সূরা আল-আ‘লা (আয়াত: 3)
হরকত ছাড়া:
والذي قدر فهدى ﴿٣﴾
হরকত সহ:
وَ الَّذِیْ قَدَّرَ فَهَدٰی ۪ۙ﴿۳﴾
উচ্চারণ: ওয়াল্লাযী কাদ্দারা ফাহাদা-।
আল বায়ান: আর যিনি নিরূপণ করেন অতঃপর পথ নির্দেশ দেন।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ৩. আর যিনি নির্ধারণ করেন(১) অতঃপর পথনির্দেশ করেন(২),
তাইসীরুল ক্বুরআন: যিনি সকল বস্তুকে পরিমাণ মত সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর (জীবনে চলার) পথনির্দেশ করেছেন।
আহসানুল বায়ান: ৩। এবং যিনি তকদীর (নিয়তি) নির্ধারণ করেছেন। তারপর পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। [1]
মুজিবুর রহমান: এবং যিনি নিয়ন্ত্রণ করেছেন, তারপর পথ দেখিয়েছেন,
ফযলুর রহমান: যিনি (সবকিছু) সুপরিমিত করেছেন ও (সবাইকে) পথ দেখিয়েছেন
মুহিউদ্দিন খান: এবং যিনি সুপরিমিত করেছেন ও পথ প্রদর্শন করেছেন
জহুরুল হক: আর যিনি সুসমঞ্জস করেন, তারপর পথ দেখিয়ে নেন,
Sahih International: And who destined and [then] guided
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ৩. আর যিনি নির্ধারণ করেন(১) অতঃপর পথনির্দেশ করেন(২),
তাফসীর:
(১) অর্থাৎ প্রতিটি বস্তুকে তাকদীর নির্ধারণ করেছেন। প্রতিটি জিনিস সে তাকদীর অনুসরণ করছে। [সা'দী]
(২) অর্থাৎ স্রষ্টা যে কাজের জন্যে যাকে সৃষ্টি করেছেন, তাকে সে কাজের পথনির্দেশও দিয়েছেন। সত্যিকারভাবে এ পথনির্দেশে আকাশ ও পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টিই অন্তর্ভুক্ত আছে। কেননা, এক বিশেষ ধরনের বুদ্ধি ও চেতনা আল্লাহ তা'আলা সবাইকে দিয়েছেন, যদিও তা মানুষের বুদ্ধি ও চেতনা থেকে নিম্নস্তরের। অন্য আয়াতে আছেঃ (قَالَ رَبُّنَا الَّذِي أَعْطَىٰ كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَىٰ) প্রত্যেক বস্তুর জন্য তাকদীর নির্ধারণ করেছেন, তারপর পথনির্দেশ করেছেন।” [সূরা ত্বাহা: ৫০] এ হিসেবে আলোচ্য আয়াতের অর্থ, আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক বস্তুকে সৃষ্টি করে এর জন্য তাকদীর নির্ধারণ করেছেন। তারপর সে তাকদীর নির্ধারিত বিষয়ের দিকে মানুষকে পরিচালিত করছেন। মুজাহিদ বলেন, মানুষকে সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যের পথ দেখিয়েছেন। আর জীব-জন্তুকে তাদের চারণভূমির পথ দেখিয়েছেন। [ইবন কাসীর]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: ৩। এবং যিনি তকদীর (নিয়তি) নির্ধারণ করেছেন। তারপর পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। [1]
তাফসীর:
[1] অর্থাৎ, নেকী এবং বদীর। অনুরূপ জীবন-যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কিছুর পথ তিনি দেখিয়েছেন। এই পথনির্দেশ পশু-পক্ষীকেও করা হয়েছে। قدَّر শব্দের অর্থ হল প্রত্যেক বস্তুর শ্রেণী ও তার প্রকারভেদ, গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে মানুষকেও তার প্রতি তিনি পথ প্রদর্শন করেছেন, যাতে মানুষ উপকৃত হতে পারে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: নামকরণ ও ফযীলত:
الْأَعْلَي মহান আল্লাহর একটি সিফাত বা গুণবাচক নাম, যার অর্থ সুউচ্চ। প্রথম আয়াতে উল্লিখিত গুণবাচক নাম থেকেই সূরার নামকরণ করা হয়েছে।
