সূরা আন-নাহাল (আয়াত: 3)
হরকত ছাড়া:
خلق السماوات والأرض بالحق تعالى عما يشركون ﴿٣﴾
হরকত সহ:
خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ بِالْحَقِّ ؕ تَعٰلٰی عَمَّا یُشْرِکُوْنَ ﴿۳﴾
উচ্চারণ: খালাকাছছামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদা বিলহাক্কি তা‘আ-লা-‘আম্মা-ইউশরিকূন।
আল বায়ান: তিনি আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন যথাযথই, তারা যা শরীক করে, তা থেকে তিনি ঊর্ধ্বে।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ৩. তিনি যথাযথভাবে(১) আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন; তারা যা শরীক করে তিনি তার ঊর্ধ্বে।(২)
তাইসীরুল ক্বুরআন: তিনি (বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে) প্রকৃতভাবেই আসমানসমূহ যমীন সৃষ্টি করেছেন, তারা যাকে আল্লাহর অংশীদার গণ্য করে তাত্থেকে তিনি বহু ঊর্ধ্বে।
আহসানুল বায়ান: (৩) তিনি যথাযথভাবে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন;[1] তারা যাকে অংশী করে, তিনি তার ঊর্ধ্বে।
মুজিবুর রহমান: তিনি যথাযথভাবে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; তারা যাকে শরীক করে তিনি তার উর্ধ্বে।
ফযলুর রহমান: তিনি যথাযথভাবে আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন। তারা (তাঁর সাথে) যা কিছু শরীক করে তিনি তার ঊর্ধ্বে।
মুহিউদ্দিন খান: যিনি যথাবিধি আকাশরাজি ও ভূ-মন্ডল সৃষ্টি করেছেন। তারা যাকে শরীক করে তিনি তার বহু উর্ধ্বে।
জহুরুল হক: তিনি মহাকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন সত্যের সাথে। তারা যা অংশী দাঁড় করায় তিনি তার থেকে বহু ঊর্ধ্বে।
Sahih International: He created the heavens and earth in truth. High is He above what they associate with Him.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ৩. তিনি যথাযথভাবে(১) আসমানসমূহ ও যমীন সৃষ্টি করেছেন; তারা যা শরীক করে তিনি তার ঊর্ধ্বে।(২)
তাফসীর:
(১) এখান থেকে আবার তাওহীদের দলীল-প্রমাণাদি পেশ করা হচ্ছে। [ফাতহুল কাদীর] প্রথমে আসমান ও যমীনকে আল্লাহ তা'আলা যে যথার্থরূপে সৃষ্টি করেছেন সেটা বর্ণনা করছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তা'আলা আসমান ও যমীন কোন খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেননি। বরং এগুলোর সৃষ্টির পিছনে অনেক হিকমত রয়েছে। এগুলোর সৃষ্টি হক কারণেই হয়েছে আর তা হচ্ছে এগুলো আল্লাহর একত্ববাদ ও কুদরাতের উপর প্রমাণ জীবিত করতে সক্ষম। অথবা এগুলো নিজেরাই প্রমাণ করবে যে, এগুলো ধ্বংসশীল। [ফাতহুল কাদীর] তাছাড়া এগুলো সৃষ্টির পিছনে আল্লাহর এক মহান উদ্দেশ্য হলোঃ যারা খারাপ কাজ করেছে তাদেরকে শাস্তি আর যারা ভাল কাজ করেছে তাদেরকে উত্তম প্রতিদান প্রদান করবেন। [দেখুনঃ সূরা আন-নাজমঃ ৩১] [ইবন কাসীর]
(২) আল্লাহর সাথে যাদেরকে শরীক করা হয়, তারা কোনভাবেই আল্লাহর সমকক্ষ হতে পারে না। তিনি তাদের শরীক করা থেকে অনেক উর্ধ্বে, অনুরূপভাবে কোন শরীকের শরীক হওয়া থেকেও তিনি অনেক উর্ধ্বে। [ফাতহুল কাদীর] তিনি সর্বদিক থেকে উর্ধ্বে। সম্মানের দিক থেকে উর্ধ্বে তিনি, অবস্থানের দিক থেকেও তিনি আরশের উপর। সবকিছুর উপরে তাঁর অবস্থান, আর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির দিক থেকেও তার সমকক্ষ কেউ নেই।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: (৩) তিনি যথাযথভাবে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন;[1] তারা যাকে অংশী করে, তিনি তার ঊর্ধ্বে।
তাফসীর:
[1] অর্থাৎ, শুধু অযথা খেল-তামাশার জন্য সৃষ্টি করিনি, বরং এক লক্ষ্যকে সামনে রেখে করা হয়েছে, আর তা হল পুণ্যের প্রতিদান ও পাপের শাস্তিদান; যেমন পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা হল।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: ৩-৪ নং আয়াতের তাফসীর:
অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বর্ণনা করছেন যে, তিনি আকাশ-জমিন অযথা সৃষ্টি করেননি বরং একটি বিরাট উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্যই আল্লাহ তা‘আলা এ আকাশ-জমিন সৃষ্টি করেছেন। আর তা হল সৎ কর্মশীলদের উত্তম প্রতিদান দেয়া এবং অবাধ্যদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া। এ সম্পর্কের আলোচনা সূরা হিজর-এর ৮৫ নং আয়াতে করা হয়েছে।
সুতরাং যে আল্লাহ এ বিশাল মাখলূকাতের সৃষ্টিকর্তা সে আল্লাহর সাথে এমন কারো ইবাদত করা হবে যারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না এরূপ থেকে তিনি পবিত্র ও অনেক ঊর্ধ্বে। এ জন্য আল্লাহ আকাশ-জমিন সৃষ্টির সাথে মুশরিকদের শিরক থেকে তিনি পবিত্র এ কথা সংযুক্ত করেছেন।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(أَمْ جَعَلُوْا لِلّٰهِ شُرَكَا۬ءَ خَلَقُوْا كَخَلْقِه۪ فَتَشَابَهَ الْخَلْقُ عَلَيْهِمْ ط قُلِ اللّٰهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَّهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ)
“তবে কী তারা আল্লাহর এমন শরীক স্থাপন করেছে যারা সৃষ্টি করেছে আল্লাহর সৃষ্টির ন্যায়, যে কারণে সৃষ্টি তাদের নিকট সাদৃশ্য মনে হয়েছে? বল: ‘আল্লাহ সকল বস্তুর স্রষ্টা; তিনি এক, পরাক্রমশালী।’’ (সূরা রা‘দ ১৩:১৬)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(أَيُشْرِكُوْنَ مَا لَا يَخْلُقُ شَيْئًا وَّهُمْ يُخْلَقُوْنَ)
“তারা কি এমন বস্তুকে শরীক করে যারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না? বরং তারা নিজেরাই সৃষ্ট।” (সূরা আ‘রাফ ৭:১৫১)
এ আয়াতগুলো দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনিই সকল ইবাদত পাওয়ার হকদার, তিনিই সত্যিকার মা‘বূদ।
نُّطْفَةٍ অর্থ মিশ্রিত তরল পদার্থ। অর্থাৎ নারী ও পুরুষের মিশ্রিত তরল পদার্থ যাকে বীর্য বলা হয়। নারী ও পুরুষের ডিম্বানু ও শুক্রাণু মিশ্রিত হওয়ার পরেও ভ্রুণ নুতফা আকারে অবস্থান করে। মিশ্রিত তরল পদার্থ শুক্রাণুজাতীয় তরল পদার্থকেও বুঝানো হতে পারে যা বিভিন্ন লালাগ্রন্থির নিঃসরিত রস থেকে তৈরি হয়। এ তরল পদার্থকে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করার পর এক পূর্ণ আকার দান করা হয়। তারপর তাতে রূহ বা জীবন দান করা হয়। এরপর তা মায়ের পেট হতে পৃথিবীতে বাচ্চা আকারে বের হয়ে আসে। পৃথিবীতে সে জীবন যাপন করতে করতে যখন জ্ঞানপ্রাপ্ত হয় তখন সে প্রতিপালক আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করে, তাঁকে অস্বীকার করে। কিংবা আল্লাহর সাথে শিরক করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَھُوَ الَّذِیْ خَلَقَ مِنَ الْمَا۬ئِ بَشَرًا فَجَعَلَھ۫ نَسَبًا وَّصِھْرًاﺚ وَکَانَ رَبُّکَ قَدِیْرًاﮅوَیَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللہِ مَا لَا یَنْفَعُھُمْ وَلَا یَضُرُّھُمْﺚ وَکَانَ الْکَافِرُ عَلٰی رَبِّھ۪ ظَھِیْرًاﮆ)
“এবং তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি হতে; অতঃপর তিনি তার বংশগত ও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন। তোমার প্রতিপালক সর্বশক্তিমান। তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ‘ইবাদত করে যা তাদেরকে উপকার করতে পারে না এবং তাদের অপকারও করতে পারে না, কাফির তো স্বীয় প্রতিপালকের বিরোধী।” (সূরা ফুরকান ২৫:৫৪-৫৫) خَصِيْمٌ অর্থ প্রকট ঝগড়াটে।
