সূরা আল-আসর (আয়াত: 3)
হরকত ছাড়া:
إلا الذين آمنوا وعملوا الصالحات وتواصوا بالحق وتواصوا بالصبر ﴿٣﴾
হরকত সহ:
اِلَّا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ وَ تَوَاصَوْا بِالْحَقِّ ۬ۙ وَ تَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ ﴿۳﴾
উচ্চারণ: ইল্লাল্লাযীনা আ-মানূওয়া ‘আমিলুসসা-লিহা-তি ওয়া তাওয়া-সাওবিল হাক্কি ওয়া তাওয়া-সাও বিসসাবরি।
আল বায়ান: তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দিয়েছে এবং পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ৩. কিন্তু তারা নয়(১), যারা ঈমান এনেছে(২) এবং সৎকাজ করেছে(৩) আর পরস্পরকে উপদেশ দিয়েছে হকের(৪) এবং উপদেশ দিয়েছে ধৈর্যের।(৫)
তাইসীরুল ক্বুরআন: কিন্তু তারা নয় যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় এবং পরস্পরকে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়।
আহসানুল বায়ান: ৩। কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে[1] এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয়। [2] আর উপদেশ দেয় ধৈর্য ধারণের। [3]
মুজিবুর রহমান: কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎ কাজ করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ও ধৈর্য ধারণে পরস্পরকে উদ্ধুদ্ধ করে।
ফযলুর রহমান: তবে তারা নয়, যারা (সত্যে) বিশ্বাস করে, সৎকাজ করে, একে অপরকে সত্যের (সত্য গ্রহণের) উপদেশ দেয় এবং একে অপরকে ধৈর্যের (ধৈর্যধারণের) উপদেশ দেয়।
মুহিউদ্দিন খান: কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের।
জহুরুল হক: তারা ব্যতীত যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করছে, আর পরস্পরকে সত্য অবলন্বনের জন্য মন্ত্রণা দিচ্ছে, এবং পরস্পরকে অধ্যবসায় অবলন্বনের পরামর্শ দিচ্ছে।
Sahih International: Except for those who have believed and done righteous deeds and advised each other to truth and advised each other to patience.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ৩. কিন্তু তারা নয়(১), যারা ঈমান এনেছে(২) এবং সৎকাজ করেছে(৩) আর পরস্পরকে উপদেশ দিয়েছে হকের(৪) এবং উপদেশ দিয়েছে ধৈর্যের।(৫)
তাফসীর:
(১) এখানে পূর্ববর্তী আয়াতে বর্ণিত মানবজাতি যে অত্যন্ত ক্ষতিগ্ৰস্ততার মধ্যে আছে তার থেকে উত্তরণের পথ বলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, এই ক্ষতির কবল থেকে কেবল তারাই মুক্ত, যারা চারটি বিষয় নিষ্ঠার সাথে পালন করে— ঈমান, সৎকর্ম, অপরকে সত্যের উপদেশ এবং সবরের উপদেশদান। দ্বীন ও দুনিয়ার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার এবং মহা উপকার লাভ করার চার বিষয় সম্বলিত এ ব্যবস্থাপত্রের প্রথম দুটি বিষয় আত্মসংশোধন সম্পর্কিত এবং দ্বিতীয় দুটি বিষয় অপর মুসলিমদের হেদায়েত ও সংশোধন সম্পর্কিত। [সাদী]
(২) এই সূরার দৃষ্টিতে যে চারটি গুণাবলীর উপস্থিতিতে মানুষ ক্ষতিমুক্ত অবস্থায় থাকতে পারে তন্মধ্যে প্রথম গুণটি হচ্ছে ঈমান। ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে স্বীকৃতি দেয়া। আর শরীয়তের পরিভাষায় এর অর্থ অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকার এবং কাজকর্মে বাস্তবায়ন। [মাজমু ‘ফাতাওয়া ৭/৬৩৮] এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, ঈমান আনা বলতে কিসের ওপর ঈমান আনা বুঝাচ্ছে? এর জবাবে বলা যায়, কুরআন মজীদে একথাটি একবারে সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথমত আল্লাহকে মানা। নিছক তাঁর অস্তিত্ব মেনে নেয়া নয়।
