সূরা আন-নাসর (আয়াত: 3)
হরকত ছাড়া:
فسبح بحمد ربك واستغفره إنه كان توابا ﴿٣﴾
হরকত সহ:
فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّکَ وَ اسْتَغْفِرْهُ ؕؔ اِنَّهٗ کَانَ تَوَّابًا ﴿۳﴾
উচ্চারণ: ফাছাব্বিহবিহামদি রাব্বিকা ওয়াছতাগফিরহু ইন্নাহূকা-না তাওওয়া-বা-।
আল বায়ান: তখন তুমি তোমার রবের সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চাও নিশ্চয় তিনি তাওবা কবূলকারী।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ৩. তখন আপনি আপনার রবের প্ৰশংসাসহ তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী।(১)
তাইসীরুল ক্বুরআন: তখন তুমি (শুকরিয়া আদায়ের উদ্দেশে) তোমার প্রতিপালকের প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে আর তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। তিনি বড়ই তাওবা কবূলকারী।
আহসানুল বায়ান: ৩। তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি অধিক তাওবা গ্রহণকারী। [1]
মুজিবুর রহমান: তখন তুমি তোমার রবের কৃতজ্ঞতা মূলক পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর এবং তাঁর সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা কর; তিনিতো সর্বাপেক্ষা অধিক অনুতাপ গ্রহণকারী।
ফযলুর রহমান: তখন তোমার প্রভুর পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করবে এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চাইবে। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাকারী (অথবা তওবা কবুলকারী)।
মুহিউদ্দিন খান: তখন আপনি আপনার পালনকর্তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাকারী।
জহুরুল হক: তখন তোমার প্রভুর প্রশংসায় জপতপ করো ও তাঁর পরিত্রাণ খোঁজো। নিঃসন্দেহ তিনি বারবার প্রত্যাবর্তনকারী।
Sahih International: Then exalt [Him] with praise of your Lord and ask forgiveness of Him. Indeed, He is ever Accepting of repentance.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ৩. তখন আপনি আপনার রবের প্ৰশংসাসহ তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন, নিশ্চয় তিনি তাওবা কবুলকারী।(১)
তাফসীর:
(১) একাধিক হাদীস ও সাহাবীর উক্তিতে আছে যে, এ সূরায় রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওফাত নিকটবর্তী হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত আছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আমাকে বদরী সাহাবীগণের সাথে তার কাছে প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন। তারা এটাকে মনে-প্ৰাণে মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা বলেই ফেলল, একে আবার আমাদের সাথে কেন? আমাদের কাছে তার সমবয়সী সন্তান-সন্ততি রয়েছে। তখন উমর বললেন, তোমরা তো জান সে কোত্থেকে এসেছে। তারপর একদিন তিনি তাদের মজলিসে তাকে ডেকে পাঠালেন। আমি বুঝতে পারলাম যে, তিনি আমাকে তাদের মাঝে ডেকে আমাকে তাদের সাথে রাখার ব্যাপারটি স্পষ্ট করারই ইচ্ছা পোষণ করেছেন। অতঃপর উমর বললেন, তোমরা মহান আল্লাহর বাণী, “ইযা জাআ নাসরুল্লাহি ওয়াল ফাতিহ” সম্পর্কে কি বল? তাদের কেউ বলল, আমাদের বিজয় লাভ হলে যেন আমরা আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর কাছে ক্ষমা চাই তা-ই বলা হয়েছে। আবার তাদের অনেকেই কিছু না বলে চুপ ছিল।
