আল কুরআন


সূরা আল-ফাজর (আয়াত: 12)

সূরা আল-ফাজর (আয়াত: 12)



হরকত ছাড়া:

فأكثروا فيها الفساد ﴿١٢﴾




হরকত সহ:

فَاَکْثَرُوْا فِیْهَا الْفَسَادَ ﴿۪ۙ۱۲﴾




উচ্চারণ: ফাআকছারূ ফীহাল ফাছা-দ।




আল বায়ান: অতঃপর তারা সেখানে বিপর্যয় বাড়িয়ে দিয়েছিল।




আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ১২. অতঃপর সেখানে অশান্তি বৃদ্ধি করেছিল।




তাইসীরুল ক্বুরআন: আর সেখানে বহু বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল।




আহসানুল বায়ান: ১২। অনন্তর সেখানে তারা বিপর্যয় বৃদ্ধি করেছিল।



মুজিবুর রহমান: অতঃপর সেখানে তারা বহু বিপ্লব (সংঘটিত) করেছিল।



ফযলুর রহমান: এবং সেখানে অনেক অশান্তি সৃষ্টি করেছিল?



মুহিউদ্দিন খান: অতঃপর সেখানে বিস্তর অশান্তি সৃষ্টি করেছিল।



জহুরুল হক: আর সেখানে অশান্তি বাড়িয়ে দিয়েছিল?



Sahih International: And increased therein the corruption.



তাফসীরে যাকারিয়া

অনুবাদ: ১২. অতঃপর সেখানে অশান্তি বৃদ্ধি করেছিল।


তাফসীর:

-


তাফসীরে আহসানুল বায়ান

অনুবাদ: ১২। অনন্তর সেখানে তারা বিপর্যয় বৃদ্ধি করেছিল।


তাফসীর:

-


তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ


তাফসীর: নামকরণ:



الْفَجْرِ ফজর বলতে ফজরের সময়কে বুঝানো হয়েছে। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত الْفَجْرِ শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সূরার গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্বের সূরাগুলোতে একাধিকবার আলোচনা করা হয়েছে।



সূরাতে কয়েকটি বিষয় আলোচনা স্থান পেয়েছেন যেমন সূরার শুরুতে কয়েকটি বিষয়ের শপথ করা হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে, কাউকে সম্পদ দেয়া আর না দেয়া, সম্মান-অসম্মানের বিষয় নয় বরং যদি আল্লাহ তা‘আলা কাউকে ঈমান ও সৎআমলের তাওফীক দান করেন সেটাই প্রকৃত সম্মান। তারপর অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিদের চারটি মন্দ আচরণের কথা বর্ণনা করা হয়েছে, সর্বশেষে আল্লাহ তা‘আলার প্রিয় বান্দাদের পুরস্কার জান্নাতে সসম্মানে প্রবেশের কথা বলা হয়েছে।



১-১৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর:



সূরার শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের শপথ করার পর পূর্ববর্তী কয়েকজন নাবীর জাতির আলোচনা নিয়ে এসেছেন, যারা ঈমান বর্জন করত জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করেছিল ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে শাস্তি দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।



الْفَجْرِ ফজর রাতের বিদায় ও দিনের আগমনের মাঝে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। কেউ বলেছেন : এখানে ফজর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো يوم النحر বা যিলহাজ্জের ১০ তারিখের কুরবানী দিনের ফজর। আবার কেউ বলেছেন : এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, ফজরের সালাত ইত্যাদি। তবে সঠিক কথা হলো এর দ্বারা প্রতি দিনের সাধারণ ফজরকে বুঝানো হয়েছে। কোন নির্দিষ্ট দিনের ফজর উদ্দেশ্য নয়। (তাফসীর মুয়াসসার)



(وَلَيَالٍ عَشْرٍ)



দশ রাত দ্বারা দু’টি উদ্দেশ্য হতে পারে।



১. যিলহাজ্জের প্রথম দশ রাত-দিন। হাদীসে এসেছে, নাবী (সাঃ) বলেন : যিলহাজ্জের প্রথম দশ দিনের কৃত আমলের চেয়ে আল্লাহ তা‘আলার নিকট অধিক পছন্দনীয় আর কোন আমল নেই। সাহাবীরা বললেন : আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদও না? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদও না, তবে ঐ ব্যক্তি ব্যতীত, যে তার জান মাল নিয়ে বের হয়ে গেছে আর ফিরে আসতে পারেনি। (সহীহ বুখারী হা. ৯৬৯)



২. রমযানের শেষ দশ রাত। এ রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর বা কদরের রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। তবে অধিকাংশ আলেমগণ প্রথম মতটাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।



(وَّالشَّفْعِ وَالْوَتْرِ)



এখানে জোড় ও বেজোড় দ্বারা কী উদ্দেশ্য এ নিয়ে অনেক মতামত তাফসীর গ্রন্থে পাওয়া যায়। ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) এ ব্যাপারে সাতটি মত বর্ণনা করেছেন। এ সকল মতামত পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় এর দ্বারা নির্দিষ্ট কোন কিছু বুঝানো হয়নি। বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো জোড় ও বেজোড় সংখ্যা এবং জোড় ও বেজোড় সংখ্যক বস্তু। (আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন)



(وَاللَّيْلِ إِذَا يَسْرِ)



