সূরা আল-আম্বিয়া (আয়াত: 63)
হরকত ছাড়া:
قال بل فعله كبيرهم هذا فاسألوهم إن كانوا ينطقون ﴿٦٣﴾
হরকত সহ:
قَالَ بَلْ فَعَلَهٗ ٭ۖ کَبِیْرُهُمْ هٰذَا فَسْـَٔلُوْهُمْ اِنْ کَانُوْا یَنْطِقُوْنَ ﴿۶۳﴾
উচ্চারণ: কা-লা বাল ফা‘আলাহূ কাবীরুহুম হা-যা-ফাছআলূহুম ইন কা-নূইয়ানতিকূন।
আল বায়ান: সে বলল, ‘বরং তাদের এ বড়টিই একাজ করেছে। তাই এদেরকেই জিজ্ঞাসা কর, যদি এরা কথা বলতে পারে’।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ৬৩. তিনি বললেন, বরং এদের এ প্রধান-ই তো এটা করেছে(১), সুতরাং এদেরকে জিজ্ঞেস কর যদি এরা কথা বলতে পারে।
তাইসীরুল ক্বুরআন: সে বলল, ‘না, তাদের এই বড়টাই এ সব করেছে, তারা যদি কথা বলতে পারে তবে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর।’
আহসানুল বায়ান: (৬৩) সে বলল, ‘বরং ওদের মধ্যে এই বড়টিই এরূপ করেছে। সুতরাং তোমরা ওদেরকেই জিজ্ঞেস কর; যদি ওরা কথা বলতে পারে।’ [1]
মুজিবুর রহমান: সে বললঃ সে’ই তো এটা করেছে, এইতো এদের প্রধান। এদেরকে জিজ্ঞেস কর যদি এরা কথা বলতে পারে।
ফযলুর রহমান: সে বলল, “এটা বরং ওদের এই বড়টাই করেছে। তোমরা ওদের কাছেই জিজ্ঞেস করো, যদি ওরা কথা বলতে পারে।”
মুহিউদ্দিন খান: তিনি বললেনঃ না এদের এই প্রধানই তো একাজ করেছে। অতএব তাদেরকে জিজ্ঞেস কর, যদি তারা কথা বলতে পারে।
জহুরুল হক: তিনি বললেন -- "আলবৎ কেউ এটা করেছে, এই তো এদের প্রধান, কাজেই এদের জিজ্ঞেস করো, যদি তারা বলতে পারে।"
Sahih International: He said, "Rather, this - the largest of them - did it, so ask them, if they should [be able to] speak."
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ৬৩. তিনি বললেন, বরং এদের এ প্রধান-ই তো এটা করেছে(১), সুতরাং এদেরকে জিজ্ঞেস কর যদি এরা কথা বলতে পারে।
তাফসীর:
(১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তিন জায়গা ব্যতীত কোন দিন মিথ্যা কথা বলেননি। তন্মধ্যে দুটি খাস আল্লাহর জন্যে বলা হয়েছে। একটি (بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ) (বরং তাদের প্রধানই তো এটা করেছে) বলা। দ্বিতীয়টি ঈদের দিনে সম্প্রদায়ের কাছে ওযর পেশ করে (إِنِّي سَقِيمٌ) (আমি অসুস্থ) বলা এবং তৃতীয়টি স্ত্রী সারাহ সহ সফরে এক জনপদের নিকট দিয়ে গমন করেছিলেন। জনপদের প্রধান ছিল যালেম ও ব্যভিচারী। কোন ব্যক্তির সাথে তার স্ত্রীকে দেখলে সে স্বামীকে হত্যা করত ও তার স্ত্রীকে পাকড়াও করত এবং তার সাথে ব্যভিচার করত। কিন্তু কোন কন্যা পিতার সাথে কিংবা ভগিনী ভাইয়ের সাথে থাকলে সেই এরূপ করত না।
ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্ত্রীসহ এই জনপদে পৌছার খবর কেউ এই যালেম ব্যভিচারীর কাছে পৌঁছে দিলে সে সারাহকে গ্রেফতার করিয়ে আনল। গ্রেফতারকারীরা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করলঃ এই মহিলা সাথে তোমার আত্মীয়তার সম্পর্ক কি? ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যালেমের কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য বলে দিলেন: সে আমার ভগিনী। (এটা হাদীসে বর্ণিত তৃতীয় মিথ্যা)। [বুখারীঃ ৩১৭৯, ৪৪৩৫। মুসলিমঃ ২৩৭১]