সাহাবী বারা বিন আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : নাবী (সাঃ)-এর সাহাবীদের মধ্যে প্রথম যারা আমাদের নিকট মদীনায় আসেন তারা হলেন মুসআব বিন উমাইর, ইবনু উম্মে মাকতুম । তারা আমাদেরকে কুরআন পড়াতে শুরু করেন। তারপর আম্মার, বেলাল, সা‘দ আগমন করেন। অতঃপর উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) বিশজন সাহাবীসহ আগমন করেন। তারপর নাবী (সাঃ) আসেন। আমি মদীনাবাসীকে অন্য কোন ব্যাপারে এতো বেশি খুশি হতে দেখিনি যতটা খুশি তারা নাবী (সাঃ) এবং তাঁর সহচরদের আগমনে হয়েছিল। ছোট ছোট শিশু ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালকরা পর্যন্ত আনন্দে কোলাহল শুরু করে যে, ইনি হলেন আল্লাহ তা‘আলার রাসূল মুহাম্মাদ (সাঃ)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আগমনের পূর্বেই আমি
(سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَي)
সূরাটি এ ধরনের অন্যান্য সূূরাগুলোর সাথে মুখস্থ করেছিলাম। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৪১)
সূরা ইনফিতারে এ সূরার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সহীহ মুসলিমে এসেছে নাবী (সাঃ) দু ঈদ ও জুমু‘আর সালাতে সূরা আ‘লা ও সূরা গাশিয়াহ পাঠ করতেন। আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিতরের সালাতে সূরা আ‘লা, সূরা কাফিরূন এবং সূরা ইখলাস পাঠ করতেন। আয়িশাহ (রাঃ) বৃদ্ধি করে বলেন : সূরা ফালাক ও সূরা নাসও পাঠ করতেন। (তিরমিযী হা. ৪৬২-৬৩, মিশকাত হা. ১২৬৯, সহীহ)
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : রাসূলুল্লাহ (সাঃ)
(سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَي)
পাঠ করার পর
سبحان ربي الأعلي
(পবিত্র আমার প্রতিপালক, যিনি সর্বোচ্চ) বলতেন। (আবূ দাঊদ হা. ৮৮৩, মিশকাত হা. ৮৮৩, সহীহ)
১-১৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর:
উকবা বিন আমের আল জুহানী (রাঃ) বলেন : যখন
(فسَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ العَظِيم)
অবতীর্ণ হলো তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন :
اجعلوها في ركوعكم
এটা তোমরা রুকূতে (পাঠ করার জন্য) গ্রহণ করে নাও। তারপর যখন
(سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَي)
অবতীর্ণ হলো তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন :
اجعلوها في سجودكم
এটা তোমরা সিজদায় (পাঠ করার জন্য) গ্রহণ করে নাও। (আহমাদ ৪/১৫৫, আবূ দাঊদ হা. ৮৬৯, দুর্বল)
نزه اسم ربك الأعلي عن الشريك والنقائص تنزيها يليق بعظمته
অর্থ:
‘তোমার সর্বোচ্চ প্রভুর নামের পবিত্রতা ঘোষণা কর সব শরীক ও অপূর্ণাঙ্গ গুণাবলী হতে তাঁর শান মহত্ত্বের উপযোগী। (তাফসীর মুয়াসসার), ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : এর অর্থ হল তোমার মহান পালনকর্তার বড়ত্ব ঘোষণা কর। (কুরতুবী) অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা সকল দোষত্রুটি, অপূর্ণতা থেকে ঊর্ধ্বে। তিনি তাঁর নাম, গুণাবলী, কাজ ও কথায় পরিপূর্ণ, সর্বোচ্চ। এখানে নাবী (সাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে নির্দেশ দেওয়া হলেও মূলত সব উম্মতকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক মুসলিম আল্লাহ তা‘আলাকে যাবতীয় শিরক এবং তাঁর শানে ও মহত্ত্বে অশোভনীয় এমন কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকবে। শব্দ এটাও প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা সুউচ্চ ও সুমহান, তিনি সর্বত্র বিরাজমান নন। বরং তিনি স্বসত্তায় আরশের সমুন্নত আছেন।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাসবীহ পাঠ সম্পর্কে বলেন : আল্লাহ তা‘আলার নিকট সর্বাধিক প্রিয় বাক্য হল চারটি: সুবহানাল্লাহ, আল হামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার। (সহীহ মুসলিম হা. ২১৩৭, মিশকাত হা. ২২৯৪) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরো বলেছেন : যে ব্যক্তি দৈনিক ১০০ বার সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী পাঠ করবে, তার সকল (সগীরাহ) গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে, যদিও তা সাগরের ফেনা সমতুল্য হয়। (সহীহ বুখারী হা. ৬৪০৫, সহীহ মুসলিম হা. ২৬৯১) তিনি আরো বলেছেন: আল হামদুল্লিাহ মিযানের পাল্লা ভরে দেয়, সুবহানাল্লাহ ও আল হামদুলিল্লাহ আকাশসমূহ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী স্থানকে নেকী দিয়ে পূর্ণ করে দেয়। (সহীহ মুসলিম হা. ২২৩, মিশকাত হা. ২৮১)
পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা চারটি বিষয় তুলে ধরেছেন সৃষ্টি করা, সুবিন্যস্ত করা, পরিমিত করা এবং পথ প্রদর্শন করা। মানুষসহ সকল মাখলূকের মাঝে এ চারটি বিষয় বিদ্যমান। প্রত্যেক প্রাণীর দৈহিক গঠন, আকার-আকৃতি ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে বিশেষ মিল ও সামঞ্জস্য বিধান করে আল্লাহ তা‘আলা তাকে অস্তিত্ব দান করেছেন। সাথে সাথে তাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেছেন তাকে পরিমাণ মত সে কাজের যোগ্যতা দান করেছেন ও সে কাজের জন্য পথ প্রদর্শন করেছেন।
فَسَوّٰي সূরা ইনফিতারের ৭ নম্বর আয়াতের টীকায় আলোচনা করা হয়েছে।
(وَالَّذِيْ قَدَّرَ فَهَدٰي)
অর্থাৎ তিনি মানুষের তাকদীর নির্ধারণ করেছেন এবং ভাল মন্দের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। এ আয়াত আল্লাহ তা‘আলার ঐ কথার মত যেমন মূসা (আঃ) ফির‘আউনকে বলেছিলেন:
(قَالَ رَبُّنَا الَّذِيْٓ أَعْطٰي كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَه۫ ثُمَّ هَدٰي)
“মূসা বলল : ‘আমাদের প্রতিপালক তিনি, যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথনির্দেশ করেছেন।” (সূরা ত্ব-হা ২০ : ৫০)
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :
كتب الله مقادير الخلائق قبل أن يخلق السماوات والأرض بخمسين ألف سنة، قال : وعرشه علي الماء
আল্লাহ তা‘আলা আকাশ-জমিন সৃষ্টি করার পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে সৃষ্টি জীবের তাকদীর নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। তখন তার আরশ ছিল পানির ওপর। (সহীহ মুসলিম হা. ২৬৫৩)
(أَخْرَجَ الْمَرْعٰي)
অর্থাৎ আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করে বিভিন্ন প্রকারের তৃণলতা উৎপন্ন করেছেন।
(غُثَا۬ءً أَحْوٰي)
ঘাস শুকিয়ে গেলে তাকে غُثَا۬ءً বলা হয়। أَحْوٰي শব্দের অর্থ হলো কালো করে দিয়েছেন। অর্থাৎ তাজা সবুজ ঘাসকে শুকিয়ে কালো করে দিয়েছেন। ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: অতীব শুষ্ক হওয়ায় বা পুড়ে যাওয়ার কারণে সবুজ ঘাসপাতা যখন কালো রং ধারণ করে।
(سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنْسٰيٓ)
অত্র আয়াতে স্বীয় রাসূলকে কুরআন মুখস্থ করানোর সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছেন বলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে আশ্বস্ত করেছেন। সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কুরআন ভুলবেন না, মানুষ যেমন সাধারণত মুখস্থ বিদ্যা ভুলে যায়। জিবরীল (আঃ) যখন ওয়াহী নিয়ে আসতেন তখন তা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাড়াতাড়ি পড়তে শুরু করতেন যাতে ভুলে না যান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(لاَ تُحَرِّكْ بِه۪ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِه۪ إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَه۫ وَقُرْاٰنَه۫ فَإِذَا قَرَأْنٰهُ فَاتَّبِعْ قُرْاٰنَه۫)
