সূরা আল-গাশিয়া (আয়াত: 3)
হরকত ছাড়া:
عاملة ناصبة ﴿٣﴾
হরকত সহ:
عَامِلَۃٌ نَّاصِبَۃٌ ۙ﴿۳﴾
উচ্চারণ: ‘আ-মিলাতুন না-সিবাহ।
আল বায়ান: কর্মক্লান্ত, পরিশ্রান্ত।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ৩. ক্লিষ্ট, ক্লান্ত(১),
তাইসীরুল ক্বুরআন: হবে কর্মক্লান্ত, শ্রান্ত।
আহসানুল বায়ান: ৩। কর্মক্লান্ত পরিশ্রান্ত। [1]
মুজিবুর রহমান: কর্মক্লান্ত পরিশ্রান্তভাবে;
ফযলুর রহমান: শ্রান্ত, ক্লান্ত।
মুহিউদ্দিন খান: ক্লিষ্ট, ক্লান্ত।
জহুরুল হক: পরিশ্রান্ত, অবসাদগ্রস্ত,
Sahih International: Working [hard] and exhausted.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ৩. ক্লিষ্ট, ক্লান্ত(১),
তাফসীর:
(১) দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থা হবে (عَامِلَةٌ نَاصِبَةٌ) বাকপদ্ধতিতে অবিরাম কর্মের কারণে পরিশ্রান্ত ব্যক্তিকে عَامِلَةٌ এবং ক্লান্ত ও ক্লিষ্ট ব্যক্তিকে বলা হয় نَاصِبَةٌ। [ফাতহুল কাদীর] কাফেরদের এ অবস্থা কখন হবে? এ নিয়ে কয়েকটি মত রয়েছে। কোন কোন মুফাসসিরের মতে, কাফেরদের এ দুরাবস্থা দুনিয়াতেই হবে। কেননা, আখেরাতে কোন কর্ম ও মেহনত নেই। [ফাতহুল কাদীর] কেননা, অনেক কাফের দুনিয়াতে মুশরিকসুলভ ইবাদত এবং বাতিল পন্থায় অধ্যবসায় ও সাধনা করে থাকে। হিন্দু যোগী ও নাসারা পাদ্রী অনেক এমন আছে, যারা আন্তরিকতা সহকারে আল্লাহ্ তা'আলারই সন্তুষ্টির জন্যে দুনিয়াতে ইবাদত ও সাধনা করে থকে এবং এতে অসাধারণ পরিশ্রম স্বীকার করে। কিন্তু এসব ইবাদত মুশরিকসুলভ ও বাতিল পন্থায় হওয়ার কারণে আল্লাহর কাছে সওয়াব ও পুরস্কার লাভের যোগ্য হয় না।
অতএব, তাদের মুখমণ্ডল দুনিয়াতেও ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত রইল এবং আখেরাতে তাদেরকে লাঞ্ছনা ও অপমানের অন্ধকার আচ্ছন্ন করে রাখবে। খলীফা ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন শাম সফর করেন তখন জনৈক নাসারা বৃদ্ধ পাদ্ৰী তাঁর কাছ দিয়ে যেতে দেখলেন। সে তাঁর ধর্মীয় ইবাদত সাধনা ও মোজাহাদায় এত বেশী আত্মনিয়োগ করেছিল যে, অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে চেহারা বিকৃত এবং দেহ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। তার পোশাকের মধ্যেও কোন শ্ৰী ছিল না। খলীফা তাকে দেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। ক্ৰন্দনের কারণ জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেনঃ এই বৃদ্ধার করুণ অবস্থা দেখে আমি ক্ৰন্দন করতে বাধ্য হয়েছি। বেচারী স্বীয় লক্ষ্য অজর্নের জন্যে জীবনপণ পরিশ্রম ও সাধনা করেছে কিন্তু সে তার লক্ষ্য অজর্নে ব্যর্থ হয়েছে এবং আল্লাহর সন্তুটি অর্জন করতে পারেনি। তারপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন। [ইবন কাসীর]
কাতাদাহ রাহেমাহুল্লাহর মতে, তাদের অবিরাম কষ্ট ও ক্লান্তি দু’টোই আখেরাতে হবে। সে হিসেবে আয়াতের অর্থ, যারা দুনিয়াতে আল্লাহর ইবাদত করতে অহংকার করেছিল তাদেরকে সেদিন কর্মে খাটানো হবে এবং তাদেরকে জাহান্নামে প্রতিষ্ঠিত করা হবে; এমতাবস্থায় যে তারা তাদের ভারী জিঞ্জির ও ভারী বোঝাসমূহ বহন করতে থাকবে। অনুরূপভাবে তারা হাশরের মাঠের সে বিপদসংকুল সময়ে নগ্ন পা ও শরীর নিয়ে কঠিন অবস্থায় অবস্থান করতে থাকবে, যার পরিমান হবে পঞ্চাশ হাজার বছর। হাসান বসরী ও সাঈদ ইবনে জুবাইর রাহেমাহুমাল্লাহ বলেন, তারা যেহেতু দুনিয়াতে আল্লাহর জন্য কোন নেক আমল করেনি, সেহেতু সেখানে তারা জাহান্নামে কঠিন খাটুনি ও কষ্ট করবে। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, তাদেরকে কঠিন কঠিন পাহাড়ে ওঠা-নামার কাজে লাগানো হবে। পরে কষ্ট ও ক্লান্তি উভয়টিরই সম্মুখীন হবে। [ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: ৩। কর্মক্লান্ত পরিশ্রান্ত। [1]
তাফসীর:
[1] ناصِبَة ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। অর্থাৎ, তাদের আযাব এমন কষ্টদায়ক হবে যে, তাতে তাদের অবস্থা খুবই করুণ হবে। এর দ্বিতীয় অর্থ এটাও নেওয়া যেতে পারে যে, দুনিয়াতে আমল করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ, তারা অনেক অনেক আমল করেছে। কিন্তু সে সব আমল বাতিল ধর্ম অনুযায়ী অথবা বিদআত ভিত্তিক হবে। আর এ জন্যই ‘ইবাদত’ ও ‘ক্লান্তকর আমল’ মওজুদ থাকা সত্ত্বেও তারা জাহান্নামে যাবে। এই অর্থানুযায়ী ইবনে আব্বাস (রাঃ) عامِلَة نَاصِبَة শব্দ থেকে উদ্দেশ্য ‘খ্রিষ্টান’ বুঝিয়েছেন। (সহীহ বুখারী সূরা গাশিয়ার ব্যাখ্যা পরিচ্ছেদ)
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: নামকরণ ও গুরুত্ব:
الْغَاشِيَةِ কিয়ামতের অন্যতম একটি নাম। الْغَاشِيَةِ অর্থ : আচ্ছন্ন করে নেয়া, আবৃত করা ইত্যাদি। কিয়ামতকে এ নামে নামকরণ করার কারণ হলো সেদিন মানুষকে কিয়ামতের ভয়াবহতা আচ্ছন্ন করে নেবে। সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে। সূূরার গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্বের সূরাতে আলোচনা করা হয়েছে।
সূরায় জান্নাতী ও জাহান্নামীÑদুদলে মানুষকে বিভক্ত করা হয়েছে এবং তাদের কী অবস্থা হবে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তারপর দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলার কয়েকটি নির্দশনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সর্বশেষ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে সান্ত্বনা প্রদান করা হয়েছে।
১-৭ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
এ আয়াতগুলোতে জাহান্নামীদের অবস্থা এবং জাহান্নামীরা জাহান্নামে যা খাবে ও পান করবে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
خَاشِعَةٌ অর্থ : অবনত, বিনীত বা লাঞ্ছিত। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন কাফিরদের মুখমন্ডল লাঞ্ছনায় অবনত হয়ে যাবে। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: দুনিয়াতে বহু আমলকারী ক্লান্ত-শ্রান্ত ব্যক্তিগণ আখেরাতে হবে ভীত-নমিত। ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: তারা বহু আমল করেছে ও তাতে পরিশ্রমও হয়েছে (ইবনু কাসীর)। এ কথার সপক্ষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কথা পাওয়া যায়: তোমরা কি জান মুফলিস কে? সাহাবীগণ বললেন : যার টাকা পয়সা নেই সে মুফলিস বা সর্বহারা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন না, বরং মুফলিস বা সর্বহারা হল যে কিয়ামতের দিন অনেক আমল নিয়ে আসবে কিন্তু উমুকের ওপর এরূপ জুলুম করেছে অমুকের ওপর এরূপ জুলুম করেছেÑতারা তাদের জুলুম পরিমাণ সে ব্যক্তি থেকে সৎআমল কেটে নেবে অবশেষে সে লোকের কোন সৎআমল থাকবে না।.... (হাদীসের শেষ পর্যন্ত)। (তিরমিযী হা. ২৪১৮, ইবুন হিব্বান হা. ৭৩৫৯, সহীহ)
(عَامِلَةٌ نَّاصِبَةٌ)
অর্থ: ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। অর্থাৎ তাদের আযাব এমন কষ্টদায়ক হবে যে, তাতে তাদের অবস্থা খুবই করুণ হবে। এর দ্বিতীয় অর্থ এটাও হতে পারে যে, দুনিয়াতে অনেক আমল করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে কিন্তু সেসব আমল বাতিল ধর্ম অনুযায়ী হওয়ায় গ্রহণযোগ্য হয়নি। আর এজন্যই ইবাদত ও ক্লান্তিকর আমল থাকা সত্ত্বেও তারা জাহান্নামে যাবে।
হাসান বাসরী (রহঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন : উমার (রাঃ) শাম সফরে এলে তাঁর কাছে একজন জীর্ণ-শীর্ণ খ্রিস্টান পাদ্রী দেখা করতে আসে। উমার (রাঃ) তার ক্লিষ্ট-করুণ দশা দেখে কেঁদে ফেলেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন : এ হতভাগা মিসকীন যা চেয়েছিল তা পায়নি, যা আকাক্সক্ষা করেছিল তাতে ব্যর্থ হয়েছে। তারপর তিনি অত্র আয়াতটি পাঠ করেন। (তাফসীর কুরতুবী) ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন :
(عَامِلَةٌ نَّاصِبَةٌ)
