আল কুরআন


সূরা ইউসুফ (আয়াত: 20)

সূরা ইউসুফ (আয়াত: 20)



হরকত ছাড়া:

وشروه بثمن بخس دراهم معدودة وكانوا فيه من الزاهدين ﴿٢٠﴾




হরকত সহ:

وَ شَرَوْهُ بِثَمَنٍۭ بَخْسٍ دَرَاهِمَ مَعْدُوْدَۃٍ ۚ وَ کَانُوْا فِیْهِ مِنَ الزَّاهِدِیْنَ ﴿۲۰﴾




উচ্চারণ: ওয়া শারাওহু বিছামানিম বাখছিন দারা-হিমা মা‘দূদাতিওঁ ওয়া কা-নূফীহি মিনাযযাহিদীন।




আল বায়ান: আর তারা তাকে অতি নগণ্য মূল্যে কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল এবং তারা তার ব্যাপারে ছিল অনাগ্রহী।




আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ২০. আর তারা তাকে বিক্রি করল স্বল্প মূল্যে, মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে(১) এবং তারা ছিল তার ব্যাপারে অনাগ্রহী(২)।




তাইসীরুল ক্বুরআন: তারা তাকে স্বল্প মূল্যে- মাত্র কয়টি দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল, তারা ছিল তাকে তুচ্ছ জ্ঞানকারী!




আহসানুল বায়ান: (২০) আর তারা তাকে স্বল্প মূল্যে মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল।[1] তারা ছিল এতে নির্লোভ। [2]



মুজিবুর রহমান: আর তারা তাকে বিক্রি করল স্বল্প মূল্যে, মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে, তারা এতে ছিল নির্লোভ।



ফযলুর রহমান: তারা সস্তা মূল্যে মাত্র কয়েক দিরহামে তাকে বিক্রি করে দিয়েছিল। তারা তাকে গুরুত্বহীন মনে করেছিল।



মুহিউদ্দিন খান: ওরা তাকে কম মূল্যে বিক্রি করে দিল গনাগুণতি কয়েক দেরহাম এবং তাঁর ব্যাপারে নিরাসক্ত ছিল।



জহুরুল হক: আর তারা তাঁকে বিক্রি করল সামান্য মূল্যে -- গুণতির কয়েকটি দিরহামে, আর তাঁর প্রতি তারা ছিল অনাসক্ত।



Sahih International: And they sold him for a reduced price - a few dirhams - and they were, concerning him, of those content with little.



তাফসীরে যাকারিয়া

অনুবাদ: ২০. আর তারা তাকে বিক্রি করল স্বল্প মূল্যে, মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে(১) এবং তারা ছিল তার ব্যাপারে অনাগ্রহী(২)।


তাফসীর:

(১) আরবী ভাষায় شَراء শব্দ ক্রয় করা ও বিক্রয় করা উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ স্থলেও উভয় অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে। যদি সর্বনামকে ইউসুফ ভ্রাতাদের দিকে ফেরানো হয়, তবে বিক্রয় করার অর্থ হবে এবং কাফেলার লোকদের দিকে ফেরানো হলে ক্রয় করার অর্থ হবে। [ইবন কাসীর] উদ্দেশ্য এই যে, ইউসুফ ভ্রাতারা বিক্রয় করে দিল কিংবা কাফেলার লোকেরা ইউসুফকে খুব সস্তা মূল্যে অর্থাৎ নামে মাত্র কয়েকটি দিরহামের বিনিময়ে ক্রয় করল। আয়াতে বর্ণিত بَخْسٍ এর দুটি অর্থ হতে পারেঃ (এক) খুব কম মূল্যে; [তাবারী] কারণ তারা বাস্তবিকই তাকে খুব কম মূল্যে বিক্রয় করেছিল। (দুই) অন্যায় বা নিকৃষ্ট বিক্রয় সম্পন্ন করল; কারণ তারা স্বাধীন মানুষকে বিক্রয় করেছিল। স্বাধীন মানুষকে বিক্রয় করা হারাম। [কুরতুবী] ইমাম কুরতুবী আরও বলেনঃ আরব বণিকদের অভ্যাস ছিল, তারা মোটা অঙ্কের লেন-দেন পরিমাপের মাধ্যমে করত এবং চল্লিশের উর্ধ্বে নয়, এমন লেন-দেন গণনার মাধ্যমে করত। তাই دَرَاهِمَ শব্দের সাথে مَعْدُودَةٍ (গুণাগুনতি) শব্দের প্রয়োগ থেকে বোঝা যায় যে, দিরহামের পরিমাণ চল্লিশের কম ছিল। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের বর্ণনায় এসেছে, বিশ দিরহামের বিনিময়ে ক্রয়-বিক্রয় হয়েছিল এবং দশ ভাই দুই দিরহাম করে নিজেদের মধ্যে তা বন্টন করে নিয়েছিল। [কুরতুবী]


