সূরা আত-তূর (আয়াত: 13)
হরকত ছাড়া:
يوم يدعون إلى نار جهنم دعا ﴿١٣﴾
হরকত সহ:
یَوْمَ یُدَعُّوْنَ اِلٰی نَارِ جَهَنَّمَ دَعًّا ﴿ؕ۱۳﴾
উচ্চারণ: ইয়াওমা ইউদা‘‘ঊনা ইলা-না-রি জাহান্নামা দা‘‘আ-।
আল বায়ান: সেদিন তাদেরকে জাহান্নামের আগুনের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ১৩. যেদিন তাদেরকে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের আগুনের দিকে
তাইসীরুল ক্বুরআন: যেদিন তাদেরকে জাহান্নামের আগুনের দিকে তাড়িয়ে নেয়া হবে ধাক্কাতে ধাক্কাতে,
আহসানুল বায়ান: (১৩) সেদিন তাদেরকে ধাক্কা মারতে মারতে[1] নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের আগুনের দিকে।
মুজিবুর রহমান: যেদিন তাদেরকে হাকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের আগুনের দিকে,
ফযলুর রহমান: যেদিন তাদেরকে ধাক্কা দিতে দিতে জাহান্নামের আগুনের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে,
মুহিউদ্দিন খান: সেদিন তোমাদেরকে জাহান্নামের অগ্নির দিকে ধাক্কা মেরে মেরে নিয়ে যাওয়া হবে।
জহুরুল হক: সেইদিন তাদের ধাক্কা দিয়ে নেওয়া হবে জাহান্নামের আগুনের দিকে ধাক্কা দিতে দিতে।
Sahih International: The Day they are thrust toward the fire of Hell with a [violent] thrust, [its angels will say],
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ১৩. যেদিন তাদেরকে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের আগুনের দিকে
তাফসীর:
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: (১৩) সেদিন তাদেরকে ধাক্কা মারতে মারতে[1] নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের আগুনের দিকে।
তাফসীর:
[1] الدَّعَّ এর অর্থ হল অত্যন্ত জোরে ধাক্কা দেওয়া।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: নামকরণ ও ফযীলত :
الطُّوْرِ তূর সে পাহাড় যেখানে মূসা (আঃ) মহান আল্লাহ তা‘আলা সাথে বাক্যালাপ করেছিলেন। এ পাহাড়টিকে “তূরে সাইনা”-ও বলা হয়। এ طور শব্দ থেকেই সূরার নাম ‘তূর’ রাখা হয়েছে।
যুবাইর ইবনু মুত‘ঈম (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, আমি নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে মাগরিবের সালাতে সূরা ‘তূর’ পড়তে শুনেছি। তাঁর চেয়ে উত্তম সুর বা উত্তম কিরাআতে আর কারো কাছে শুনিনি। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৫৩)
উম্মে সালামাহ্ (রাঃ) বলেন : আমার অসুস্থতার কথা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানালাম। তিনি বললেন : তুমি আরোহী হয়ে মানুষের পেছনে তাওয়াফ করো। আমি সেভাবেই তাওয়াফ করলাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাইতুল্লাহর পাশে সালাতে
(وَالطُّوْرِ- وَكِتَابٍ مَّسْطُورٍ)
পড়ছিলেন। (সহীহ বুখারী হা. ৪৮৫৩)
১-১৬ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
وَالطُّورِ পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, ‘তূর’ সে পাহাড় যেখানে মূসা (আঃ) আল্লাহ তা‘আলার সাথে বাক্যালাপ করেছিলেন। (আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর) এ পাহাড়ের শপথ করেছেন তার সম্মান ও মর্যাদা এবং তাতে যে সকল নিদর্শন রয়েছে তার দিকে লক্ষ্য রেখে।