তখন তিনি আমাকে বললেন, হে ইবনে আব্বাস! তুমি কি অনুরুপ বল? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, তাহলে কি বল? আমি বললাম, এটা তো রাসূলের মৃত্যুর সময়, যা তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, “যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এসে যাবে”, আর এটাই হবে আপনার জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার আলামত, “সুতরাং আপনি আপনার রবের সপ্ৰশংস তাসবীহ পাঠ করুন এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চান; কেননা তিনিই তো তাওবা কবুলকারী”। তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তুমি যা বললে তা ছাড়া এ সূরা সম্পর্কে আর কিছু আমি জানি না।” [বুখারী: ৪৯৭০] সুতরাং সূরার অর্থ হচ্ছে, আপনার দুনিয়াতে অবস্থান করার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেছে, তাবলীগ তথা পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব পালিত হয়েছে। অতএব, আপনি তাসবীহ ও ইস্তেগফারে মনোনিবেশ করুন। [ইবনুল কায়্যিম: ইলামুল মুয়াক্কিয়ীন, ১/৪৩৬]
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেনঃ এই সূরা নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রত্যেক সালাতের পর এই দো'আ পাঠ করতেন سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي [বুখারী: ৭৯৪, ৮১৭, ৪২৯৩, ৪৯৬৭, মুসলিম: ৪৮৪, আবু দাউদ: ৮৭৭, ইবনে মাজহ: ৮৮৯] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ বয়সে বেশী বেশী আগত দো’আ পাঠ করতেনঃ سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ [মুসলিম ৪৮৪, মুসনাদে আহমাদ: ৬/৩৫] অনুরূপভাবে উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, এই সূরা নাযিল হওয়ার পর তিনি উঠাবসা, চলাফেরা তথা সর্বাবস্থায় سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ এই দো'আ পাঠ করতেন। তিনি বলতেন, আমাকে এর আদেশ করা হয়েছে। অতঃপর প্রমাণস্বরূপ সূরাটি তেলাওয়াত করতেন। [তাবারীঃ ৩৮২৪৮]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: ৩। তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ঘোষণা কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় তিনি অধিক তাওবা গ্রহণকারী। [1]
তাফসীর:
[1] অর্থাৎ, বুঝে নাও যে, রিসালতের তবলীগ ও হক প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যা তোমার উপর ছিল তা পূর্ণ হয়ে গেছে। এবার দুনিয়া থেকে তোমার বিদায় নেওয়ার পালা এসে গেছে। এ জন্য তুমি আল্লাহর তসবীহ, প্রশংসা এবং ক্ষমা প্রার্থনায় অধিকাধিক মনোযোগী হও। এ থেকে আমরা জানতে পারি যে, জীবনের শেষ দিনগুলিতে উক্ত কর্মাবলী করতে অধিক যত্নবান হওয়া উচিত।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: নামকরণ ও গুরুত্ব:
النصر শব্দের অর্থ সাহায্য, সহযোগিতা। এ শব্দটি প্রথম আয়াতেই এসেছে, সেখান থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। এ সূরার অপর নাম সূরাতুত তাওদী বা বিদায়ের সূরা। এ সূরাতে নাবী (সাঃ)-এর ওফাত নিকটবর্তী হওয়ার ইঙ্গিত করা হয়েছে বিধায় এর নাম সূরাতুত্ তাওদী করা হয়েছে। (তাফসীর মারেফুল কুরআন)। এ সূরাটি অবতীর্ণের দিক দিয়ে সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা। (ফাতহুল বারী ৮/৬০৫, সহীহ মুসলিম হা. ৩০২৪)
ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : আইয়ামে তাশরীক (১১, ১২, ১৩ই যিলহাজ্জের) মাঝামাঝি দিনে মিনায় এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিদায় হাজ্জে ছিলেন। সূরাটি শেষ পর্যন্ত পড়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বুঝতে পারলেন যে, এটাই তাঁর শেষ হাজ্জ, অতঃপর তিনি জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রসিদ্ধ ভাষণটি প্রদান করেন। (ইমাম বায়হাকী তার দালায়েল গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন হা. ৯৪৬৪)
আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
(إِذَا جَا۬ءَ نَصْرُ اللّٰهِ وَالْفَتْحُ)
সূরাটি অবতীর্ণ হওয়ার পর নাবী (সাঃ) যে সালাতই আদায় করতেন তাতে
سبحانك ربنا وبحمدك اللهم اغفرلي
-পাঠ করতেন। (সহীহ বুখারী, হা. ৪৯৬৭, সহীহ মুসলিম হা. ৪৮৪)