এই হাদীসে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দিকে পরিষ্কারভাবে তিনটি মিথ্যার সম্বন্ধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কোন কোন আলেমের ব্যাখ্যা হলো যে, তিনটির মধ্যে একটিও সত্যিকার অর্থে মিথ্যা ছিল না। বরং এটা ছিল অলংকার শাস্ত্রের পরিভাষায় “তাওরিয়া”। এর অর্থ দ্ব্যৰ্থবোধক ভাষা ব্যবহার করা এবং শ্ৰোতা কর্তৃক এক অর্থ বোঝা ও বক্তার নিয়তে অন্য অর্থ থাকা। যুলুম থেকে আত্মরক্ষার জন্যে ফিকাহবিদগণের সর্বসম্মত মতে এই কৌশল অবলম্বন করা জায়েয ও হালাল। এটা মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত নয়। উল্লেখিত হাদীসে এর প্রমাণ এই যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজেই সারাহকে বলেছিলেন আমি তোমাকে ভগিনী বলেছি। তোমাকে জিজ্ঞেস করা হলে তুমি ও আমাকে ভাই বলো। ভগিনী বলার কারণও তিনি বলে দিয়েছেন যে আমরা উভয় ইসলামী সম্পর্কের দিক দিয়ে ভ্রাতা-ভগিনী। বলাবাহুল্য এটাই “তাওরিয়া”।
হুবহু এমনি ধরনের কারণ প্রথমোক্ত দুই জায়গায় বলা যায় যে, অসুস্থ শব্দটি যেমন শারীরিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, তেমনি মানসিক অসুস্থতা অর্থাৎ চিন্তান্বিত ও অবসাদগ্ৰস্ত হওয়ার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দ্বিতীয় অর্থেই “আমি অসুস্থ” বলেছিলেন, কিন্তু শ্রোতারা একে শারীরিক অসুস্থতার অর্থে বোঝেছিলেন। মূর্তি ভাঙ্গার কাজটিতে তিনি যে ভাঙ্গার কাজটি বড় মূর্তির দিকে সম্পর্কযুক্ত করেছিলেন এ ব্যাপারে আলেমগণ নানা সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন:
১. ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এ উক্তি ধরে নেয়ার পর্যায়ে ছিল; অথাৎ তোমরা একথা ধরেই নাও না কেন যে, একাজ প্রধান মুর্তিই করে থাকবে। ধরে নেয়ার পর্যায়ে বাস্তববিরোধী কথা বলা মিথ্যার আওতায় পড়ে না। [ফাতহুল কাদীর]
২. কোন কোন মুফাসসিরের মতে, মূলতঃ প্রধান মূর্তিটি ইইবরাহীম আলাইহিস সালামকে একাজ করতে উদ্ধৃদ্ধ করেছিল। তার সম্প্রদায় এই মুর্তির প্রতি সর্বাধিক সম্মান প্রদর্শন করত। সম্ভবত এ কারণেই বিশেষভাবে এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর]
তবে এ ব্যাপারে আলেমগণ একমত যে, নবী-রাসূলগণ কখনো নবুওয়ত ও তাবলীগ বা প্রচার-প্রসার সংক্রান্ত ব্যাপারে মিথ্যার আশ্রয় নেননি। তারা জগতশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী লোক ছিলেন। [ইবন তাইমিয়্যাহ, আল-জাওয়াবুস সহীহ ১/৪৪৬]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: (৬৩) সে বলল, ‘বরং ওদের মধ্যে এই বড়টিই এরূপ করেছে। সুতরাং তোমরা ওদেরকেই জিজ্ঞেস কর; যদি ওরা কথা বলতে পারে।’ [1]
তাফসীর:
[1] সুতরাং ইবরাহীম (আঃ)-কে জনসমক্ষে আনা হল এবং জিজ্ঞাসা করা হল। ইবরাহীম (আঃ) উত্তর দিলেন যে, এ কাজ তো বড় মূর্তিটিই করেছে। যদি এই ভাঙ্গা মূর্তিগুলো কথা বলতে পারে, তাহলে এদেরকেই জিজ্ঞেস কর। তাদের জন্য এ বক্রোক্তি আভাসে তিরস্কারস্বরূপ ব্যবহার করেছিলেন, যাতে তারা জানতে পারে যে, যারা কথা বলার ক্ষমতা রাখে না, বা কোন জিনিস সম্পর্কে কোন খবর রাখে না, তারা মাবূদ হতে পারে না; তাদেরকে সঠিক অর্থে ‘উপাস্য’ বলাই সঠিক নয়।। একটি সহীহ হাদীসে ইবরাহীম (আঃ)-এর ‘বরং ওদের মধ্যে এই বড়টিই এরূপ করেছে’ উক্তিটিকে তাঁর মিথ্যা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি তিনটি মিথ্যা বলেছিলেন; দু’টি আল্লাহর জন্য এবং একটি নিজের জন্য। প্রথমঃ তাঁর কথা, আমি অসুস্থ। (অথচ তিনি অসুস্থ ছিলেন না।) দ্বিতীয়ঃ ‘বরং ওদের মধ্যে এই বড়টিই এরূপ করেছে।’ আর তৃতীয়ঃ আপন স্ত্রী সারাকে বোন বলা। (সহীহ বুখারী, আম্বিয়া অধ্যায়) সম্প্রতিকালের কিছু ব্যাখ্যাকারিগণ এই সহীহ হাদীসটিকে কুরআন-বিরোধী মনে করে অস্বীকার করেছেন এবং সহীহ মানার ব্যাপারে তাকীদ করলে তাঁরা সেটাকে অতিরঞ্জন ও বর্ণনার উপর অন্ধবিশ্বাস বলে মনে করেন। কিন্তু তাদের এ অভিমত সঠিক নয়।
নিঃসন্দেহে বাস্তবিকতার দিক দিয়ে এগুলিকে যেরূপ মিথ্যা বলা যায় না, ঠিক অনুরূপই বাহ্যিকভাবে এগুলিকে মিথ্যা থেকে খারিজ করাও যায় না। কারণ এগুলি আল্লাহর জন্যই বলা হয়েছিল। আর কোন পাপ কাজ আল্লাহর জন্য হতে পারে না। অবশ্য এটা তখনই সম্ভব যখন এগুলি বাহ্যিক দৃষ্টিতে মিথ্যা হলেও প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা নয় বলে মেনে নেওয়া যায়। যেমন আদম (আঃ)-এর ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, ‘আদম তার প্রতিপালকের অবাধ্য হল; ফলে সে পথভ্রষ্ট হয়ে গেল।’ অথচ তাঁর নিষিদ্ধ গাছ খাওয়ার কাজকে তাঁর ভুলে যাওয়া বা ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতার পরিণতিও বলা হয়েছে। যার পরিষ্কার অর্থ হল, প্রত্যেক কাজের দু’টি দিক থাকতে পারে; একদিক ভালো এবং অপরদিক মন্দ। ইবরাহীম (আঃ)-এর উক্ত কথাগুলি একদিক দিয়ে বাহ্যিকরূপে মিথ্যা ছিল। কারণ তা ছিল বাস্তব ও সত্যের বিপরীত। মূর্তিগুলি তিনি নিজেই ভেঙ্গেছিলেন, কিন্তু ভাঙ্গার সম্পর্ক বড় মূর্তিটির দিকে জুড়লেন। কিন্তু যেহেতু তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, (এই কাজের মাধ্যমে তাদেরকে জ্ঞান দেওয়া,) তাদেরকে তিরস্কার করা এবং তওহীদ সাব্যস্ত করা, সেহেতু বাস্তবতার দিক দিয়ে আমরা তা মিথ্যা না বলে, প্রমাণের পূর্ণতা দানের একটি কৌশল এবং মুশরিকদের মূর্খতা প্রতিপাদন ও প্রকাশ করার একটি যুক্তিময় পদ্ধতি বলব। এ ছাড়া হাদীসের মধ্যে এসব উক্তিকে মিথ্যা বলে আখ্যায়ন যে পরিস্থিতিতে করা হয়েছে তাও বিবেচ্য। আর তা হল হাশরের ময়দানে মহান আল্লাহর সামনে সুপারিশ করা হতে নিজেকে দূরে রাখা। যেহেতু পার্থিব জীবনে তিন জায়গায় তার ত্রুটি হয়ে গিয়েছিল। যদিও লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বাস্তবতার দিক দিয়ে তা মিথ্যা (ত্রুটি) নয়। কিন্তু তিনি আল্লাহর মাহাত্ম্য ও প্রতাপের জন্য এত ভীত হবেন যে, এ কথাগুলির মিথ্যার সাথে বাহ্যিক সাদৃশ্য থাকার কারণে পাকড়াও যোগ্য মনে করবেন। অতএব হাদীসের উদ্দেশ্য ইবরাহীম (আঃ)-কে মিথ্যা সাব্যস্ত করা কখনই নয়; বরং উদ্দেশ্য হল, ঐ অবস্থার বিবরণ, যা কিয়ামতের দিন আল্লাহর ভয়ে তাঁর ঘটবে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: ৫১-৭০ নং আয়াতের তাফসীর:
মূসা (عليه السلام) ও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সম্পর্কে আলোচনা করার পর অত্র আয়াতগুলোতে মুসলিম মিল্লাতের পিতা ইবরাহীম (عليه السلام) স¤পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে সৎ পথের জ্ঞান দান করেছিলেন। مِنْ قَبْلُ অর্থাৎ মূসা (عليه السلام) ও মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে প্রেরণ করা ও তাঁদেরকে কিতাব দেয়ার পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে হিদায়াতের জ্ঞান দান করেছিলেন, ফলে তিনি মানুষকে এদিকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। (وَكُنَّا بِه۪ عٰلِمِيْنَ) অর্থাৎ ইবরাহীম (عليه السلام)-কে সঠিক পথের জ্ঞান দান করা, তাঁকে নাবী হিসেবে চয়ন করা, তাঁকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা এবং দুনিয়া ও পরকালে শ্রেষ্ঠত্ব দান করার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান ছিল যে, ইবরাহীম (عليه السلام)-এর অধিকারী ও যোগ্য।
ইবরাহীম (عليه السلام) তাঁর পিতা ও সম্প্রদায়কে বললেন: এ মূর্তিগুলো কী? تماثيل শব্দটি تمثال এর বহুবচন। অর্থ কোন জিনিসের হুবহু প্রতিকৃতি। عاكف অর্থ অবস্থান করা, ধরে রাখা। অর্থাৎ এ মূর্তিগুলো কী, যাদের কাছে নিরবে অবস্থান কর? তারা বলল: আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এরূপ পূজা করতে দেখেছি। তখন ইবরাহীম (عليه السلام) বললেন: তোমরা ও তোমাদের বাপ দাদারা প্রকাশ্য গুমরাহীতে লিপ্ত রয়েছ। তখন তারা বলল: তুমি কি আমাদের নিকট সত্য জিনিস নিয়ে এসেছ, না তুমি কৌতুক করছ। তখন তিনি বললেন: না, তোমাদের প্রতিপালক তো তিনি যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আর আমি এ বিষয়ে অন্যতম সাক্ষী। প্রাথমিক দাওয়াতের কাজ এখানে সমাপ্ত, এরপরও যখন তারা আল্লাহ তা‘আলার পরিবর্তে মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল তখন ইবরাহীম (عليه السلام) তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন: আল্লাহ তা‘আলার শপথ! তোমরা অনুষ্ঠানে বা ঈদে চলে যাওয়ার পর আমি এ মূর্তিগুলোর ব্যাপারে কিছু একটা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যখন তারা চলে গেল তখন তিনি এ মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিলেন। শুধুমাত্র তাদের বড় মূর্তিটি ব্যতীত। অতঃপর যখন তারা ফিরে এসে এরূপ অবস্থা দেখতে পেল তখন তারা বলল: কে আমাদের উপাস্যগুলোর সাথে এরূপ আচরণ করেছে? নিশ্চয়ই সে একজন সীমালঙ্ঘনকারী। তখন তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ বলল: আমরা এক যুবককে এদের ব্যাপারে সমালোচনা করতে শুনেছি যার নাম ইবরাহীম। তখন তাঁকে নিয়ে আসার জন্য বলা হল। অতঃপর যখন তাঁকে নিয়ে আসা হল তখন তারা তাঁকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমাদের উপাস্যদের সাথে এরূপ ব্যবহার করেছ? তাদের প্রশ্নের জবাবে ইবরাহীম (عليه السلام) বললেন: তাদের মধ্যে যে বড় সেই তো এ কাজ করেছে, তাকেই জিজ্ঞেস কর যদি তারা কথা বলতে পারে। একথা শুনে তারা লজ্জায় মাথা অবনত করল এবং বলল: তুমি তো জানো যে, এরা কথা বলতে পারে না।
তখন ইবরাহীম (عليه السلام) তাদেরকে বললেন: তোমরা এমন জিনিসের পূজা করছ যারা তোমাদের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারে না? সুতরাং তোমাদের জন্য এবং তোমরা যাদের ইবাদত কর তাদের জন্য ভর্ৎসনা।
তখন তাঁর সম্প্রদায় আর কোন জবাব দিতে পারলনা। শুধুমাত্র বলল যে, তাঁকে আগুনে পুড়ে ফেল, তোমাদের মা‘বূদদেরকে রক্ষা কর। যেমন আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেনঃ
(فَمَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهِ إِلَّا أَنْ قَالُوا اقْتُلُوهُ أَوْ حَرِّقُوهُ)
“অতঃপর তার সম্প্রদায়ের এ কথা বলা ছাড়া কোন উত্তর ছিল না যে, ‘একে হত্যা কর অথবা অগ্নিদগ্ধ কর।” (আনকাবুত ২৯:২৪)
তখন তারা তাকে আগুনে নিক্ষেপ করল জ্বালিয়ে দেয়ার জন্য। ইবরাহীম (عليه السلام)-কে যখন আগুনে নিক্ষেপ করা হল তখন তিনি বলেছিলেন: حسبي الله ونعم الوكيل আমার জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্মকর্তা। তখন আল্লাহ তা‘আলা আগুনকে নির্দেশ দিয়ে বললেন: আগুন! তুমি ইবরাহীমের জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। অবশেষে তারা ক্ষতি করতে গিয়ে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল। আর ইবরাহীম (عليه السلام) অক্ষত অবস্থায় সে আগুন থেকে পরিত্রাণ পেলেন। ইবরাহীম (عليه السلام) সম্পর্কে আরো আলোচনা সূরা আন‘আমে ও সূরা মারইয়ামে উল্লেখ করা হয়েছে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. ইবরাহীম (عليه السلام)-এর মত হিকমত নিয়ে ইসলামের দিকে দাওয়াত দিতে হবে।
২. মূর্তি ভাঙ্গা নাবীদের বৈশিষ্ট্য, মুসলিমদের উচিত নাবীদের এ বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করা।
৩. ইবরাহীম (عليه السلام) জানতেন মূর্র্তি ভাঙ্গলে তাকে পাকড়াও করবে, তারপরেও তিনি ভেঙ্গেছেন।
৪. সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করতে হবে।
৫. যারা আল্লাহ তা‘আলার পথে অবিচল থাকে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সহযোগিতা করেন।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: ৫৭-৬৩ নং আয়াতের তাফসীর:
উপরে উল্লিখিত হয়েছে যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় কওমকে মূর্তিপূজা হতে বিরত থাকতে বলেন এবং তাওহীদের প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে শপথ করে বলেনঃ “তোমরা চলে গেলে আমি তোমাদের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা অবলম্বন করবো।” তার একথা তার কওমের কতকগুলি লোক শুনে নেয়। তাদের যে ঈদের দিনটি নির্ধারিত ছিল, ঐ দিনটিকে লক্ষ্য করে হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাদেরকে বলেনঃ “যখন তোমরা তোমাদের ঈদের নীতিমালা আদায় করার উদ্দেশ্যে বের হবে তখন আমি তোমাদের মূর্তিগুলি সম্বন্ধে অবশ্যই একটা ব্যবস্থা অবলম্বন করবো।” ঈদের দু'একদিন পূর্বে তার পিতা তাঁকে বলেঃ “হে আমার প্রিয় বৎস! তুমি আমাদের সাথে আমাদের ঈদ পর্বে যোগদান কর, যাতে তুমি আমাদের ধর্মের গুণাবলী সম্পর্কে অবগতি লাভ করতে পারো।` সুতরাং তার পিতা তাঁকে নিয়ে ঈদ পর্ব উদযাপনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো। কিছুদূর যাওয়ার পর তিনি তাঁর পিতাকে বললেনঃ “আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি, সুতরাং আমি আপনাদের সাথে যেতে পারবো না।” তার পিতা তখন তাকে ছেড়েই চলে গেল। তাঁর পার্শ্ব দিয়ে গমনকারী লোকেরা তাকে জিজ্ঞেস করতে থাকেঃ “কি ব্যাপার? তুমি রাস্তায় বসে আছ। কেন?” তিনি তাদেরকে উত্তর দেনঃ “আমি রুগ্ন হয়ে পড়েছি।` অতঃপর যখন সাধারণ লোকেরা সব চলে গেল এবং বুড়োরা রয়ে গেল। তখন তিনি তাদেরকে বললেনঃ “তোমরা সবাই চলে যাবার পর আমি তোমাদের মূর্তিগুলির অবশ্যই সংস্কার সাধন করবো।` তিনি যে তাদেরকে বললেনঃ ‘আমি রুগ্ন হয়ে পড়েছি' আগের দিন সত্যিই তিনি কিছুটা অসুস্থ ছিলেন। যখন তারা সবাই চলে গেল, তখন ময়দান খালি পেয়ে তিনি স্বীয় উদ্দেশ্য পুরো করার কাজে লেগে পড়েন এবং বড় মূর্তিটিকে রেখে সমস্ত মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন। যেমন অন্যান্য আয়াতে এর বিস্তারিত বিবরণ বিদ্যমান রয়েছে যে, নিজের হাতে তিনি ঐ মূর্তিগুলিকে চুর্ণ-বিচুর্ণ করে ফেলেন। ঐ বড় মূর্তিটিকে বাকী রাখার মধ্যে যৌক্তিকতা ও নিপুণতা ছিল এই যে, যেন ঐ লোকগুলির মস্তিষ্কে এই খেয়াল জাগে যে, সতঃ তাদের ঐ বড় দেবতাটি ঐ ছোট দেবতাগুলিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কেননা, হয়তো এই বড় দেবতার মনে মর্যাদাবোধ হয়েছে যে, তার মত বড় দেবতা থাকতে এই ছোট দেবতাগুলি কিরূপে পূজনীয় হতে পারে? এই খেয়াল তাদের মস্তিষ্কে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যেই তিনি ঐ বড় দেবতার কাধে কুঠারঠিও লটকিয়ে দিয়ে ছিলেন, যেমন এটা বর্ণিত আছে।
যখন ঐ মুশরিকরা মেলা থেকে ফিরে আসে তখন তারা দেখতে পায় যে, তাদের সমস্ত দেবতা মুখের ভরে পড়ে রয়েছে এবং নিজেদের অবস্থার মাধ্যমে বলতে রয়েছে যে, তারা শুধু প্রাণহীন তুচ্ছ ও ঘৃণ্য বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়। লাভ বা ক্ষতি করার ক্ষমতা তাদের মোটেই নেই। তারা যেন তাদের ঐ অবস্থা দ্বারা তাদের পূজারী ও উপাসকদের নির্বুদ্ধিতা ও বোকামী প্রকাশ করতে রয়েছে। কিন্তু এতে ঐ নির্বোধদের উপর উল্টো প্রতিক্রিয়া হলো। তারা বলতে শুরু করলোঃ কোন্ যালিম ব্যক্তি আমাদের উপাস্যদের এই অবস্থা ঘটিয়েছে?''
