আল কুরআন


সূরা কাফ (আয়াত: 19)

সূরা কাফ (আয়াত: 19)



হরকত ছাড়া:

وجاءت سكرة الموت بالحق ذلك ما كنت منه تحيد ﴿١٩﴾




হরকত সহ:

وَ جَآءَتْ سَکْرَۃُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ؕ ذٰلِکَ مَا کُنْتَ مِنْهُ تَحِیْدُ ﴿۱۹﴾




উচ্চারণ: ওয়া জাআত ছাকরাতুল মাওতি বিলহাক্কি যা-লিকা মা-কুনতা মিনহু তাহীদ।




আল বায়ান: আর মৃত্যুর যন্ত্রণা যথাযথই আসবে। যা থেকে তুমি পলায়ন করতে চাইতে।




আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ১৯. আর মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে এসেছে (সে) সত্যই(১); এটা (তা-ই) যা থেকে তুমি পালাতে চাচ্ছিলে।




তাইসীরুল ক্বুরআন: মৃত্যুর যন্ত্রণা প্রকৃতই আসবে যাত্থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য তুমি চেষ্টা করতে।




আহসানুল বায়ান: (১৯) মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যই আসবে; [1] এ তো তাই, যা হতে তুমি অব্যাহতি চেয়ে আসছ। [2]



মুজিবুর রহমান: মৃত্যুযন্ত্রণা অবশ্যই আসবে। এটা হতেই তোমরা অব্যাহিত চেয়ে আসছ।



ফযলুর রহমান: মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যই আসবে। এ বিষয়টাই তুমি এড়িয়ে যেতে।



মুহিউদ্দিন খান: মৃত্যুযন্ত্রণা নিশ্চিতই আসবে। এ থেকেই তুমি টালবাহানা করতে।



জহুরুল হক: আর মৃত্যুকালীন মূর্ছা সত্যি-সত্যি আসবে, -- "এইটিই তো তাই যা থেকে তুমি অব্যাহতি চাও।"



Sahih International: And the intoxication of death will bring the truth; that is what you were trying to avoid.



তাফসীরে যাকারিয়া

অনুবাদ: ১৯. আর মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে এসেছে (সে) সত্যই(১); এটা (তা-ই) যা থেকে তুমি পালাতে চাচ্ছিলে।


তাফসীর:

(১) ওফাতের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মধ্যে এই অবস্থা দেখা দিলে তিনি হাত ভিজিয়ে মুখমণ্ডলে মালিশ করেছিলেন এবং বলেছিলেনঃ لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ ، إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَاتٍ আল্লাহ ছাড়া কোন হক ইলাহ নেই, মৃত্যু যন্ত্রণা বড় সাংঘাতিক। [বুখারী: ৪০৯৪, ৭১৭৫] এখানে সে সত্য বলে আখেরাতের কথা বুঝানো হয়েছে। যে সত্যকে তারা অস্বীকার করত। [জালালাইন|


তাফসীরে আহসানুল বায়ান

অনুবাদ: (১৯) মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যই আসবে; [1] এ তো তাই, যা হতে তুমি অব্যাহতি চেয়ে আসছ। [2]


তাফসীর:

[1] এর দ্বিতীয় অর্থ হল, মৃত্যু-যন্ত্রণা সত্য নিয়ে আসবে। অর্থাৎ, মৃত্যুর সময় সত্য স্পষ্ট এবং সেই সকল প্রতিশ্রুতির সত্যতা প্রকাশ হয়ে যায়, যা কিয়ামত এবং জান্নাত ও জাহান্নামের ব্যাপারে নবীগণ দিয়ে গেছেন।

[2] تَحِيْدُ، تَمِيْلُ عَنْهُ وَتَفِرُّ তুমি এই মৃত্যুকে এড়াতে চাইতে এবং তা থেকে পলায়ন করতে।


তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ


তাফসীর: ১৬-২২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :



আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর জ্ঞান দ্বারা তাদের গতিবেগ, কথা-বার্তা ও কাজ-কর্ম এমনকি অন্তরে কি উদ্রেক হয় তা সবকিছু বেষ্টন করে আছেন।



