সূরা আল-হুজুরাত (আয়াত: 15)
হরকত ছাড়া:
إنما المؤمنون الذين آمنوا بالله ورسوله ثم لم يرتابوا وجاهدوا بأموالهم وأنفسهم في سبيل الله أولئك هم الصادقون ﴿١٥﴾
হরকত সহ:
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا بِاللّٰهِ وَ رَسُوْلِهٖ ثُمَّ لَمْ یَرْتَابُوْا وَ جٰهَدُوْا بِاَمْوَالِهِمْ وَ اَنْفُسِهِمْ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ ؕ اُولٰٓئِکَ هُمُ الصّٰدِقُوْنَ ﴿۱۵﴾
উচ্চারণ: ইন্নামাল মু’মিনূনাল্লাযীনা আ-মানূবিল্লা-হি ওয়া রাছূলিহী ছুম্মা লাম ইয়ারতা-বূওয়া জাহাদূবিআমওয়া-লিহিম ওয়া আনফুছিহিম ফী ছাবিলিল্লা-হি উলাইকা হুমুসসা-দিকূন।
আল বায়ান: মুমিন কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করেনি। আর নিজদের সম্পদ ও নিজদের জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে। এরাই সত্যনিষ্ঠ।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ১৫. তারাই তো মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করেনি এবং তাদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারাই সত্যনিষ্ঠ।
তাইসীরুল ক্বুরআন: মু’মিন তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের উপর ঈমান আনে, অতঃপর কোনরূপ সন্দেহ করে না, আর তাদের মাল দিয়ে ও জান দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করে; তারাই সত্যবাদী।
আহসানুল বায়ান: (১৫) বিশ্বাসী তো তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং নিজেদের সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ। [1]
মুজিবুর রহমান: তারাই মু’মিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করেনা এবং জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, তারাই সত্যনিষ্ঠ।
ফযলুর রহমান: আসলে মুমিন তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে বিশ্বাস করে, অতঃপর (এ ব্যাপারে কোন) সন্দেহ পোষণ করে না এবং নিজেদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে জেহাদ করে। তারাই হল সত্যবাদী।
মুহিউদ্দিন খান: তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে প্রাণ ও ধন-সম্পদ দ্বারা জেহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।
জহুরুল হক: নিঃসন্দেহ মুমিন তারাই যারা আল্লাহ্তে ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপরে তারা সন্দেহ পোষণ করেনা, আর তাদের ধনসম্পদ ও তাদের জানপ্রাণ দিয়ে আল্লাহ্র পথে জিহাদ করে। এরাই খোদ সত্যনিষ্ঠ।
Sahih International: The believers are only the ones who have believed in Allah and His Messenger and then doubt not but strive with their properties and their lives in the cause of Allah. It is those who are the truthful.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ১৫. তারাই তো মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করেনি এবং তাদের জীবন ও সম্পদ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারাই সত্যনিষ্ঠ।
তাফসীর:
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: (১৫) বিশ্বাসী তো তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং নিজেদের সম্পদ ও জীবন দ্বারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ। [1]
তাফসীর:
[1] তারা মু’মিন বা বিশ্বাসী নয়, যারা কেবল মুখেই ইসলাম প্রকাশ করে এবং উল্লিখিত আমলগুলোর প্রতি কোন যত্নই নেয় না।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: ১৪-১৮ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
الْأَعْرَابُ অর্থ বেদুঈন, মরুবাসী, যারা গ্রামে বসবাস করে। কোন কোন মুফাস্সিরের মতে, এ বেদুঈন লোকগুলো হলো, মদীনার বনু আসাদ ও খুযাইমাহ্ গোত্রের মুনাফিক। তারা দুর্ভিক্ষের সময় কেবল সাদকা লাভের উদ্দেশ্যে অথবা হত্যা ও বন্দী হওয়া থেকে বাঁচার জন্য মৌখিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করার কথা ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু তাদের ঈমান, ‘আক্বীদাহ্ এবং ইসলামের আন্তরিকতা মুক্ত ছিল। (ফাতহুল কাদীর, অত্র আয়াতের তাফসীর)
ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এখানে এমন বেদুঈন লোকদের বুঝানো হয়েছে যারা নতুন মুসলিম হয়েছিল, কিন্তু ঈমান তাদের অন্তরে তখনো দৃঢ়ভাবে স্থান পায়নি। অথচ তাদের অন্তরে যতটুকু ঈমান ছিল দাবী করেছিল তার চেয়ে বেশি।
ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বলে দিতে বললেন যে, বলো না আমরা ঈমান এনেছি বরং বলো ইসলাম গ্রহণ করেছি। তোমাদের অন্তরে এখনো পূর্ণ ঈমান প্রবেশ করেনি।
আয়াতের ভাষ্য দ্বারা বুঝা যাচ্ছে ঈমান ও ইসলামে পার্থক্য রয়েছে। এরূপ একটি হাদীস দ্বারাও বুঝা যায় যে, ঈমান ও ইসলামের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কতগুলো লোককে (দানের মাল হতে) দান করলেন এবং একটি লোককে কিছুই দিলেন না। তখন সা‘দ (রাঃ) বললেন : হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আপনি অমুক অমুককে দিলেন আর অমুককে দিলেন না। অথচ সে মু’মিন। এ-কথা তিনবার বললেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জবাবে বললেন : সে কি মুসলিম? (সহীহ বুখারী হা. ২৭)
আবার অনেক আয়াত ও হাদীস প্রমাণ করে যে, ঈমান ও ইসলামের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(فَأَخْرَجْنَا مَنْ كَانَ فِيْهَا مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ - فَمَا وَجَدْنَا فِيْهَا غَيْرَ بَيْتٍ مِّنَ الْمُسْلِمِيْنَ)
“সেখানে যেসব মু’মিন ছিল আমি তাদের বের করে নিলাম। এবং সেখানে একটি পরিবার [লূত-এর পরিবার] ব্যতীত কোন মুসলিম আমি পাইনি।” (সূরা যারিয়াত ৫১ : ৩৫-৩৬)
হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) উভয়ের মাঝে সমাধান দিতে গিয়ে বলেন : যখন ঈমান ও ইসলাম একত্রে উল্লেখ থাকবে তখন আলাদা আলাদা অর্থে ব্যবহার হবে, আর যখন আলাদা আলাদা করে উল্লেখ থাকবে তখন একই অর্থ প্রকাশ করবে।
(قُوْلُوْآ أَسْلَمْنَا)
‘আমরা ইসলাম গ্রহণ করেছি’ প্রকৃতপক্ষে তাদের ঈমান ছিল না, হত্যা ও বন্দি হওয়ার ভয়ে বাহ্যিকভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল। এটা মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য। বাহ্যিকভাবে মু’মিনদের মত ইসলামের কিছু বিধান পালন করলেই মু’মিন হওয়া যায় না যতক্ষণ না অন্তরের বিশ্বাস ও মহব্বতের সাথে আমল করবে। তাই তারা বাহ্যিকভাবে ইসলামের কিছু বিধান মেনে নিয়ে দাবী করছে আমরা মু’মিন হয়েছি, মূলত তারা মু’মিন ছিল না, তাই ইসলামের প্রতি তাদের বাহ্যিক আত্মসমর্পণ করাকে আভিধানিক অর্থে মুসলিম বলা হয়েছে।
(لَا يَلِتْكُمْ مِنْ أَعْمَالِكُمْ)
অর্থাৎ যদি তোমরা প্রকৃতপক্ষে স্বচ্ছ ঈমান এনে থাক তাহলে আল্লাহ তোমাদের কর্মের প্রতিদান কম করে দেবেন না, নষ্ট করবেন না।
যেমন আল্লাহ বলেন :
(وَالَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَاتَّبَعَتْھُمْ ذُرِّیَّتُھُمْ بِاِیْمَانٍ اَلْحَقْنَا بِھِمْ ذُرِّیَّتَھُمْ وَمَآ اَلَتْنٰھُمْ مِّنْ عَمَلِھِمْ مِّنْ شَیْءٍﺚ کُلُّ امْرِئئ بِمَا کَسَبَ رَھِیْنٌ)
“এবং যারা ঈমান আনে আর তাদের সন্তান-সন্ততিও ঈমানে তাদের অনুসারী হয়, তাদের সাথে মিলিত করব তাদের সন্তান-সন্ততিকে এবং আমি তাদের কর্মফলের ঘাটতি করব না, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ কৃতকর্মের জন্য দায়ী।” (সূরা তূর ৫২ : ২১)
অতঃপর শুধু মুখে নয় প্রকৃতপক্ষে যারা মু’মিন তাদের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : মু’মিন তারাই যারা ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করেনি বরং ঈমানের ওপর অটল থাকে এবং জান মাল দিয়ে জিহাদ করে আর তারাই সত্যবাদী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّ الَّذِيْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللّٰهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا)