অর্থাৎ রাত যখন আগত হয় এবং যখন বিদায় নেয়। কেননা يسير শব্দটি আসা ও যাওয়া উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয়।



(قَسَمٌ لِّذِيْ حِجْرٍ)



অর্থাৎ পূর্বে উল্লিখিত শপথসমূহ কি জ্ঞানীদের জন্য مقنع বা উপকার নেই। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আছে।





(لِّذِيْ حِجْرٍ) অর্থ :



لِّذِيْ عقل ولب



বা জ্ঞানী, বুদ্ধিমান। حِجْرٍ শব্দের শাব্দিক অর্থ : বাধা দেয়া, বারণ করা। জ্ঞানীদেরকে حِجْرٍ বলার কারণ হলো : জ্ঞান মানুষকে এমন কথা ও কাজ থেকে বিরত রাখে বা বাধা প্রদান করে যা তার জন্য উপযোগী নয়। এখান থেকেই বলা হয় حجر البيت বা বাইতুল্লাহর প্রতিবন্ধক। কেননা তা তওয়াফকারীদেরকে শামী দেয়ালের সাথে লেপটে থাকা থেকে বাধা দেয়। (ইবনু কাসীর)



(أَلَمْ تَرَ كَيْفَ..... الْبِلَادِ)

অর্থাৎ যখন আদ জাতি তাদের নিকট প্রেরিত রাসূল হূদ (আঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল, তাঁর আনুগত্য বর্জন করল, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে আযাব দ্বারা গ্রাস করলেন। যেমন সূরা হাক্কাতে আলোচনা করা হয়েছে।



(إِرَمَ ذَاتِ الْعِمَادِ) ارم-



‘ইরাম’ একটি গোত্রের নাম। আবার বলা হয় إِرَمَ আদ জাতির পিতামহের নাম। যেমন তাদের বংশ তালিকা হলো ‘আদ বিন আউস বিন ইরাম বিন সাম বিন নূহ। عاد দ্বারা উদ্দেশ্য হলো প্রথম আদ বা তাদের সন্তানরা। (ফাতহুল কাদীর)



(ذَاتِ الْعِمَادِ)



(স্তম্ভ ওয়ালা) বলে তাদের ক্ষমতা, শক্তি, সামর্থ্য ও দৈহিক দীর্ঘতার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাছাড়া তারা অট্টালিকা নির্মাণেও খুব দক্ষ কারিগর ছিল। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: তারা সে সময় উঁচু উঁচু প্রাসাদসমূহে বসবাস করত এবং দৈহিক আকৃতি ও বস্তুগত ক্ষমতায় ছিল সে যুগের সেরা শক্তিশালী জাতি। হূদ (আঃ) তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিলে তারা তা প্রত্যাখ্যান করল এবং তারা হঠকারিতা করল ও বাপ-দাদার আমল থেকে ফিরে না আসার দোহাই দিয়ে শির্কের ওপর অটল রইল। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দিলেন।



(لَمْ يُخْلَقْ مِثْلُهَا فِي الْبِلَادِ)



অর্থাৎ তৎকালীন সময়ে তাদের মত শক্তিশালী আর কোন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়নি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:



(وَاذْکُرُوْٓا اِذْ جَعَلَکُمْ خُلَفَا۬ئَ مِنْۭ بَعْدِ قَوْمِ نُوْحٍ وَّزَادَکُمْ فِی الْخَلْقِ بَصْۜطَةًﺆ فَاذْکُرُوْٓا اٰلَا۬ئَ اللہِ لَعَلَّکُمْ تُفْلِحُوْنَ)



“এবং স্মরণ কর! ‘আল্লাহ তোমাদেরকে নূহের সম্প্রদায়ের পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তোমাদের দৈহিক গঠনে অধিকতর হৃষ্টপুষ্ট-বলিষ্ঠ করেছেন। সুতরাং তোমরা ‘আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর! হয়ত তোমরা সফলকাম হবে।’ (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৬৯)



তাই তারা গর্ব করে বলত :



(فَأَمَّا عَادٌ فَاسْتَكْبَرُوْا فِي الْأَرْضِ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَقَالُوْا مَنْ أَشَدُّ مِنَّا قُوَّةً)



“আর ‘আদ সম্প্রদায়ের ব্যাপার এই যে, তারা পৃথিবীতে অযথা দম্ভ করত এবং বলত: আমাদের অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী কে আছে?” (সূরা হা-মীম সাজদাহ ৪১: ১৫) তাদের অহংকার ও হঠকারীতার শাস্তি স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতি প্রবল বায়ু প্রেরণ করলেন। যা আট দিন ও সাত রাত স্থায়ী ছিল এবং সব কিছু সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:



(وَأَمَّا عَادٌ فَأُهْلِكُوْا بِرِيْحٍ صَرْصَرٍ عٰتِيَةٍ سَخَّرَهَا عَلَيْهِمْ سَبْعَ لَيَالٍ وَّثَمٰنِيَةَ أَيَّامٍ لا حُسُوْمًا فَتَرَي الْقَوْمَ فِيْهَا صَرْعٰي كَأَنَّهُمْ أَعْجَازُ نَخْلٍ خَاوِيَةٍ)



