সূরা আত-তাওবা (আয়াত: 3)
হরকত ছাড়া:
وأذان من الله ورسوله إلى الناس يوم الحج الأكبر أن الله بريء من المشركين ورسوله فإن تبتم فهو خير لكم وإن توليتم فاعلموا أنكم غير معجزي الله وبشر الذين كفروا بعذاب أليم ﴿٣﴾
হরকত সহ:
وَ اَذَانٌ مِّنَ اللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖۤ اِلَی النَّاسِ یَوْمَ الْحَجِّ الْاَکْبَرِ اَنَّ اللّٰهَ بَرِیْٓءٌ مِّنَ الْمُشْرِکِیْنَ ۬ۙ وَ رَسُوْلُهٗ ؕ فَاِنْ تُبْتُمْ فَهُوَ خَیْرٌ لَّکُمْ ۚ وَ اِنْ تَوَلَّیْتُمْ فَاعْلَمُوْۤا اَنَّکُمْ غَیْرُ مُعْجِزِی اللّٰهِ ؕ وَ بَشِّرِ الَّذِیْنَ کَفَرُوْا بِعَذَابٍ اَلِیْمٍ ۙ﴿۳﴾
উচ্চারণ: ওয়া আযা-নুম মিনাল্লা-হি ওয়া রাছূলিহীইলান্না-ছি ইয়াওমাল হাজ্জিল আকবারি আন্নাল্লাহা বারী-উম মিনাল মুশরিকীনা ওয়া রাছূলুহূ ফাইন তুবতুম ফাহুওয়া খাইরুল্লাকুম ওয়া ইন তাওয়াল্লাইতুম ফা‘লামূআন্নাকুম গাইরু মু‘জিযিল্লা-হি ওয়া বাশশিরিল্লাযীনা কাফারূবি‘আযা-বিন আলীম।
আল বায়ান: আর মহান হজ্জের দিন* মানুষের প্রতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে ঘোষণা, নিশ্চয় আল্লাহ মুশরিকদের থেকে দায়মুক্ত এবং তাঁর রাসূলও। অতএব, যদি তোমরা তাওবা কর, তাহলে তা তোমাদের জন্য উত্তম। আর যদি তোমরা ফিরে যাও, তাহলে জেনে রাখ, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না। আর যারা কুফরী করেছে, তাদের তুমি যন্ত্রণাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ৩. আর মহান হজের দিনে(১) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি এটা এক ঘোষণা যে, নিশ্চয় মুশরিকদের সম্পর্কে আল্লাহ দায়মুক্ত এবং তার রাসূলও। অতএব, তোমরা যদি তাওবাহ কর তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর তোমরা যদি মুখ ফিরাও তবে জেনে রাখ যে, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না এবং কাফেরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন।
তাইসীরুল ক্বুরআন: আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ হতে বড় হাজ্জের দিনে মানুষদের কাছে ঘোষণা দেয়া হল যে আল্লাহ মুশরিকদের সাথে সম্পর্কহীন এবং তাঁর রসূলও। কাজেই এখন যদি তোমরা তাওবাহ কর, তাতে তোমাদেরই ভাল হবে, আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে জেনে রেখ যে, তোমরা আল্লাহকে হীন-দুর্বল করতে পারবে না, আর যারা কুফরী করে চলেছে তাদেরকে ভয়াবহ শাস্তির সুসংবাদ শুনিয়ে দাও।
আহসানুল বায়ান: (৩) মহান হজ্জের দিনে[1] আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ হতে মানুষের প্রতি এ এক ঘোষণা যে, আল্লাহর সাথে অংশীবাদীদের কোন সম্পর্ক নেই এবং তাঁর রসূলের সাথেও নয়। যদি তওবা কর, তাহলে তোমাদের কল্যাণ হবে, আর তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে জেনে রাখ যে, তোমরা আল্লাহকে হীনবল করতে পারবে না। আর অবিশ্বাসীদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সুসংবাদ দাও।
মুজিবুর রহমান: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে বড় হাজ্জের তারিখসমূহে জনগণের সামনে ঘোষণা করা হচ্ছে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল উভয়ই এই মুশরিকদের (নিরাপত্তা প্রদান করা) হতে নিঃসম্পর্ক হচ্ছেন; তবে যদি তোমরা তাওবাহ কর তাহলে তা তোমাদের জন্য উত্তম, আর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে জেনে রেখ যে, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবেনা, আর (হে নাবী!) এই কাফিরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।
ফযলুর রহমান: আর মহান হজ্জের দিনে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি একটি ঘোষণা এই যে, আল্লাহ মুশরিকদের ব্যাপারে সবরকমের দায় থেকে মুক্ত এবং তাঁর রসূলও। তবে তোমরা যদি তওবা করো তাহলে সেটা তোমাদের জন্য ভাল। আর যদি (তা থেকে) মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে জেনে রাখবে, তোমরা আল্লাহকে অপারগ করতে পারবে না (তাঁর শাস্তি থেকে পালাতে পারবে না)। আর কাফেরদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তির কথা জানিয়ে দাও।