(২) এর দুটি অর্থ হতে পারে-

(এক) ইউসুফের ভাইয়েরা ইউসুফ-এর ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত ছিল, তাই তারা এত কম দামে বিক্রয় করে দিয়েছিল। [ইবন কাসীর] ইউসুফকে কম মূল্যে বিক্রয় করার কারণ আবার দুটি হতে পারে। প্রথমতঃ এ কারণে যে, তারা এ মহাপুরুষের সঠিক মূল্য সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। দ্বিতীয়তঃ তাদের আসল লক্ষ্য তার দ্বারা টাকা-পয়সা উপার্জন করা ছিল না; বরং পিতার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়াই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। তাই শুধু বিক্রয় করে দিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি; বরং তারা আশংকা করছিল যে, কাফেলার লোকেরা তাকে এখানেই ছেড়ে যাবে এবং অতঃপর সে কোন রকমে পিতার কাছে পৌছে আগাগোড়া চক্রান্ত ফাঁস করে দেবে। তাই তাফসীরবিদ মুজাহিদের বর্ণনা অনুযায়ী, তারা কাফেলা রওয়ানা হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই অপেক্ষা করল। যখন কাফেলা রওয়ানা হয়ে গেল, তখন তারা কিছুদূর পর্যন্ত কাফেলার পিছনে পিছনে গেল এবং তাদেরকে বললঃ দেখ, এর পলায়নের অভ্যাস রয়েছে। একে মুক্ত ছেড়ে দিও না; বরং বেঁধে রাখ। [কুরতুবী; সাদী]

(দুই) এ আয়াতের আরেকটি অর্থ হতে পারে যে, কাফেলার লোকেরা ইউসুফের ব্যাপারে খুব গুরুত্ব দিচ্ছিল না, কেননা, কুড়িয়ে পাওয়া বস্তুর মূল্য আর কতই হতে পারে? [ফাতহুল কাদীর] কাফেলা বিভিন্ন মনযিল অতিক্রম করে মিশর পর্যন্ত পৌছে ইউসুফ আলাইহিস সালাম-কে বিক্রি করে দিল।


তাফসীরে আহসানুল বায়ান

অনুবাদ: (২০) আর তারা তাকে স্বল্প মূল্যে মাত্র কয়েক দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করে দিল।[1] তারা ছিল এতে নির্লোভ। [2]


তাফসীর:

[1] ভাইরা অথবা অন্য ব্যাখ্যা অনুযায়ী কাফেলার লোকেরা বিক্রি করেছিল।

[2] কারণ কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু, যা মানুষ বিনা পরিশ্রমে অর্জন করে, তা যতই দামী হোক না কেন, তার সঠিক মূল্য মানুষের নিকট পরিষ্ফুটিত হয় না।


তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ


তাফসীর: ১৯-২২ নং আয়াতের তাফসীর:



সিরিয়া থেকে মিসরে যাওয়ার পথে একটি ব্যবসায়ী কাফেলা পথ ভুল করে জঙ্গলের মধ্যে উক্ত পরিত্যক্ত কূপের নিকটে এসে তাঁবু ফেলে। (কুরতুবী, আল বিদায়াহ ১/১৮৯) তারা পানির সন্ধানে কূপে বালতি নিক্ষেপ করল। وَارِدٌ বলা হয় কাফেলার সে ব্যক্তিদেরকে যারা যাত্রীদের পানি ইত্যাদি ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে কাফেলার আগে আগে চলে। বালতির রশি ধরে ইউসুফ (عليه السلام) উপরে উঠে এলেন। কাফেলার সবাই এরূপ এক সুদর্শন বালক দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠল যে, কী সুখবর! এ যে এক গোলাম বা সুদর্শন বালক। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিরাজের রাতে ইউসুফ (عليه السلام) কে দেখে বলেছিলেন:



قَدْ اُعْطِيَ شَطْرَ الْحُسْنِ



তাঁকে অর্ধেক সৌন্দর্য দেয়া হয়েছে। (সহীহ মুসলিম হা: ২৪৯)



বিষয়টি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে হলেও সবকিছুই ছিল আল্লাহর পূর্ব পরিকল্পিত। ইউসুফ (عليه السلام) কে উদ্ধার করার জন্যই আল্লাহ উক্ত কাফেলাকে তারেদ ভুলক্রমে এখানে এনেছেন। আবূ বকর ইবনু আইয়াশ বলেন: ইউসুফ (عليه السلام) তিনদিন কূপের মধ্যে ছিলেন। (তাফসীর ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)



بِضَاعَةً অর্থ বাণিজ্যিক পণ্য, وَأَسَرُّوْهُ অর্থ তারা তাকে লুকিয়ে ফেলল, অর্থাৎ বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ইউসুফ (عليه السلام) কে তারা লুকিয়ে ফেলল। কিন্তু কারা লুকিয়ে ফেলল? এ নিয়ে দুটি মত পাওয়া যায় (১) মুজাহিদ, সুদ্দী ও ইবনু জারীর বলেন, পানি সংগ্রহকারীরা লুকিয়ে রেখেছিল যাতে কাফেলার সবাই জানতে না পারে, কারণ জানতে পারলে সবাই শরীক দাবী করবে। কাফেলার লোক জিজ্ঞেস করলে বলব: কূপের মালিক আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে যাতে মিসরে নিয়ে বিক্রি করে দিই। (২) ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, ইউসুফ (عليه السلام) এর ভাইয়েরা ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক লুকিয়ে রেখেছিল আর ইউসুফ (عليه السلام) নিজেও তার বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন এ ভয়ে যে, হয়তো তাকে হত্যা করে ফেলবে। ইমাম শাওকানী বলেন: উত্তম কথা হল কাফেলার লোকেরা গোপন রেখেছিল যাতে স্বজনরা এসে খোঁজাখুঁজি না করে। কারণ যেহেতু কূপে পড়েছিল সেহেতু নিশ্চয়ই এ এলাকার হবে। সুতরাং তারা তাঁকে পেয়ে সাথে সাথে গোপন করে নিল যাতে কাফেলার সমস্ত লোক শরীক দাবী করে না বসে অথবা তাঁর আত্মীয়-স্বজন খবর পেয়ে যেন তাঁকে ফিরিয়ে নিতে না আসে।