“আর ‘আদ সম্প্রদায়, তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় দ্বারা। যা তিনি তাদের ওপর প্রবাহিত করেছিলেন বিরামহীনভাবে সাত রাত ও আট দিন, তুমি (উপস্থিত থাকলে) সেই সম্প্রদায়কে দেখতে খেজুর কাণ্ডের ন্যায় সেখানে ছিন্ন ভিন্নভাবে পড়ে আছে।” (সূরা হাক্কাহ ৬৯: ৬-৮)



এ আয়াতের তাফসীরে ইমাম কুরতুবী সনদবিহীন একটি বর্ণনা নিয়ে এসেছেন যে, আদ এর দুই পুত্র ছিল, একজন শাদ্দাদ ও অপর জন শাদীদ। শাদীদের মৃত্যুর পর শাদ্দাদ রাজত্বের মালিক হয়। সে নয়শ বছর জীবিত ছিল। জান্নাতের কথা শুনে সে আদনের মরুভূমিতে তিনশ বছর ধরে বিশাল শহর নির্মাণ করে ও তাকে জান্নাত নামে নামকরণ করে। সেখানে সোনা-রূপা ও মনি মুক্তা ইত্যাদি দিয়ে বড় বড় অট্টালিকা তৈরি করে ও বিভিন্ন জাতের বৃক্ষ রোপণ করে। নির্মাণ শেষ হলে শাদ্দাদ তার দলবল নিয়ে সেখানে পৌঁছার একদিন ও একরাতের পথ বাকী থাকতেই এক ভীষণ আসমানী বজ্রধ্বনি এসে সব ধ্বংস করে দেয়। (তাফসীর কুরতুবী) তবে ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) এ সম্পর্কে বলেন : এসবই ইসরাঈলী বর্ণনা যা তাদের কতক নাস্তিকগণ তৈরি করেছে, এর দ্বারা মূর্খ লোকদের জ্ঞানের পরিধি জানার জন্য। যাতে তারা তাদের সবকিছুকে বিশ্বাস করে নেয়। (ইবনু কাসীর) সুতরাং এসব কাহিনী মিথ্যা বানোয়াট এবং এর উদ্দেশ্য মানুষকে ধোঁকায় নিপতিত করা ছাড়া কিছুই নয়।



(وَثَمُوْدَ الَّذِيْنَ جَابُوا الصَّخْرَ)



অর্থাৎ সামূদ জাতি যাদের নিকট সালেহ (আঃ)-কে প্রেরণ করা হয়েছিল, তারাও যখন নাবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতঃ আনুগত্য বর্জন করল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করলেন। এরা এতো শক্তিশালী ছিল যে, তারা পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ করত। তারপরেও তারা আল্লাহ তা‘আলার আযাব থেকে রেহাই পায়নি। এ সম্পর্কে সূরা শুয়ারার ১৪৯ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।





(وَفِرْعَوْنَ ذِي الْأَوْتَادِ)



অর্থাৎ ফির‘আউনকেও আল্লাহ তা‘আলা ধ্বংস করেছেন, যে অনেক সৈন্যের মালিক ছিল এবং বিশাল রাজত্বের অধিপতি ছিল। যখন সে কুফরী এবং নাবী ও ঈমানদারদের হত্যা করার চেষ্টা করে ও জমিনে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিল তখন সে তার এ বিশাল রাজত্ব ও সৈন্য বাহিনী আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারেনি। صَبَّ অর্থ ঢেলে দেয়া, سَوْطَ অর্থ চাবুক দিয়ে মারা। অর্থাৎ তাদের ওপর আযাব ঢেলে দেয়া হয়েছিল।



(إِنَّ رَبَّكَ لَبِالْمِرْصَادِ)



অর্থাৎ যে অপরাধ করে তাকে আল্লাহ তা‘আলা কিছু সময়ের অবকাশ দেন, তারপর কঠিনভাবে পাকড়াও করেন। যুগে যুগে যারা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে জমিনে ফাসাদ সৃষ্টি করেছে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করেছেন। তাদের থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করে সতর্ক হওয়া উচিত।



আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:



১. পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা যেকোন সৃষ্টির নামে শপথ করতে পারেন; কিন্তু মানুষ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার নাম ছাড়া অন্য কোন কিছুর নামে শপথ করতে পারবে না।

২. আল্লাহ তা‘আলা যে জিনিসের শপথ করেন তার গুরুত্ব অপরিসীম।

৩. যিলহাজ্জের প্রথম দশ দিনের ফযীলত জানতে পারলাম।

৪. পূর্ববর্তী অবাধ্য জাতির ঘটনা বর্ণনা করে আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন যে, নাবীদের আনুগত্য বর্জন করলে শাস্তি দ্বারা পাকড়াও করা হবে।


তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)


তাফসীর: সুনানে নাসাঈতে হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত মুআয (রাঃ) নামায পড়াচ্ছিলেন, একটি লোক এসে ঐ নামাযে শামিল হয়। হযরত মুআয (রাঃ) নামাযে কিরআত লম্বা করেন। তখন ঐ আগন্তুক জামাআত ছেড়ে দিয়ে মসজিদের এক কোণে গিয়ে একাকী নামায আদায় করে চলে যায়। হযরত মুআয (রাঃ) এ ঘটনা জেনে ফেলেন এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে অভিযোগের আকারে এ ঘটনা বিবৃত করেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন ঐ লোকটিকে ডেকে নিয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি এছাড়া কি করবো? আমি তার পিছনে নামায শুরু করেছিলাম, আর তিনি শুরু করেছিলেন লম্বা সূরা। তখন আমি জামাআত ছেড়ে দিয়ে মসজিদের এক কোণে একাকী নামায আদায় করে নিয়েছিলাম। অতঃপর মসজিদ হতে বের হয়ে এসে আমার উন্ত্রীকে ভূষি দিয়েছিলাম। তার এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত মুআয (রাঃ)-কে বলেন যে, হে মুআয (রাঃ)! তুমি তো জনগণকে ফিত্নার মধ্যে নিক্ষেপকারী। তুমি কি (আরবি) এবং (আরবি) এই সূরাগুলো পড়তে পার না?”