ঐ সময় যে লোকগুলি হযরত ইবরাহীমের (আঃ) ঐ কথা শুনেছিল তাদের তা স্মরণ হয়ে গেল। তারা বললোঃ ইবরাহীম (আঃ) নামক যুবকটিকে আমরা আমাদের দেবতাদের সমালোচনা করতে শুনেছি।` হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) এই আয়াতটি পাঠ করতেন ও বলতেনঃ “আল্লাহ যে নবীকেই পাঠিয়েছেন। যুবকরূপেই পাঠিয়েছেন এবং যে আলেমকেই ইলম দান করা হয়েছে তিনি যুবকই রয়েছেন। (অর্থাৎ যুবক অবস্থাতেই ইল্ম লাভ করেছেন।
তারা বললোঃ “তাকে লোক সম্মুখে হাজির কর যাতে তারা সাক্ষ্য দিতে পারে।” হযরত ইবরাহীমের (আঃ) কওমের লোকেরা পরামর্শক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, লোকজনকে জমা করা হোক এবং ইবরাহীমকে (আঃ) তাদের সামনে হাজির করে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। হযরত ইবরাহীমও (আঃ) এটাই চাচ্ছিলেন যে, এরূপ একটা সমাবেশের ব্যবস্থা করাহলেই তিনি তাদের সামনে হাজির হয়ে তাদের ভুলটা তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিবেন। এভাবে তিনি তাদের মধ্যে একত্ববাদ প্রচার করবেন এবং তাদেরকে বলবেনঃ “তোমরা কত বড় যালিম ও অজ্ঞ যে, যারা কারো কোন লাভ বা ক্ষতি করতে পারে না, এমন কি নিজেদের জীবনেরও যারা কোন অধিকার রাখে না, তাদের ইবাদত কর তোমরা কোন যুক্তিতে?”
সুতরাং জনসমাবেশ হলো। ছোট বড় সবাই এসে গেল। হযরত ইবরাহীমও (আঃ) অভিযুক্ত হিসেবে হাজির হলেন। তারা তাকে জিজ্ঞেস করলোঃ “হে ইবরাহীম (আঃ)! তুমিই কি আমাদের উপাস্যগুলির প্রতি এইরূপ করেছো?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “এই বড় মূর্তিটিই এ কাজ করেছে।` একথা বলার সময় তিনি ঐ মূর্তিটির প্রতি ইশারা করেন যেটাকে তিনি ভেঙ্গে ফেলেন নাই। তারপর তাদেরকে বলেনঃ “তোমরা বরং এই দেবতাগুলিকেই প্রশ্ন কর যদি এরা কথা বলতে পারে। এর দ্বারা হযরত ইবরাহীমের (আঃ) উদ্দেশ্য ছিল, ঐলোকগুলি যেন নিজেরাই বুঝতে পারে যে, ঐ পাথরগুলি কি কথা বলবে? আর তারা যখন এতই অপারগ তখন তারা মা'বুদ হতে পারে কি করে? সুতরাং আল্লাহপাকের ফযল ও করমে হযরত ইবরাহীমের (আঃ) এই উদ্দেশ্যও পূর্ণ হয়। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “হযরত ইবরাহীম (আঃ) মাত্র তিনটি মিথ্যা কথা বলেছিলেন। একটি তো হলো তাঁর একথা বলা যে, এই মূর্তিগুলিকে বড় মুর্তিটিই ভেঙ্গেছে। দ্বিতীয় হলো তার একথা বলাঃ “আমি রুগ্ন বা অসুস্থ। তৃতীয় হলো এই যে, একবার তিনি তাঁর স্ত্রী হযরত ‘সারা’সহ সফরে ছিলেন। ঘটনাক্রমে তিনি এক অত্যাচারী রাজার রাজ্যের সীমানা অতিক্রম