বরং তাকে এমনভাবে মানা যাতে বুঝা যায় যে, তিনি একমাত্র প্রভূ ও ইলাহ। তাঁর সর্বময় কর্তৃত্বে কোন অংশীদার নেই। একমাত্র তিনিই মানুষের ইবাদাত, বন্দেগী ও আনুগত্য লাভের অধিকারী। তিনিই ভাগ্য গড়েন ও ভাঙ্গেন। বান্দার একমাত্র তারই কাছে প্রার্থনা এবং তারই ওপর নির্ভর করা উচিত। তিনিই হুকুম দেন ও তিনিই নিষেধ করেন। তিনি যে কাজের হুকুম দেন তা করা ও যে কাজ থেকে বিরত রাখতে চান তা না করা বান্দার ওপর ফরয। তিনি সবকিছু দেখেন ও শোনেন। মানুষের কোন কাজ তাঁর দৃষ্টির আড়ালে থাকা তো দুরের কথা, যে উদ্দেশ্য ও নিয়তের ভিত্তিতে মানুষ কাজটি করে তাও তাঁর অগোচরে থাকে না।
দ্বিতীয়ত রাসূলকে মানা। তাঁকে আল্লাহর নিযুক্ত পথপ্রদর্শক ও নেতৃত্বদানকারী হিসেবে মানা। তিনি যা কিছু শিক্ষা দিয়েছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে দিয়েছেন, তা সবই সত্য এবং অবশ্যি গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নেয়া। সাথে সাথে এটার স্বীকৃতি দেয়া যে, আল্লাহ তা'আলা যুগে যুগে অনেক রাসূল ও নবী পাঠিয়েছেন। কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নবী ও রাসূল। তার পরে আর কোন নবী বা রাসূল কেউ আসবে না। তৃতীয়ত ফেরেশতাদের উপর ঈমান। চতুর্থত আল্লাহর কিতাবসমমূহের উপর ঈমান, বিশেষ করে পবিত্র কুরআনের উপর ঈমান আনা ও কুরআনের নির্দেশ বাস্তবায়নে সদা সচেষ্ট থাকা। পঞ্চমত আখেরাতকে মানা।
মানুষের এই বর্তমান জীবনটিই প্রথম ও শেষ নয়, বরং মৃত্যুর পর মানুষকে পুনরায় জীবিত হয়ে উঠতে হবে, নিজের এই দুনিয়ার জীবনে সে যা কিছু কাজ করেছে আল্লাহর সামনে তার জবাবদিহি করতে হবে এবং হিসেবা-নিকেশে যেসব লোক সৎ গণ্য হবে তাদেরকে পুরস্কৃত করা হবে এবং যারা অসৎ গণ্য হবে তাদেরকে শাস্তি দেয়া হবে, এই অর্থে আখেরাতকে মেনে নেয়া। ষষ্ঠত তাকদীরের ভাল বা মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত থাকার বিষয়টি মেনে নেয়া। মূলত ঈমানের এই ছয়টি অঙ্গ যে কোন লোকের নৈতিক চরিত্র ও তার জীবনের সমগ্র কর্মকাণ্ডের জন্য অতীব জরুরি। যেখানে ঈমানের অস্তিত্ব নেই সেখানে মানুষের জীবন যতই সৌন্দর্য বিভূষিত হোক না কেন তা আল্লাহ তা'আলার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। [বিস্তারিত দেখুন: ড. আবদুল আযীয আল-কারী; তাফসীর সূরাতিল আসর; ড. সুলাইমান আল-লাহিম, রিবহু আইয়ামিল উমর কী তাদাব্বুরি সূরাতিল আসর]
(৩) ঈমানের পরে মানুষকে ক্ষতি থেকে বাঁচাবার জন্য দ্বিতীয় যে গুণটি অপরিহার্য সেটি হচ্ছে সৎকাজ। কুরআনের পরিভাষায় একে বলা হয় আমাল সালেহা। সমস্ত সৎকাজ এর অন্তর্ভুক্ত। কোন ধরনের সৎকাজ ও সৎবৃত্তি এর বাইরে থাকে না। কিন্তু কুরআনের দৃষ্টিতে যে কাজের মূলে ঈমান নেই এবং যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল প্রদত্ত হেদায়াতের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়নি তা কখনো সৎকাজের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তাই কুরআন মজীদের সর্বত্র সৎকাজের আগে ঈমানের কথা বলা হয়েছে এবং এই সূরায়ও ঈমানের পরেই এর কথা বলা হয়েছে।
