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ “সাধারণভাবে জান্নাতে প্রবেশ লাভের মাধ্যম কি?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আল্লাহভীতি ও উত্তম চরিত্র।” আবার তাকে জিজ্ঞেস করা হয়? “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সাধারণতঃ কি কারণে মানুষ জাহান্নামে প্রবেশ করে?” তিনি জবাবে বলেনঃ “দু’টি ছিদ্র বিশিষ্ট জিনিসের কারণে অর্থাৎ মুখ ও গুপ্তাঙ্গ।”

হযরত উসামা ইবনে শুরাইক (রাঃ) বলেন, আমি একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট ছিলাম, এমন সময় প্রত্যেক জায়গা হতে আরববাসীরা তাঁর নিকট আগমন করে এবং জিজ্ঞেস করেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! মানুষকে সর্বাপেক্ষা উত্তম জিনিস কি দেয়া হয়েছে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “উত্তম চরিত্র।”

হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেনঃ “নেকীর পাল্লায় উত্তম চরিত্র অপেক্ষা অধিক ভারী জিনিস আর কিছুই নেই।”

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বাপেক্ষা উত্তম যার চরিত্র উত্তম।”

হযরত হাসান ইবনে আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর পথে জিহাদকারীকে যেমন আল্লাহ তাআলা সকাল সন্ধ্যায় প্রতিদান দিয়ে থাকেন তেমনই তিনি সৎ চরিত্রের অধিকারীকেও তার উত্তম চরিত্রের বিনিময় প্রদান করে থাকেন।”

হযরত আবু সা'লাবা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় এবং আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী ঐ ব্যক্তি যার চরিত্র সবচেয়ে উত্তম। পক্ষান্তরে ঐ ব্যক্তি আমার কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় এবং জান্নাতের মনযিলে আমার চেয়ে অধিক দূরবর্তী যার চরিত্র খারাপ ও ভাষা কর্কষ।”

হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “পূর্ণ ঈমানদার ও উত্তম চরিত্রের লোক ঐ ব্যক্তি, যে সবারই সাথে উত্তম ব্যবহার করে ও প্রেম প্রীতির সাথে মিলেমিশে থাকে।”

হযরত বকর ইবনে আবি ফুরাত (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যার জন্ম ও স্বভাব-চরিত্র ভাল, আল্লাহ তাআলা তাকে জাহান্নামের ইন্ধন বানাবেন না।”

হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মুমিনের মধ্যে দুটি স্বভাব একত্রিত হতে পারে না। একটি হলো কৃপণতা এবং অপরটি হলো মন্দ চরিত্র।”

হযরত মাইমূন ইবনে মাহরান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে বর্ণনা করেছেনঃ “আল্লাহ তা'আলার নিকট মন্দ চরিত্র অপেক্ষা বড় পাপ আর কিছুই নেই। কেননা, মন্দ স্বভাবের কারণে এক একটি বড় পাপে মানুষ জড়িয়ে পড়ে।

কুরায়েশের একটি লোক হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর কাছে মন্দ চরিত্র অপেক্ষা বড় পাপ আর নেই। ভাল চরিত্রের কারণে গুনাহ মাফ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে মন্দ চরিত্র সৎ আমলকে নষ্ট করে দেয়- যেমন সির্কা মধুকে নষ্ট করে থাকে।”

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মাল দ্বারা তোমরা মানুষকে বশে আনতে পার না, বরং উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে মানুষকে বশে আনা যায়।”
মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন (রঃ) বলেনঃ “উত্তম চরিত্র দ্বীনের সহায়ক।”

অহংকার নিন্দনীয় হওয়ার বর্ণনা:

হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেনঃ “ঐ ব্যক্তি জান্নাতে যাবে না যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও অহংকার আছে এবং ঐ ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে না যার অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান আছে।”

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যার অন্তরে অণু পরিমাণও অহংকার আছে সে উল্টো মুখে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।”

হযরত সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মানুষ আত্মগরিমায় এমনভাবে মেতে ওঠে যে, আল্লাহর নিকট তার নাম যালিম ও অহংকারীদের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। তখন তার উপর ঐ শাস্তি এসে পৌঁছে যা অহংকারী যালিমদের উপর পৌছেছিল।”