ইউসুফ (عليه السلام) এর ভাইয়েরা কাফেলার কাছে বিক্রির প্রস্তাব দিয়ে বলল: ছেলেটি আমাদের পলাতক গোলাম। তোমরা ওকে আমাদের কাছ থেকে কিনে নিতে পার। কাফেলা নামে মাত্র কয়েকটি দিরহাম দিয়ে সস্তা মূল্যে ইউসুফকে কিনে নিল। যেহেতু ইউসুফ (عليه السلام) এর ভাইয়েরা বলেছে এটা আমাদের পালিয়ে আসা গোলাম, তাই কাফেলা কিনার পর তাদের থেকে একটি লিখিত নেয় যাতে করে কেউ দাবী না করতে পারে। এর দ্বারা ইউসুফ (عليه السلام) এর ভাইদের দুটি উদ্দেশ্য ছিল। এক যাতে ইউসুফ তার বাপ-ভাইদের নাম করে পুনরায় বাড়ি ফিরে আসার সুযোগ না পায়। দুই যাতে ইউসুফ দেশান্তরী হয়ে যায় ও অন্যের ক্রীতদাস হয়ে জীবন যাপন করে। কত নিষ্ঠুর হলে ভাইয়েরা ভায়ের প্রতি এরূপ আচরণ করতে পারে, কল্পনা করা যায় কি!



মিসরের অর্থমন্ত্রীর গৃহে ইউসুফ (عليه السلام):



ইউসুফ (عليه السلام) কে তার ভাইদের কাছ থেকে স্বল্পমূল্যে ক্রয় করে নিয়ে ব্যবসারী কাফেলা তাকে বিক্রির জন্য মিসরের বাজারে উপস্থিত করল। বালক ইউসুফের রূপ-সৌন্দর্য দেখে বিত্তশালীরা হাটে রীতিমত দামের প্রতিযোগিতা শুরু করল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এ মর্যাদাবান ব্যক্তিকে মর্যাদার স্থানে সমুন্নত করবেন। তাই ইউসুফের প্রতি মিসরের অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিপাত করালেন। সকল খরিদদারকে ডিঙিয়ে মিসরের তৎকালীন অর্থ ও রাজস্বমন্ত্রী ক্বিৎফীর (قطفير) তাকে বহু মূল্য দিয়ে খরিদ করে নিলেন। ক্বিৎফীর ছিলেন নিঃসন্তান।



মিসরের অর্থমন্ত্রীর উপাধি ছিল ‘আযীয’ বা ‘আযীযে মিসর’। ইউসুফকে ক্রয় করে এনে তিনি তাকে স্বীয় স্ত্রীর হাতে অর্পণ করলেন এবং বললেন, একে উত্তমভাবে লালন-পালন কর। এর জন্য উত্তম থাকার উত্তম ব্যবস্থা কর। ভবিষ্যতে আমাদের কল্যাণে আসতে পারে অথবা আমরা সন্তান হিসেবে গ্রহণ করে নেব। যেহেতু তাদের কোন সন্তান ছিল না। সে সময়ে মিসরের বাদশা ছিল রাইয়ান বিন অলীদ এবং আযীযে মিসর (মিসরের মন্ত্রী) যিনি ইউসুফ (عليه السلام) কে ক্রয় করেন তার স্ত্রীর নাম কেউ বলে রাঈল, আবার কেউ বলে যুলাইখা। তবে যুলাইখা নামেই প্রসিদ্ধ। রাজ প্রাসাদে ইউসুফ (عليه السلام) এর মিসরীয় জীবন শুরু হল।



এভাবেই আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফ (عليه السلام)-কে মিসরের ভূখণ্ডে একটি উৎকৃষ্ট বাসস্থান প্রদান করলেন, যেমন জালিম ভাই ও কূপ থেকে রক্ষা করেছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা এভাবেই তাঁর কার্য সম্পাদন করলেন এবং তাকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা শিক্ষা দিলেন। অতঃপর যখন তিনি পূর্ণ বয়সে উপনীত হলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে নবুওয়াত দান করলেন এবং তাকে প্রজ্ঞা শিক্ষা দিলেন। সৎকর্মপরায়ণদেরকে আল্লাহ তা‘আলা এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকেন।



আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :



১. রাখে আল্লাহ তা‘আলা মারে কে? ইউসুফ (عليه السلام) এর ভাইয়েরা তাঁকে মারার চেষ্টা করলেও আল্লাহ তা‘আলা রাখবেন বিধায় মারা সম্ভব হয়নি।