১-১৪ নং আয়াতের তাফসীর

এটা সর্বজন বিদিত যে, ফজরের অর্থ হলো সকাল বেলা। হযরত আলী (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) এবং হযরত সুদ্দীর (রঃ) এটা উক্তি। হযরত মাসরুক (রঃ) এবং হযরত মুহাম্মদ ইবনে কাব (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা বিশেষভাবে ঈদুল আযহার সকালবেলাকে বুঝানো হয়েছে। আর ওটা হলো দশ রাত্রির সমাপ্তি। কারো কারো মতে এর অর্থ হলো সকাল বেলার নামায। আবার কেউ কেউ বলেছেন যে, এর দ্বারা পুরো দিনকেই বুঝানো হয়েছে।

দশ রজনী দ্বারা যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ রাত্রিকে বুঝানো হয়েছে, যেমন এ কথা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত ইবনে যুবায়ের (রাঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) এবং পূর্ব ও পর যুগীয় আরো বহু গুরুজন বলেছেন। সহীহ বুখারীতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে মারফুরূপে বর্ণিত আছেঃ “কোন ইবাদতই এই দশ দিনের ইবাদত হতে উত্তম নয়।” রাসূলুল্লাহকে (সঃ) জিজ্ঞেস করা হলোঃ “আল্লাহর পথে জিহাদও কি নয়?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “না, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে হ্যা, যে ব্যক্তি নিজের জান-মাল নিয়ে বেরিয়েছে, তারপর ওগুলোর কিছুই নিয়ে ফিরেনি (তার কথা স্বতন্ত্র)।” কেউ কেউ বলেছেন, যে, এর দ্বারা মুহররমের প্রথম দশদিনকে বুঝানো হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো রমযান মাসের প্রথম দশ দিন। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই সঠিকতম। অর্থাৎ যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশদিন।

মুসনাদে আহমদে হযরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ (আরবি) হলো ঈদুল আযহার দিন, (আরবি) হলো আরাফার দিন এবং (আরবি) হলো কুরবানীর দিন।” এ হাদীসের সনদে কোন প্রকার গরমিল নেই। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

(আরবি) হলো আরাফার দিন। এটা যদি নবম তারিখ হয়ে থাকে তাহলে (আরবি)শব্দের অর্থ হবে দশম তারিখ অর্থাৎ ঈদুল আযহার দিন।

হযরত ওয়াসিল ইবনে সায়েব (রঃ) হযরত আতা (রঃ) কে জিজ্ঞেস করেনঃ (আরবি) দ্বারা কি বিতরের নামায উদ্দেশ্য?` উত্তরে তিনি বলেনঃ “না, বরং হলো আরাফার দিন এবং হলো ঈদুল আযহার রাত।”

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ) খুৎবাহ্ দিচ্ছিলেন, এমন সময় একটি লোক দাঁড়িয়ে বললোঃ “হে আমীরুল মুমিনীন! (আরবি) কি এবং (আরবি) কি?` তিনি জবাবে বললেনঃ “আল্লাহ তা'আলা যে বলেছেনঃ (আরবি) (২:২০৩) এখানে দুই দিন দ্বারা (আরবি) এবং(আরবি) এখানে একদিন দ্বারা কে বুঝানো হয়েছে।” তিনি আরো বলেছেন যে, (১১ই, ১২ই ও ১৩ই যিলহজ্জ) এর মাঝামাঝি দিন হলো (আরবি) এবং (আরবি) হলো শেষ দিন।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা'আলার নিরানব্বইটি নাম রয়েছে। যে ব্যক্তি এই নামগুলো মুখস্থ করে নিবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তিনি (আল্লাহ) বেতর বা বেজোড় এবং তিনি বেতরকে ভালবাসেন।`