“তাড়াতাড়ি ওয়াহী আয়ত্ত করার জন্য তুমি তোমার জিহ্বা ওর সাথে দ্রুত সঞ্চালন কর না।” তা সংরক্ষণ ও পাঠ করাবার দায়িত্ব আমারই। সুতরাং যখন আমি তা (জিবরীল-এর মাধ্যমে) পাঠ করি তুমি তখন সেই পাঠের অনুসরণ কর। (সূরা কিয়ামাহ ৭৫: ১৬)
অতএব কুরআন হেফাযত করে আল্লাহ তা‘আলা রাসূলের অন্তরে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন। ফলে তিনি তা ভুলবেন না। তবে আল্লাহ তা‘আলার হিকমত যা চাইবে ভুলে যাওয়ার তা ভুলে যাবেন। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা এরূপ চাননি যার কারণে সমস্ত কুরআন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মুখস্থ ছিল। কেউ কেউ বলেছেন : এর অর্থ হলো যা আল্লাহ তা‘আলা রহিত করার ইচ্ছা করবেন কেবল তাই ভুলিয়ে দেবেন। (ফাতহুল কাদীর)
(يَعْلَمُ الْـجَهْرَ وَمَا يَخْفٰي)
অর্থাৎ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য আল্লাহ তা‘আলা সবকিছু জানেন। তাই কোন্ কথা রাসূলকে ভুলিয়ে দিলে তা জনসাধারণের কল্যাণ হবে তাও আল্লাহ তা‘আলা জানেন।
(وَنُيَسِّرُكَ لِلْيُسْرٰي)
এটাও নাবী (সাঃ)-এর জন্য আরো একটি সুসংবাদ যে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলের জন্য সকল কাজ সহজ করে দেবেন এবং তার দীন ও শরীয়তকেও সহজ করে দেবেন। সে কথাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলছেন :
إِنَّ الدِّينَ يُسْرٌ، وَلَنْ يُشَادَّ الدِّينَ أَحَدٌ إِلَّا غَلَبَهُ
নিশ্চয়ই দীন সহজ, কেউ দীনের ব্যাপারে কঠোরতা করলে দীন তার ওপর জয়ী হয়ে যাবে। (সহীহ বুখারী হা. ৩৯) এ অনুগ্রহ শুধু রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে সীমাবদ্ধ নয় বরং প্রত্যেক নেককার বান্দার জন্যও উন্মুক্ত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(فَأَمَّا مَنْ أَعْطٰي وَاتَّقٰي وَصَدَّقَ بِالْـحُسْنٰي فَسَنُيَسِّرُه۫ لِلْيُسْرٰي)
“অতএব যে দান করে, আল্লাহভীরু হয়, এবং উত্তম বিষয়কে সত্য মনে করে, আমি তাকে সুখের বিষয়ের জন্য সহজ পথ দান করব।” (সূরা লাইল ৯২: ৫-৭) হাদীসে এসেছে : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: তোমরা কাজ করে যাও কেননা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ঐ কাজ সহজ করে দেওয়া হয় যার জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা. ৪৯৪৯, সহীহ মুসলিম হা. ২৬৪৭) অর্থাৎ যারা সঠিক তাওহীদ ও ঈমানের ওপর অটল থাকবে তাদের জন্য এ সুসংবাদ।
(فَذَكِّرْ إِنْ نَّفَعَتِ الذِّكْرٰي)
অর্থাৎ যতক্ষণ উপদেশ কাজে আসে ততক্ষণ মানুষকে উপদেশ দাও। চাই উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ অর্জন হোক আর না হোক। (তাফসীর সাদী) অর্থাৎ নবীর দায়িত্ব হল দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া ও মানুষকে নসীহত করা যতক্ষণ তা কাজে আসবে। যত নসীহত বর্জন করে ততই তাদেরকে সৎ পথে আনার জন্য নসীহত করেই যেতে হবে এমন নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِيْنَ يَخُوْضُوْنَ فِيْٓ اٰيٰتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتّٰي يَخُوْضُوْا فِيْ حَدِيْثٍ غَيْرِه۪)
“তুমি যখন দেখ, তারা আমার আয়াতসমূহ সম্বন্ধে উপহাসমূলক আলোচনায় মগ্ন তখন তুমি তাদের হতে সরে পড়, যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসঙ্গে প্রবৃত্ত হয়” (সূরা আন‘আম ৬: ৬৮) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন: দীন হল নসীহত করা। (সহীহ মুসলিম হা. ২০৫) সুতরাং স্থান-কাল ও পাত্র ভেদে নসীহত করা কখনও ফরয, কখনও মুস্তাহাব হয়ে থাকে। তবে সাধারণ নির্দেশ হল সকলকে নসীহত করতে হবে। হিদায়াতের মালিক আল্লাহ তা‘আলা।
(وَيَتَجَنَّبُهَا الْأَشْقَي)