মহান আল্লাহ তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে মানুষের ঘাড়ে অবস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটে। মানুষ মনে মনে কি চিন্তা-ভাবনা করে তাও আল্লাহ তা‘আলা জানেন। যেমন- হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আমার উম্মাতের মনে যে কুমন্ত্রণা জাগে তা আল্লাহ তা‘আলা ক্ষমা করে দিয়েছেন যদি তা না বলে বা আমল করে। (সহীহ বুখারী হা. ৫২৬৯, মুসলিম হা. ১২৭)



وريد (শাহরগ) বলা হয় প্রধান অথবা এমন প্রাণ ধারক ধমনীকে যা কেটে গেলে মৃত্যু হয়ে যায়। এ ধমনী (কণ্ঠনালীর দু’ পাশে দু’টি মোটা আকারের শিরা) মানুষের কাঁধ পর্যন্ত থাকে। ইবনু কাসীর (রহঃ) نحن (আমরা) দ্বারা ফেরেশতাদেরকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ আমার ফেরেশতাগণ মানুষের শাহ রগের চেয়েও নিকটে।



(إِذْ يَتَلَقّٰي الْمُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِيْنِ وَعَنِ الشِّمَالِ)



“যখন দুই গ্রহণকারী (ফেরেশতা) তার ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে’’ অর্থাৎ দুজন ফেরেশতা মানুষের ডান ও বাম পাশে বসে আমল লিপিবদ্ধ করে। ডান পার্শ্বের ফেরেশতা পুণ্য আর বাম পার্শ্বের ফেরেশতা পাপ কাজ লিপিবদ্ধ করে।



রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : তোমাদের মাঝে রাতের ও দিনের ফেরেশতারা পালাক্রমে যাতায়াত করে। তারা (উভয় দল) ফজর ও ‘আসর সালাতে একত্রিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেন আমার বান্দাদের কিভাবে রেখে এসেছ অথচ তিনি তাদের সম্পর্কে ভাল জানেন। তারা জবাবে বলেন : আমরা তাদের নিকট পৌঁছার সময় সালাত অবস্থায় পেয়েছিলাম আর রেখে আসার সময় সালাত অবস্থায় রেখে এসেছিলাম। (সহীহ মুসলিম হা. ৬৩২)



رقيب অর্থ : সংরক্ষণকারী, পর্যবেক্ষক, তত্ত্বাবধায়ক আর عتيد অর্থ : হলো তৎপর, সদা-সর্বদা প্রস্তুত। অর্থাৎ মানুষের মুখ দিয়ে যত কথা বের হয় তা উঁচু আওয়াজে হোক আর নিচু আওয়াজে হোক তা পর্যবেক্ষকগণ লিপিবদ্ধ করে নেন। সুতরাং মানুষ তার মুখ দিয়ে কী বলছে তা বলার পূর্বে একটু ভেবে চিন্তা করে বলা উচিত। আমার কথা কি কোন উপকারে আসছে, না অনর্থক কোন কথা বলছি, আমার কথার দ্বারা মানুষের ক্ষতি করছি না কারো দোষত্র“টি বর্ণনা করছি। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :



مَنْ يَضْمَنُ لِيْ مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الجَنَّةَ



যে ব্যক্তি আমার কাছে দু’চোয়ালের মধ্যবর্তী স্থান ও দু’রানের মধ্যবর্তী স্থানের জামিন হবে আমি তার জন্য জান্নাতের জামিনদার হব। (সহীহ বুখারী হা. ৬৪৭৪)



এ আয়াত এও প্রমাণ করছে- মুখ দিয়ে প্রকাশ না পেলে সে কথার জন্য পাকড়াও করা হবে না।



(وَجَا۬ءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ)



‘মৃত্যু যন্ত্রণা সত্যই আসবেই’ অর্থাৎ মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যিই আসবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মৃত্যুর সময় বলেছিলেন : নিশ্চয়ই মৃত্যু যন্ত্রণা খুব বেদনাদায়ক। (সহীহ বুখারী হা. ৪০৯৪)



এ আয়াতের অন্য একটি অর্থ হলো : মৃত্যু যন্ত্রণা সত্য নিয়ে আসবে। অর্থাৎ মৃত্যুর সময় সত্য স্পষ্ট এবং সে সকল প্রতিশ্রুতির সত্যতা প্রকাশ হয়ে যায়। যা কিয়ামতের ব্যাপারে নাবীগণ বলেছেন।