হযরত হাসান বসরী (রঃ) এবং হযরত ইবনে আসলাম (রাঃ) বলেন যে, এর অর্থ হলো সমস্ত সৃষ্টি জগত। এর মধ্যে (আরবি) রয়েছে এবং (আরবি) রয়েছে। আবার এটাও বলা হয়েছে যে, (আরবি) হলো ফজরের নামায এবং (আরবি) হলো মাগরিবের নামায। এটাও উল্লিখিত হয়েছে যে, মাখলুক বা সৃষ্টিজগত হলো এবং হলেন আল্লাহ। এ উক্তিও রয়েছে যে, এর অর্থ হলো জোড়া জোড়া এবং হলেন আত্মাহ রাব্দুল আলামীন। যেমন আসমান-জমীন, জল-স্থল, মানুষ-জ্বিন, সূর্য-চন্দ্র ইত্যাদি। কুরআন কারীমে রয়েছেঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আমি সকল জিনিসকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি, যেন তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পার।” (৫১:৪৯) অর্থাৎ যেন তোমরা জানতে পার যে, সকল জিনিসের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বল আলামীন, তাঁর কোন শরীক নেই। এটাও বলা হয়েছে যে, এর অর্থ হলো জোড় বেজোড়ের গণনা। একটি হাদীসে রয়েছে যে, (আরবি) এর অর্থ হলো দুদিন এবং (আরবি) এর অর্থ হলো তৃতীয় দিন। এক বর্ণনায় রয়েছে যে, এর অর্থ হলো নামায, এতে জোড় রয়েছে, যেমন ফজরের দুই রাকআত এবং যুহর, আসর ও ইশার চার রাকআত। আবার বেজোড়েও রয়েছে যেমন মাগরিবের তিন রাকআত। একটি মারফু হাদীসে শুধু নামায অর্থেও এ শব্দ দুটির ব্যবহারের কথা রয়েছে। কোন কোন সাহাবী বলেছেন যে, এ দুটি শব্দ দ্বারা ফরয নামায উদ্দেশ্য। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ শপথ রাত্রির যখন তা গত হতে থাকে। আবার এ অর্থও করা হয়েছে যে, রাত্রি যখন আসতে থাকে। এটাই অধিক সমীচীন বলে মনে হয়। এ উক্তিটি (আরবি) এর সাথে অধিক সঙ্গতিপূর্ণ। ফজর বলা হয় যখন রাত্রি শেষ হয়ে যায় এবং দিনের আগমন ঘটে ঐ সময়কে। কাজেই এখানে দিনের বিদায় ও রাত্রির আগমন অর্থ হওয়াই যুক্তিসংগত। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “শপথ রজনীর যখন ওর আগমন ঘটে এবং অন্ধকার ছড়িয়ে দেয় এবং শপৰ সকালের যখন তা আসে ও আলো ছড়িয়ে দেয়।” (৮১:১৭-১৮)

ইকরামা (রঃ) বলেন যে, এখানে অর্থ হলো মুযদালিফার রাত্রি। (আরবি) এর অর্থ হহে আকল বা বিবেক। হিজর বলা হয় প্রতিরোধ বা বিরতকরণকে। বিবেক ও ভ্রান্তি, মিথ্যা ও মন্দ থেকে বিরত রাখে বলে ওকে আকল বা বিবেক বলা হয় (আরবি) এ কারণেই বলা হয় যে, কা'বাতুল্লাহর যিয়ারতকারীদেরকে শামী দেয়াল থেকে এই বিরত রাখে। এ থেকেই হিজরে ইয়াম মা শব্দ গৃহীত হয়েছে। এ কারণেই আরবের লোকেরা বলে থাকে।(আরবি) অর্থাৎ শাসনকর্তা অমুককে বিরত রেখেছেন। যখন কোন লোককে বাদশাহ বাড়াবাড়ি করতে বিরত রাখেন তখন আরবরা একথা বলে থাকে।

আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ নিশ্চয়ই এর মধ্যে শপথ রয়েছে বোধসম্পন্ন ব্যক্তির জন্যে। কোথাও ইবাদত বন্দেগীর শপথ, কোথাও ইবাদতের সময়ের শপথ, যেমন হজ্জ, নামায ইত্যাদি। আল্লাহ তা'আলার পুণ্যবান বান্দারা তাঁর নৈকট্য লাভ করার জন্যে সচেষ্ট থাকে এবং তাঁর সামনে নিজেদের হীনতা প্রকাশ করে অনুনয় বিনয় করতে থাকে। পুণ্যবান নেককারদের গুণাবলী বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা'আলা তাদের বিনয় ও ইবাদত বন্দেগীর কথা উল্লেখ করেছেন, সাথে সাথে বিদ্রোহী, হঠকারী, পাপী ও দুবৃত্তদেরও বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, হে নবী (সঃ)! তুমি কি দেখনি তোমার প্রতিপালক স্তম্ভসদৃশ আ’দ জাতির সাথে কি করে ছিলেন? কিভাবে তিনি তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছেন? তারা ছিল হঠকারী এবং অহংকারী। তারা আল্লাহর নাফরমানী করতো।, রাসূলকে অবিশ্বাস করতো এবং নিজেদেরকে নানা প্রকারের পাপকর্মে নিমজ্জিত রাখতো। তাদের নিকট আল্লাহর রাসূল হযরত হূদ (আঃ) আগমন করেছিলেন।