২. ইউসুফ (عليه السلام) কে পৃথিবীর মানুষের অর্ধেক সৌন্দর্য দেয়া হয়েছে।

৩. যারা আল্লাহ পথে অবিচল থাকে আল্লাহ এভাবেই তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দিয়ে থাকেন।

৪. যে যুবক আল্লাহর পথে জীবনকে পরিচালনা করে আল্লাহ তাকে ইলম ও হিকমত দান করেন।

৫. স্বাধীন ব্যক্তিকে ক্রয়-বিক্রয় করা হারাম।


তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)


তাফসীর: ১৯-২০ নং আয়াতের তাফসীর

ইউসুফের (আঃ) ভ্রাতাগণ তাঁকে কূপে নিক্ষেপ করার পর কি ঘটেছিল আল্লাহ তাআ’লা এখানে তারই বর্ণনা দিচ্ছেন। তারা তাঁকে কূপের মধ্যে নিক্ষেপ করে চলে যায়। তিনি তিন দিন ধরে একাকী ঐ অন্ধকার কূপের মধ্যে অবস্থান করেন। মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, ঐ কূপে নিক্ষেপ করার পর তাঁর ভ্রাতাগণ তামাশা দেখার উদ্দেশ্যে ঐ কূপের আশে পাশে সারাদিন ঘোরাফেরা করে। মহান আল্লাহর কুদরতের ফলে এক যাত্রীদল সেখান দিয়ে গমন করে। তারা তাদের পানি সংগ্রাহককে পানি আনার জন্যে পাঠিয়ে দেয়। লোকটি ঐ কূপেই তার বালতি নামিয়ে দেয়। হযরত ইউসুফ (আঃ) শক্ত করে বালতির রশি ধরে নেন এবং পানির পরিবর্তে তিনিই উপরে উঠে পড়েন। পানি সংগ্রাহক লোকটি তো এ দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে যায় এবং সশব্দে বলে ওঠেঃ “আরে সুবহানাল্লাহ! এ যে কিশোর ছেলে এসে গেছে! অন্য পঠনে (আরবি) এরূপও রয়েছে। সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, পানি সংগ্রাহককে যে লোকটি পাঠিয়েছিল তার নামও ছিল বুশরা। পানি সংগ্রাহক লোকটি তার নাম ধরে ডেকে বলেছিল যে, তার ডোলে একটি ছেলে উঠে গেছে। কিন্তু সুদ্দীর (রঃ) এই উক্তিটি খুবই দুর্বল। এই ধরনের পঠনে এইরূপ অর্থই হতে পারে। এর ইযাফত বা সম্বন্ধ তার নিজের দিকেই হয়েছে এবং ইযাফতের (আরবি) অক্ষরকে লোপ করে দেয়া হয়েছে। এরই পৃষ্ঠপোষকরূপে (আরবি) এই কিরআতটি রয়েছে। যেমন আরবের লোকেরা (আরবি) ও (আরবি) এইরূপ বলে থাকে। (আরবি) এর অক্ষরটিকে লোপ করে দিয়ে ঐ সময় (আরবি) দেয়াও জায়েয এবং (আরবি) দেয়াও জায়েয। সুতরাং এটা এরই পর্যায়ভুক্ত। আর (আরবি) এই দ্বিতীয় কিরআতটি এর তাফসীর। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআ’লাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