অর্থাৎ যারা দীন ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তারাই হতভাগা তাদের জন্যই জাহান্নাম।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاَمَّا الَّذِیْنَ شَقُوْا فَفِی النَّارِ لَھُمْ فِیْھَا زَفِیْرٌ وَّشَھِیْقٌ﮹ خٰلِدِیْنَ فِیْھَا مَا دَامَتِ السَّمٰوٰتُ وَالْاَرْضُ اِلَّا مَا شَا۬ئَ رَبُّکَﺚ اِنَّ رَبَّکَ فَعَّالٌ لِّمَا یُرِیْدُ﮺ وَاَمَّا الَّذِیْنَ سُعِدُوْا فَفِی الْجَنَّةِ خٰلِدِیْنَ فِیْھَا مَا دَامَتِ السَّمٰوٰتُ وَالْاَرْضُ اِلَّا مَا شَا۬ئَ رَبُّکَﺚ عَطَا۬ئً غَیْرَ مَجْذُوْذٍ)
“অতঃপর যারা হতভাগা তারা থাকবে অগ্নিতে এবং সেথায় তাদের জন্য থাকবে চীৎকার ও আর্তনাদ, সেথায় তারা স্থায়ী হবে যতদিন আকাশসমূহ ও পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে যদি না তোমার প্রতিপালক অন্যরূপ ইচ্ছা করেন; নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালক তাই করেন যা তিনি ইচ্ছা করেন। পক্ষান্তরে যারা ভাগ্যবান তারা থাকবে জান্নাতে সেথায় তারা স্থায়ী হবে, যত দিন আকাশসমূহ ও পৃথিবী বিদ্যমান থাকবে, যদি না তোমার প্রতিপালক অন্যরূপ ইচ্ছা করেন; এটা এক নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার।” (সূরা হূদ ১১: ১০৬-১০৮)
(النَّارَ الْكُبْرٰي)
‘মহা অগ্নি’ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন :
نَارُكُمْ جُزْءٌ مِنْ سَبْعِينَ جُزْءًا مِنْ نَارِ جَهَنَّمَ
তোমাদের এ আগুন জাহান্নামের আগুনের ৭০ ভাগের এক ভাগ মাত্র। (সহীহ বুখারী হা. ৩২৬৫) অর্থাৎ দুনিয়ার আগুনের চেয়ে তা ৬৯ গুণ বেশি উত্তাপের অধিকারী এবং সে কারণে এখানে জাহান্নামের আগুনকে মহা অগ্নি বলা হয়েছে। সুতরাং এমন আগুনে যাতে যেতে না হয় সেজন্য সাধ্যমত সৎকাজ করতে হবে।
(لَا يَمُوْتُ فِيْهَا وَلَا يَحْيٰي)
অর্থাৎ যেসব দুর্ভাগা উপদেশ বর্জন করবে তারা জাহান্নামে যাবে, যেখানে তারা মারাও যাবেনা, জীবিতও থাকে না। অর্থাৎ মারা যাবে না যাতে শাস্তি থেকে বেঁচে যায় বা আরাম না পায়, আবার ভালভাবে জীবিতও থাকবে না যাতে আরাম পায়। মোট কথা সবর্দা আযাবে হাবুডুবু খাবে। এ সম্পর্কে সূরা ত্বহার ৭৪ নম্বর আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
تَزَكّٰي অর্থাৎ যারা নিজেদের আত্মাকে খারাপ চরিত্র এবং পাপ ও শিরক থেকে পবিত্র করতে পেরেছে তারাই সফলকাম।
(وَذَكَرَ اسْمَ رَبِّه۪ فَصَلّٰي)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার স্মরণে মগ্ন থাকে, তাঁর একত্বতা ঘোষণা করে, একমাত্র তাঁকেই ডাকে এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্য আমল করে। فَصَلّٰي অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য শরীয়ত বাস্তবায়ন লক্ষ্যে যথাসময়ে সালাত আদায় করে। (তাফসীর মুয়াসসার)
আর যারা তাফসীর করে থাকেন تَزَكّٰي অর্থ ফিতরা আদায় করা এবং আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করা, আর فَصَلّٰي অর্থ ঈদের সালাত আদায় করাÑতাদের কথা যদিও শব্দের অর্থের মাঝে অন্তর্ভুক্ত এবং আংশিকের ওপর প্রমাণ বহন করে কিন্তু শুধু এটুকুর মাঝে আয়াতের অর্থ সীমাবদ্ধ নয়। (তাফসীর সা‘দী)
সুতরাং যে ব্যক্তি সকল প্রকার দুনিয়াবী স্বার্থ মানুষের সন্তুষ্টি হাসিল থেকে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারল এবং সকল প্রকার শিরক ও বিদআত থেকে মুক্ত থেকে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য সঠিক পদ্ধতিতে আমল করল সে ব্যক্তিই সফলকাম।
(بَلْ تُؤْثِرُوْنَ الْـحَيٰوةَ الدُّنْيَا)