অন্য বর্ণনায় রয়েছে তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রুকু ও সিজদাতে এ দু‘আটি বেশি বেশি পড়তেন। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৬৮) কারণ এ সূরা কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা। (সহীহ মুসলিম হা. ৭৭৩১) এ সূরার ফযীলত সূরা যিলযালে আলোচনা করা হয়েছে।
তাফসীর:
إِذَا সাধারণত শর্তের অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : যখন তুমি সাহায্য চাইবে, তখন আল্লাহ তা‘আলার কাছে চাইবে। (তিরমিযী হা. ২৫১৬, মিশকাত হা. ৫৩০২, সহীহ) তবে নিশ্চয়তার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এখানে সে অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
(نَصْرُ اللّٰهِ) বলতে কুফর ও কাফিরদের ওপর ইসলাম ও মুসলিমদের বিজয়কে বুঝানো হয়েছে। الْفَتْحُ দ্বারা মক্কা বিজয়কে বুঝানো হয়েছে যা ৮ম হিজরীর ১৭ই রমাযান মঙ্গলবার সকালে অর্জিত হয়েছিল। এ সূরাতে কয়েকটি বিষয় আলোচনা স্থান পেয়েছে:
১. সুসংবাদ : এ সুসংবাদটি হলো ইসলাম, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও মুসলিমদেরকে সাহায্য করার সুসংবাদ এবং মক্কা বিজয় ও দলে দলে দীন ইসলামে মানুষের প্রবেশের সুসংবাদ। এ সুসংবাদটি ইতোমধ্যে সংঘঠিত হয়ে গেছে। মক্কা বিজয়ের পরের বছর ৯ম ও ১০ম হিজরীকে প্রতিনিধি দলের আগমনের বছর বলে আখ্যায়িত করা হয়। ঐ সময় আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকেরা দলে দলে মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করে। মক্কা বিজয়ের পর দলে দলে ইসলাম গ্রহণের অন্যতম কারণ হল হারাম শরীফকে আল্লাহ তা‘আলা হস্তীবাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছিলেন, সে হারামের তত্ত্বাবধায়কদের ওপর যখন মুহাম্মাদ জয়লাভ করেছেন তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি সত্য নাবী। (সহীহ বুখারী হা. ৪৩০২)
ইকরিমা ও মুকাতিল (রহঃ) বলেন : (نَصْرُ اللّٰهِ) বা বিজয় বলতে ইয়ামানী প্রতিনিধি দলের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা তাদের প্রায় সাতশত লোক মুসলিম হয়ে কেউ আযান দিতে দিতে, কেউ কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে, কেউ কালেমা পড়তে পড়তে মদীনায় এসে উপস্থিত হয়েছিল। এতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খুবই খুশি হন। কিন্তু উমার ও আব্বাস (রাঃ) কাঁদতে থাকেন। (তাফসীর কুরতুবী)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : نَصْرُ اللّهِ বিজয় এসেছে, সাহায্য এসেছে এবং ইয়ামানবাসীরাও এসেছে। জনৈক ব্যক্তি বলল : হে আল্লাহর রাসূল! ইয়ামানবাসী কারা? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন :
جَاءَ أَهْلُ الْيَمَنِ، هُمْ أَرَقُّ أَفْئِدَةً، الْإِيمَانُ يَمَانٍ، وَالْفِقْهُ يَمَانٍ، وَالْحِكْمَةُ يَمَانِيَةٌ
ইয়ামানবাসীরা আগমন করেছে, এদের হৃদয় খুবই নরম। ঈমান ইয়ামানবাসীদের মাঝে, বুঝশক্তি ইয়ামানবাসীদের এবং দূরদর্শিতা ইয়ামানবাসীদের মাঝেই। (সহীহ মুসলিম হা. ৫২)
২. সূরাতে দুটি ইঙ্গিত প্রদান করা হয়েছে। একটি ইঙ্গিত হলো : আল্লাহ তা‘আলার এ সাহায্য বলবত থাকবে এমনকি তা আরো বৃদ্ধি পাবে যদি মানুষ প্রকৃত ঈমান ও আমলে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এর প্রমাণ খুলাফায়ে রাশেদা ও তার পরবর্তী যুগ। আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য নিয়েই খুলাফায়ে রাশেদাগণ ও পরবর্তী মুজতাহিদগণ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের বাণী পৌঁছে দিয়েছেন।