এখানে প্রথম আ’দ (আ’দেউলা) এর কথা বলা হয়েছে। তারা আদ ইবনে ইরম ইবনে আউস ইবনে সাম ইবনে নূহের (আঃ) বংশধর ছিল। আল্লাহ তা'আলা তাদের মধ্যকার ঈমানদারদেরকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং বাকি সব বেঈমানকে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। ক্রমাগত সাত রাত্র ও আট দিন পর্যন্ত ঐ সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত হয়েছিল। তাতে আ’দ সম্প্রদায়ের সমস্ত কাফির ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। তাদের একজনও ভয়াবহ শাস্তি হতে রক্ষা পায়নি। মাথা ও দেহ ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পড়ে রয়েছিল। কুরআনের মধ্যে কয়েক জায়গায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। সূরা আল হাককাহতেও এর বর্ণনা রয়েছে। সেখানে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আর আ’দ সম্প্রদায়, তাদেরকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচণ্ড ঝঞ্জা বায়ু দ্বারা; যা তিনি তাদের উপর প্রবাহিত করেছিলেন সপ্তরাত্রি ও অষ্টদিবস বিরামহীনভাবে। তখন তুমি উক্ত সম্প্রদায়কে দেখতে তারা সেথায় লুটিয়ে পড়ে আছে সারশূন্য বিক্ষিপ্ত খর্জুর কাণ্ডের ন্যায়। অতঃপর তাদের কাউকেও তুমি বিদ্যমান দেখতে পাও কি?” (৬৯:৬-৮) (আরবি) (ইরাম গোত্রের প্রতি-যারা অধিকারী ছিল সুউচ্চ প্রাসাদের) তাদের অতিরিক্ত পরিচয় প্রদানের জন্যে এটা (আরবি) হয়েছে। তাদেরকে (আরবি) বলার কারণ এ যে, তারা দৃঢ় ও সুউচ্চ স্তম্ভ বিশিষ্ট গৃহে বসবাস করতো। সমসাময়িক যুগের লোকদের তুলনায় তারা ছিল অধিক শক্তিশালী এবং দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী। এ কারণেই। হযরত হূদ (আঃ) তাদেরকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের পরে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন এবং তোমাদের অবয়ব অন্য লোক অপেক্ষা শক্তিতে অধিকতর সমৃদ্ধ করেছেন। সুতরাং তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর, হয়ত তোমরা সফল কাম হবে।” আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “আদ সম্প্রদায় অন্যায়ভাবে ভূ-পৃষ্ঠে অহংকার ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করেছিল এবং বলেছিলঃ আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী আর কে আছে। তারা কি দেখে নাই যে, যে আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তিনি তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী।” (৪১:১৫) আর এখানে আল্লাহ পাক বলেনঃ যার সমতুল্য (প্রাসাদ) কোন দেশে নির্মিত হয়নি। তারা খুবই দীর্ঘ দেহ ও অসাধারণ শক্তির অধিকারী ছিল। সেই যুগে তাদের মত দৈহিক শক্তির অধিকারী আর কেউ ছিল না। ইয়াম ছিল তাদের রাজধানী। তাদেরকে শুভের অধিকারী বলা হতো কারণ তারা ছিল খুবই দীর্ঘ দেহী। তাদের মত অন্য কেউ ছিল না।

হযরত মিকদাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) (আরবি) এর উল্লেখ করে বলেনঃ “তাদের এতো বেশী শক্তি ছিল যে, তাদের কেউ উঠতো এবং একটি (প্রকাণ্ড) পাথর উঠিয়ে অন্য কোন সম্প্রদায়ের উপর নিক্ষেপ করতো। এ পাথরে চাপা পড়ে ঐ সম্প্রদায়ের লোকেরা সবাই মারা যেতে। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত আনাস ইবনে আইয়ায (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত সাওর ইবনে যায়েদ দাইলী (রঃ) বলেনঃ “আমি একটি পাতায় দেখেছি যে, তাতে লিখিত ছিলঃ “আমি শাদ্দাদ ইবনে আদি, আমি শুম্ভ মজবুত করেছি, আমি হাত মযবুত করেছি, আমি সাথে হাতের একটি ধনভাণ্ডৱ জমা করে রেখেছি। হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর উমত এটা বের করবে।` (এটাও ফুলে ইবনে আবি হাতিয়ে বর্ণিত হয়েছে) অথবা এটা বলা যায় যে, তারা উৎকৃষ্ট উচ্চবিশিষ্ট গৃহে বাস করতো। অথবা বলা যায় যে, তারা ছিল উচ্চ স্তম্ভের অধিকারী। অথবা ভায়া ছিল উন্নতমানের অক্সশর মালিক। অথবা তারা দীর্ঘ দেহেয়, অধিকারী ছিল। অর্থাৎ ভাৱ এক কওম বা সম্প্রদায় ছিল যাদের কথা কুরআনে সামূদ সম্প্রদায়ের সাথে বহু জায়গায় উল্লেখিত হয়েছে। এখানেও আদ ও সামূদ উভয় কওমের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।

কেউ কেউ বলেছেন যে, (আরবি) হলো একটি শহর, তার নাম হয় তো আমে অথবা আলেকজান্দ্রিয়া। কিন্তু এ উক্তি সঠিক বলে অনুভূত হয় না। কারণ এতে আয়াতের অর্থে সঙ্গতি পরিলক্ষিত হয় না। তাছাড়া এখানে এটা বুঝানো হয়েছে যে, প্রত্যেক হঠকারী বিশ্বাসঘাতককে আত্মাহ তাআলা ধ্বংস করে দিয়েছেন যাদের নাম ছিল আলী, কোন শহরের কথা বুঝানো হয়নি। আমি এ সব কথা এখানে এ কারণেই বর্ণনা করেছি যে, যেন কতিপয় তাফসীরকারের অপব্যাখ্যায় কেউ বিভ্রান্ত না হয়। তাঁরা লিখেছেন যে, ইরুম একটি শহরের নাম যার একটি ইট সোনার ও অন্যটি কপার, এভাবে শহরটি নির্মিত হয়েছে। অ সেই শহরের বাড়ি-ঘর, বাগবাগীচা সবই সোনা-রূপার তৈরি, কংকর হলে মুতা ও জওহর এবং মাটি হলো মিশক। ঝর্ণাসমূহ প্রবাহমান এবং ফল ভারে বৃক্ষগুলো আনত। সেই শহরের বসবাস করার মত কোন মানুষ নেই। ঘর দুয়ার সব শূন্য। হাঁ হুঁ করার মত কেউ নেই। এই শহর স্থানান্তরিত হতে থাকে, কখনো সিরিয়ায়, কখনো ইয়ামনে, কখনো ইরাকে এবং কখনো অন্য কোথাও। এসব অপকাহিনী বানী ইসরাইল বানিয়ে নিয়েছে। তারা এ সব মনগড়া গল্প তৈরি করে মুখদেরকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে থাকে।