মুহিউদ্দিন খান: আর মহান হজ্বের দিনে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে লোকদের প্রতি ঘোষণা করে দেয়া হচ্ছে যে, আল্লাহ মুশরেকদের থেকে দায়িত্ব মুক্ত এবং তাঁর রসূলও। অবশ্য যদি তোমরা তওবা কর, তবে তা, তোমাদের জন্যেও কল্যাণকর, আর যদি মুখ ফেরাও, তবে জেনে রেখো, আল্লাহকে তোমরা পরাভূত করতে পারবে না। আর কাফেরদেরকে মর্মান্তিক শাস্তির সুসংবাদ দাও।
জহুরুল হক: আর আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের তরফ থেকে জনগণের প্রতি এই মহান হজের দিনে এ এক ঘোষণা যে আল্লাহ্ মুশরিকদের কাছে দায়মুক্ত, আর তাঁর রসূলও। অতএব তোমরা যদি তওবা করো তবে সেটি হবে তোমাদের জন্য কল্যাণজনক, কিন্তু তোমরা যদি ফিরে যাও তাহলে জেনে রেখো -- তোমরা নিঃসন্দেহ আল্লাহ্র কাছ থেকে ফসকে যাবার পাত্র নও। আর যারা অবিশ্বাস পোষণ করে তাদের মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও, --
Sahih International: And [it is] an announcement from Allah and His Messenger to the people on the day of the greater pilgrimage that Allah is disassociated from the disbelievers, and [so is] His Messenger. So if you repent, that is best for you; but if you turn away - then know that you will not cause failure to Allah. And give tidings to those who disbelieve of a painful punishment.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ৩. আর মহান হজের দিনে(১) আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে মানুষের প্রতি এটা এক ঘোষণা যে, নিশ্চয় মুশরিকদের সম্পর্কে আল্লাহ দায়মুক্ত এবং তার রাসূলও। অতএব, তোমরা যদি তাওবাহ কর তবে তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর তোমরা যদি মুখ ফিরাও তবে জেনে রাখ যে, তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না এবং কাফেরদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন।
তাফসীর:
(১) এখানে মহান হজের দিনে বলতে কি বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে মুফাসসিরগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস, উমর, আবদুল্লাহ ইবন ওমর এবং আবদুল্লাহ ইবন যুবায়ের রাদিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ সাহাবা বলেনঃ এর অর্থ আরাফাতের দিন। [ইবন কাসীর] কারণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে এরশাদ করেছেন “হজ হল আরাফাতের দিন”। [তিরমিযী: ৮৮৯] পক্ষান্তরে আলী, আবদুল্লাহ ইবন আবি আওফা, মুগীরা ইবন শুবাহ, ইবন আব্বাসসহ সাহাবায়ে কিরামের এক বড় দল এবং অনেক মুফাসসির বলেন, এর অর্থ কোরবানীর দিন বা দশই যিলহজ। [ইবন কাসীর] এর সপক্ষে বেশ কিছু সহীহ হাদীস রয়েছে। যেমন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানীর দিন প্রশ্ন করেছিলেন, “এটা কোন দিন? লোকেরা চুপ ছিল এমনকি মনে করেছিল যে, তিনি হয়ত: অন্য কোন নামে এটাকে নাম দিবেন, শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটা কি বড় হজের দিন নয়?” [বুখারী ৪৪০৬; মুসলিম: ১৬৭৯] ইমাম সুফিয়ান সওরী রাহিমাহুল্লাহ এবং অপরাপর ইমামগণ এ সকল উক্তির সমস্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে বলেন, হজের দিনগুলো হজ্জে আকবরের দিন। এতে আরাফাত ও কোরবানীর দিনগুলোও রয়েছে। [ইবন কাসীর]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: (৩) মহান হজ্জের দিনে[1] আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ হতে মানুষের প্রতি এ এক ঘোষণা যে, আল্লাহর সাথে অংশীবাদীদের কোন সম্পর্ক নেই এবং তাঁর রসূলের সাথেও নয়। যদি তওবা কর, তাহলে তোমাদের কল্যাণ হবে, আর তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে জেনে রাখ যে, তোমরা আল্লাহকে হীনবল করতে পারবে না। আর অবিশ্বাসীদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সুসংবাদ দাও।
তাফসীর:
[1] সহীহায়ন (বুখারী, মুসলিম) ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে প্রমাণিত যে, মহান বা বড় হজ্জ বলতে কুরবানীর (১০ই যিলহজ্জ) দিনকে বোঝানো হয়েছে। (বুখারী ৪৬৫৫, মুসলিম ৯৮২, তিরমিযী ৯৫৭নং) এই দিনে মিনাতে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা শুনানো হয়। ১০ই যুলহজ্জকে বড় হজ্জের দিন এই জন্য বলা হয় যে, এই দিনে হজ্জের সব থেকে অধিক ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী আদায় করা হয়ে থাকে। আর সাধারণতঃ লোকেরা উমরাহকে ‘হাজ্জে আসগার’ (ছোট হজ্জ) বলত। এই জন্য উমরাহ থেকে পৃথক করার জন্য হজ্জকে ‘হাজ্জে আকবার’ (বড় হজ্জ) বলা হয়। পক্ষান্তরে জনসাধারণের মাঝে এই কথা প্রসিদ্ধ আছে যে, জুমআর দিনে হজ্জের (আরাফাতের) দিন পড়লে তা বড় হজ্জ (বা আকবরী হজ্জ) হয়। কিন্তু এ কথার কোন দলীল নেই, এ হল ভিত্তিহীন কথা।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: নামকরণ ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা:
মুফাসসিরগণ এ সূরাটির একাধিক নাম বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে দু’টি নাম প্রসিদ্ধ:
১. তাওবাহ: এ সূরাতে কয়েকজন সাহাবীর তাওবাহ কবূলের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, তাই একে তাওবাহ বলা হয়।
২. বারাআহ: একে বারাআহ বলা হয় এজন্য যে, এতে মুশরিকদের সাথে মুসলিমদের সাধারণভাবে বারাআহ বা সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা বলা হয়েছে এবং সূরার প্রথম শব্দটিও বারাআহ।
এটা কুরআন মাজীদের একমাত্র সূরা যার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ নেই। এ ব্যাপারে ইমাম কুরতুবী (রাঃ) পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছেন। তন্মেধ্যে:
ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি উসমান (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কী কারণে সূরা আনফালকে সূরা বারাআহর সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন? (অথচ সূরা আনফাল مثاني তথা একশত এর কম আয়াতবিশিষ্ট সূরা আর বারাআহ একশত এর বেশি আয়াতবিশিষ্ট সূরা) এবং উভয়ের মাঝে বিসমিল্লাহ লেখেননি, অনুরূপ এটাকে সাতটি দীর্ঘ সূরার মধ্যে শামিল করেছেন। উসমান (রাঃ) বলেন: কোন কোন সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ওপর অনেক আয়াতবিশিষ্ট কয়েকটি সূরা অবতীর্ণ হত। যখন আয়াত অবতীর্ণ হত তখন তিনি লেখকদের কাউকে ডেকে বলতেন: এ আয়াতটি উমুক সূরার মধ্যে রেখে দাও যার মধ্যে এরূপ এরূপ বর্ণনা রয়েছে। সূরা আনফাল মদীনায় অবতীর্ণ সূরাগুলোর মধ্যে প্রথম দিকের অন্যতম একটি, আর সূরা বারাআহ সর্বশেষ অবতীর্ণ সূরাসমূহের অন্তর্ভুক্ত। উভয় সূরার ঘটনা সাদৃশ্যপূর্ণ। তাই আমি মনে করেছি সূরা বারাআহ আনফালের অন্তর্ভুক্ত। আর এ অবস্থাতেই নাবী (সাঃ) মারা গেলেন কিন্তু এ সম্পর্কে কিছু বর্ণনা করে যাননি। এ কারণে আমি দুটি সূরাকে মিলিয়ে দিয়েছি; মাঝে বিসমিল্লাহ লেখিনি। আর এটাকে সাতটি দীর্ঘ সূরার মধ্যে শামিল করে দিয়েছি। (তিরমিযী হা: ৩০৮৬, আবূ দাঊদ হা: ৭৮৬, হাকিম: ২/৩৩০, ইমাম হাকিম বলেন: সনদ সহীহ)
ইমাম ইবনু কাসীর (রাঃ) বলেন: এ সূরার প্রথম অংশ ঐ সময় অবতীর্ণ হয় যখন নাবী (সাঃ) তাবূকের যুদ্ধ হতে ফিরে আসছিলেন। তখন হাজ্জের মওসুম ছিল। মুশরিকরা নিজেদের অভ্যাস মত হাজ্জ করতে এসে উলঙ্গ অবস্থায় বায়তুল্লাহর চারদিকে তাওয়াফ করত। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের সাথে মিলিত হতে অপছন্দ করতেন, তাই আবূ বাকর (রাঃ)-কে ঐ বছর হাজ্জের ইমাম বানিয়ে মক্কা অভিমুখে প্রেরণ করেন। মানুষকে হাজ্জের নিয়ম-কানুন শিক্ষা দেয়ার এবং মুশরিকদের মাঝে এ ঘোষণা দেয়ার জন্য যে, এ বছরের পর থেকে কোন মুশরিক হাজ্জ করতে পারবে না। তখন তিনি জনগণের মাঝে সূরা বারাআহ তেলাওয়াত করে শুনালেন। (ইবনে কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
সাহাবী বারা বিন আযেব (রাঃ) বলেন:
أَخِرُ سُوْرَةٍ نَزَلَتْ بَرَاءَةٌ
সূরা বারাআহ সর্বশেষ অবতীর্ণ হওয়া সূরা। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৫৪) যখন সূরা তাওবাহ নাযিল হল তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে চারটি নির্দেশ দিয়ে মক্কায় প্রেরণ করলেন।