অর্থাৎ হে মানব জাতি! তোমরা দুনিয়ার চাকচিক্যময় জীবনকেই আখেরাতের নেয়ামতের ওপর প্রাধান্য দিয়ে থাকো অথচ আখেরাত ও তার নেয়ামতরাজি সব চিরস্থায়ী এবং দুনিয়া থেকে উত্তম। আনাস (রাঃ) বলেন : আমরা একদা আবূ মূসা আশআরী (রাঃ)-এর সাথে ছিলাম। তিনি সবাইকে বললেন : এসো আমরা কিছুক্ষণ আমাদের প্রভুকে স্মরণ করি। অতঃপর তিনি বলেন : হে আনাস! তুমি কি জান কোন বস্তু মানুষকে আখিরাত থেকে আটকে রাখে? আমি বললাম; দুনিয়া, শয়তান ও কুপ্রবৃত্তি। তিনি বলেন : না। বরং দুনিয়া নগদ পাওয়া যায় আর আখেরাত অদৃশ্যে থাকে। আল্লাহ তা‘আলার কসম! যদি তারা আখেরাতকে চোখের সামনে দেখতে পেত তাহলে তারা পিঠ ফেরাতো না বা ইতস্তত করত না। (তাফসীর কুরতুবী) আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّهُمْ يَرَوْنَه۫ بَعِيْدًا وَّنَرَاهُ قَرِيْبًا)
“নিশ্চয়ই তারা ঐ দিনকে অনেক দূরে মনে করে, কিন্তু আমি তা দেখছি নিকটে।” (সূরা মাআরিজ ৭০ : ৬-৭)
সুতরাং আখেরাতের তুলনায় দুনিয়াকে প্রাধ্যান্য দেওয়া ঈমানের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই না। অথচ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া অনুরূপ তুচ্ছ, যেরূপ তোমাদের কেউ সাগরে আঙ্গুল ডুবালে তাতে যৎসামান্য পানি উঠে আসে। (সহীহ মুসলিম হা. ২৮৫৮, মিশকাত হা. ৫১৫৬)
(اِنَّ ھٰذَا لَفِی .....)
অর্থাৎ অত্র সূরায় যেসব উত্তম বিধি-বিধান ও সংবাদ উল্লেখ করা হলো এ সব কিছুর অর্থ ইবরাহীম ও মূসা (আঃ)-এর ওপর অবতীর্ণ সহীফায় উল্লেখ ছিল। ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : ১৪-১৭ নম্বর আয়াতে বর্ণিত বক্তব্য হল বিগত ইলাহী ধর্ম ও আসমানী কিতাবসমূহের শিক্ষার সারনির্যাস। যা মানুষকে দুনিয়াবী লোভ-লালসার কলুষ হতে মুক্ত করে এবং আখেরাতের স্বচ্ছ গুণাবলীতে আলোকিত করে।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. সূরার গুরুত্ব জানতে পারলাম।
২. মাখলূক সৃষ্টি করার পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ তা‘আলা তাকদীর নির্ধারণ করে রেখেছেন।
৩. সূরার প্রথম আয়াত পড়ে سبحان ربي الأعلي বলা মুস্তাহাব।
৪. অত্র সূরা ও সূরা গাশিয়াহ জুমু‘আ ও ঈদের সালাতে এবং বিতর সালাতে পাঠ করা সুন্নাত।
৫. যতক্ষণ দাওয়াতী কাজে উপকার আসবে ততক্ষণ তা বহাল রাখা আবশ্যক।
৬. দুনিয়ার চাকচিক্যকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দেয়া ঈমানের দুর্বলতা।
৭. আল্লাহ তা‘আলাকে যাবতীয় শির্ক, ত্রুটিপূর্ণ গুণ ও অসঙ্গতিপূর্ণ কথা থেকে পবিত্র করা আবশ্যক। তাঁর শানে অশোভনীয় কোন কথা বলা উচিত নয়।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: এ সূরাটি যে মক্কী সূরা তার প্রমাণ এই যে, হযরত বারা ইবনে আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “নবী করীম (সঃ)-এর সাহাবীদের মধ্যে যারা সর্ব প্রথম আমাদের নিকট (মদীনায়) আসেন তারা হলেন হযরত মুসআব ইবনে উমায়ের (রাঃ) এবং হযরত ইবনে উম্মি মাকতুম (রাঃ)। তাঁরা আমাদেরকে কুরআন পড়াতে শুরু করেন। অতঃপর হযরত বিলাল (রাঃ), হযরত আম্মার (রাঃ) এবং হযরত সা'দ (রাঃ) আগমন করেন। তারপর হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) বিশজন সাহাবী সমভিব্যাহারে আমাদের কছে আসেন। তারপর নবী করীম (সঃ) আসেন। আমি মদিনাবাসীকে অন্য কোন ব্যাপারে এতো বেশী খুশী হতে দেখিনি যতোটা খুশী তারা নবী (সঃ) এবং তাঁর সহচরদের আগমনে হয়েছিলেন। ছোট ছোট শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকরা পর্যন্ত আনন্দে কোলাহল শুরু করে যে, ইনি হলেন আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সঃ) রাসুলুল্লাহ্ (সঃ)-এর আগমনের পূর্বেই আমি(আরবি) সূরাটি, এ ধরনের অন্যান্য সূরাগুলোর সাথে মুখস্থ করে ফেলেছিলাম।”