হাফিয ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : ‘তূর’ বলা হয় এমন পাহাড়কে যেখানে গাছপালা জন্মায়। যেমন মূসা (আঃ) আল্লাহ তা‘আলা সাথে যে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে বাক্যালাপ করেছিলেন এবং যেখান হতে ‘ঈসা (আঃ)-কে পাঠিয়েছিলেন। আর যে পাহাড়ে কোন প্রকার গাছপালা জন্মায় না তাকে “তূর” বলা হয় না; তাকে “জাবাল” বলা হয়। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
(وَكِتَابٍ مَّسْطُوْرٍ)
‘শপথ কিতাবের, যা লিখিত আছে’ مَسْطُورٍ অর্থ হলো : লিপিবদ্ধ, লিখিত বস্তু। কেউ বলেছেন- এটা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো লাওহে মাহফূজ। কেউ বলেছেন : কুরআন মাজীদ, কেউ বলেছেন : মানুষের আমলনামা যা ফেরেশতাগণ লিখে থাকে।
(رَقٍّ مَّنْشُوْرٍ) ‘খোলা পত্রে’ অর্থ : পাতলা চামড়া যার ওপর লেখা হয়। منشور অর্থ : উন্মুক্ত, বিস্তৃত এ আয়াতের সম্পর্ক পূর্বের আয়াতের সাথে।
(وَالْبَيْتِ الْمَعْمُوْرِ)
‘শপথ বায়তুল মা’মূরের’ বাইতুল মা‘মুর হলো সপ্ত আকাশের ওপর অবস্থিত সে ‘ইবাদতখানা যেখানে ফেরেশতারা ‘ইবাদত করেন। এ ‘ইবাদতখানা ফেরেশতাগণের দ্বারা এমনভাবে পরিপূর্ণ হয়ে থাকে যে, প্রত্যহ এতে সত্তর হাজার করে ফেরেশতা ‘ইবাদতের জন্য প্রবেশ করেন। যাদের কিয়ামত পর্যন্ত পুনরায় প্রবেশের পালা আসবে না। যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মি‘রাজের হাদীসে বলেন (সপ্তম আকাশ অতিক্রম করার পর) :
অতঃপর আমাকে বাইতুল মা‘মূরে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা ‘ইবাদতের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে থাকেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের পুনরায় আসার পালা আসবে না। (সহীহ বুখারী হা. ৩২০৭, সহীহ মুসলিম হা. ৪৩৪)
অর্থাৎ ফেরেশতারা সেখানে ‘ইবাদত ও তাওয়াফ করে, যেমন দুনিয়াবাসী কা‘বা ঘর তাওয়াফ করে। সেটা আকাশবাসীদের জন্য কাবা। এজন্য ইবরাহীম (আঃ) বাইতুল মা‘মূরে পিঠ লাগিয়ে বসে আছেন, কারণ তিনি দুনিয়ার কাবা তৈরি করেছেন। (ইবনু কাসীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
(وَالسَّقْفِ الْمَرْفُوعِ)
‘শপথ সমুন্নত আকাশের’ এ থেকে আকাশকে বুঝানো হয়েছে যা পৃথিবীর জন্য ছাদস্বরূপ। পবিত্র কুরআনে এটাকে “সুরক্ষিত ছাদ” বলা হয়েছে।
(وَجَعَلْنَا السَّمَا۬ءَ سَقْفًا مَّحْفُوْظًا ج وَّهُمْ عَنْ اٰيٰتِهَا مُعْرِضُوْنَ)
“এবং আকাশকে করেছি সুরক্ষিত ছাদ; কিন্তু তারা আকাশস্থিত নিদর্শনাবলী হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়।” (সূরা আম্বিয়া- ২১ :৩২)
(وَالْبَحْرِ الْمَسْجُورِ)
‘এবং শপথ উদ্বেলিত সমুদ্রের’ আলিমগণ এখানে দু’ধরনের তাফসীর করেছেন।
(১) مسجور অর্থাৎ সমুদ্রকে আগুন হিসেবে প্রজ্জ্বলিত করা। কেননা সমুদ্রকে কিয়ামতের দিন আগুন দ্বারা প্রজ্জ্বলিত করা হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
( فِي الْحَمِيْمِ ৫لا ثُمَّ فِي النَّارِ يُسْجَرُوْنَ)
“ফুটন্ত পানিতে, অতঃপর তাদেরকে দগ্ধ করা হবে অগ্নিতে।” (সূরা আল মু’মিন ৪০ :৭২)
