সূরা আল-মুলক (আয়াত: 13)
হরকত ছাড়া:
وأسروا قولكم أو اجهروا به إنه عليم بذات الصدور ﴿١٣﴾
হরকত সহ:
وَ اَسِرُّوْا قَوْلَکُمْ اَوِ اجْهَرُوْا بِهٖ ؕ اِنَّهٗ عَلِیْمٌۢ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ ﴿۱۳﴾
উচ্চারণ: ওয়া আছিররূকাওলাকুম আবিজহারূবিহী ইন্নাহূ‘আলীমুম বিযা- তিসসুদূ র।
আল বায়ান: আর তোমরা তোমাদের কথা গোপন কর অথবা তা প্রকাশ কর, নিশ্চয় তিনি অন্তরসমূহে যা আছে সে বিষয়ে সম্যক অবগত।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ১৩. আর তোমরা তোমাদের কথা গোপনেই বল অথবা প্রকাশ্যে বল, তিনি তো অন্তরসমূহে যা আছে তা সম্পর্কে সম্যক অবগত।
তাইসীরুল ক্বুরআন: তোমরা তোমাদের কথা চুপেচাপেই বল আর উচ্চৈঃস্বরেই বল, তিনি (মানুষের) অন্তরের গোপন কথা সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত।
আহসানুল বায়ান: (১৩) তোমরা তোমাদের কথা গোপনেই বল অথবা প্রকাশ্যে,[1] নিশ্চয় তিনি অন্তর্যামী।[2]
মুজিবুর রহমান: তোমরা তোমাদের কথা গোপনেই বল অথবা প্রকাশ্যে বল, তিনিতো অন্তর্যামী।
ফযলুর রহমান: তোমরা তোমাদের কথা গোপন রাখ অথবা প্রকাশ করো, (তিনি তা জানেন, কারণ) তিনি তো অন্তরের বিষয়াদি সম্যক অবগত।
মুহিউদ্দিন খান: তোমরা তোমাদের কথা গোপনে বল অথবা প্রকাশ্যে বল, তিনি তো অন্তরের বিষয়াদি সম্পর্কে সম্যক অবগত।
জহুরুল হক: অথচ তোমাদের কথাবার্তা তোমরা গোপন কর অথবা তা প্রকাশই কর। নিঃসন্দেহ তিনি বুকের ভেতরের বিষয় সন্বন্ধেও সর্বজ্ঞাতা।
Sahih International: And conceal your speech or publicize it; indeed, He is Knowing of that within the breasts.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ১৩. আর তোমরা তোমাদের কথা গোপনেই বল অথবা প্রকাশ্যে বল, তিনি তো অন্তরসমূহে যা আছে তা সম্পর্কে সম্যক অবগত।
তাফসীর:
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: (১৩) তোমরা তোমাদের কথা গোপনেই বল অথবা প্রকাশ্যে,[1] নিশ্চয় তিনি অন্তর্যামী।[2]
তাফসীর:
[1] এখানে আবারও কাফেরদেরকে সম্বোধন করা হচ্ছে। অর্থাৎ, তোমরা রসূল (সাঃ)-এর ব্যাপারে গোপনে কথা বল অথবা প্রকাশ্যে, সব কিছুই আল্লাহ অবগত আছেন। কোন কথাই তাঁর কাছে গোপন থাকে না।
[2] এখানে তাঁর গোপনীয় ও প্রকাশ্য বিষয় জানার কারণ বর্ণনা করে বলা হচ্ছে যে, তিনি তো মনের ও অন্তরের গুপ্ত রহস্যসমূহের ব্যাপারেও অবহিত। অতএব তোমাদের কথাসমূহ কিভাবে তাঁর কাছে গোপন থাকতে পারে?