১. কেউ উলঙ্গ অবস্থায় কাবা তাওয়াফ করতে পারবে না।
২. এ বছরের পর কোন মুশরিক বাইতুল্লাহর নিকটে আসতে পারবে না।
৩. কোন ব্যক্তি ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাঝে যদি কোন অঙ্গীকার থাকে তাহলে তা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে।
৪. মু’মিন ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
১-৬ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে এটা সেই সকল মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা যাদের সাথে স্থায়ী অথবা চার মাসের কম অথবা চার মাসের বেশি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চুক্তি ছিল। এখন মুশরিকদের থেকে আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সম্পূর্ণ মুক্ত। অতএব হে মুশরিকরা! তোমরা চার মাস (শাওয়াল, যুলকাদা, যুলহাজ্জ ও মুহাররাম) যেথায় ইচ্ছা ঘুরে বেড়াও তাতে মুসলিমদের থেকে পূর্ণ নিরাপদ থাকবে। চার মাস পর কোন অঙ্গীকার থাকবে না, কোন প্রতিশ্র“তিও থাকবে না।
(يَوْمَ الْحَجِّ الْأَكْبَرِ)
‘মহান হাজ্জের দিবসে’ মহান হাজ্জের দিন বলতে দশই যিলহাজ্জকে বুঝানো হয়েছে। এ দিনে মিনাতে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা শুনানো হয়। (সহীহ বুখারী হা: ৪৬৫৫, সহীহ মুসলিম হা: ৯৮২, তিরমিযী হা: ৯৫৭)
দশই যিলহাজ্জকে বড় হাজ্জের দিন বলার কারণ হল, এ দিনে হাজ্জের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী সম্পন্ন করা হয়। মানুষের মাঝে প্রচলন আছে যে, জুমুআর দিন আরাফা হলে ঐ হাজ্জকে বড় হাজ্জ বা হাজ্জে আকবার বলা হয়, এরূপ কথা ভিত্তিহীন। মূলত বড় হাজ্জ দ্বারা হাজ্জকে বুঝানো হয়েছে, যেহেতু উমরাকে ছোট হাজ্জ বলা হয়।
(إِلا الَّذِينَ عَاهَدْتُمْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ)
‘তবে মুশরিকদের মধ্যে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ’ অর্থাৎ পূর্বের বিধান থেকে ঐ সকল মুশরিকরা আলাদা যারা নির্দিষ্ট মেয়াদে চুক্তিবদ্ধ আর তোমাদের সাথে খিয়ানত করেনি এবং তোমাদের বিরুদ্ধে শত্রুদের সহযোগিতাও করেনি। তাহলে তাদের সাথে মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পূর্ণ কর।
(فَإِذَا انْسَلَخَ الْأَشْهُرُ الْحُرُمُ)
‘অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে’এখানে হারাম মাস বলতে কোন্ মাসকে বুঝানো হয়েছে তা নিয়ে একাধিক মত পাওয়া যায়।
আল্লামা সা‘দী (রহঃ) বলেন: যে মাসগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ হারাম। তাহল যুলক্বা‘দাহ, যুলহাজ্জ, মুহাররাম ও রজব। প্রবীণ মুফাসসিরদের মধ্যে ইমাম ইবনু কাসীর (রাঃ)ও এ মত পোষণ করেছেন।
(فَاقْتُلُوا الْمُشْرِكِيْنَ حَيْثُ وَجَدْتُّمُوهُمْ)
‘মুশরিকদেরকে যেখানে পাবে হত্যা কর’অনেকে এ আয়াতকে ব্যাপক বলেছেন। অর্থাৎ যেখানে পাও সেখানেই মুশরিকদেরকে হত্যা কর। কিন্তু মাসজিদে হারামের সীমানায় হত্যা করা নিষেধ এটাই প্রসিদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَاقْتُلُوْهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوْهُمْ وَأَخْرِجُوْهُمْ مِّنْ حَيْثُ أَخْرَجُوْكُمْ وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ ج وَلَا تُقٰتِلُوْهُمْ عِنْدَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتّٰي يُقَاتِلُوْكُمْ فِيْهِ ج فَإِنْ قٰتَلُوْكُمْ فَاقْتُلُوْهُمْ ط كَذٰلِكَ جَزَآءُ الْكٰفِرِيْنَ)
“তাদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর এবং তারা তোমাদেরকে যেখান থেকে বহিষ্কৃত করেছে তোমরাও তাদেরকে সেখান থেকে বের করে দাও, আর হত্যা অপেক্ষা ফেত্না-ফাসাদ (কুফর ও শির্ক) গুরুতর অপরাধ এবং তোমরা তাদের সাথে মাসজিদুল হারামের নিকট যুদ্ধ কর না যে পর্যন্ত না তারা তোমাদের সাথে সেখানে যুদ্ধ করে; কিন্তু যদি তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তবে তোমরাও তাদের সাথে যুদ্ধ কর। কাফিরদের প্রতিফল এরূপই।” (সূরা বাকারাহ ২:১৯১, ইবনে কাসীর, ৪/১২০)