দ্বিতীয় ইঙ্গিত হলো : রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ইনতেকালের সময় নিকটবর্তী। এজন্য তিনি সালাতের মাঝে রুকু ও সিজদাতে বেশি বেশি তাসবীহ পাঠ করতেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : বদরের যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী বয়স্ক মুজাহিদদের সাথে উমার (রাঃ) আমাকেও শামিল করে নিতেন। এ কারণে কারো মনে সম্ভবত অসন্তুষ্টির ভাব সৃষ্টি হত। একদা তাদের মধ্যে একজন আমার সম্পর্কে মন্তব্য করে বলল : সে কেন আপনার সাথে আসে? আমাদেরও তো তার মত সন্তান আছে। উমার (রাঃ) বললেন : তোমরা তো তার ব্যাপারে ভাল করেই জান। একদিন তিনি সবাইকে ডাকলেন এবং আমাকেও তাদের সাথে প্রবেশ করালেন। আমি বুঝতে পারলাম আজ তিনি তাদেরকে কিছু দেখাতে চান, উমার (রাঃ) সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন : তোমরা
(إِذَا جَا۬ءَ نَصْرُ اللّٰهِ وَالْفَتْحُ)
এ আয়াতটির ব্যাপারে কী বল? তাদের কতকজন বললেন : যখন বিজয় ও সাহায্য আসবে তখন আমাদেরকে তাসবীহ, তাহলীল ও ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আর কতকজন চুপ থাকলেন, কোন কথা বললেন না। এবার তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন : তুমি এরূপই বল, হে ইবনু আব্বাস? আমি বললাম : এ সূরায় নাবী (সাঃ)-এর পরলোক গমনের কথা বলা হয়েছে। এটা জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তাঁর ইহলৌকিক জীবন শেষ হয়ে এসেছে। এ কথা শুনে উমার (রাঃ) বললেন : আমিও তাই বুঝেছি (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৭০)।
(فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ)
অর্থাৎ তুমি তাঁর প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা কর। প্রশংসা বা হামদ হল ভালবাসা ও সম্মানসহকারে পূর্ণরূপে আল্লাহ তা‘আলার গুণকীর্তন করা। আর পবিত্রতা হল আল্লাহ তা‘আলার শানে উপযুক্ত নয় এমন সব কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা। এ আয়াতে উভয়টার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, এ সূরা অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বেশি বেশি ইসতিগফার পড়তেন। প্রশ্ন হতে পারে; রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর তো পূর্বাপর সব গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে তবুও কেন তাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হল?
উত্তর : এরূপ প্রশ্ন আয়িশাহ (রাঃ) করলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জবাবে বলেন :
أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا
আমি কি আল্লাহ তা‘আলার একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? (সহীহ বুখারী হা. ১১৩০)
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : এর মধ্যে উম্মাতের শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যে, তারা যেন নিরাশ না হয় এবং ক্ষমা প্রার্থনা করা ছেড়ে না দেয়। তিনি বলেন : নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও যখন তাঁকে আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা প্রার্থনা করার নির্দেশ দিয়েছেন তখন অন্যদের কেমন ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। (তাফসীর কুরতুবী)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে যে অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন সেজন্য তাঁর শুকুরগুজার হওয়া উচিত এবং বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সূরা নাছর কুরআনের সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরা।
২. সূরা নাছরে মু’মিনদেরকে আল্লাহ তা‘আলার সাহায্যের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।
৩. মৃত্যু নিকটবর্তী মনে হলে বেশি বেশি তাসবীহ ও ইসতেগফার করা উচিত।