(৪) হক শব্দের কয়েকটি অর্থ বর্ণিত হয়েছে। ইবন আব্বাসের মতে, ঈমান ও তাওহীদ [বাগভী; কুরতুবী] কাতাদা বলেন, কুরআন। [কুরতুবী] সুদ্দী বলেন, এখানে হক্ক বলে আল্লাহকেই উদ্দেশ্য নেয়া হয়েছে। [কুরতুবী] কোন কোন মুফাসসিরের মতে, এখানে হক বলে শরী’আত নির্দেশিত কাজগুলো করা এবং শরীআত নিষিদ্ধ কাজগুলো পরিত্যাগ করা বোঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর] কারও কারও মতে, হক বলে এমন কাজ বোঝানো হয়েছে যা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। আর তা হচ্ছে যাবতীয় কল্যাণমূলক কাজ। সেটা তাওহীদ, শরীআতের আনুগত্য, আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ, দুনিয়াবিমুখ ও আখেরাতমুখী হওয়া সবই বোঝায়। [কাশশাফ] বস্তুত: হকের আদেশের প্রতি আসিয়ত করার বিষয়টি ওয়াজিব হক ও নফল হক উভয়টিকেই শামিল করে। [আত-তিবইয়ান ফী আকসামিল কুরআন ৮৩–৮৮]
তাই সার্বিকভাবে আয়াতের অর্থ হচ্ছে: সঠিক, নির্ভুল, সত্য, ন্যায় ও ইনসাফ অনুসারী এবং আকীদা ও ঈমান বা পার্থিব বিষয়াদির সাথে সম্পর্কিত প্রকৃত সত্য অনুসারী কথা বলতে হবে। আর এটা না করলে অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বরং আল্লাহর লা'নতে পতিত হবে। একথাটিই পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, “দাউদ ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের মুখ দিয়ে বনি ইসরাঈলদের ওপর লা'নত করা হয়েছে। কারণ এই যে, তাদের সমাজে গোনাহ ও যুলুম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং লোকেরা পরস্পরকে খারাপ কাজে বাধা দেয়া থেকে বিরত থেকেছিল। [সূরা আল মায়িদাহ: ৭৮–৭৯] আবার একথাটি অন্যত্র এভাবে বলা হয়েছে, “বনী ইসরাঈলরা যখন প্রকাশ্যে শনিবারের বিধান অমান্য করে মাছ ধরতে শুরু করে তখন তাদের ওপর আযাব নাযিল করা হয় এবং সেই আযাব থেকে একমাত্র তাদেরকেই বঁচানো হয় যারা লোকদেরকে এই গোনাহর কাজে বাধা দেবার চেষ্টা করতো। [সূরা আল আরাফ: ১৬৩–১৬৬]
অন্য সূরায় আবার একথাটি এভাবে বলা হয়েছে, “সেই ফিতনাটি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করো যার ক্ষতিকর প্রভাব বিশেষভাবে শুধুমাত্র সেসব লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। যারা তোমাদের মধ্যে গোনাহ করেছে। [সূরা আল-আনফাল: ২৫] সুতরাং এ সূরায় মুসলিমদের প্রতি একটি বড় নির্দেশ এই যে, নিজেদের দ্বীনকে কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারী করে নেয়া যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি, ততটুকুই জরুরি অন্য মুসলিমদেরকেও ঈমান ও সৎকর্মের প্রতি আহবান করার সাধ্যমতো চেষ্টা করা। এ কারণেই কুরআন ও হাদীসে প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি সাধ্যমতো সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ ফরয বা দায়িত্ব ও কর্তব্য গণ্য করা হয়েছে। [দেখুন: সূরা আলে ইমরান: ১০৪] আর সেই উম্মতকে সর্বোত্তম উম্মত বলা হয়েছে, যারা এই দায়িত্ব পালন করে। [দেখুন: সূরা আলে ইমরান ১১০]