অতএব মানুষকে সৃষ্টির উদ্দেশ্য হল মানুষ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে, অন্য কারো নয়। তাই মানুষের উচিত তাদের সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা, এবং শয়তানের পথ অবলম্বন করা থেকে বিরত থাকা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আকাশ ও জমিন অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি।
২. মানুষকে মিশ্রিত তরল পদার্থ থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।
৩. যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনি সকল ইবাদত পাওয়ার হকদার।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: ৩-৪ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ তাআলা খবর দিচ্ছেন যে, উর্ধ্ব জগত ও নিম্ন জগতের সৃষ্টিকর্তা তিনিই। উর্ধ্ব আকাশ এবং বিস্তৃত ধরণী এবং এতোদুভয়ের মধ্যস্থিত সমস্ত মাখলুক তিনিই সৃষ্টি করেছেন। এগুলি সবই সঠিক ও সত্য। এগুলো তিনি বৃথা সৃষ্টি করেন নাই। তিনি পুণ্যবানদেরকে পুরস্কার এবং পাপীদেরকে শাস্তি প্রদান করবেন। তিনি অন্যান্য সমস্ত মাবুদ থেকে মুক্ত ও পবিত্র এবং তিনি মুশরিকদের প্রতি অসন্তুষ্ট। তিনি এক ও শরীক বিহীন। তিনি একাকী সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা। সুতরাং তিনি একাকীও ইবাদতের যোগ্য। তিনি মানব সৃষ্টির ক্রম শুক্রের মাধ্যমে চালু রেখেছেন যা অতি তুচ্ছ ও ঘৃণ্য পানি মাত্র। যখন তিনি সবকিছু সঠিকভাবে সৃষ্টি করলেন, তখন মানুষ প্রকাশ্যভাবে বিতর্কে লেগে পড়লো এবং রাসূলদের বিরুদ্ধাচরণ করতে শুরু করলো। সে যখন বান্দা তখন তার বন্দেগী করাই উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে সে হঠকারিতা শুরু করে দিলো। যেমন অন্য জায়গায় মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি হতে; অতঃপর তিনি তার বংশগত ও বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করেছেন; তোমার প্রতিপালক সর্বশক্তিমান। তারা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর ইবাদত করে যা তাদের উপকার করতে পারে না, অপকারও করতে পারে না; কাফির তো স্বীয় প্রতিপালকের বিরোধী।” (২৫:৫৪-৫৫) আল্লাহ তাআলা আর এক জায়গায় বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “মানুষ কি দেখে না যে, আমি তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু হতে? অথচ পরে সে হয়ে পড়ে প্রকাশ্য বিতণ্ডাকারী। আর সে আমার সামনে। উপমা রচনা করে, অথচ সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়; বলেঃ “অস্থিতে প্রাণ সঞ্চার করবে কে যখন ওটা পচে গলে যাবে? বলঃ ওর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করবেন তিনিই, যিনি ওটা প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি প্রত্যেকটি সৃষ্টি সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত।” (৩৬:৭৭-৭৯)
হযরত বিশ্ব ইবনু জাহহাশ (রাঃ) হতে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় হাতের তালুতে থুথু ফেলেন এবং বলেনঃ আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “হে মানুষ! তুমি কি আমাকে অপারগ করতে পার? অথচ আমি তোমাকে এইরূপ জিনিস হতে সৃষ্টি করেছি। যখন সৃষ্টি পূর্ণ হয়ে গেল, ঠিকঠাক হলো, তোমরা পোষাক এবং ঘর বাড়ি পেয়ে গেলে তখন আমার পথ থেকে নিজে সরে যেতে এবং অপরকে সরিয়ে ফেলতে শুরু করে দিলে! আর যখন দম কণ্ঠে আটকে গেল তখন বলতে লাগলেঃ! এখন আমি দান খায়রাত করছি, আল্লাহর পথে খরচ করছি। কিন্তু এখন দান খয়রাত করার সময় পার হয়ে গেছে।”
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।