(২) مسجور অর্থ مملوء বা পরিপূর্ণ। কেননা সমুদ্র পানি দ্বারা পরিপূর্ণ। مسجور-এর উভয় অর্থের কথা এ আয়াতে রয়েছে।
(وَإِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ)
“এবং সমুদ্রগুলোকে যখন উদ্বেলিত করা হবে।” (সূরা আত্ তাকভীর ৮১ :৬)
এ সব মাখলুকের শপথ করার পর আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি আসবেই। এর কোন প্রতিরোধকারী নেই।
(تَمُوْرُ السَّمَا۬ءُ) -- مور
অর্থ হলো : আন্দোলন, অস্থিরতা। অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আকাশের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার মধ্যে যে বিশৃঙ্খলা এবং মহাশূন্যে ভ্রাম্যমান তারকারাজি ঝরে ও খসে পড়ার কারণে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে, সেটাকেই বুঝানো হয়েছে। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন : চরমভাবে নড়াচড়া করবে।
(وَتَسِيْرُ الْجِبَالُ)
অর্থাৎ পাহাড়গুলো দ্রুত চলবে, ফলে তা ধূলিকণার মতো পাতলা হয়ে যাবে।
সে কঠিন দিনে তাদের জন্য দুর্ভোগ যারা মিথ্যুক, যারা দুনিয়াতে বাতিলের সাথে ছিল আর ধর্মকে ঠাট্টা-বিদ্রƒপের বস্তু হিসেবে গ্রহণ করে ছিল।
(يُدَعُّوْنَ إِلَي نَارِ) শব্দের অর্থ হলো : শক্তি ব্যবহার করে জোরপূর্বক হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া। যেমন আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী :
(فَذٰلِكَ الَّذِيْ يَدُعُّ الْيَتِيْمَ)
“এ তো হচ্ছে সেই ব্যক্তি, যে (নিরীহ) এতীমকে গলা ধাক্কা দেয়।” (সূরা আল মা‘ঊন ১০৭ :৩)
উক্ত আয়াত দু’টি বিষয় শামিল করেছে-
(১) কাফিরদেরকে সেদিন শক্তি ব্যবহার করে জোরপূর্বক জাহান্নামে নিয়ে যাওয়া হবে।
আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) -কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার কারণে এটা তাদের পরিণাম।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :
(وَأَمَّا الَّذِيْنَ فَسَقُوْا فَمَأْوٰهُمُ النَّارُ ط كُلَّمَآ أَرَادُوْآ أَنْ يَّخْرُجُوْا مِنْهَآ أُعِيْدُوْا فِيْهَا وَقِيْلَ لَهُمْ ذُوْقُوْا عَذَابَ النَّارِ الَّذِيْ كُنْتُمْ بِه۪ تُكَذِّبُوْنَ)
“আর যারা পাপ কাজ করেছে তাদের বাসস্থান হবে জাহান্নাম। যখনই তারা সেখান থেকে বের হতে চাইবে, তখনই তাদেরকে সেথায় ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং তাদেরকে বলা হবে, আগুনের স্বাদ গ্রহণ (শাস্তি ভোগ) কর যা তোমরা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে।” অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اِنْطَلِقُوْٓا اِلٰی مَا کُنْتُمْ بِھ۪ تُکَذِّبُوْنَﭬاِنْطَلِقُوْٓا اِلٰی ظِلٍّ ذِیْ ثَلٰثِ شُعَبٍﭭ لَّا ظَلِیْلٍ وَّلَا یُغْنِیْ مِنَ اللَّھَبِﭮاِنَّھَا تَرْمِیْ بِشَرَرٍ کَالْقَصْرِﭯکَاَنَّھ۫ جِمٰلَتٌ صُفْرٌ)
‘‘তোমরা চল তারই দিকে যাকে মিথ্যা মনে করতে। ==
চল সে ছায়ার দিকে যার তিনটি শাখা রয়েছে, যে ছায়া শীতল নয় এবং যা অগ্নিশিখা হতে রক্ষাও করে না, নিশ্চয়ই তা নিক্ষেপ করবে প্রাসাদতুল্য স্ফুলিঙ্গ। যা (দেখে মনে হবে) হলুদ বর্ণের উট।” (সূরা মুরসালাত ৭৭ :২৯-৩৩)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. আল্লাহ তা‘আলা যে কোন মাখলুকের শপথ করতে পারেন, কিন্তু বান্দা কেবল আল্লাহ তা‘আলা নাম ছাড়া অন্য নামে শপথ করতে পারবে না।