ইমাম মালিক ইবনে দীনার (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত সুলাইমান ইবনে দাউদ (আঃ) সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন, ঐ সময় তাঁর দরবারে দু’লক্ষ মানুষ ও দু’লক্ষ জ্বিন সমবেত ছিল। তাঁকে আসমান পর্যন্ত পৌছিয়ে দেয়া হয়, এমন কি ফেরেশতাদের তাসবীহ পাঠের শব্দ তিনি শুনতে পান। অতঃপর তাঁকে যমীনে ফিরিয়ে আনা হয়, এমন কি সমুদ্রের পানিতে তার পা ভিজে যায়। এমন সময় গায়েবী আওয়ায হয়ঃ “যদি তার অন্তরে অণু পরিমাণও অহংকার যতো উপরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার চেয়ে বেশী নীচে তাকে প্রোথিত করা হতো।”

হযরত আবু বকর (রাঃ) একদা স্বীয় ভাষণে মানুষের জন্মের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন যে, সে দু’জন মানুষের প্রস্রাবের স্থান হতে বের হয়ে থাকে। এটা তিনি এমনভাবে বর্ণনা করেন যে, শ্রোতারা তা শুনতে ঘৃণা বোধ করে।

ইমাম শাবী (রঃ) বলেন যে, যে ব্যক্তি দু’জন লোককে হত্যা করে ফেলে সে বড়ই উদ্ধত ও যালিম। অতঃপর তিনি নিম্নের আয়াতটি পাঠ করেন (আরবি) “(হে মুসা আঃ)! গতকল্য তুমি যেমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছে, সেভাবে কি আমাকেও হত্যা করতে চাচ্ছ? তুমি তো পৃথিবীতে স্বেচ্ছাচারী হতে চাচ্ছ।” (২৮:১৯)

হযরত হাসান (রঃ) বলেনঃ “যে দু’বার নিজের হাতে নিজের পায়খানা পরিষ্কার করে সে কিসের ভিত্তিতে অহংকার করে এবং তাঁর বিশেষণ নিজের মধ্যে সৃষ্টি করতে চায় যিনি আকাশসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং এগুলোকে নিজের অধিকারে রেখেছেন?” হযরত যহহাক ইবনে সুফিয়ান (রঃ) হতে দুনিয়ার দৃষ্টান্ত এমন জিনিস দ্বারা দেয়াও বর্ণিত আছে যা মানুষ হতে বের হয়।

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে হুসাইন ইবনে আলী (রাঃ) বলেনঃ “যার অন্তরে যে পরিমাণ অহংকার ও আত্মম্ভরিতা থাকে সেই পরিমাণ জ্ঞান তার কমে যায়।”

ইউনুস ইবনে উবায়েদ (রাঃ) বলেনঃ “সিজদা করার সাথে অহংকার এবং তাওহীদের সাথে নিফাক বা কপটতা থাকতে পারে না।”

বানু উমাইয়ারা নিজেদের ছেলেদেরকে মেরে মেরে গর্বভরে চলা শিক্ষা দিতো।

হযরত উমর ইবনে আবদিল আযীয (রঃ)-কে একদা দম্ভ ও গর্বভরে চলতে দেখে হযরত তাউস (রঃ) তার পার্শ্বদেশে একটি খোঁচা মেরে বলেনঃ “যার পেট মলে পরিপূর্ণ তার এ ধরনের চাল কেন?” হযরত উমার (রঃ) এতে লজ্জিত হয়ে বলেনঃ “জনাব, ক্ষমা করুন! আমাকে মেরে পিটে এ ধরনের অভ্যাস করানো হয়েছে।”

গর্ব ও ঔদ্ধত্যের নিন্দার বর্ণনা

হযরত বুরাইদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি গর্বভরে নিজের কাপড় মাটিতে ঝুলিয়ে চলবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা'আলা তার দিকে করুণার দৃষ্টিতে দেখবেন না।”

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি তার লুঙ্গী মাটিতে হেঁচড়িয়ে চলবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দিকে রহমতের দৃষ্টিতে দেখবেন না। কোন একটি লোক সুন্দর চাদর গায়ে দিয়ে অত্যন্ত গর্বভরে চলছিল। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা'আলা তাকে মাটির মধ্যে প্রোথিত করেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত সে প্রোথিত হতেই থাকবে।”





সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।