৪. ছোটরাও অনেক সময় বড়দের থেকে বেশি জ্ঞান রাখে।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: পূর্বেই হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, এই সূরাটি কুরআন কারীমের এক চতুর্থাংশের সমতুল্য।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উবাহ (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করেনঃ “সর্বশেষ কোন সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছে তা কি তুমি জান?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “হ্যা, সূরা ইযাজাআ নাসরুল্লাহি ওয়াল ফাতহু' (সর্বশেষ অবতীর্ণ হয়েছে।)” হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) তখন বললেনঃ “তুমি সত্য বলেছো।” (এ হাদীসটি ইমাম নাসায়ী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আইয়ামে তাশরীকের (১১ই, ১২ইও ১৩ই যিল হজ্ব তারিখের) মধ্যভাগে (আরবি) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর অবতীর্ণ হলে তিনি বুঝতে পারেন যে, এটা বিদায়ী সূরা। সুতরাং তখনই তিনি সওয়ারী তৈরি করার নির্দেশ দিলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) সওয়ারীতে আরোহণ করলেন। তারপর তিনি তার সুপ্রসিদ্ধ খুৎবাহ প্রদান করলেন। (এ হাদীসটি হাফিয আবু বকর বাযার (রঃ) এবং হাফিয বারহাকী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ যখন (আরবি) সূরা অবতীর্ণ হয় তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে ডেকে বলেনঃ “আমার পরলোক গমনের খবর এসে গেছে।” এ কথা শুনে হযরত ফাতিমা (রাঃ) কাঁদতে শুরু করলেন। তারপরই তিনি হাসতে লাগলেন। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেনঃ “আমার আব্বার (সঃ) পরলোক গমনের সময় নিকটবর্তী হওয়ার খবর শুনে আমার কান্না এসেছিল। কিন্তু আমার কান্নার সময় তিনি আমাকে বললেনঃ “তুমি ধৈর্য ধারণ করে। আমার পরিবার-পরিজনের মধ্যে তুমিই সর্ব প্রথম আমার সাথে মিলিত হবে।” (এ হাদীসটি ইমাম বায়হাকী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। সুনানে নাসায়ীতে এটা বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু তাতে হযরত ফাতিমার (রঃ) উল্লেখ করা হয়নি)
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বয়স্ক মুজাহিদদের সাথে হযরত উমার (রাঃ) আমাকেও শামিল করে নিতেন। এ কারণে কারো কারো মনে সম্ভবতঃ অসন্তুষ্টির ভাব সৃষ্টি হয়ে থাকবে। একদা তাদের মধ্যে একজন আমার সম্পর্কে মন্তব্য করলেনঃ সে যেন আমাদের সাথে না থাকে। তার সমবয়সী ছেলে আমাদেরও তো রয়েছে।” তার এ মন্তব্য শুনে হযরত উমার (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ তোমরা তো তাকে খুব ভাল রূপেই জান!” একদিন তিনি সবাইকে ডাকলেন এবং আমাকেও স্মরণ করলেন আমি বুঝতে পারলাম যে, আজ তিনি তাদেরকে কিছু দেখাতে চান। আমরা সবাই হাজির হলে তিনি সকলকে জিজ্ঞেস করলেনঃ (আরবি) সূরাটি সম্পর্কে তোমাদের অভিমত কি (অর্থাৎ এ সূরাটি কিসের ইঙ্গিত বহন করছে)।” কেউ কেউ বললেনঃ “এ সূরায় আল্লাহ তাআলার গুণগান করার জন্যে এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্যে আমাদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা'আলার সাহায্য এলে এবং আমাদের বিজয় সূচিত হলেই যেন আমরা এইরূপ করি।” কেউ কেউ আবার সম্পূর্ণ নীরব থাকলেন, কিছুই বললেন হযরত উমার (রাঃ) তখন আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমার মতামতও কি এদের মতই?” আমি উত্তরে বললামঃ না, বরং আমি এই বুঝেছি এ সূরায় রাসূলুল্লাহর (সঃ) পরলোক গমনের ইঙ্গিত রয়েছে। তাঁকে এটা জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তার ইহলৌকিক জীবন শেষ হয়ে এসেছে। সুতরাং তিনি যেন তাঁর প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করেন ও তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন। একথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “আমিও এটাই বুঝেছি।