(وَنُفِخَ فِي الصُّوْرِ)



‘আর শিংগায় ফুঁৎকার দেয়া হবে’ অর্থাৎ ইসরাফিল (রহঃ) মানুষকে কবর থেকে উত্থিত করার জন্য তৃতীয় ফুঁৎকার দেবেন। এ সম্পর্কে সূরা আলি ইমরান ৩ :১৭৩ নং আয়াতে আলোচনা হয়েছে।



(مَعَهَا سَا۬ئِقٌ وَشَهِيْدٌ)



‘তার সাথে থাকবে চালক ও সাক্ষী’ سَائِقٌ অর্থ হলো চালক, شَهِيدٌ অর্থ হলো সাক্ষী। অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে একজন ফেরেশতা থাকবে যিনি তাকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাবে হাশরের ময়দানে, আর অন্য আরেকজন ফেরেশতা সাক্ষী দেবে এটাই সঠিক কথা। (ইবনু কাসীর- অত্র আয়াতের তাফসীর)



(لَقَدْ كُنْتَ فِيْ غَفْلَةٍ) –



‘তুমি এ দিবস সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিলে’ এ আয়াত দ্বারা কাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে সে সম্পর্কে ইবনু জারীর তাবারী তিনটি মত উল্লেখ করেছেন :



(১) এখানে সম্বোধন করা হয়েছে কাফিরদেরকে।

(২) এখানে উদ্দেশ্য খারাপ ভাল সকলেই।

(৩) এর দ্বারা উদ্দেশ্য নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। অর্থাৎ ওয়াহী করার পূর্বে তুমি কুরআন সম্পর্কে অজ্ঞ ছিলে। ওয়াহী করার মাধ্যমে জানিয়ে দিলাম।



ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এ তিনটি মতের মাধ্যমে জানা গেল : এখানে সম্বোধন সকলের জন্য প্রযোজ্য। আয়াতের অর্থ হলো : তুমি এ দিন সম্পর্কে গাফেল ছিলে, এখন পর্দা খুলে দিয়েছি ফলে দৃঢ়ভাবে দেখতে পাচ্ছো। অর্থাৎ প্রত্যেকে কিয়ামতের দিন দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন হবে।



এমন কি কাফিরও সেদিন সোজা হয়ে যাবে কিন্তু তা উপকারে আসবে না। মহান আল্লাহ বলেন :



(وَلَوْ تَرٰٓي إِذِ الْمُجْرِمُوْنَ نٰكِسُوْا رُؤُوْسِهِمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ ط رَبَّنَآ أَبْصَرْنَا وَسَمِعْنَا فَارْجِعْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا إِنَّا مُوْقِنُوْنَ) ‏



“আর যদি তুমি দেখতে, যখন পাপীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে স্বীয় মাথা নীচু করে বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা দেখলাম ও শ্রবণ করলাম, (এখন) তুমি আমাদেরকে পুনরায় (পৃথিবীতে) প্রেরণ কর; আমরা নেক কাজ করব। আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী হয়েছি।” (সূরা সাজদাহ্ ৩২ :১২)



আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :

১. আল্লাহ তা‘আলার কুদরত ও জ্ঞান সম্পর্কে জানলাম যে তিনি তাঁর জ্ঞান দ্বারা সবকিছু বেষ্টন করে আছেন।

২. প্রত্যেকের আমল লিপিবদ্ধকারী দুজন ফেরেশতা সর্বদা নিযুক্ত রয়েছে।

৩. মৃত্যু যন্ত্রণা খুব ভয়াবহ।

৪. প্রত্যেক ব্যক্তির সাথে তার ব্যাপারে একজন সাক্ষী থাকবে।

৫. পুনরুত্থান ও প্রতিদানের প্রতি ঈমান আনা জরুরী।


তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)


তাফসীর: ১৬-২২ নং আয়াতের তাফসীর:

আল্লাহ তা'আলা বলছেন যে, তিনিই মানুষের সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর জ্ঞান সব কিছুকে পরিবেষ্টন করে আছে, এমনকি মানুষের মনে যে ভাল-মন্দ ধারণার উদ্রেক হয় সেটাও তিনি জানেন। সহীহ হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমার উম্মতের অন্তরে যে ধারণা আসে আল্লাহ তা'আলা তা ক্ষমা করে দিয়েছেন যে পর্যন্ত না তা তাদের মুখ দিয়ে বের হয়।”

মহান আল্লাহ বলেনঃ “আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী অপেক্ষাও নিকটতর।' অর্থাৎ তাঁর ফেরেশতাগণ। কেউ কেউ বলেন যে, এর দ্বারা আল্লাহর ইলম বা অবগতিকে বুঝানো হয়েছে। তাঁদের উদ্দেশ্য এই যে, যাতে মিলন ও একত্রিত হওন অবশ্যম্ভাবী হয়ে না পড়ে যা হতে তাঁর পবিত্র সত্তা বহু দূরে রয়েছে এবং তিনি এটা হতে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত ও পবিত্র। কিন্তু শব্দের চহিদা এটা নয়। কেননা, এখানে (আরবী) একথা বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছে (আরবী) -এই কথা। যেমন মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফটকারীর ব্যাপারে আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তোমাদের অপেক্ষা তার নিকটতর, কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না।” (৫৬:৮৫) এর দ্বারাও ফেরেশতাদের তার এরূপ নিকটবর্তী হওয়া বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা'আলা আরো বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি যিকর (অর্থাৎ কুরআন) অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই ওর হিফাযতকারী ।” (১৫:৯) ফেরেশতারাই কুরআন কারীমকে নিয়ে অবতীর্ণ হতেন এবং এখানেও ফেরেশতাদের এরূপ নৈকট্য বুঝানো হয়েছে। এর উপর আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা তাঁদেরকে ক্ষমতা প্রদান করেছেন। সুতরাং মানুষের উপর ফেরেশতাদেরও প্রভাব থাকে এবং শয়তানেরও প্রভাব থাকে। শয়তান মানুষের দেহের মধ্যে রক্তের মত চলাফেরা করে। যেমন আল্লাহর চরম সত্যবাদী নবী (সঃ) বলেছেন। এজন্যেই এর পরেই আল্লাহ তাআলা বলেনঃ দু’জন ফেরেশতা মানুষের ডানে ও বামে বসে তার কর্ম লিপিবদ্ধ করে। মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্যে তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অথাৎ “অবশ্যই আছে তোমাদের জন্যে তত্ত্বাবধায়কগণ; সম্মানিত লিপিকরবৃন্দ; তারা জানে তোমরা যা কর।” (৮২:১০-১২)

হযরত হাসান (রঃ) ও হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, ফেরেশতারা মানুষের ভাল ও মন্দ সমস্ত আমল লিপিবদ্ধ করে থাকেন। এ ব্যাপারে হযরত ইবনে আব্বাস (রঃ)-এর দু’টি উক্তি রয়েছে। একটি উক্তিতো এটাই এবং অপর উক্তিটি এই যে, যে আমলের উপর পুরস্কার ও শাস্তি আছে শুধু ঐ আমলগুলোই লিখেন। কিন্তু প্রথম উক্তিটিই বেশী প্রকাশমান। কেননা, প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা হচ্ছেঃ মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিপিবদ্ধ করার জন্যে তৎপর প্রহরী তার নিকটেই রয়েছে।

হযরত বিলাল ইবনে হারিস মুযানী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টির এমন কোন কথা উচ্চারণ করে যেটাকে সে বড় সওয়াবের কথা মনে করে না, কিন্তু আল্লাহ ওরই কারণে কিয়ামত পর্যন্ত স্বীয় সন্তুষ্টি তার জন্যে লিখে দেন। পক্ষান্তরে, সে কোন সময় আল্লাহর অসন্তুষ্টির এমন কোন কথা উচ্চারণ করে ফেলে যেটাকে সে তেমন কোন বড় গুনাহর কথা মনে করে না, কিন্তু ওরই কারণে আল্লাহ স্বীয় সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত তার জন্যে তার অসন্তুষ্টি লিখে দেন।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ), ইমাম নাসাঈ (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহও (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) হাদীসটিকে হাসান বলেছেন) হযরত আলকামা (রঃ) বলেনঃ “এ হাদীসটি আমাকে বহু কথা হতে বাঁচিয়ে নিয়েছে।”