করছিলেন। সেখানে তিনি মঞ্জিল করে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ঐ সময় কে একজন বাদশাহকে খবর দেয়ঃ :“একজন মুসাফিরের সাথে একটি সুন্দরী মহিলা রয়েছে এবং তারা এখন আমাদের রাজ্যের সীমানার মধ্যেই রয়েছে। তৎক্ষণাৎ বাদশাহ হযরত সারাকে ধরে আনার জন্যে একজন সিপাহীকে পাঠিয়ে দেন। সে হযরত ইবরাহীমকে (আঃ) জিজ্ঞেস করেঃ “এটা আপনার। কে?` হযরত ইবরাহীম (আঃ) উত্তরে বলেনঃ “এটা আমার বোন। সে বলেঃ “একে বাদশাহর দরবারে পাঠিয়ে দিন।” তিনি হযরত সারার কাছে গিয়ে বলেনঃ “এই যালিম বাদশাহ তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে এবং আমি তোমাকে আমার বোন বলেছি। তোমাকে জিজ্ঞেস করা হলে তুমিও একথাই বলবে। আর দ্বীনের দিক দিয়ে তুমি আমার বোনও বটে। জেনে রেখো যে, ভূ-পৃষ্ঠে আমি ও তুমি ছাড়া কোন মুসলমান নেই।` একথা বলে তিনি চলে আসেন। হযরত সারা বাদশাহর দরবারে চলে যান। আর হযরত ইবরাহীম (আঃ) নামাযে দাড়িয়ে যান। ঐ যালিম বাদশাহ হযরত সারাকে দেখা মাত্রই তার দিকে ধাবিত হয়। সাথে সাথে আল্লাহর আযাব তাকে পাকড়াও করে। তার হাত পা অবশ হয়ে যায়। সুতরাং সে হতবুদ্ধি হয়ে তাকে বলেঃ “তুমি আমার জন্যে আল্লাহর নিকট দুআ কর আমি ওয়াদা করছি যে, তোমার কোন ক্ষতি করবো না। তিনি দুআ করলেন এবং সে ভাল হয়ে গেল। কিন্তু ভাল হওয়া মাত্রই সে আবার কুপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার ইচ্ছা করলো। সুতরাং পুনরায় সে আল্লাহর শাস্তির কবলে পতিত হলো। আর এই শাস্তি পূর্বাপেক্ষা কঠিনতর। ফলে আবার সে তার কাছে অনুনয় বিনয় করলো। তৃতীয়বার মুক্তি পাওয়া মাত্রই সে তার নিকট অবস্থানরত পরিচারককে বললো? তুমি আমার কাছে কোন মানুষ মহিলাকে আনয়ন কর নাই, বরং শয়তান মহিলাকে এনেছো। একে তুমি বের করে দাও এবং হাজেরাকে তার সাথে পাঠিয়ে দাও।` তৎক্ষণাৎ তাঁকে সেখান হতে বের করে দেয়া হয় এবং হাজেরাকে (দাসী হিসেবে) তাঁর কাছে সমর্পণ করা হয়। হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁদের পদধ্বনি শুনেই নামায শেষ করেন এবং তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “বল, খবর কি?` তিনি উত্তরে বলেনঃ “মহান আল্লাহ ঐ কাফিরের চক্রান্ত বানচাল করে দিয়েছেন এবং হাজেরাকে আমার খিদমতের জন্যে আমাকে প্রদান করা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) এই হাদীসটি বর্ণনা করে বলেনঃ “হে আকাশের পানির সন্তানরা! ইনি হলেন তোমাদের মাত্য।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।