(৫) ‘সবর’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিজেকে বাধা দেয়া ও অনুবর্তী করা। এখানে কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক. যাবতীয় গোনাহের কাজ থেকে বেঁচে থাকা। দুই. সৎকাজ করা এবং এর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। তিন. বিপদাপদে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। [মাদারেজুস সালেকীন। ২/১৫৬] সুতরাং সৎকর্ম সম্পাদন, গোনাহ থেকে আত্মরক্ষা এবং এতদসংক্রান্ত বিপদাপদ মোকাবেলা করা সবই ‘সবর’ এর শামিল। সুতরাং আয়াতের অর্থ হচ্ছে, হকের নসিহত করার সাথে সাথে দ্বিতীয় যে জিনিসটি ঈমানদারগণকে ও তাদের সমাজকে ক্ষতি থেকে বাঁচাবে তা হচ্ছে এই যে, এই সমাজের ব্যক্তিবর্গ পরস্পরকে সবর করার উপদেশ দিতে থাকবে। হককে সমর্থন করতে ও তার অনুসারী হতে গিয়ে যেসব সমস্যা ও বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয় এবং এপথে যেসব কষ্ট, পরিশ্রম, বিপদ-আপদ, ক্ষতি ও বঞ্চনা মানুষকে নিরন্তর পীড়িত করে তার মোকাবেলায় তারা পরস্পর অবিচল ও দৃঢ়পদ থাকার উপদেশ দিতে থাকবে। সবরের সাথে এসব কিছু বরদাশত করার জন্য তাদের প্রত্যেক ব্যক্তি অন্যকে সাহস যোগাতে থাকবে। [ড. কারী, তাফসীর সূরাতিল আসর পৃ. ৬২–৬৩]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: ৩। কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে[1] এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয়। [2] আর উপদেশ দেয় ধৈর্য ধারণের। [3]
তাফসীর:
[1] তবে ক্ষতি হতে সেই ব্যক্তিরা নিরাপত্তা লাভ করবে, যারা ঈমান এনে নেক আমল করবে। কেননা, তার পার্থিব জীবন যেমনভাবেই অতিবাহিত হোক না কেন, মৃত্যুর পর সে চিরস্থায়ী নিয়ামত এবং জান্নাতের চিরসুখ লাভ করে ধন্য হবে। পরবর্তীতে মু’মিনদের আরো কিছু গুণ বর্ণনা করা হয়েছে।
[2] অর্থাৎ, তারা একে অপরকে আল্লাহ তাআলার শরীয়তের আনুগত্য করার এবং নিষিদ্ধ বস্তু এবং পাপাচার হতে দূরে থাকার উপদেশ দেয়।
[3] অর্থাৎ, মসীবত ও দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য, শরীয়তের হুকুম-আহকাম ও ফরযসমূহ পালন করতে ধৈর্য, পাপাচার বর্জন করতে ধৈর্য, কামনা-বাসনা ও কুপ্রবৃত্তিকে দমন করতে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়। যদিও ধৈর্যধারণের উপদেশ সত্যের উপদেশেরই অন্তর্ভুক্ত, তবুও তা বিশেষ করে উল্লেখ করা হয়েছে। আর তাতে ধৈর্যধারণ ও তার উপদেশের মর্যাদা, মাহাত্ম্য এবং সুচরিত্রতায় তার পৃথক বৈশিষ্ট্য থাকার কথা সুস্পষ্ট হয়ে যায়।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: নামকরণ ও গুরুত্ব:
العصر শব্দের অর্থ সময়, কাল, যুগ ইত্যাদি। সূূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত العصر শব্দ থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
আব্দুল্লাহ বিন হাফস (রাঃ) বলেন : দুজন সাহাবীর অভ্যাস ছিল যে, যখন তারা পরস্পর সাক্ষাৎ করত তখন একজন এ সূরাটি পড়তেন এবং অপরজন শুনতেন। তারপর সালাম বিনিময় করে বিদায় নিতেন। (বায়হাকী হা. ৯০৫৮, সনদ সহীহ)
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) এ সূরার গুরুত্ব বুঝাতে বলেছেন :
لو ما انزل الله علي الخلق إلا هذه السورة لكقته
সৃষ্টি জীবের জন্য আল্লাহ তা‘আলা এ সূরা ছাড়া অন্য কিছু অবতীর্ণ না করলেও তা যথেষ্ট হত। (ইবনু কাসীর)
ঐতিহাসিকগণ বলেছেন :