আহনাফ ইবনে কায়েস (রঃ) বলেন যে, ডান দিকের ফেরেশতা পুণ্য লিখেন এবং তিনি বাম দিকের ফেরেশতার উপর আমানতদার। বান্দা যখন কোন পাপকার্য করে তখন তিনি বাম দিকের ফেরেশতাকে বলেনঃ “থামো।` যদি সে তাড়াতাড়ি বা সাথে সাথে তাওবা করে নেয় তবে তিনি তাকে পাপ লিখতে দেন। কিন্তু তাওবা না করলে বাম দিকের ফেরেশতা ওটা লিখে নেন। (ইমাম ইবনে আবি হাতিম (রঃ) এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)

হযরত হাসান বসরী (রঃ) (আরবী)-এ আয়াতটি তিলাওয়াত করার পর বলেনঃ “হে আদম সন্তান! তোমার জন্যে সহীফা খুলে দেয়া হয়েছে। দু’জন সম্মানিত ফেরেশতাকে তোমার উপর নিযুক্ত করা হয়েছে। একজন আছেন তোমার ডান দিকে এবং একজন আছেন বাম দিকে। ডানের জন তোমার পুণ্যগুলো লিপিবদ্ধ করছেন এবং বামের জন লিপিবদ্ধ করছেন তোমার পাপগুলো। এখন তুমি যা ইচ্ছা আমল কর, বেশী কর অথবা কম কর। যখন তুমি মৃত্যুবরণ করবে তখন এই দফতর জড়িয়ে নেয়া হবে এবং তোমার কবরে রেখে দেয়া হবে। অতঃপর কিয়ামতের দিন যখন তুমি কবর হতে উঠবে তখন এটা তোমার সামনে পেশ করা হবে। একথাই আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “প্রত্যেক মানুষের কর্ম আমি তার গ্রীবালগ্ন করেছি এবং কিয়ামতের দিন আমি তার জন্যে বের করবে এক কিতাব, যা সে পাবে উন্মুক্ত। (তাকে বলা হবে) তুমি তোমার কিতাব পাঠ কর, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশের জন্যে যথেষ্ট।” (১৭:১৩-১৪) তারপর তিনি বলেনঃ “আল্লাহর কসম! তিনি বড়ই ন্যায় বিচার করেছেন যিনি তোমাকেই তোমার নিজের হিসাব রক্ষক করে দিয়েছেন।”

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, ভাল-মন্দ যা কিছু কথা মুখ হতে বের হয় তার সবই লিখা হয়। এমন কি মানুষ যে বলেঃ আমি খেয়েছি’, ‘আমি পান করেছি’, ‘আমি গিয়েছি’, ‘আমি এসেছি ইত্যাদি সব কিছুই লিখিত হয়। তারপর বৃহস্পতিবারে তার কথা ও কাজগুলো পেশ করা হয়। অতঃপর ভাল ও মন্দ রেখে দেয়া হয় এবং বাকী সব কিছুই সরিয়ে ফেলা হয়। আল্লাহ তা'আলার নিম্নের উক্তির অর্থ এটাইঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ যা চান মিটিয়ে দেন এবং যা চান ঠিক রাখেন এবং তাঁর নিকট উম্মুল কিতাব রয়েছে।” (১৩:৩৯)

হযরত ইমাম আহমাদ (রঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি তাঁর মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। তখন তিনি জানতে পারলেন যে, হযরত তাউস (রঃ)-এর মতে ফেরেশতারা এটাও লিখে থাকেন। তখন তিনি কাতরানোও বন্ধ করে দেন। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহম করুন যে, তিনি মৃত্যুর সময় উহ পর্যন্ত করেননি।