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: ১২-১৫ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
কাফিরদের অবস্থা বর্ণনা করার পর আল্লাহ তা‘আলাকে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ভয় করে এমন ঈমানদারদের বিবরণ তুলে ধরেছেন। এখানে الْغَيْب শব্দ দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে :
১. যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে চলে, অথচ তারা আল্লাহ তা‘আলাকে দেখেনি। আর যারা নাবী-রাসূলদের কথায় ঈমান এনে জান্নাতের আশায় সৎ আমল করে এবং জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য অসৎ আমল থেকে বেঁচে থাকে তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও বড় প্রতিদান। এটা গায়েবের প্রতি ঈমানের অন্তর্ভুক্ত।
২. যারা আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে চলে লোকদের দৃষ্টির অন্তরালে একাকী অবস্থায়। লোকজনের সামনে যেমন অপরাধ করে না তেমনি লোকজনের আড়ালেও অপরাধ করে না। যেমন হাদীসে এসেছে : সাত শ্রেণীর মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা আরশের ছায়ার নীচে ছায়া দেবেন যেদিন অন্য কোন ছায়া থাকবে না। তার মধ্যে একশ্রেণি হলো যাকে সুন্দরী ও সম্ভ্রান্ত নারী খারাপ কাজের জন্য ডাকে (এবং তার খারাপ কাজ করতে কোন বাধা নেই) কিন্তু সে বলে আমি আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করি। (সহীহ মুসলিম হা. ৬২৯)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন যে, তিনি (عَلِیْمٌۭ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ) অর্থাৎ মানুষের প্রকাশ্য সহ অন্তরে যা উদ্রেক হয় তাও তিনি জানেন।
اللَّطِيْفُ অর্থ হল : সূক্ষ্মদর্শী।
الذي لطف علمه بما في القلوب
যিনি অন্তরের সমস্ত খবর জানেন ও দেখেন (ফাতহুল কাদীর)।
ذَلُوْلًا শব্দের অর্থ : এমন অনুগত যে, সামনে অবনত হয়ে যায় এবং কোন প্রকার অবাধ্য হয় না। অর্থাৎ জমিনকে আল্লাহ তা‘আলা মানুষের বসবাসের অনুগামী করে দিয়েছেন যাতে তারা চলতে-ফিরতে পারে। আনুগত্য বা বশীভূত হওয়া বা পোষ মানার এ গুণটি সাধারণত জন্তু জানোয়ারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ গুণটি স্বয়ং পৃথিবীর উপরেও প্রযোজ্য। আমরা যে পৃথিবী দেখি, একই জায়গায় স্থির ও নিস্তদ্ধ হয়ে আছে, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে আসলে তা চলমান, শুধু চলমান নয় বরং সবেগে ধাবমান এক জন্তুর ন্যায়। আবার একই সাথে সে বিনয়াবনত এবং অনুগতও। সে তার আরোহীকে পিঠ থেকে নাড়া দিয়ে ফেলে দেয়না। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে যেমন মানুষকে সুন্দর ও সস্তির সাথে বসবাস করার সুযোগ দান করেছেন তেমনি পৃথিবী থেকে খাদ্যসম্ভারও উৎপন্ন করছেন।
مَنٰكِب শব্দটি منكب এর বহুবচন। অর্থ : দিক। অর্থাৎ পৃথিবীর দিক-দিগন্তে ভ্রমণ করা এবং তাতে দেওয়া রিযিক অন্বেষণ করা, রিযিকের জন্য ভ্রমণ করা, ব্যবসায় করা, কাজ করা ইত্যাদি আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করার পরিপন্থী নয়। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন; তোমরা যদি আল্লাহ তা‘আলার ওপর সত্যিকার ভরসা কর যেমন ভরসা করা উচিত তাহলে তিনি তোমাদেরকে পাখির মত রিযিক দেবেন। পাখি যেমন সকাল বেলা খালি পেটে বের হয় আবার বিকাল বেলা ভরা পেটে ফিরে আসে। (তিরমিযী হা. ২৩৪৪, ইবনু মাযাহ হা. ৪১৬৪, সহীহ)
সুতরাং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সর্বাবস্থায় আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে চলা এবং তাঁর ওপর ভরসা করা উচিত।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. যারা আল্লাহ তা‘আলাকে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সর্বদা ভয় করে তাদের মর্যাদা জানলাম।
২. আল্লাহ তা‘আলা মানুষের অন্তরের খবরও রাখেন।
৩. পৃথিবীর সব কিছু আল্লাহ তা‘আলা মানুষের উপকারার্থে সৃষ্টি করেছেন।
৪. আল্লাহ তা‘আলার ওপর ভরসা করার প্রকৃত অর্থ জানলাম।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: ১২-১৫ নং আয়াতের তাফসীর