লোকগুলি হযরত ইউসুফকে (আঃ) মূলধন হিসেবে লুকিয়ে রাখে। যাত্রীদলের অন্যান্য লোকদের কাছে এটা গোপন রাখার চেষ্টা করে। তাদেরকে বলে যে, তারা তাঁকে কূপের পার্শ্ববর্তী লোকদের নিকট থেকে ক্রয় করে নিয়েছে। প্রকত ব্যাপার গোপন করার কারণ ছিল এই যে, যাত্রীদলের অন্যান্য লোক যেন তাদের সাথে অংশীদার হতে না পারে। এটা মুজাহিদ (রঃ), সুদ্দী (রঃ) এবং ইবনু জারীরের (রঃ) উক্তি। (আরবি) (তারা তাকে পণ্যরূপে লুকিয়ে রাখে) এই উক্তি সম্পর্কে আওফী (রঃ) হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ ইউসুফের (আঃ) ভ্রাতাগণ তাঁর অবস্থা এবং তিনি যে তাদের ভাই একথা গোপন রাখে। আর ইউসুফও (আঃ) নিজের অবস্থা গোপন রাখেন এই ভয়ে যে তাঁর ভ্রাতাগণ হয়তো তাকে মেরে ফেলবে। তাই তিনি তাঁর ভাইদের মাধ্যমে বিক্রি হয়ে যাওয়াই পছন্দ করলেন।

(আরবি) অর্থাৎ আল্লাহ তাআ’লা হযরত ইউসুফের (আঃ) ভাইদের কার্যকলাপ পূর্ণরূপে অবগত ছিলেন। কিছুই তাঁর অজানা ছিল না। যদিও তিনি তৎক্ষণাৎ এই গুপ্ত রহস্য প্রকাশ করে দিতে সক্ষম ছিলেন, তথাপি যে তিনি তখনই তা প্রকাশ করা হতে বিরত থাকলেন, এতে তাঁর পূর্ণ নিপুণতা রয়েছে। তাঁর (ইউসুফের আঃ) ভাগ্যে এটাই লিপিবদ্ধ ছিল। কাজেই তিনি তাঁকে তাঁর ভাগ্যের উপরই ছেড়ে দেন। সৃষ্টি ও হুকুম একমাত্র তাঁরই, সারা বিশ্বের প্রতিপালক কতইনা মহান।

এর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহকেও (সঃ) এক প্রকারের সান্ত্বনা দান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ যেন তাঁকে বলছেনঃ হে মুহাম্মদ (সঃ) তোমার কওম যে তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে এটা আমি দেখতে রয়েছি। আমার এ ক্ষমতা রয়েছে যে, এখনই তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে তোমাকে বিপদ মুক্ত করি। কিন্তু আমার সমস্ত কাজ হিকমতে পরিপূর্ণ। এখনই আমি তাদেরকে ধ্বংস করবো না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। অচিরেই তুমি তাদের উপর বিজয় লাভ করবে। ধীরে ধীরে আমি তাদেরকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবো। যেমন আমি ইউসুফ (আঃ) এবং তার ভাইদের মাঝে হিকমতের সাথে কাজ করেছি। অবশেষে ইউসুফের (আঃ) এবং তার ভাইদের মাঝে হিকমতের সাথে কাজ করেছি। অবশেষে ইউসুফের (আঃ) সামনে তাদেরকে মাথা নত করতে হয়েছে এবং তারা তার মর্যাদার কথা অকপটে স্বীকার করে নিয়েছে।

(আরবি) অর্থাৎ ইউসুফের ভ্রাতাগণ তাঁকে অতি অল্প মূল্যে বিক্রি করে দিলো। মুজাহিদ (রঃ) ও ইকরামা (রঃ) বলেন যে, (আরবি)শব্দের অর্থ হচ্ছে কম। যেমন আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “সে (মু'মিন) পুরস্কার কমে যাওয়ার ও আযাব বৃদ্ধি পাওয়ার ভয় করবে না।” (৭২: ১৩) অর্থাৎ ইউসুফের (আঃ) ভাই এরা তাঁকে খুবই কম মূল্যে বণিকদের হাতে বিক্রি করে দিলো এবং এভাবে কম মূল্যে বিক্রি করতে তাদের মনে বাধেনি। এমন কি তারা বিনা মূল্যে চাইলেও দিয়ে দিতো। কেননা, তাঁর প্রতি তাদের কোন আকর্ষণই ছিল না।

হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ), মুজাহিদ (রঃ) এবং যহহাক (রঃ) বলেন যে, (আরবি) এর `(আরবি)` সর্বনামটি ইউসুফের (আঃ) ভাইদের দিকে ফিরেছে। আর কাতাদা’ (রঃ) বলেন যে ওটা ফিরেছে যাত্রীদলের দিকে। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই বেশী প্রবল। কেননা, যাত্রীদল তো হযরত ইউসুফকে (আঃ) দেখে খুবই খুশী হয়েছিল এবং তাঁকে মুলধন হিসেবে লুকিয়ে রেখেছিল। সুতরাং তাঁর প্রতি তাদের যদি আকর্ষণ না থাকতো তবে তারা এরূপ করবে কেন? সুতরাং এখানে ভাবার্থ এটাই হবে যে, ইউসুফের (আঃ) ভাই এরা তাঁকে অতি নগন্য মূল্যে বিক্রি করে দিয়েছিল।

(আরবি) দ্বারা হারাম ও যুলুমও উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য এটা নয়। কেননা এই মূল্যের হারাম হওয়ার কথা তো সর্বজন বিদিত। কারণ তিনি নিজে ছিলেন নবী, তাঁর পিতা ছিলেন নবী, তাঁর পিতামহ ছিলেন নবী এবং তাঁর প্রপিতামহ ছিলেন আল্লাহর নবী ও খলীল (দোস্ত) হযরত ইবরাহীম (আঃ)। সুতরাং তিনি ছিলেন কারীম ইবনু কারীম ইবনু কারীম ইবনু কারীম। অতএব, এখানে অর্থ হবে অল্প, নগণ্য এবং নামে মাত্র মূল্যে বিক্রি করা, যদিও সেটা হারাম ও যুলুমও ছিল। তারা ভাইকে বিক্রি করে দিচ্ছে, তাও আবার নগণ্য মূল্যে। এ জন্যই আল্লাহ পাক (আরবি) (কয়েক দিরহামের বিনিময়ে) বলেছেন। হযরত ইবনু মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তারা তাঁকে বিশ দিরহামের বিনিময়ে বিক্রি করেছিল। হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ), নাওফুল বাকালী (রাঃ), সুদ্দী (রঃ), কাতাদা’ (রঃ) এবং আতিয়া আওফীও (রঃ) এরূপই বলেছেন। তারা পরস্পরের মধ্যে দু’দিরহাম করে বণ্টন করে নেয়। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, তারা তাঁকে বাইশ দিরহামে বিক্রি করেছিল আর মুহাম্মদ ইবনু ইসহাক (রঃ) এবং ইকরামা (রঃ) বলেন যে, চল্লিশ দিরহামে বিক্রি করেছিল। (আরবি) এই উক্তি সম্পর্কে যহ্‌হাক (রঃ) বলেনঃ তারা হযরত ইউসুফের (আঃ) নুবওয়াত এবং মহা মহিমান্বিত আল্লাহর নিকট তাঁর কি মর্যাদা রয়েছে এসব সম্পর্কে মোটেই অবহিত ছিল না তাই তারা ঐ নগণ্য মূল্যে বিক্রি করেই সন্তুষ্ট হয়েছিল। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এতো সব করেও তাদের মনে তৃপ্তি আসে নাই বরং তারা যাত্রীদলের পিছনে পিছনে চলতে শুরু করে এবং তাদেরকে বলেঃ “এই গোলামের মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার অভ্যাস আছে। সুতরাং তাকে মযবুত করে বেধে নাও, না হলে হয়তো তোমাদের হাত থেকেও পালিয়ে যাবে।” এ ভাবে বেঁধে বেঁধে তারা তাকে মিসর পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং সেখানকার বাজারে তাঁকে বিক্রী করতে উদ্যত হয়। হযরত ইউসুফ (আঃ) ঐ সময় বলেছিলেনঃ “আমাকে যে ব্যক্তি ক্রয় করবে সে অবশ্যই খুশী হয়ে যাবে।” অতঃপর তাকে মিসরের বাদশাহ্ (আযীয) ক্রয় করে নেন এবং তিনি মুসলমান ছিলেন।





সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।