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এ সূরা অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “(এ বছরই আমার ইন্তেকাল হবে) আমাকে আমার মৃত্যুর সংবাদ দেয়া হয়েছে।” মুজাহিদ (রঃ), আবুল আলিয়া (রঃ), যহহাক (রঃ) প্রমুখ গুরুজনও এই তাফসীর বর্ণনা করেছেন। (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমদে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) মদীনায় অবস্থান করছিলেন, একদা তিনি বলেনঃ “আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান! আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এসে পড়েছে। ইয়ামনের অধিবাসীরা এসে গেছে।” তাকে জিজ্ঞেস করা হলোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ইয়ামনবাসীরা কেমন লোক?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “তারা কোমল প্রাণ ও পরিচ্ছন্ন স্বভাবের অধিকারী। ঈমান, বুদ্ধিমত্তা এবং হিকমত এ সবই ইয়ামনবাসীদের রয়েছে।” (এ হাদসিটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, যেহেতু এ সূরাটিতে রাসূলুল্লাহর (সঃ) পরলোকগমনের সংবাদ ছিল সেহেতু সূরাটি অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আখেরাতের কাজে পূর্বের চেয়ে অধিক মনোযোগী হন। অতঃপর তিনি বলেনঃ “আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এসে গেছে এবং ইয়ামনবাসী এসে পড়েছে।” তখন একটি লোক জিজ্ঞেস করলেনঃ “ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ইয়ামনবাসীরা কি (প্রকৃতির লোকে)?” উত্তরে তিনি বললেন! “তাদের অন্তর কোমল, স্বভাব নম্র এবং তারা ঈমান ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী।” (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, সূরা সমূহের মধ্যে পুরো সূরা অবতীর্ণ হওয়ার দিক থেকে (আরবি) এ সূরাটিই সর্বশেষ সূরা। (এ হাদীসটিও ইমাম তিবরানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,(আরবি) এ সূরাটি অবতীর্ণ হলে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তা শেষ পর্যন্ত পাঠ করেন, অতঃপর বলেনঃ “সব মানুষ এক দিকে এবং আমি ও আমার সাহাবীরা এক দিকে। জেনে রেখো যে, মক্কা বিজয়ের পর আর হিজরত নেই, তবে রয়েছে। জিহাদ এবং নিয়ত।” মারওয়ানকে হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) এ হাদীসটি শোনালে তিনি বলে ওঠেনঃ “তুমি মিথ্যা বলছো” ঐ সময় মারওয়ানের সাথে তার মজলিসে হযরত রাফে ইবনে খাদীজ (রঃ) এবং হযরত যায়েদ ইবনে সাবিতও (রাঃ) উপবিষ্ট ছিলেন। হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) তাঁদের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন! “এঁরাও এ হাদীসটি জানেন এবং বর্ণনা করতে পারেন। কিন্তু একজন নিজের নেতৃত্ব চলে যাওয়ার আশংকায় এবং অপরজন যাকাত আদায়ের পদমর্যাদা থেকে বরখাস্ত হওয়ার ভয়ে এটা বর্ণনা করছেন না।` একথা শুনে মারওয়ান হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) কে চাবুক মারতে উদ্যত হলে উভয় সাহাবী মারওয়ানকে লক্ষ্য করে বলেনঃ “শোনো মারওয়ান! হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) সত্য কথাই বলেছেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদে বর্ণনা করেছেন। এ হাদীস নির্ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কা বিজয়ের দিন বলেনঃ “হিজরত আর অবশিষ্ট নেই, তবে জিহাদ এবং নিয়ত বাকি রয়েছে। তোমাদেরকে যখন চলতে বলা হবে তখন তোমরা উঠে দাড়িয়ে চলতে শুরু করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) তাখরীজ করেছেন) তবে হ্যা, এটাও মনে রাখতে হবে যে, যে সব সাহাবী (রাঃ) হযরত উমারের (রাঃ) প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেনঃ “যখন আল্লাহ তা'আলা আমাদের উপর শহর ও দূর্গের বিজয় দান করবেন এবং আমাদেরকে সাহায্য করবেন তখন আমরা যেন তার প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করি ও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি, এ সূরায় এ নির্দেশই তিনি আমাদেরকে