আল্লাহ ঐ লোকদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছেন যারা তাদের প্রতিপালকের সম্মুখে দণ্ডায়মান হওয়া সম্পর্কে ভয় করে। যদিও তারা নির্জনে অবস্থান করে, যেখানে কারো দৃষ্টি পড়বে না; তথাপিও তারা আল্লাহর ভয়ে তার অবাধ্যতামূলক কাজ করে না এবং তাঁর আনুগত্য ও ইবাদত হতে বিমুখ হয় না। আল্লাহ তা'আলা তাদের পাপরাশি মার্জনা করে দিবেন। যেমন সহীহ্ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে রয়েছেঃ “সাত প্রকারের লোককে আল্লাহ তাঁর আরশের ছায়ায় এমন দিনে স্থান দিবেন যেই দিন তাঁর (আরশের) ছায়া ছাড়া আর কোন ছায়া থাকবে না।” তাদের মধ্যে এক প্রকার হলো ঐ ব্যক্তি যাকে এক সম্ভ্রান্ত বংশীয়া সুন্দরী মহিলা (ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে, কিন্তু সে উত্তরে বলেঃ “আমি আল্লাহকে ভয় করি (সুতরাং আমি তোমার সাথে এ কাজে লিপ্ত হতে পারি না)।” আর এক প্রকার হলো ঐ ব্যক্তি যে-গোপনে দান করে, এমনকি তার ডান হাত যা দান করে বাম হাত তা জানতে পারে না।”
হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, সাহাবীগণ বলেনঃ `হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার সামনে আমাদের অন্তরের যে অবস্থা থাকে, আপনার সাহচর্য হতে পৃথক হওয়ার পর আমাদের অন্তরের ঐ অবস্থা আর থাকে না। (তাহলে কি আমরা মুনাফিকের মধ্যে গণ্য হবে?)।” তাঁদের এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বলেনঃ “তোমাদের প্রতিপালকের সাথে তোমাদের অবস্থা কি থাকে?” জবাবে তারা বললেনঃ “প্রকাশ্যে ও গোপনে আমরা ‘আল্লাহকেই আমাদের প্রতিপালক বলে স্বীকার করে থাকি।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “(তা হলে নিশ্চিন্ত থাকো,) তোমাদের এটা নিফাক বা কপটতা নয়।` (এ হাদীসটি হাফিয আবূ বকর আল বাযযার (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ তোমরা তোমাদের কথা গোপনেই বল অথবা প্রকাশ্যে বল, তিনি তো অন্তর্যামী। অর্থাৎ তোমাদের অন্তরের খবরও তিনি জানেন। সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টজীব হতে বে-খবর থাকবেন, এটা তো অসম্ভব। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তো সূক্ষ্মদর্শী ও সবকিছুই সম্যক অবগত।
মহামহিমান্বিত আল্লাহ এরপর স্বীয় নিয়ামতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেনঃ তিনিই তো তোমাদের জন্যে ভূমিকে সুগম করে দিয়েছেন এটা স্থিরতার সাথে বিছানো রয়েছে। এটা মোটেই হেলা-দোলা করছে না। ফলে তোমরা এর উপর শান্তিতে বিচরণ করছে। এটা যেন নড়া-চড়া করতে না পারে তজ্জনে আল্লাহ পাক পাহাড় পর্বতকে এতে পেরেক রূপে মেরে দিয়েছেন। এতে তিনি পানির প্রস্রবণ প্রবাহিত করেছেন। বিভিন্ন প্রকারের উপকার তিনি এতে রেখে দিয়েছেন। এটা হতে তিনি ফল ও শস্য উৎপন্ন করছেন। তোমরা এখানে যথেচ্ছা ভ্রমণ করতে রয়েছে। এখানে তোমরা ব্যবসা বাণিজ্য করে অর্থ উপার্জন করতে রয়েছে। এভাবে তিনি তোমাদের জীবনোপকরণের ব্যবস্থা করেছেন। তোমরা জীবিকা অর্জনের জন্যে চেষ্টা তদবীর করছে এবং আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা তোমাদের চেষ্টাকে সফল করছেন।
এর দ্বারা জানা গেল যে, জীবনোপকরণ লাভ করার জন্য চেষ্টা করা নির্ভরশীলতার পরিপন্থী নয়। যেমন মুসনাদে আহমাদে হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে বলতে শুনেছেনঃ “তোমরা যদি আল্লাহর উপর যথাযোগ্য ভরসা করতে তবে তিনি তোমাদেরকে ঐভাবেই জীবিকা দান করতেন যেমনভাবে পাখীকে জীবিকা দান করে থাকেন, পাখী সকালে খালি পেটে যায় এবং সন্ধ্যায় ভরা পেটে ফিরে আসে। (এ হাদীসটি ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহও (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) এটাকে হাসান সহীহ বলেছেন) সুতরাং পাখীর সকাল-সন্ধ্যায় জীবিকার সন্ধানে গমনাগমন করাকেও নির্ভরশীলতার অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হয়েছে। কেননা, উপকরণ সৃষ্টিকারী এবং ওটাকে সহজকারী একমাত্র আল্লাহ রাব্বল আলামীনই বটে। কিয়ামতের দিন তাঁরই নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ গুরুজন (আরবি)-এর অর্থ নিয়েছেন প্রান্ত এবং এদিক ওদিকের স্থান। হযরত কাতাদাহ (রঃ) প্রমুখ মনীষী বলেন যে, (আরবি) দ্বারা পাহাড় পর্বতকে বুঝানো হয়েছে।
হযরত বাশীর ইবনে কা'ব (রঃ) এ আয়াতটি পাঠ করার পর তাঁর ঐ দাসীকে, যার গর্ভে তাঁর সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল, বলেনঃ “তুমি যদি (আরবি) এর সঠিক তাফসীর বলতে পার তবে আমি তোমাকে আযাদ করে দিবো।” তখন ঐ দাসীটি বলে যে, এর দ্বারা পাহাড় উদ্দেশ্য। হযরত বাশীর (রঃ) তখন হযরত আবূ দারদা (রাঃ)-কে এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তরে বলেন যে, এটা সঠিক তাফসীরই বটে।
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।