সালাবী (রঃ) প্রমুখ গুরুজন বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মুআবিয়ার (রাঃ) শাসনামলে এক বেদুঈন তার হারানো উট খোঁজ করার উদ্দেশ্যে এক জন-মানব শূন্য জঙ্গলে গিয়ে প্রবেশ করে। ঐ জঙ্গলে সে উপরোল্লিখিত গুণাবলী বিশিষ্ট একটি শহর দেখতে পায়। ঐ শহরে গিয়ে সে ঘোরাফেরা করে। তারপর ফিরে এসে জনগণের নিকট তা বর্ণনা করে। জনগণও তখন সেখানে গমন করে কিন্তু তারা সেখানে কিছুই দেখতে পায়নি।

ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) এখানে এ ধরনের কাহিনী খুব লম্বা চওড়াভাবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ কাহিনীও সত্য নয়। বেদুঈনের কাহিনীটি যদি সনদের দিক দিয়ে সত্য বলে ধরে নেয়াও হয় তাহলে বলতে হয় যে, বেদুঈন মনে মনে এ কাহিনী কল্পনা করেছিল, ফলে তার দৃষ্টিভ্রম ঘটেছিল। সে ভেবে বসেছিল যে, সে যা দেখেছে তা সেই কল্পিত শহর। প্রকৃতপক্ষে সে কিছুই দেখতে পায়নি।

অনুরূপভাবে যে সব মূর্ণ এবং কল্পনাবিশ্বাসী মনে করে যে, কোন বিশেষ স্থানে মাটির তলায় সোনা কৃপা লুকানো রয়েছে, হীরাজহরত ও মণিমাণিক্য রয়েছে, কিন্তু সেখানে পৌছতে পারে না। যেমন বলা হয়ঃ ধন-ভাণ্ডারের মুখে বড় অজগর বসে আছে অথবা তার উপর জ্বিনের পাহারা রয়েছে। এ ধরনের বাজে ও ভিত্তিহীন কাহিনী বর্ণনা করে থাকে। কখনো ধ্যানে বসে, কখনো বা রোগ-ব্যাধির মুক্তির উপায় আছে বলে জানায়। এসব আইয়ামে জাহেলিয়াতের বা প্রাচীন যাণ পর প্রখত কোন ধন সম্পদ ঘটনাক্রমে কেউ পেতে পেতে পারে, সেখানে দেও, জ্বি, ভূত প্রেত বা সাপ বিন্দু ইত্যাদির আশংকা সম্পূর্ণ অমূলক। এসৰ অপকাহিনী ফন্দিবাজরা প্রচার করে বেড়ায়। আল্লাহ এদের সুবুদ্ধি দান করুন!

ইমাম ইবনে জাৱীর (রঃ) বলেছেন যে, সম্ভবতঃ এখানে সম্প্রদায় বুঝানো হয়েছে অথবা হয়তো শহর বুঝানো হয়েছে। কিন্তু এটা সঠিক নয়। এখানে তো সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এটা একটা কওমের বর্ণনা। এটা কোন শহরের বর্ণনা নয়। এ কারণেই আদ সম্প্রদায়ের বর্ণনার পরেই সামূদ সম্প্রদায়ের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সামূদ সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, তারা পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ করতো। যেমন আল্লাহ বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ “তোমরা পাহাড় কেটে প্রশস্ত ও আরামদায়ক বাসগৃহ নির্মাণ করছে।” (২৬:১৪৯)

ইবনে ইসহাক (রঃ) বলেন যে, সামুদরা ছিল আরবের অধিবাসী। তারা ফুরা নামক স্থানে বসবাস করতো। আদদের কাহিনী সূরা আ'রাফে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ আর (তুমি কি দেখোনি যে, তোমার প্রতিপালক কি করেছিলেন) কীলক ওয়ালা ফিরাউনের সঙ্গে? (আরবি) এর অর্থ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) কাহিনী বা দল বলে উল্লেখ করেছেন যারা ফিরাউনের কার্যাবলী সুদৃঢ় করতো। এমনও বর্ণিত আছে যে, ফিরাউনের ক্রোধের সময় তারা লোকদের হাতে পায়ে পেরেক পুঁতে মেরে ফেলতো। উপর থেকে পাথর নিক্ষেপ করে মাথার মগজ বের করে ফেলতো, তারপর মেরে ফেলা হতো। কেউ কেউ বলেন যে রশি এবং পেরেক নিয়ে তার সামনে খেলা করা হতো। এর একটি কারণ এও বর্ণনা করা হয়েছে যে, তার স্ত্রী (হযরত আছিয়া (রাঃ) মুসলমান হয়ে যাওয়ার পর তাঁকে পিঠের ভরে শুইয়ে দিয়ে হাতে পায়ে পেরেক মেরে দেয়া হয়েছিল। তারপর পেটের উপর প্রকাণ্ড পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছিল। আল্লাহ তা'আলা ঐ পুণ্যবতী মহিলার প্রতি অনুগ্রহ করুন!