مَرْصَدٍ শত্রুরা যেখানে থাকে তাকে মারসাদ বা ঘাঁটি বলা হয়। অর্থাৎ শত্রুদের প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওৎ পেতে বসে থাক, সুযোগ পেলেই হামলা করবে।
(فَإِنْ تَابُوْا وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ)
‘অতঃপর তারা যদি তাওবাহ করে, সালাত কায়েম করে..’ অর্থাৎ যদি তারা শির্ক বর্জন করে তাওবাহ করতঃ ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। কেননা তখন তারা তোমাদের দীনী ভাই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَإِنْ تَابُوْا وَأَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَاٰتَوُا الزَّكٰوةَ فَإِخْوَانُكُمْ فِي الدِّيْنِ ط وَنُفَصِّلُ الْاٰيٰتِ لِقَوْمٍ يَّعْلَمُوْنَ)
“অতঃপর তারা যদি তাওবাহ করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের দীনী ভাই; জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য আমি নিদর্শন স্পষ্টরূপে বর্ণনা করি।”(সূরা তাওবাহ ৯:১১)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্য কোন মা‘বূদ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর রাসূল- এ সাক্ষ্য দিয়ে সালাত কায়িম করবে, যাকাত দেবে; নচেৎ আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আদিষ্ট হয়েছি। (সহীহ বুখারী হা: ২৫)
(وَإِنْ أَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِيْنَ اسْتَجَارَكَ)
‘মুশরিকদের মধ্যে যদি কেউ তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে’অর্থাৎ যে সকল মুশরিকদেরকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাদের মধ্য হতে কেউ যদি নিরাপত্তা চায় তাহলে তাকে এমনভাবে নিরাপত্তা দাও যেন কুরআন শ্রবণ করতে পারে। আশা করা যায়, সে ঈমান আনবে। যদি কোন পরিবর্তন না হয় তাহলে তাদের বাসস্থানে নিরাপদে পৌঁছে দাও।
সুতরাং যেখানে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল কাফির-মুশরিকদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিয়েছেন সেখানে কোন মু’মিনের সম্পর্ক রাখা ঈমানের পরিচায়ক হতে পারে না। এটা সর্বদা আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তারা কখনো আমাদের জন্য কল্যাণ চায় না, যদিও বাহ্যিক হিতাকাক্সিক্ষতা প্রকাশ করে। তবে তারা যদি তাওবাহ করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় তাহলে তারা তোমাদের দীনী ভাই, তাদের সাথে সম্পর্ক করতে পারবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সাধারণভাবে অমুসলিমদের সাথে কোন মুসলিমের কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে ইসলামের স্বার্থে মুসলিম ও মুশরিকদের মাঝে চুক্তি করা বৈধ।
২. নির্দিষ্ট মেয়াদে সম্পাদিত চুক্তিগুলো যথাযথভাবে পূর্ণ করা আবশ্যক।
৩. দশই যিলহাজ্জকে হাজ্জে আকবার বলা হয়।
৪. কোন ব্যক্তি তাওবাহ করতঃ সালাত কায়েম করলে, যাকাত প্রদান করলে সে মুসলিম ভাই বলে গণ্য হবে।
৫. কোন মুশরিক নিরাপত্তা চাইলে নিরাপত্তা দেয়া যাবে। তবে এমনভাবে নিরাপত্তা দেয়া উচিত যাতে সে ইসলাম সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়, আশা করা যায় এতে সে ইসলাম গ্রহণ করবে।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং এটা হয়েছে আবার বড় হজ্বের দিনে অর্থাৎ কুরবানীর ঈদের দিনে, যা হজ্বের সমস্ত দিন অপেক্ষা বড় ও উত্তম। ঐ ঘোষণা এই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) মুশরিকদের থেকে দায়িত্বমুক্ত, অসন্তুষ্ট ও পৃথক। তবে হে মুশরিকদের দল! এখনও যদি তোমরা পথভ্রষ্টতা, শিক এবং দুষ্কার্য পরিত্যাগ কর তবে তা তোমাদের পক্ষে উত্তম হবে। আর যদি পরিত্যাগ না কর এবং পথভ্রষ্টতার উপরই প্রতিষ্ঠিত থাকো তবে তোমরা আল্লাহর আয়ত্তের বাইরে এখনও নও এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না। আর তোমরা আল্লাহকে অক্ষম করতে পারবে না। তিনি তোমাদের উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান। তিনি কাফিরদেরকে দুনিয়াতেও শাস্তি প্রদান করবেন এবং পরকালেও আযাবে নিপতিত করবেন।
আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ “কুরবানীর দিন (১০ই যিলহজ্ব) আবু বকর (রাঃ) আমাকে লোকদের মধ্যে ঐ কথা প্রচার করতে পাঠালেন যার জন্যে তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন। আমি ঘোষণা করে দিলাম- এই বছরের পর কোন মুশরিক যেন হজ্ব করতে না আসে এবং কেউ যেন উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ না করে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আলী (রাঃ)-কে পাঠান যে, তিনি যেন জনগণের মধ্যে সূরায়ে তাওবাহ প্রচার করে দেন। সুতরাং তিনি মিনায় আমাদের সাথে ঈদের দিন ঐ আহকামই প্রচার করেন। হজ্বে আকবার হচ্ছে বকরা ঈদের দিন। কেননা, জনগণ এটাকে হজ্বে আসগার বলে থাকতো। আবু বকর (রাঃ)-এর এই ঘঘাষণার পর হাজ্বাতুল বিদা বা বিদায় হজ্বে একজনও মুশরিক হজ্ব করতে আসেনি। (এ হাদীসটিকে ইমাম বুখারী (রঃ) কিতাবুল জিহাদের মধ্যে তাখরীজ করেছেন)
হুনাইনের যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) জিরানা থেকে উমরার ইহরাম বেঁধেছিলেন। অতঃপর ঐ বছর তিনি আবু বকর (রাঃ)-কে হজ্বের আমীর নিযুক্ত করে প্রেরণ করেন। আবু বকর (রাঃ) আবূ হুরাইরা (রাঃ)-কে ঘোষণা দেয়ার জন্যে পাঠান। তারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আলী (রাঃ)-কে সূরায়ে বারাআতের প্রচারের জন্যে পাঠিয়ে দেন। আলী (রাঃ)-এর আগমনের পরেও হজ্বের আমীর আবু বকর (রাঃ)-ই থাকেন। কিন্তু এই বর্ণনায় গুরবাত বা দুর্বলতা রয়েছে। কেননা, জিরানা থেকে উমরার ইহরাম বাঁধার বছরে হজের আমীর ছিলেন ইতা ইবনে উসাইদ (রাঃ)। আবূ বকর (রাঃ) তো নবম হিজরীতে হজ্বের আমীর ছিলেন। মুসনাদের রিওয়ায়াতে রয়েছে যে, আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, ঐ বছর আলী (রাঃ)-এর সাথে আমি ছিলাম। আমরা সশব্দে ঘোষণা করতে থাকিঃ “জান্নাতে শুধুমাত্র মুমিনরাই যাবে। আগামী বছর থেকে কোন ব্যক্তি উলঙ্গ হয়ে বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতে পারবে না। যাদের সাথে আমাদের চুক্তি ও সন্ধি রয়েছে তাদের মেয়াদ হচ্ছে আজ থেকে নিয়ে চার মাস পর্যন্ত। এই মেয়াদ অতিক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ) মুশরিকদের থেকে দায়িত্বমুক্ত ও সম্পর্কহীন হয়ে যাবেন। এই বছরের পর থেকে কোন কাফিরের বায়তুল্লাহর হজু করার অনুমতি নেই।” এই ঘোষণা দিতে দিতে আমার কণ্ঠস্বর বসে যায়। আলী (রাঃ)-এর গলা বসে যাওয়ার পর আমি ঘোষণা দিতে শুরু করেছিলাম। আর একটি বর্ণনায় আছে যে, যাদের সাথে চুক্তি রয়েছে তাদের মেয়াদ ওটাই। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেনঃ “আমার তো ভয় হচ্ছে যে, না জানি এ বাক্যটি কোন বর্ণনাকারীর সন্দেহের কারণে হয় তো এসেছে। কেননা, মেয়াদের ব্যাপারে এর বিপরীত বহু রিওয়ায়াত রয়েছে।
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, সূরায়ে বারাআতের ঘোষণার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আবু বকর (রাঃ)-কে প্রেরণ করেন। যখন তিনি যুলহুলাইফা নামক স্থানে। পৌছেন তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এটা প্রচার তো আমি নিজেই করবো অথবা আমার আহলে বায়তের কেউ করবে ।” অতঃপর তিনি আলী (রাঃ)-কে প্রেরণ করেন। (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান গারীব বলেছেন)
আলী (রাঃ) বলেন, সূরায়ে বারাআতের দশটি আয়াত যখন অবতীর্ণ হয় তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) আবূ বকর (রাঃ)-কে ডেকে বলেনঃ “তুমি এগুলো নিয়ে গিয়ে মক্কাবাসীকে শুনিয়ে দাও।” তারপর আমাকে ডেকে তিনি বলেনঃ “তুমি যাও এবং আবু বকর (রাঃ)-এর সাথে মিলিত হও। যেখানে তাকে পাবে সেখানে তার নিকট থেকে কিতাব গ্রহণ করতঃ মক্কা চলে যাবে এবং লোকদেরকে তা পড়ে শুনাবে।” আমি রওয়ানা হলাম এবং ‘জুহফা নামক স্থানে আবু বকর (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করলাম। তাঁর নিকট থেকে আমি কিতাব নিয়ে নিলাম আর তিনি ফিরে গেলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আমার ব্যাপারে কোন আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ না, জিবরাঈল (আঃ) আমার কাছে এসে বলেছেন- “এ পয়গাম হয় আপনি নিজেই প্রচার করুন, না হয় আপনার আহলে বায়তের কোন লোককে তা প্রচার করতে