২. মিথ্যুকদের জন্য কিয়ামতের দিন দুর্ভোগ।
৩. যেমন কর্ম তেমন ফল।
৪. কিয়ামতের পূর্বে আকাশ ও জমিনের কঠিন অবস্থা সম্পর্কে জানলাম।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: হযরত জুবায়ের ইবনে মুতইম (রাঃ) বলেনঃ “আমি মাগরিবের নামাযে নবী (সাঃ)-কে সূরায়ে তূর পড়তে শুনেছি। তার চেয়ে অধিক সুমিষ্ট সুর বিশিষ্ট উত্তম কিরআতকারী লোক আমি একটিও দেখিনি।” (এ হাদীসটি ইমাম মালিক তাঁর মুআত্তা' গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ “হজ্বের সময় আমি রুগ্না হয়ে পড়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে আমি আমার অবস্থা বর্ণনা করলে তিনি আমাকে বলেনঃ “তুমি সওয়ারীর উপর আরোহণ করে জনগণের পিছনে পিছনে তাওয়াফ করে নাও।” সুতরাং আমি সওয়ারীর উপর বসে তাওয়াফ করলাম। ঐ সময় নবী (সঃ) বায়তুল্লাহ শরীফের এক কোণে নামায পড়ছিলেন এবং (আরবী)-এর তিলাওয়াত করছিলেন।” (ইমাম বুখারী (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)
১-১৬ নং আয়াতের তাফসীর:
যেগুলো আল্লাহ তাআলার ব্যাপক ও মহাশক্তির নিদর্শন সেগুলোর শপথ করে আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ তার শাস্তি অবশ্যই আসবে। যখন তাঁর শাস্তি আসবে তখন কারো ক্ষমতা নেই যে, তা প্রতিরোধ করতে পারে।
যে পাহাড়ের উপর গাছ থাকে ঐ পাহাড়কে ‘র’ বলে। যেমন ঐ পাহাড়টি, যার উপর আল্লাহ তা'আলা হযরত মূসা (আঃ)-এর সাথে কথা বলেছিলেন এবং যেখান হতে হযরত ঈসা (আঃ)-কে পাঠিয়েছিলেন। আর শুষ্ক পাহাড়কে ‘জাবাল বলা হয়। এটাকে ‘র’ বলা হয় না।
(আরবী) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো লাওহে মাহফুয’ বা রক্ষিত ফলক। অথবা এর দ্বারা আল্লাহ তা'আলার অবতারিত ও লিখিত কিতাব সমূহকে বুঝানো হয়েছে যেগুলো মানুষের সামনে পাঠ করা হয়। এ জন্যেই এর পরেই বলা হয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ উন্মুক্ত পত্রে।
বায়তুল মা'মূর' এর ব্যাপারে মিরাজ সম্বলিত হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “সপ্তম আকাশ হতে সামনে অগ্রসর হওয়ার পর আমাকে বায়তুল মা'মূর দেখানো হয় যেখানে প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে থাকেন। দ্বিতীয় দিনও এই সংখ্যকই ফেরেশতাদের সমাবেশ সেখানে ঘটে থাকে। কিন্তু প্রথম দিন যাদের সমাবেশ হয়, কিয়ামত পর্যন্ত আর তাঁদের পালা পড়বে না। ভূ-পৃষ্ঠে যেমন কাবা শরীফের তাওয়াফ হয়ে থাকে তেমনই বায়তুল মা'মূর হলো আকাশবাসীদের তাওয়াফ ও ইবাদতের জায়গা।” ঐ হাদীসেই রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ সময় হযরত ইবরাহীম (আঃ)-কে বায়তুল মা'মূরের সাথে কোমর লাগিয়ে বসে থাকতে দেখেন। এতে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত এই রয়েছে যে, যেহেতু হযরত ইবরাহীম (আঃ) বায়তুল্লাহ শরীফের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং তাঁর হাতেই তা নির্মিত হয়েছে সেই হেতু সেখানেও তাঁকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) ওর সাথে লেগে থাকতে দেখতে পান। সুতরাং আল্লাহ তা'আলা যেন তাকে তার আমলেরই অনুরূপ প্রতিদান দিলেন। এই বায়তুল মা'মূর কাবা শরীফের ঠিক উপরে রয়েছে। আর ওটা রয়েছে সপ্তম আকাশের উপর। এমন তো প্রতিটি আকাশে এমন একটি ঘর রয়েছে যেখানে ঐ আকাশের ফেরেশতারা আল্লাহ তা'আলার ইবাদত করে থাকেন। প্রথম আকাশে এরূপ যে ঘরটি রয়েছে ওটাকে বলা হয় বায়তুল ইযত। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “সপ্তম আকাশে একটি ঘর রয়েছে যাকে মা’মূর বলা হয়, যা কা'বার দিকে রয়েছে। চতুর্থ আকাশে একটি নহর আছে যার নাম হাইওয়ান। তাতে হযরত জিবরাঈল (আঃ) প্রত্যহ ডুব দিয়ে থাকেন এবং উঠে দেহ ঝেড়ে থাকেন। ফলে তাঁর দেহ হতে সত্তরটি বিন্দু ঝরে পড়ে। প্রত্যেক বিন্দু হতে আল্লাহ তা'আলা এক একজন ফেরেশতা সৃষ্টি করেন। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, তারা যেন বায়তুল মামুরে গিয়ে নামায আদায় করেন। তারপর তারা সেখান হতে বেরিয়ে আসে। অতঃপর আর তাদের সেখানে যাওয়ার সুযোগে ঘটে না। তাঁদের একজন নেতা থাকেন যাঁকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, তিনি যেন তাদেরকে নিয়ে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে যান। তারপর তারা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করতে থাকেন। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের এই ব্যস্ততাই থাকে।” (এ হাদীসটি ইবনে আবি হাতিম (রঃ) বর্ণনা করেছেন। এটা খুবই গারীব হাদীস। এর বর্ণনাকারী রাওহ্ ইবনে সবাহ এতে একাকী রয়েছেন। হাফিযদের একটি দল তার উপর এ হাদীসটিকে অস্বীকার করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন জাওজানী (রঃ), আকীল (রঃ), হাকিম আবু আবদিল্লাহ নীশাপুরী (রঃ) প্রমুখ। হাকিম (রঃ) হাদীসটিকে ভিত্তিহীন বলেছেন)
হযরত খালিদ ইবনে আরআরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একটি লোক হযরত আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেঃ “বায়তুল মা'মূর কি?` উত্তরে তিনি বলেনঃ “ওটা আকাশে রয়েছে। ওটাকে সুরাহ বলা হয়। কা'বার ঠিক উপরে ওটা রয়েছে। যমীনের কা'বা যেমন মর্যাদা সম্পন্ন স্থান, অনুরূপভাবে ওটা আসমানে মর্যাদা সম্পন্ন স্থান। প্রত্যহ তাতে সত্তর হাজার ফেরেশতা নামায আদায় করে থাকেন। কিন্তু একদিন যারা তাতে প্রবেশ করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত আর তাঁদের সেখানে যাওয়ার পালা পড়বে না। কেননা, ফেরেশতা অসংখ্য রয়েছেন। (এটা ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন) একটি রেওয়াইয়াতে রয়েছে যে, এই প্রশ্নকারীর নাম ছিল ইবনুল কাওয়া (রাঃ)। হযরত ইবনে আব্বাস (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, বায়তুল মা'মূর আরশের পাদদেশে রয়েছে।
একটি মারফু হাদীসে রয়েছে যে, একদা বাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে (রাঃ) জিজ্ঞেস করেনঃ “বায়তুল মা'মূর কি তা তোমরা জান কি?” তারা উত্তরে বললেনঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই (সঃ) ভাল জানেন।” তখন তিনি বললেনঃ “ওটা হলো আসমানী কাবা। ওটা যমীনী কাবার ঠিক উপরে রয়েছে। যদি ওটা পড়ে যায় তবে যমীনের কা’বার উপরই পড়বে। এতে প্রত্যহ সত্তর হাজার ফেরেশতা নামায আদায় করে থাকেন। এক দল যখন ওটা হতে বের হন তখন কিয়ামত পর্যন্ত আর তারা সেখানে ফিরে যান না।