দিয়েছেন। তাছাড়া আমরা যেন নামায আদায় করি ও নিজেদের পাপের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করি, এ নির্দেশও আমাদেরকে দেয়া হয়েছে। তাদের এ অর্থ ও তাফসীরও খুবই সুন্দর ও বিশুদ্ধ, এতে কোন সন্দেহ নেই। রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কা বিজয়ের দিন চাশতের আট রাকআত নামায আদায় করেছিলেন, যদিও কেউ কেউ বলেন যে, ওটা ছিল চাশতের নামায, কিন্তু আমরা জানি যে, তিনি চাশতের নামায নিয়মিতভাবে আদায় করতেন না। তাছাড়া ঐসময় ব্যস্ততা ছিল এবং কাজকর্মও অনেক ছিল। তিনি ছিলেন মুসাফির, এ অবস্থায় কি করে তিনি চাশতের নামায পড়তে পারেন? এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সঃ) মক্কা বিজয়ের সময়ে মক্কা শরীফে রমযানের শেষ পর্যন্ত উনিশ দিন অবস্থান করেছিলেন। ঐ সময়ে তিনি ফরয নামাযও কসর করেছিলেন। তিনি রোযাও রাখেননি। তাঁর সঙ্গীয় প্রায় দশ হাজার মুসলমান সবাই এ নিয়ম পালন করেছিলেন। এতে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) আট রাকআত নামায মক্কা বিজয়ের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ছিল। এ কারণেই সেনাবাহিনী প্রধান বা সমকালীন ইমামের জন্যে কোন শহর জয় করার সাথে সাথে ঐ শহরে আট রাকআত নামায আদায় করা মুস্তাহাব।
হযরত সা'দ ইবনে অক্কাস (রাঃ) মাদায়েন বিজয়ের দিন অনুরূপ আট রাকআত নামায আদায় করেছিলেন। এই আট রাকআত নামায দুই রাকআত করে আদায় করতে হবে। কারো কারো মতে আট রাকআতে একবার সালাম ফিরালেই চলবে। অর্থাৎ একবারই সালাম ফিরানোর নিয়তে আট রাকআত নামায পড়া যাবে। কিন্তু সুনানে আবি দাউদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এ নামায প্রতি দুই রাকআতে সালাম ফিরিয়ে আদায় করেছিলেন। অন্যান্য তাফসীরও বিশুদ্ধ। যেমন, ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন বলেছেন যে, এ সূরায় রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে তার ইন্তেকালের সংবাদ দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! যে মক্কা থেকে কাফিররা তোমাকে চলে যেতে বাধ্য করেছে, সেই মক্কা বিজয় যখন তুমি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে, নিজের পরিশ্রমের ফলে যখন দেখতে পাবে, আরো যখন দেখতে পাবে যে, জনগণ আল্লাহর ধর্মে দলে দলে প্রবেশ করছে তখন তুমি স্বীয় প্রতিপালকের তাসবীহ ও তাহমীদ পাঠ করবে এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করবে। তুমি পরকালের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকো। মনে রেখো যে, তোমার ইহকালীন দায়িত্ব সম্পন্ন হয়েছে। সুতরাং এখন পরকালের প্রতি মনোযোগী হও। সেখানে তোমার জন্যে বহুবিধ কল্যাণ রয়েছে। তোমার মেহমানদারী স্বয়ং আমিই করবো। কাজেই আমার রহমত ও কুদরতের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করে অধিক পরিমাণে আমার প্রশংসা করো, তাওবা ইসতিগফার করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবা কবুল করে থাকেন।
সহীহ বুখারীতে হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভর রুকু ও সিজদায় নিম্নলিখিত তাসবীহ অধিক পরিমাণে পাঠ করতেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি মহাপবিত্র এবং আপনার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন! রাসূলুল্লাহ (সঃ) কুরআন কারীমের (আরবি) এ আয়াতের উপর অধিক পরিমাণে আমল করতেন।
অন্য এক রিওয়াইয়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর শেষ জীবনে নিম্নলিখিত কালেমাগুলো অধিক পরিমাণে পাঠ করতেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “আল্লাহ মহাপবিত্র, তার জন্যেই সমস্ত প্রশংসা, আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁর নিকট তাওবা করছি।” তিনি আরো বলতেনঃ “আমার প্রতিপালক আমাকে আদেশ দিয়ে রেখেছেনঃ যখন আমি দেখতে পাই যে, মক্কা বিজয় অত্যাসন্ন এবং দলে দলে লোক ইসলামে প্রবেশ করছে তখন যেন আমি এ কালেমা অধিক পরিমাণে পাঠ করি। সুতরাং আল্লাহর রহমতে আমি মক্কা বিজয় প্রত্যক্ষ করেছি। এ কারণে এখন (মনোযোগ সহকারে) এ কালেমা নিয়মিত পাঠ করছি।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে)