মহাপ্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যারা দেশে সীমালংঘন করেছিল। অর্থাৎ যারা নগরসমূহে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করার পরে অধিক মাত্রায় উপদ্রব করেছিল। যারা মানুষকে খুবই নিকৃষ্ট মনে করতো এবং নানাভাবে অত্যাচার উৎপীড়ন করতো। ফলে আল্লাহ তা'আলা তাদের প্রতি শাস্তির বৃষ্টি বর্ষণ করেছিলেন। তাই আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ হে নবী (সঃ)! অতঃপর তোমার প্রতিপালক তাদের উপর শাস্তির কষাঘাত হানলেন। অর্থাৎ তাদের প্রতি অবশেষে এমন শাস্তি এসেছে যে, তা টলানো যায়নি। ফলে তারা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আল্লাহ তা'আলা অবশ্যই সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। নির্ধারিত সময়ে তিনি প্রত্যেককে ভাল মন্দের বিনিময় প্রদান করবেন। সমস্ত মানুষ অবশ্যই তাঁর কাছে ফিরে যাবে এবং সবাই এককভাবে বিচারের জন্য দাঁড়াবে। ঐ সময় আল্লাহ তা'আলা সবারই প্রতি সুবিচার করবেন। তিনি সর্বপ্রকার অত্যাচার হতে মুক্ত ও পবিত্র। এখানে ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ওটা খুবই গরীব বা দুর্বল হাদীস। ওর সনদের ব্যাপারে বক্তব্য রয়েছে এবং ওর সঠিকতার ক্ষেত্রেও চিন্তাভাবনার অবকাশ রয়েছে। ঐ হাদীসটি হযরত মুআয (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “হে মুআয (রাঃ)। (জেনে রেখো যে,) মুমিন ব্যক্তি হকের নিকট বন্দী। হে মুআয! পুলসিরাত পার না হওয়া পর্যন্ত মুমিন ভয় ও উদ্বেগ হতে নিরাপত্তা লাভ করবে না। হে মুআয (রাঃ)! কুরআন মুমিনকে তার অনেক ইচ্ছা হতে বিরত রাখে।, যাতে সে ধ্বংস হতে রক্ষা পেতে পারে। কুরআন তার দলীল, ভয়ভীতি তার হুজ্জত, আল্লাহর প্রতি আকর্ষণ তার বাহন, নামায তার আশ্রয়, রোযা তার ঢাল, সাদকা তার ছাড়পত্র, সততা তার আমীর এবং লজ্জা তার উযীর। এ সবের পরেও তার প্রতিপালক তার সম্পর্কে অবহিত রয়েছেন। তিনি তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছেন।” (এ হাদীসটি দু’জন বর্ণনাকারী ইউনুস হিযা, ও আবু হামযাহ অজ্ঞাত। এটা মুরসাল হাদীস। সম্ভবতঃ এটা আবূ হামযাহর উক্তি হবে)

মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমেরই অন্য একটি বর্ণনা রয়েছে যে, হযরত ইবনে আবদিল কালাঈ (রঃ) তাঁর একভাষণে বলেনঃ হে জনমণ্ডলী! জাহান্নামের সাতটি পুল রয়েছে। প্রত্যেকটির উপর সিরাত বা পথ রয়েছে। প্রথম পুলসিরাতের উপরই মানুষকে আটক করে দেয়া হবে। সেখানে আল্লাহ তা'আলা ফেরেশতাদেরকে বলবেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ তাদেরকে থামাও, কারণ তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে।” অতঃপর তাদের কাছে নামাযের হিসাব নেয়া হবে। তারপর যারা মুক্তি পাবার তারা মুক্তি পাবে এবং যারা ধ্বংস হবার তারা ধ্বংস হবে। এরপর যখন তারা দ্বিতীয় পুলসিরাতে পৌঁছবে তখন তাদের কাছে আমানতের হিসাব নেয়া হবে যে, কিভাবে তা আদায় করেছিল এবং কিভাবে খিয়ানত করেছিল। সুতরাং এখানেও যারা মুক্তি পাওয়ার তারা মুক্তি পাবে এবং যারা ধ্বংস হওয়ার তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। অতঃপর যখন তারা তৃতীয় পুলসিরাতে পৌছবে তখন তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে আত্মীয়তার সম্পর্ক সম্বন্ধে যে, কিভাবে তারা তা মিলিত রেখেছে এবং কিভাবে ছিন্ন করেছে। এখানেও যারা পরিত্রাণ লাভ করার তারা পরিত্রাণ লাভ করবে এবং যারা ধ্বংস হওয়ার তারা ধ্বংস হবে। এই আত্মীয়তা সেই দিন স্বয়ং অবয়ব ধারণ করে বলবেঃ “হে আল্লাহ! যে আমার সাথে সম্পর্ক মিলিত রেখেছে তার সাথে আপনিও সম্পর্ক মিলিত রাখুন এবং যে আমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে আপনিও তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করুন!” আল্লাহ তা'আলার এরশাদ করেন (আরবি) এর ভাবার্থ এটাই।”





সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।