মুসনাদে আহমদে হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) (আরবি) এই সূরাটিকে খুবই ভালবাসতেন।
সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত মুআয (রাঃ)-কে বলেনঃ “কেন তুমি নামাযে(আরবি) এই সূরাগুলো পড় না?” মুসনাদে আহমদে আরও বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) উভয় ঈদের নামাযে , (আরবি) এবং এ সূরা দুটি পাঠ করতেন। যদি ঘটনাক্রমে একই দিনে জুমআ ও ঈদের নামায পড়ে যেতো তবে তিনি উভয় নামাযেই এই সূরা দুটি পড়তেন। (এ হাদীসটি সহীহ মুসলিম, সুনানে আবী দাউদ, জামে তিরমিযী, সুনানে নাসায়ী এবং সুনানে ইবনে মাজাহতেও বর্ণিত হয়েছে)
মুসনাদে আহমদে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বেতরের নামাযে (আরবি) এবং (আরবি) এই সূরাগুলো পাঠ করতেন। অন্য একটি বর্ণনায় আরো বাড়িয়ে বলা হয়েছে যে, (আরবি) এবং(আরবি) এই সূরা দু’টিও পড়তেন। (এই হাদীসটিও নানাভাবে বহুসংখ্যক সাহাবী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তবে, এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী)
১-১৩ নং আয়াতের তাফসীর
মুসনাদে আহমদে হযরত উকবা ইবনে আমির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন (আরবি) অবতীর্ণ হয় তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) সাহাবীদেরকে বলেনঃ “এটাকে তোমরা রুকুর মধ্যে গ্রহণ করে নাও।” তারপর যখন (আরবি) অবতীর্ণ হলো তখন তিনি বললেনঃ “এটাকে তোমরা তোমাদের সিজদাহ্নর মধ্যে গ্রহণ কর।” (এ হাদীসটি ইমাম আবু দাউদ (রঃ) ও ইমাম ইবনে মাজা (রঃ) ও বর্ণনা করেছেন)
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) যখন (আরবি) পাঠ করতেন তখন তিনি (আরবি)বলতেন। [এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ (রঃ) ও ইমাম আবু দাউদ (রঃ)]
হযরত আলী (রাঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে আরো বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) (আরবি) পাঠ করে বলতেন এবং যখন তিনি (আরবি)এ সূরাটি পাঠ করতেন এবং শেষে, (আরবি) পড়তেন তখন বলতেন। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
আল্লাহ্ তা'আলা এখানে বলেনঃ তুমি তোমার সুমহান প্রতিপালকের নামের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর যিনি সমস্ত মাখলুককে সৃষ্টি করেছেন এবং সকলকে সুন্দর ও উন্নত আকৃতি দান করেছেন। যিনি মানুষকে সৌভাগ্যের বলতেন পনির্দেৰেছেন। যিনি পশুদের চারণভূমিতে তৃণ ও সবুজ ঘাসের ব্যবস্থা ফোন আল্লাহ্ তা'আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “(হযরত মুসা বললেন) আমাদের প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন, অতঃপর পথ নির্দেশ করেছেন।” (২০ ৫০) যেমন সহীহ মুসলিমে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আসমান ও জমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে আল্লাহ্ তা'আলা তাঁর সৃষ্ট জীবের ভাগ্যলিপি নির্ধারণ করেছেন। সেই সময় তার আরশ ছিল পানির উপর।”
মহান আল্লাহ বলেনঃ “যিনি তৃণাদি উৎপন্ন করেন, পরে ওকে ধূসর আবর্জনায় পরিণত করেন।
আরবের কোন কোন ভাষা-বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, এখানে (আরবি) শব্দটিকে যদিও শেষে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু অর্থের দিক দিয়ে এটাকে প্রথমে ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ যিনি ঘাস, তৃণ, শস্য, গাঢ় সবুজ রঙের করে সৃষ্টি করেছেন, তারপর ওকে বিশুদ্ধ করেছেন।