যহহাক (রঃ) বলেন যে, এই ফেরেশতাগুলো ইবলীস গোত্রের জ্বিনদের অন্তর্ভুক্ত। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
সমুন্নত ছাদ’ দ্বারা আকাশকে বুঝানো হয়েছে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি আকাশকে রক্ষিত ছাদ করেছি।” (২১:৩২)।
রাবী' ইবনে আনাস (রঃ) বলেন যে, এর দ্বারা আরশ’কে বুঝানো হয়েছে। কেননা, ওটা সমস্ত মাখলুকের ছাদ স্বরূপ। এই উক্তির ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া যেতে পারে যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আ’ম বা সাধারণ।
(আরবী) বা উদ্বেলিত সমুদ্র দ্বারা ঐ পানি উদ্দেশ্য যা আরশের নীচে রয়েছে। ওটা বৃষ্টির মত বর্ষিত হবে যার দ্বারা কিয়ামতের দিন মৃতরা পুনর্জীবন লাভ করে নিজ নিজ কবর হতে উথিত হবে। জমহুর বলেন যে, এর দ্বারা সাধারাণ সমুদ্র উদ্দেশ্য।
এটাকে (আরবী) বলার কারণ এই যে, কিয়ামতের দিন এতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হবে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “সমুদ্র যখন স্ফীত হবে।” (৮১:৬) অর্থাৎ যখন তাতে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হবে এবং ওটা ছড়িয়ে গিয়ে সারা হাশরের মাঠকে পরিবেষ্টন করে ফেলবে।
হযরত আ’লা ইবনে বদর (রঃ) বলেনঃ এটাকে উদ্বেলিত সমুদ্র বলার কারণ এই যে, ওর পানি পানের অযোগ্য হয়ে যাবে। ওটাকে জমিতে দেয়াও চলবে না। কিয়ামতের দিন সমুদ্রগুলোর অবস্থা এরূপই হবে। এর অর্থ প্রবাহিত সমুদ্রও করা হয়েছে। আবার বলা হয়েছে যে, এর অর্থ হলোঃ পরিপূর্ণ সমুদ্র, যার পানি এদিকে ওদিকে প্রবাহিত।
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, (আরবী)দ্বারা উদ্দেশ্য হলো খালি বা শূন্য। কোন দাসী পানি আনতে যায়, অতঃপর ফিরে এসে বলেঃ (আরবী) অর্থাৎ “নিশ্চয়ই চৌবাচ্ছা শূন্য।” এটাও বলা হয়েছেঃ এর অর্থ এই যে, এটাকে যমীন হতে থামিয়ে দেয়া হয়েছে, যেন ডুবিয়ে না দেয়।
হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “প্রতি রাত্রে সমুদ্র তিন বার করে আল্লাহ তা'আলার নিকট অনুমতি প্রার্থনা করে যে, সমস্ত মানুষকে ডুবিয়ে দেয়ার যেন তাকে হুকুম দেয়া হয়। কিন্তু আল্লাহ তা'আলা তাকে থামিয়ে দেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, একজন বুযুর্গ ব্যক্তি, যিনি একজন মুজাহিদ ছিলেন এবং সমুদ্রের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থানকারী সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তিনি জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণে সেখানে অবস্থান করছিলেন, তিনি। বলেনঃ “একদা রাত্রে আমি পাহারার উদ্দেশ্যে বের হই। ঐ রাত্রে অন্য কোন প্রহরী ছিল না। আমি টহল দিতে দিতে ময়দানে পৌছি। সেখান হতে আমি সমুদ্রের দিকে দৃষ্টিপাত করলে এরূপ মনে হয় যে, সমুদ্র যেন পর্বতের চূড়ার সাথে ধাক্কা খাচ্ছে। বার বার এই দৃশ্যই আমার দৃষ্টিগোচর হয়। আমি ঘটনাটি হযরত আবু সালেহ (রঃ)-এর কাছে বর্ণনা করলে তিনি হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত উপরোক্তে হাদীসটি আমাকে শুনিয়ে দেন।” (এর সনদে একজন বর্ণনাকারী অস্পষ্ট রয়েছেন, যার নাম উল্লেখ করা হয়নি)