বলুন।” এই সনদে দুর্বলতা রয়েছে। আর এর দ্বারা এটাও উদ্দেশ্য নয় যে, আবু বকর (রাঃ) তখনই ফিরে এসেছিলেন। বরং তাঁর নেতৃত্বেই ঐ হজ্ব পালিত হয়। হজ্ব পর্ব সমাপ্ত করে তিনি ফিরে আসেন। যেমন অন্যান্য রিওয়ায়াতে পরিষ্কারভাবে এটা বর্ণিত আছে। এক হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) যখন আলী (রাঃ)-কে এটা প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করেন তখন তিনি ওযর পেশ করে বলেনঃ “আমি বয়সের দিক থেকে এবং ভাষণ দেয়ার দিক দিয়ে নিজের মধ্যে ঘাটতি অনুভব করছি।” তাঁর এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “কিন্তু প্রয়োজন এটাই যে, হয় আমি নিজেই এটা প্রচার করবো, না হয় তুমি করবে।” তখন আলী (রাঃ) বলেনঃ “তা হলে ঠিক আছে, আমিই যাচ্ছি।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বললেনঃ “যাও, আল্লাহ তোমার ভাষা ঠিক রাখুন এবং অন্তরে হিদায়াত দান করুন!” তারপর তিনি স্বীয় হস্ত মুবারক তাঁর মুখের উপর রাখলেন। জনগণ আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আপনাকে আবু বকর (রাঃ)-এর কি কথা প্রচারের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছিলেন?” তিনি তখন উপরের চারটি বিষয়ের কথা বললেন। মুসনাদে আহমাদ ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে কয়েকটি পন্থায় এটা এসেছে। তাতে রয়েছে- “যাদের সাথে চুক্তি রয়েছে, তাদের চুক্তি মেয়াদ পর্যন্তই বলবৎ থাকবে।” অন্য হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে জনগণ বলেছিলেনঃ “আপনি এই হজ্বে আবু বকর (রাঃ)-কে আমীর করে পাঠিয়েছেন, তাঁকেই এই প্রচারের দায়িত্ব দিলেও তো চলতো!” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এটা হয় আমাকেই প্রচার করতে হবে, না হয় আমার আহলে বায়তের কাউকে করতে হবে।” আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ‘আযবা' নামী উস্ত্রীর উপর সওয়ার হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে পথে দেখে আবু বকর (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “আপনি কি সরদার নিযুক্ত হয়ে এসেছেন, না অধীনস্থ হিসেবে?” আলী (রাঃ) উত্তরে বলেনঃ “না, বরং আমি অধীনস্থ হিসেবেই এসেছি। সেখানে পৌছে আবু বকর (রাঃ) হজ্বের ব্যবস্থাপনায় লেগে পড়েন এবং ঈদের দিন (১০ই যিলহজ্ব) আলী (রাঃ) জনগণকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর এই আহকাম জানিয়ে দেন। অতঃপর তারা উভয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট ফিরে আসেন। মুশরিকদের মধ্যে যাদের সাথে যতদিনের চুক্তি ছিল তা ঠিকই থাকলো। অন্য রিওয়ায়াতে আছে যে, আলী (রাঃ) বলেনঃ “রাসূলুল্লাহ (সঃ) আবু বকর (রাঃ)-কে হজ্বের আমীর নিযুক্ত করে পাঠান এবং পরে আমাকে সূরায়ে বারাআতের চল্লিশটি আয়াতসহ তাঁর কাছে প্রেরণ করেন। আবু বকর (রাঃ) আরাফার দিন (৯ই যিলহজ্ব) আরাফার মাঠে জনগণের সামনে ভাষণ দেন। অতঃপর আমাকে বলেন, উঠুন এবং জনগণকে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পয়গাম শুনিয়ে দিন! আমি তখন দাঁড়িয়ে ঐ চল্লিশটি আয়াত পাঠ করি। তারপর মিনায় গিয়ে জামরার উপর কংকর নিক্ষেপ করি এবং কুরবানী করে মাথা মুণ্ডন করি। তারপর আমি অবগত হই যে, ভাষণের সময় সবাই উপস্থিত ছিলেন না। তাই আমি ডেরায় ডেরায় এবং তাঁবুতে তাঁবুতে গিয়ে ঘোষণা করতে থাকি। আমার ধারণা এই যে, সম্ভবতঃ এ কারণেই সাধারণ মানুষ এটাকে ১০ই যিলহজ্বের ঘটনা মনে করেছে অথচ আসল পয়গাম আরাফার দিন অর্থাৎ ৯ই যিলহজ্ব তারিখেই পৌঁছিয়ে দেয়া হয়েছিল।”