আমর ইবনুল আস (রাঃ) মুসলিম হওয়ার পূর্বে একবার ভণ্ডনাবী মুসায়লামা কাযযাবের কাছে গিয়েছিলেন। তখন মুসায়লামা তাকে বলেন : তোমাদের নাবীর ওপর সম্প্রতি কী নাযিল হয়েছে? তিনি বললেন : তাঁর ওপরে অতি সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ একটি সূরা অবতীর্ণ হয়েছে। মুসায়লামা কাযযাব বলল : সেটা কি? তখন আমর ইবনুল আস (রাঃ) তাকে সূরা আছর শুনিয়ে দিলেন। অতঃপর ভণ্ডনাবী মুসায়লামা কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল : আমার কাছেও এরূপ সূরা নাযিল হয়েছে। আমর ইবনুল আ‘স (রাঃ) বললেন : সেটা কী? তখন মুসায়লামা বলল : হে ওয়াবর (বিড়াল জাতীয় ছোট প্রাণী)! তোমার কাছে কেবল দু’টি বড় কান ও সীনা। আর তোমার বাকী সবই ফালতু। অতঃপর মুসায়লামা জিজ্ঞাসা করল : কেমন লাগল? জবাবে আমর ইবনুল আস (রাঃ) বললেন : আল্লাহ তা‘আলার শপথ! তুমি ভালভাবেই জানো যে, আমি জানি তুমি মিথ্যা বলছ। (ইবনু কাসীর)
তাফসীর:
الْعَصْرِ আছর দ্বারা উদ্দেশ্য কী এ নিয়ে মুফাসসিরদের মাঝে কয়েকটি মত পাওয়া যায়। তার মধ্যে অন্যতম হলো :
১. ইমাম বুখারী (রহঃ) বর্ণনা করেন, ইয়াহইয়া বলেন : আছর হলো যুগ আল্লাহ তা‘আলা যুগের শপথ করেছেন। (সহীহ বুখারী)
২. হাসান বাসরী ও কাতাদাহ (রহঃ) বলেন : আসর দ্বারা উদ্দেশ্য : সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে যাওয়া ও অস্ত যাওয়ার মধ্যবর্তী সময় (অর্থাৎ আসরের সময়)।
৩. প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুকাতিল (রহঃ) বলেন : আসর দ্বারা উদ্দেশ্য আছরের সালাত। কেননা এটা এমন একটি সালাত যা সংরক্ষণের ব্যাপারে বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
এ আসরের শপথ করে আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। অর্থাৎ যতক্ষণ মানুষ জীবিত থাকে ততক্ষণ দুনিয়ার পেছনে পড়ে দীন ও আখিরাত সম্পর্কে গাফেল হয়ে নিজেকে জাহান্নামের দিকে ঢেলে দেয়। এ ক্ষতিগ্রস্তের বিভিন্ন স্তর রয়েছে : কেউ সর্বস্ব ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন যার ইহকাল ও আখিরাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার কেউ কোন দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, তাই আল্লাহ তা‘আলা সব মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত বলে সম্বোধন করেছেন, তবে যারা চারটি বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তারা ব্যতীত। (১) যারা প্রকৃত ঈমানদার,
(২) যারা সৎ আমলকারী,
(৩) যারা মানুষকে সত্যের পথে আহ্বান করে,
(৪) দীনের পথে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট ও মসিবতে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়। সু
তরাং যারা এ চারটি বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ তারা দুনিয়া ও আখিরাতের সকল ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে মুক্ত। আমাদের উচিত এ চারটি বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে সকল প্রকার ক্ষতি থেকে মুক্ত হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা অর্জন করা।
সূরা হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সূরাটির গুরুত্ব সম্পর্কে অবগত হলাম।
২. চারটি বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মু’মিন ছাড়া প্রত্যেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত।