দ্বারা উদ্দেশ্য হলো খ্রিস্টানগণ। (সহীহ বুখারী, সূরা গাশিয়াহর তাফসীর)
(عَيْنٍ اٰنِيَةٍ) অর্থাৎ এমন ফুটন্ত গরম পানির ঝরণা থেকে পান করানো হবে যা গরমের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
ضَرِيْعٍ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : জাহান্নামের একটি গাছ। ইকরিমা (রহঃ) বলেন : এমন গাছ যা কাঁটাযুক্ত, জমিনের সাথে লেগে থাকে। মোটকথা এটাও যাক্কুমের মত এক প্রকার অতি তিক্ত বদহজমের গাছ এবং অতি অপবিত্র নোংরা খাবার হবে। যা ভক্ষণ করলে জাহান্নামীদের না শরীর পুষ্ট হবে, আর না তাদের ক্ষুধা নিবারণ হবে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. কাফিররা কিয়ামতের দিন লাঞ্ছিত অবস্থায় মুখমন্ডল অবনত করে থাকবে।
২. তারা এমন খাবার ও পানীয় পান করবে যা তাদের উপকারের পরিবর্তে আরো ক্ষতি হবে।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: হযরত নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত এ হাদীসটি পূর্বে গত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঈদের নামাযে এবং জুমআর দিনে(আরবি) এবং পাঠ করতেন। ইমাম মালিক (রঃ) এর মুআত্তা নামক হাদীস গ্রন্থে রয়েছে যে, জুমআর নামাযে রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রথম রাকআতে সুরা জুমআহ্ এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা (আরবি) পাঠ করতেন। (এ হাদীসটি সুনানে আবী দাউদ, সহীহ মুসলিম, সুনানে ইবনে মাজাহ এবং সুনানে নাসাঈর মধ্যেও বর্ণিত হয়েছে)
১-৭ নং আয়াতের তাফসীর
গাশিয়াহ্ হলো কিয়ামতের একটি নাম, কারণ এটা সবার উপর আসবে, সবাইকে ঘিরে ধরবে এবং ঢেকে ফেলবে। মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত আমর ইবনে মায়ুমুন (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) একটি স্ত্রী লোকের পার্শ্ব দিয়ে গমন করার সময় শুনতে পান যে, পাঠ করছে। তখন তিনি দাড়িয়ে গিয়ে শুনতে থাকেন এবং বলেনঃ (আরবি) অর্থাৎ “হ্যা, আমার নিকট (কিয়ামতের সংবাদ) এসেছে।”
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ সেইদিন বহু লোক হবে অপমানিত চেহারাবিশিষ্ট। অবমাননা তাদের উপর আপতিত হবে। তাদের পুণ্যকর্মসমূহ বিনষ্ট হয়ে যাবে। তারা বড় বড় কাজ করেছিল, আমলের জন্যে কষ্ট করেছিল, কিন্তু আজ তারা প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করবে।
হযরত আবু ইমরান জাওফী (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এক রাহিবের (খ্রিষ্টান পাদ্রীর) আশ্রমের পার্শ্ব দিয়ে গমন করছিলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি ঐ রাহিবকে ডাক দেন। খ্রিস্টান সাধক তাঁর কাছে হাজির হলে সাধককে দেখে কেঁদে ফেলেন। সাধক তাঁকে ক্রন্দনের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ “আল্লাহ তা'আলার কিতাবে উল্লেখিত তাঁর (আরবি) এই উক্তি আমার স্মরণে এসেছে এবং ওটাই আমাকে কাঁদিয়েছে (এটা হাফিয আবু বকর বারকানী (রঃ) বর্ণনা করেছেন) এর ভাবার্থ হলোঃ ইবাদত, রিয়াযত করছে, অথচ শেষ পর্যন্ত জাহান্নামে প্রবেশ করবে।
সহীহ বুখারীতে রয়েছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ (আরবি) দ্বারা খ্রিষ্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে। ইকরামা (রাঃ) এবং সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছে দুনিয়ায় তারা পাপের কাজ করছে এবং আখেরাতে তারা শাস্তি এবং প্রহারের কষ্ট ভোগ করবে।
তারা প্রবেশ করবে জ্বলন্ত অগ্নিতে। সেখানে ছাড়া অন্য কোন খাদ্য মিলবে না। এটা হবে আগুনের বৃক্ষ, জাহান্নামের পাথর। এতে বিষাক্ত কন্টক বিশিস্ট ফল ধরে থাকবে। এটা হবে দুর্গন্ধময় খাদ্য ও অত্যন্ত নিকৃষ্ট আহার্য। এটা ভক্ষণে দেহও পুষ্ট হবে না, ক্ষুধাও নিবৃত্ত হবে না এবং অবস্থারও কোন পরিবর্তন হবে না।
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।