আবু ইসহাক (রঃ) বলেনঃ “আমি আবু হুজাইফা (রঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, হজ্বে আকবার কোন দিন? তিনি উত্তরে বলেনঃ ‘আরাফার দিন। আমি পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এটা নিজের পক্ষ থেকে বলেছেন, না সাহাবীদের কাছ থেকে শুনেছেন? তিনি জবাব দিলেনঃ সব কিছু এটাই বটে। আতাও (রঃ) এটাই বলেন। উমার (রাঃ) একথাই বলার পর বলেনঃ “সুতরাং এই দিনে কেউ যেন রোযা না রাখে ।” বর্ণনাকারী বলেন, আমি আমার পিতার পরে হজ্ব করেছি। মদীনায় পৌঁছে আমি জনগণকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে আজকাল সর্বাপেক্ষা উত্তম কে? তারা উত্তরে সাঈদ ইবনে মুসাইয়াব (রাঃ)-এর নাম বললেন। আমি তখন তাঁর খিদমতে হাযির হয়ে তাকে বললাম, আমি মদীনাবাসীকে এখানকার সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তাঁরা আপনারই নাম বললেন। তাই আমি আপনার নিকট এসেছি। আচ্ছা বলুন তো, আরাফার দিনে রোযা রাখা সম্পর্কে আপনার মতামত কি? তিনি উত্তরে বললেনঃ “আপনাকে আমি আমার চেয়ে একশগুণ বেশী উত্তম ব্যক্তির নাম বলছি এবং তিনি হচ্ছেন উমার (রাঃ)। তিনি এই দিনে রোযা রাখতে নিষেধ করতেন এবং এই দিনকেই তিনি হজ্বে আকবার' বলতেন।” (এটা ইবনে জারীর (রঃ) ও ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে ইবনে আব্বাস (রাঃ), আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাঃ), মুজাহিদ (রঃ), ইকরামা (রঃ) এবং তাউস (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তারা আরাফার দিনকে হজ্বে আকবারের দিন বলেছেন) একটি মুরসাল হাদীসেও রয়েছে যে, আরাফার দিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভাষণ দেন এবং বলেনঃ “এটা হজ্বে আকবারের দিন।”
দ্বিতীয় উক্তি এই যে, এর দ্বারা করা ঈদের দিনকে বুঝানো হয়েছে। আলী (রাঃ) এ কথাই বলেছেন। একবার ঈদুল আযহার দিন তিনি তাঁর সাদা খচ্চরের উপর সওয়ার হয়ে যাচ্ছিলেন, এমন সময় একটি লোক এসে তাঁর খচ্চরের লাগাম ধরে নেন এবং হজ্বে আকবার কোন দিন তা জিজ্ঞেস করেন। তিনি উত্তরে বলেনঃ “আজকের দিনটিই হচ্ছে হজ্বে আকবারের দিন। সুতরাং লাগাম ছেড়ে দাও। আবদুল্লাহ ইবনে আওফার (রাঃ) এটাই উক্তি। মুগীরা ইবনে শু’বা (রাঃ) তাঁর ঈদের ভাষণে বলেনঃ “আজকের দিনটি হচ্ছে আযহার দিন, আজই হচ্ছে কুরবানীর এবং আজকের দিনটিই হচ্ছে হজ্বে আকবারের দিন।” ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে। আরো বহু গুরুজন এটাই সাব্যস্ত করেছেন যে, হজ্বে আকবার হচ্ছে ঈদুল আযহার দিন। ইমাম ইবনে জারীরেরও (রঃ) পছন্দনীয় উক্তি এটাই। সহীহ বুখারীর উদ্ধৃতি দিয়ে পূর্বেই হাদীস বর্ণিত হয়েছে যে, আবু বকর (রাঃ) ঈদের দিন মিনায় ঘোষণাকারীকে ঘোষণার জন্যে পাঠিয়েছিলেন। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বিদায় হজ্বে ১০ই যিলহজ্ব তারিখে জামরাতের নিকটে দাঁড়িয়ে বলেনঃ “আজকের দিনই হচ্ছে হজ্বে আকবারের দিন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে যে, তার উম্ভীটি ছিল লাল রং এর । তিনি জনগণকে জিজ্ঞেস করেনঃ “আজকে কোন দিন তা জান কি?” জনগণ উত্তরে বলেনঃ “আজকে কুরবানীর দিন।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বলেনঃ “তোমরা সত্য কথাই বলেছো। আজকের দিনটিই হচ্ছে হজ্বে আকবারের দিন।” অন্য একটি রিওয়ায়াতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) উষ্ট্রীর উপর সওয়ার ছিলেন। জনগণ ওর লাগাম ধরেছিল। তিনি সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “আজকে কোন্ দিন তা জান কি?` (বর্ণনাকারী বলেনঃ) আমরা এই ধারণায় নীরব থাকলাম যে, সম্ভবতঃ তিনি এই দিনের অন্য কোন নাম বলবেনঃ “এটা হজ্বে আকবারের দিন নয় কি?” অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, জনগণ তাঁর প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেনঃ “এটা হচ্ছে হজ্বে আকবারের দিন।”
সাঈদ ইবন মুসাইয়াব (রাঃ) বলেন যে, হজ্বে আকবারের দিন হচ্ছে ঈদের দিনের পরের দিন। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, হজ্বের সমস্ত দিনেরই নাম এটাই । সুফিয়ানও (রঃ) এ কথাই বলেন। যেমন ইয়াওমে জামাল' (উষ্ট্রের যুদ্ধের দিন) এবং 'ইয়াওমে সিফফীন’ (সিফফীনের যুদ্ধের দিন) ঐ যুদ্ধগুলোর সমস্ত দিনেরই নাম। অনুরূপভাবে এটাও তাই। হাসান বসরী (রঃ)-কে এই সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তরে বলেনঃ “তোমাদের এটা জেনে লাভ কি? এটা তো ছিল ঐ বছর যে বছর আবু বকর (রাঃ) হজ্বে আমীর নিযুক্ত হয়েছিলেন।” ইবনে সীরীন (রঃ) এই প্রশ্নের উত্তরে বলেনঃ “এটা ছিল ঐ দিন যেই দিন রাসূলুল্লাহ (সঃ) ও সাধারণ লোকদের হজ্ব পালিত হয়েছিল।`
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।