যে বিষয়ের উপর এসব শপথ করা হয়েছে সেগুলোর বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, ওটা নিশ্চিত রূপেই আসবে এবং যখন তা এসে পড়বে তখন ওর নিবারণকারী কেউই হবে না।
হাফিয আবু বকর ইবনে আবিদ দুনিয়া (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, একদা রাত্রে হযরত উমার (রাঃ) শহরের অবস্থা দেখার উদ্দেশ্যে বের হন। একজন মুসলমানের বাড়ীর পার্শ্বদিয়ে গমনকালে তিনি দেখতে পান যে, লোকটি নামায পড়ছেন এবং সূরায়ে তূর পাঠ করছেন। তখন তিনি সওয়ারী থামিয়ে দিয়ে কুরআন শুনতে শুরু করেন। লোকটি যখন পড়তে পড়তে (আরবী)পর্যন্ত পৌঁছেন তখন তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েঃ “কা’বার প্রতিপালকের শপথ! এ কথা সত্য।” অতঃপর তিনি স্বীয় গাধার উপর হতে নেমে পড়েন এবং দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়েন। চলাফেরার শক্তি তাঁর থাকলো না। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর যখন তিনি শক্তি ফিরে পেলেন তখন বাড়ী ফিরে গেলেন। কিন্তু আল্লাহ পাকের কালামের এই ভীতিপূর্ণ আয়াত তাঁর উপর এমন ক্রিয়াশীল হলো যে, দীর্ঘ এক মাস পর্যন্ত রুগ্ন অবস্থায় থাকলেন। জনগণ তাঁকে দেখতে আসতো, কিন্তু তিনি কি রোগে ভুগছেন তা তারা জানতে পারতো না। আল্লাহ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন।
হযরত আবু উবায়েদ (রঃ) ফাযায়িলুল কুরআনের মধ্যে বর্ণনা করেছেন যে, একদা হযরত উমার (রাঃ) (আরবী)-এই আয়াতগুলো পাঠ করেন। তৎক্ষণাৎ তাঁর হেঁচকী বন্ধ হয়ে যায় এবং এটা তাঁর অন্তরে এমন ক্রিয়াশীল হয় যে, তিনি রুগ্ন হয়ে পড়েন। বিশ দিন পর্যন্ত জনগণ তাকে দেখতে আসতে থাকে।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ঐ দিন আকাশ আন্দোলিত হবে এবং ফেটে যাবে ও ঘুরতে শুরু করবে। আর পর্বত দ্রুত চলতে থাকবে। ওটা নিজ স্থান হতে সরে যাবে, এদিক হতে ওদিক চলে যাবে, কাঁপতে কাঁপতে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং ধুনো কূলার মত এদিক-ওদিক উড়তে থাকবে। এভাবে ওটার কোন নাম ও নিশানা থাকবে না। ঐ দিন মিথ্যাচারীদের বড়ই দুর্ভোগ পোহাতে হবে, যারা ক্রীড়াস্থলে আসার কার্যকলাপে লিপ্ত থাকে। আল্লাহর শাস্তি, ফেরেশতাদের মার এবং জাহান্নামের আগুন তাদের জন্যে হবে যারা দুনিয়ায় মগ্ন ছিল। যারা দ্বীনকে খেল-তামাশারূপে নির্ধারণ করে নিয়েছিল। সেই দিন তাদের ধাক্কা মারতে মারতে জাহান্নামের আগুনের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। জাহান্নামের রক্ষক তাদেরকে বলবেনঃ “এটা ঐ অগ্নি যাকে তোমরা মিথ্যা মনে করতে। তারপর আরো ধমকের সুরে বলা হবেঃ “এটা কি যাদু? না কি তোমরা দেখছো না? যাও, তোমরা এতে প্রবেশ কর। এটা তোমাদেরকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলবে। তোমরা এখন ধৈর্যধারণ কর অথবা না কর উভয়ই তোমাদের জন্যে সমান। কোনক্রমেই তোমরা এখান হতে বের হতে পারবে না। এটা তোমাদের উপর আল্লাহ তা'আলার যুলুম নয়, বরং তোমরা যা করতে তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেয়া হচ্ছে।
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।