এরপর প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ হে মানুষ! মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যিই আসবে। ঐ সময় ঐ সন্দেহ দূর হয়ে যাবে যাতে তুমি এখন জড়িয়ে পড়েছে। ঐ সময় তোমাকে বলা হবেঃ এটা ওটাই যা হতে তুমি অব্যাহতি চেয়ে এসেছে। এখন ওটা এসে গেছে। তুমি ওটা হতে কোনক্রমেই পরিত্রাণ পেতে পার না। না তুমি এটাকে রোধ করতে পার, না পার এর সাথে মুকাবিলা করতে, না তোমার ব্যপারে কারো কোন সাহায্য ও সুপারিশ কোন কাজে আসবে। সঠিক কথা এটাই যে, এখানে সম্বোধন সাধারণভাবে মানুষকে করা হয়েছে, যদিও কেউ কেউ বলেন যে, এ সম্বোধন কাফিরদের প্রতি এবং অন্য কেউ অন্য কিছু বলেছেন।

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি আমার পিতা (রাঃ)-এর মৃত্যুর সময় তাঁর শিয়রে বসেছিলাম। তিনি মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিলেন। তখন আমি নিম্নের ছন্দটি পাঠ করলামঃ (আরবী) অর্থাৎ “যার অশ্রু থেমে আছে, ওটাও একবার টপ টপ করে পড়বে।” তখন তিনি মাথা উঠিয়ে বললেন, হে আমার প্রিয় কন্যা! তুমি যা বললে তা নয়, বরং আল্লাহ যা বলেছেন এটা তা-ই। তা হলোঃ (আরবী) অর্থাৎ “মৃত্যুযন্ত্রণা সত্যই আসবে; এটা হতেই তোমরা অব্যাহতি চেয়ে আসছে।” এই আসারের আরো বহু ধারা আমি সীরাতে সিদ্দীক (রাঃ)-এর মধ্যে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর মৃত্যুর বর্ণনায় আনয়ন করেছি।

সহীহ হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর যখন মৃত্যুযন্ত্রণায় মূৰ্ছিত হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয় তখন তিনি চেহারা মুবারক হতে ঘাম মুছতে মুছতে বলেনঃ “সুবহানাল্লাহ! মৃত্যুর বড়ই যন্ত্রণা!”

(আরবী) এর কয়েক প্রকার অর্থ করা হয়েছে। প্রথম এই যে, (আরবী) এখানে (আরবী) হয়েছে, অর্থাৎ এটা ওটাই যেটাকে বহু দূরের মনে করতে। দ্বিতীয় এই যে, এখানে বা নেতিবাচক। তখন অর্থ হবেঃ “এটা ওটাই, যা হতে পরিত্রাণ পাওয়ার এবং যাকে সরিয়ে ফেলার তুমি ক্ষমতা রাখো না।

হযরত সুমরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (রঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি মৃত্যু হতে পলায়ন করে তার দৃষ্টান্ত ঐ খেকশিয়ালের মত যার কাছে যমীন তার ঋণ চাইলো, তখন সে পালাতে শুরু করলো। পালাতে পালাতে যখন সে ক্লান্ত হয়ে পড়লো তখন নিজের গর্তে প্রবেশ করলো। যেহেতু যমীন সেখানেও ছিল সেহেতু ঐ যমীন তাকে বললোঃ “ওরে খেঁকশিয়াল! তুই আমার ঋণ পরিশোধ কর।” তখন সে সেখান হতে আবার পালাতে শুরু করলো। অবশেষে সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রাণ হারালো। মোটকথা, ঐ খেঁকশিয়াল যেমন যমীন হতে পালাবার রাস্তা পায়নি, অনুরূপভাবে মানুষেরও মৃত্য হতে পালাবার রাস্তা বন্ধ। (এ হাদীসটি ইমাম তিবরানী (রঃ) স্বীয় মু'জামুল কাবীর’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)

এরপর শিংগায় ফুঙ্কার দেয়ার কথা বর্ণনা করা হয়েছে যার বিস্তারিত ব্যাখ্যা স্বলিত হাদীস গত হয়েছে। অন্য হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘কিরূপে আমি শান্তি ও আরাম পেতে পারি, অথচ শিংগায় ফুঙ্কার দানকারী ফেরেশতা শিংগা মুখে নিয়ে রয়েছেন এবং গ্রীবা ঝুঁকিয়ে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন যে, কখন তিনি নির্দেশ দিবেন, আর ঐ নির্দেশ অনুযায়ী তিনি শিংগায় ফুৎকার দিবেন!” সাহাবীগণ (রাঃ) আরয করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা কি বলবে?” উত্তরে তিনি বললেন, তোমরা বলোঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমাদের জন্যে আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি উত্তম কর্মবিধায়ক।”