এরপর আল্লাহ্ পাক স্বীয় নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করে বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ) তোমাকে আমি নিশ্চয়ই পাঠ করাবো, ফলে তুমি বিস্মৃত হবে না। তবে হ্যা যদি স্বয়ং আল্লাহ্ কোন আয়াত ভুলিয়ে দিতে চান তবে সেটা স্বতন্ত্র কথা। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এ অর্থই পছন্দ করেন এবং তাতে এ আয়াতের অর্থ হবেঃ যে কুরআন আমি তোমাকে পড়াচ্ছি তা ভুলে যেয়ো না। তবে হ্যা, আমি যে অংশ মানসুখ করে দেই সেটা ভিন্ন কথা। অতঃপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা বলেনঃ আল্লাহর কাছে তাঁর বান্দাদের প্রকাশ্য ও গোপনীয় সমস্ত আমল বা কাজ এবং আকীদা বা বিশ্বাস সবই সুস্পষ্ট। হে নবী (সঃ)! আমি তোমার উপর ভাল কাজ, ভাল কথা, শরীয়তের হুকুম-আহকাম সহজ করে দিবো। এতে কোন প্রকার সংকীর্ণতা ও কাঠিন্য থাকবে না। থাকবে না কোন প্রকার বক্রতা। তুমি এমন জায়গায় উপদেশ দাও যেখানে উপদেশ হয় ফলপ্রসূ। এতে বুঝা যায় যে, অযোগ্য নালায়েকদেরকে শিক্ষাদান করা উচিত নয়। যেমন আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “যদি তোমরা কারো সাথে এমন কথা বল যা তার জন্যে বোধগম্য নয়, তবে তোমাদের কল্যাণকর কথা তার জন্যে অকল্যাণ বয়ে আনবে। তাতে ফিত্না-ফাসা ব। বরং মানুষের সাথে তোমরা তাদের বোধগম্য বিষয়ে কথা বলো, যাতে মানুষ আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে না পারে।”
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ এই কুরআন থেকে তারাই নসীহত বা উপদেশ লাভ করবে যাদের অন্তরে আল্লাহ্ ভীতি রয়েছে এবং যারা আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের ভয় মনে পোষণ করে। পক্ষান্তরে, যারা হতভাগ্য তারা এ কুরআন থেকে কোন শিক্ষা বা উপদেশ গ্রহণ করতে পারবে না। তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী। যেখানে কোনরূপ আরাম-আয়েশ ও শান্তি-সুখ নেই, বরং আছে চিরস্থায়ী আযাব ও নানা প্রকার যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
যারা আসল জাহান্নামী তারা না মৃত্যুবরণ করবে, না শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পাবে। তবে যাদের প্রতি আল্লাহ্ তা'আলা দয়া করার ইচ্ছা রাখেন তারা জাহান্নামের আগুনে পতিত হবার সাথে সাথেই পুড়ে মারা যাবে। তারপর সুপারিশকারী লোকেরা গিয়ে তাদের জন্যে সুপারিশ করবেন এবং তাদেরকে জাহান্নাম হতে বের করে এনে জীবনদানকারী ঝর্ণায় ফেলে দিবেন। তাদের উপর জান্নাতের ঐ ঝর্ণাধারা পানি ঢেলে দেয়া হবে। ফলে তারা সজীব হয়ে উঠবে যেমনভাবে বন্যায় নিক্ষেপিত বস্তুর (আবর্জনা স্কুপের) মাঝে বীজ গজিয়ে ওঠে।” তারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “তোমরা দেখো না যে, ঐ উদ্ভিদ প্রথমে সবুজ হয়, তারপর হলদে হয় এবং শেষে পূর্ণ সজীবতা লাভ করে থাকে?” তখন সাহাবীদের কোন একজন বললেনঃ “নবীপাক (সঃ), কথাগুলো এমনভাবে বললেন যে, যেন তিনি জঙ্গলেই ছিলেন।” (এ হাদীসটি মুসনাদে আহমদে হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। তাছাড়া এটা বিভিন্ন শব্দে আরো বহু হাদীসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে)
আল্লাহ্ তা'আলা জাহান্নামবাসীদের সম্পর্কে খবর দিতে গিয়ে কুরআন কারীমে বলেছেনঃ (আরবি)
অর্থাৎ “জাহান্নামীরা চীৎকার করে বলবেঃ হে (জাহান্নামের দারোগা) মালিক! আপনার প্রতিপালককে বলুন যে, তিনি যেন আমাদের মৃত্যু ঘটিয়ে দেন। তখন জবাবে তাদেরকে বলা হবেঃ তোমাদেরকে এখানেই পড়ে থাকতে হবে।” (৪৩:৭৭) আর এক জায়গায় আল্লাহ পাক বলেনঃ (আরবি)
তাদের মৃত্যুও ঘটানো হবে না এবং তাদের আযাবও হালকা করা করেন। (০৫:৬)এই অর্থ সম্বলিত আরো আয়াত রয়েছে।
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।