৩. মানুষ আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন বস্তুর নামে শপথ করতে পারবে না।
৪. নিজে সৎ আমল করতে হবে, সেই সাথে অন্যদেরও সৎ আমলের দিকে আহ্বান করতে হবে। শুধু নিজে সৎ আমল করব, অন্যকে আহবান করব না তা যেমন অনুচিত তেমনি অন্যকে সৎ আমলের দিকে আহ্বান করব, কিন্তু নিজে করব না তা-ও অনুচিত।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: বর্ণিত আছে যে, হযরত আমর ইবনে আস (রাঃ) মুসলমান হওয়ার পূর্বে একবার মুসাইলামা কাযযাবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। ঐ সময় মুসাইলামা নবুওয়াতের মিথ্যা দাবী করেছিল। হযরত আমর (রাঃ)-কে সে জিজ্ঞাসা করলোঃ “এখন কি তোমাদের রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর কোন অহী অবতীর্ণ হয়েছে?” হযরত আমর (রাঃ) জবাবে বলেনঃ “একটি সংক্ষিপ্ত, অলংকার পূর্ণ সূরা নাযিল হয়েছে।মুসাইলামা জিজ্ঞেস করলোঃ “সেটি কি?” হযরত আমর (রাঃ) তখন (আরবি) সূরাটি পাঠ করে শুনালেন। মুসাইলামা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললোঃ “জেনে রেখো, আমার উপরও এরকম সূরা নাযিল হয়েছে। হযরত আমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “সেটি কি?” সে তখন বললোঃ (আরবি)
তারপর জিজ্ঞেস করলোঃ “হে আমর (রাঃ)! বল, তোমার অভিমত কি?” তখন হযরত আমর (রাঃ) বললেনঃ “তুমি তো নিজেই জান যে, তোমার মিথ্যা ও ভণ্ডামী সম্পর্কে আমি অবহিত রয়েছি।” হলো বিড়ালের মত আকৃতি বিশিষ্ট একটা পশু। তার কান দুটি ও বুক কিছুটা প্রশস্ত ও বড়। দেহের অন্যান্য অংশ খুবই নিকৃষ্ট ও বাজে। ভণ্ড, দুবৃত্ত ও মিথ্যাবাদী মুসাইলামা এ রকম বাজে কথাকে আল্লাহ পাকের পবিত্র কালামের সাথে তুলনা করতে চেয়েছিল। তার এ ধরনের ঘৃণ্য ভণ্ডামী দেখে আরবের মূর্তি পূজকরাও তাকে মিথ্যাবাদী এবং ফালতু বলে সহজেই বুঝে নিয়েছিল।
দু’জন সাহাবীর অভ্যাস ছিল এই যে, যখন তাঁদের পরস্পর সাক্ষাৎ হতো তখন একজন এ সূরাটি পড়তেন এবং অপরজন শুনতেন। তারপর পরস্পর সালাম বিনিময় করে বিদায় নিতেন।
হযরত ইমাম শাফেয়ী (রঃ) বলেন যে, মানুষ যদি এই একটি মাত্র সুরা চিন্তা ভাবনা ও মনোযোগের সাথে পাঠ করে এবং অনুধাবন করে তবে এই একটি সূরাই যথেষ্ট।
১-৩ নং আয়াতের তাফসীর
‘আসর এর অর্থ হলো কাল বা সময়, যেই কাল বা সময়ে মানুষ পাপ পূণ্যের কাজ করে। হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) বলেন যে, আসর এর অর্থ হলো আসরের নামায বা আসরের নামাযের সময়। কিন্তু প্রথমোক্ত উক্তিটিই মাশহুর বা প্রসিদ্ধ। এই কসমের পর আল্লাহ তা'আলা বলছেনঃ নিশ্চয়ই মানুষ অত্যন্ত ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। কিন্তু যারা ঈমান আনে ও ভাল কাজ করে এবং একে অন্যকে সত্যের উপদেশ দেয় অর্থাৎ নিজে সৎকাজ করে ও অন্যকে সৎকাজ করতে উদ্বুদ্ধ করে, আর বিপদে-আপদে নিজে ধৈর্য ধারণ করে ও অন্যকেও ধৈর্য ধারণের উপদেশ দেয়, জনগণ কষ্ট দিলে ক্ষমার মাধ্যমে ধৈর্যের পরিচয় দেয় এবং ভাল কাজের আদেশ ও মন্দ কাজ হতে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে গিয়ে যে বাধাবিঘ্ন ও বিপদের সম্মুখীন হয় তাতেও ধৈর্য ধারণ করে, তারা এই সুস্পষ্ট ক্ষতি থেকে মুক্তি পাওয়ার সৌভাগ্যের অধিকারী।
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।