মহান আল্লাহ এরপর বলেনঃ “সেদিন প্রত্যেক ব্যক্তি উপস্থিত হবে, তার সঙ্গে থাকবে চালক ও তার কর্মের সাক্ষী।' একজন তাকে আল্লাহ তা'আলার দিকে চালিয়ে নিয়ে যাবেন এবং অপরজন তার কর্মের সক্ষ্য দিবেন। প্রকাশ্য আয়াত তো এটাই এবং ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এটাকেই পছন্দ করেছেন। হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাঃ) মিম্বরের উপর এ আয়াতটি তিলাওয়াত করেন এবং বলেনঃ “একজন চালক তাকে হাশরের ময়দানের দিকে চালিয়ে নিয়ে যাবেন এবং সাক্ষী হবেন যিনি তার কর্মের সাক্ষ্য দান করবেন।” হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন যে, (আরবী) দ্বারা ফেরেশতাকে এবং (আরবী) দ্বারা আমলকে বুঝানো হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, (আরবী) ফেরেশতাদের মধ্য হতে হবেন এবং (আরবী) দ্বারা উদ্দেশ্য হলো স্বয়ং মানুষ, যে নিজেই নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে।

মহান আল্লাহর “তুমি এই দিবস সম্বন্ধে উদাসীন ছিলে, এখন তোমার সম্মুখ হতে পর্দা উন্মোচন করেছি। অদ্য তোমার দৃষ্টি প্রখর।” এই উক্তিতে সম্বোধনকৃত কে? এ সম্পর্কে তিনটি উক্তি রয়েছে। (এক) এই সম্বোধন কাফিরকে করা হবে। (দুই) এই সম্বোধন সাধারণ মানুষকে করা হয়েছে, ভাল ও মন্দ সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। (তিন) এর দ্বারা স্বয়ং নবী (সঃ)-কে সম্বোধন করা হয়েছে। দ্বিতীয় উক্তির তাৎপর্য হচ্ছেঃ ‘আখিরাত ও দুনিয়ার মধ্যে ঐ সম্পর্ক রয়েছে যে সম্পর্ক বুয়েছে জাগ্রত ও স্বপ্নের অবস্থার মধ্যে। আর তৃতীয় উক্তির তাৎপর্য হলোঃ “হে বী (সঃ)! এই কুরআনের অহীর পূর্বে তুমি উদাসীন ছিলে! আমি তোমার উপর কুরআন অবতীর্ণ করে তোমার চোখের উপর হতে পর্দা সরিয়ে দিয়েছি। সুতরাং এখন তোমার দৃষ্টি প্রখর হয়ে গেছে। কিন্তু কুরআন কারীমের শব্দ দ্বারা তো এটাই প্রকাশমান যে, এটা সাধারণ সম্বোধন। অর্থাৎ প্রত্যেককে বলা হবেঃ তুমি এই দিন হতে উদাসীন ছিলে। কেননা, কিয়ামতের দিন প্রত্যেকের চক্ষু পূর্ণভাবে খুলে যাবে। এমনকি কাফিরও সেদিন সোজা হয়ে যাবে। কিন্তু তার সেদিন সোজা হওয়া তার কোন উপকারে আসবে না। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “যেদিন তারা আমার নিকট আসবে সেদিন তারা খুব বেশী শ্রবণকারী ও দর্শনকারী হয়ে যাবে।” (১৯:৩৮) মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী)

অর্থাৎ “হায়, তুমি যদি দেখতে! যখন অপরাধীরা তাদের প্রতিপালকের সামনে অধোবদন হয়ে বলবেঃ হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ও শ্রবণ করলাম; এখন আপনি আমাদেরকে পুনরায় প্রেরণ করুন; আমরা সৎ কর্ম করবে, আমরা তো দৃঢ় বিশ্বাসী।” (৩২:১২)





সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।