তাফসীরে ইবনে জারীরে হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, শেষ বয়সে রাসূলুল্লাহ (সঃ) উঠতে বসতে চলতে ফিরতে এবং আসতে যেতে নিম্নের তাসবীহ পড়তে থাকতেনঃ
(আরবি) অর্থাৎ “আল্লাহ মহাপবিত্র এবং তাঁর জন্যেই সমস্ত প্রশংসা।` হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) বলেনঃ “আমি একবার এর কারণ জিজ্ঞেস করলে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) সূরা নাসর তিলাওয়াত করেন এবং বলেনঃ “আল্লাহপাক আমাকে এরকমই আদেশ দিয়েছেন।”
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে যে, এ সূরা অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) নামাযে প্রায়ই এ সূরা তিলাওয়াত করতেন এবং রুকূতে তিনবার নিম্নের দু'আ পড়তেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আপনি মহা পবিত্র। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনারই জন্যে সমস্ত প্রশংসা। হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি তাওবা কবুলকারী, দয়ালু।` বিজয় অর্থে এখানে মক্কা বিজয়কে বুঝানো হয়েছে। এ ব্যাপারে কোন মতানৈক্য নেই। আরবের সাধারণ গোত্রগুলোর মধ্যে ব্যাপারে কোনই মতানৈক্য হয়নি। আরবের সাধারন গোত্রগুলো অপেক্ষা করছিল যে, যদি মুহাম্মদ (সঃ) স্বজাতির উপর জয়যুক্ত হন এবং মক্কা তাঁর পদানত হয় তবে তিনি যে সত্য নবী এব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ থাকবে না।
আল্লাহ তা'আলা যখন তাঁর প্রিয় নবী (সঃ) কে মহাবিজয় দান করলেন তখন এরা সবাই দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করলো। এরপর দু'বছর যেতে যেতেই সমগ্র আরব ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করলো। প্রত্যেক গোত্রের উপর ইসলামের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হলো। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য।
সহীহ বুখারীতেও হযরত আমর ইবনে সালমার (রাঃ)এ উক্তি বিদ্যমান রয়েছে যে, মক্কা বিজয়ের সাথে সকল গোত্র ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হলো। তারা ইসলাম গ্রহণের জন্যে অপেক্ষা করছিল এবং নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলঃ নবী মুহাম্মদ (সঃ) কে এবং তাঁর স্বজাতিকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দাও। যদি মুহাম্মদ (সঃ) সত্য নবী হয়ে থাকেন তবে নিজের জাতির উপর অবশ্যই জয়যুক্ত হবেন এবং মক্কার উপর তার বিজয় পতাকা উড়বে। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাব্দুল আলামীনের প্রাপ্য।
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে যে, হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহর এক প্রতিবেশী সফর থেকে ফিরে আসার পর হযরত জাবির (রাঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। সেই প্রতিবেশী মুসলমানদের মধ্যে ভেদাভেদ, দ্বন্দ্ব-কলহ এবং নতুন নতুন বিদআতের কথা ব্যক্ত করলে হযরত জাবির (রাঃ)-এর চক্ষুদ্বয় অশ্রু সজল হয়ে উঠলো। তিনি কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বললেনঃ “আমি সরদারে দো জাহান, শাফীউল মুযনিবীন, রহমাতুল লিল আলামীন হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মুখে শুনেছি, তিনি বলেছেনঃ “লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে বটে, কিন্তু শীঘ্রই তারা দলে দলে এই দ্বীন থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করবে।”
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।