“নিশ্চয়ই যারা বলে : আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, অতঃপর অবিচলিত থাকে।” (সূরা হা-মীম সিজদাহ ৪১ : ৩০)
(أَتُعَلِّمُونَ اللّٰهَ بِدِينِكُمْ)
‘তোমরা কি তোমাদের দীনের খবর আল্লাহকে জানাচ্ছ?’ এখানে تعليم শব্দটি اعلام বা জানানোর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের দীন ও অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলাকে অবগত করছ? বেদুঈনরা যখন নিজেদেরকে মু’মিন বলে দাবী করল আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নাবীকে নির্দেশ দিলেন : “তুমি বল : তোমরা ঈমান আননি ও তোমাদের অন্তরে এখনো ঈমান প্রবেশ করেনি” বলে তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য এবং আরো নির্দেশ দিলেন যেন তিনি তাদেরকে ভর্ৎসনা করে বলেন : “তোমরা কি তোমাদের দীনের খবর আল্লাহকে জানাচ্ছ?”। তোমরা মুখে যতই বল আমরা মু’মিন, প্রকৃতপক্ষে কে মু’মিন আর কে ছদ্মবেশী মু’মিন, নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য ইসলামের ছায়া তলে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা তার সব কিছু সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন।
(قُلْ لَا تَمُنُّوا عَلَيَّ إِسْلَامَكُمْ)
‘বল : তোমাদের ইসলাম দ্বারা আমাকে ধন্য করনি’ অর্থাৎ বেদুঈন আরবদের আচরণে বুঝা যাচ্ছে যে, তারা মনে করে আমরা ইসলাম গ্রহণ করে মুহাম্মাদকে অনুগ্রহ করেছি, তার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছি। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, বলে দাও! তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে আমাকে অনুগ্রহ করোনি বরং আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে হিদায়াত দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : হে আনসাররা! আমি কি তোমাদের পথহারা পাইনি, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে হিদায়াত দান করেছেন? তোমরা বিভিন্ন দলে বিচ্ছিন্ন ছিলে আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে একত্র করে দিয়েছেন? তোমরা নিঃস্ব ছিলে আমার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা ধনী করে দিয়েছেন? সাহাবীরা প্রত্যেক প্রশ্নের জবাবে বললেন : আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চেয়েও বেশি আমাদের ওপর অনুগ্রহকারী। (সহীহ বুখারী হা. ৪৩৩০)
(إِنَّ اللّٰهَ يَعْلَمُ غَيْبَ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আকাশসমূহ ও পৃথিবীর গায়েবের বিষয় সম্পর্কে অবগত আছেন’ অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(اَلَآ اِنَّھُمْ یَثْنُوْنَ صُدُوْرَھُمْ لِیَسْتَخْفُوْا مِنْھُﺚ اَلَا حِیْنَ یَسْتَغْشُوْنَ ثِیَابَھُمْﺫ یَعْلَمُ مَا یُسِرُّوْنَ وَمَا یُعْلِنُوْنَﺆ اِنَّھ۫ عَلِیْمٌۭ بِذَاتِ الصُّدُوْرِ)
“সাবধান! নিশ্চয়ই তারা আল্লাহর নিকট গোপন রাখার জন্য তাদের বক্ষ দ্বিভাঁজ করে। সাবধান! তারা যখন নিজেদেরকে বস্ত্রে আচ্ছাদিত করে তখন তারা যা গোপন করে ও প্রকাশ করে, তিনি তা জানেন। অন্তরে যা আছে, নিশ্চয়ই তিনি তা সবিশেষ অবহিত।” (সূরা হূদ ১১ : ৫)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. প্রকৃত মু’মিনদের মুখের জবান ও অন্তরের বিশ্বাস এক ও অভিন্ন থাকবে।
২. ঈমান ও ইসলামের মাঝে সম্পর্ক একটি অপরটির পরিúূরক; বিপরীত নয়।
৩. প্রকৃত মু’মিনরা ঈমান আনার পর ঈমান থেকে সরে পড়ে না।
৪. সকল সৃষ্টি আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান দ্বারা বেষ্টিত।
৫. সকল গায়েব একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞানায়ত্ত, অন্য কেউ গায়েব জানে না।
৬. ভাল কাজ করলে তা নিজের উপকারে আসবে আর খারাপ কাজ করলে তার পরিণতি নিজেকেই ভোগ করতে হবে।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: ১৪-১৮ নং আয়াতের তাফসীর:
যেসব আরব বেদুঈন ইসলামে দাখিল হওয়া মাত্রই বাড়িয়ে-চাড়িয়ে নিজেদের ঈমানের দাবী করতে শুরু করেছিল, অথচ প্রকৃতপক্ষে তাদের অন্তরে ঈমান দৃঢ় হয়নি তাদেরকে আল্লাহ তা'আলা এই দাবী করতে নিষেধ করছেন। আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে বলছেনঃ “হে নবী (সঃ)! তুমি তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, যেহেতু ঈমান তাদের অন্তরে দৃঢ়ভাবে প্রবেশ করেনি সেই হেতু তারা ঈমান এনেছে একথা যেন না বলে, বরং যেন বলে যে, তারা ইসলামের গণ্ডীর মধ্যে এসেছে এবং নবী (সঃ)-এর অনুগত হয়েছে।
এ আয়াত দ্বারা এটা জানা গেল যে, ঈমান ইসলাম হতে মাখসূস বা বিশিষ্ট, যেমন এটা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাযহাব। হযরত জিবরাঈল (আঃ) যুক্ত হাদীসটিও এটাই প্রমাণ করে। তিনি (হযরত জিবরাইল আঃ) ইসলাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন এবং পরে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করেন ইহসান সম্পর্কে। সুতরাং সাধারণ হতে ক্রমান্বয়ে বিশিষ্টের দিকে উঠে যান। তারপর উঠে যান আরো খাস বা বিশিষ্টের দিকে।
হযরত সা'দ ইবনে আবি অক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) কতগুলো লোককে (দানের মাল হতে) প্রদান করলেন এবং একটি লোককে কিছুই দিলেন না। তখন হযরত সা'দ (রাঃ) বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনি অমুক, অমুককে দিলেন আর অমুককে দিলেন না, অথচ সে মুমিন?` একথা তিনি তিনবার বললেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) জবাবে বললেনঃ “অথবা সে মুসলিম?` এই জবাবই তিনিও তিনবার দিলেন। অতঃপর তিনি বললেনঃ “নিশ্চয়ই আমি কতক লোককে প্রদান করি এবং তাদের মধ্যে আমার নিকট যে খুবই প্রিয় তাকে ছেড়ে দিই, কিছুই দিই না এই ভয়ে যে, (যাদেরকে প্রদান করি তাদেরকে প্রদান না করলে) তারা (হয়তো ইসলাম পরিত্যাগ করবে এবং এর ফলে) উল্টো মুখে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এটা তাদের নিজ নিজ সহীহ গ্রন্থে তাখরীজ করেছেন) সুতরাং এ হাদীসেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) মুমিন ও মুসলিমের মধ্যে পার্থক্য করলেন এবং জানা গেল যে, ইসলামের তুলনায় ঈমান অধিক খাস বা বিশিষ্ট। আমরা এটাকে দলীল প্রমাণাদিসহ সহীহ বুখারীর কিতাবুল ঈমানের শরাহতে বর্ণনা করেছি। সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা'আলারই প্রাপ্য।
এ হাদীস দ্বারা এটাও প্রমাণিত হয় যে, এ লোকটি মুসলমান ছিল, মুনাফিক ছিল না। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে কিছু প্রদান করেননি এবং তাকে তার ইসলামের উপর সমর্পণ করে দেন। সুতরাং জানা গেল যে, এই আয়াতে যে বেদুঈনদের বর্ণনা রয়েছে তারা মুনাফিক ছিল না, তারা ছিল তো মুসলমান, কিন্তু ঈমান তাদের অন্তরে দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল হয়নি। তারা ঈমানের এমন উচ্চ স্তরে পৌছার দাবী করেছিল যেখানে তারা আসলে পৌঁছতে পারেনি। এ জন্যেই তাদেরকে আদব বা ভদ্রতা শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এই ভাবার্থই হবে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত ইবরাহীম নাখঈ (রঃ) এবং হযরত কাতাদা (রঃ)-এর উক্তির। এটাকেই ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) গ্রহণ করেছেন। আমাদের এসব কথা এজন্যেই বলতে হলো যে, ইমাম বুখারী (রঃ)-এর মতে এলোকগুলো মুনাফিক ছিল, যারা নিজেদেরকে বাহ্যিকভাবে মুমিন রূপে প্রকাশ করতো, কিন্তু আসলে মুমিন ছিল না।
এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, ঈমান ও ইসলামের মধ্যে ঐ সময় পার্থক্য হবে যখন ইসলাম স্বীয় হাকীকতের উপর না হবে। যখন ইসলাম হাকীকী হবে তখন ঐ ইসলামই ঈমান। ঐ সময় ঈমান ও ইসলামের মধ্যে কোনই পার্থক্য থাকবে না। এর বহু সবল দলীল প্রমাণ ইমাম বুখারী (রঃ) স্বীয় কিতাব সহীহ বুখারীর মধ্যে বর্ণনা করেছেন।
হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) এবং হযরত ইবনে যায়েদ (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা'আলা যে বলেছেনঃ বরং তোমরা বল’ এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ আমরা নিহত হওয়া থেকে এবং বন্দী হওয়া থেকে বাঁচার জন্যে ফরমানের প্রতি অনুগত হলাম।
হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এ আয়াতটি বানু আসাদ ইবনে খুযাইমার ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এ আয়াত ঐ লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয় যারা মনে করেছিল যে, তারা ঈমান এনে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রতি অনুগ্রহ করেছে। কিন্তু প্রথমটিই সঠিক কথা যে, এই আয়াতটি ঐ লোকদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয় যারা ঈমানের স্থানে পৌঁছে যাওয়ার দাবী করতো, অথচ সেখানে তারা পৌঁছতে পারেনি। সুতরাং তাদেরকে আদব বা দ্রতা শিক্ষা দেয়া হয় যে, তখন পর্যন্ত তারা ঈমানের স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। যদি তারা মুনাফিক হতো তবে অবশ্যই তাদেরকে ধমকানো হতো এবং ভীতি প্রদর্শন করা হতো। আর করা হতো তাদেরকে অপদস্থ ও অপমানিত। যেমন সূরায়ে বারাআতে মুনাফিকদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে তো শুধু তাদেরকে আদব শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর আনুগত্য কর তবে তোমাদের কর্ম সামান্য পরিমাণও লাঘব হবে না। যেমন অন্য জায়গায় আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি তাদের আমল হতে কিছুই কমিয়ে দিই নি।” (৫২:২১)। মহান আল্লাহ এরপর বলেনঃ যারা আল্লাহর দিকে ফিরে আসে, অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে থাকেন এবং তাদের প্রতি দয়া করেন। কেননা, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
অতঃপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারাই পূর্ণ মুমিন যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না, বরং ঈমানের উপর অটল থাকে এবং জীবন ও সম্পদ দ্বারা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে, তারাই সত্যনিষ্ঠ। অর্থাৎ এরাই এমন লোক যারা বলতে পারে যে, তারা ঈমান এনেছে। তারা ঐ লোকদের মত নয় যারা শুধু মুখেই ঈমানের দাবী করে।
হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী (সঃ) বলেছেনঃ “দুনিয়ায় তিন প্রকারের মুমিন রয়েছে। (এক) যারা আল্লাহর উপর ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর উপর ঈমান এনেছে, অতঃপর কোন সন্দেহ পোষণ করেনি এবং নিজেদের মাল-ধন ও জীবন দিয়ে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করে। (দুই) যাদের থেকে লোকেরা নিরাপত্তা লাভ করেছে। তারা না তাদের ধন-সম্পদ আত্মসাৎ করে, না তাদেরকে হত্যা করে। (তিন) যারা লোভনীয় বস্তুর দিকে ঝুঁকে পড়ার পর মহামহিমান্বিত আল্লাহর (ভয়ের জন্যে তা পরিত্যাগ করে।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ) স্বীয় মুসনাদ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন)
এরপর মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ বলেনঃ তোমরা তোমাদের ঈমান ও দ্বীনের কথা আল্লাহকে জানাচ্ছ? অথচ আল্লাহ এমনই যে, যমীন ও আসমানের অণুপরিমাণ জিনিসও তাঁর নিকট গোপন নেই। যা কিছু আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে রয়েছে সবই তিনি জানেন। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক অবহিত।
মহান আল্লাহ বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! যেসব আরব বেদুঈন ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে তোমাকে অনুগ্রহের খোটা দিচ্ছে তুমি তাদেরকে বলে দাওঃ তোমরা ইসলাম কবুল করেছে বলে আমাকে অনুগ্রহের খোটা দিয়ো না। তোমরা ইসলাম কবুল করলে, আমার আনুগত্য করলে এবং আমাকে সাহায্য করলে তোমাদের নিজেদেরই উপকার হবে, বরং আল্লাহই ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন, এটা তোমাদের প্রতিই আল্লাহর বড় অনুগ্রহ, যদি তোমরা তোমাদের ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী হও।
সুতরাং আল্লাহ তা'আলার কাউকেও ঈমানের পথ দেখানো অর্থ তার উপর তার ইহসান বা অনুগ্রহ করা। যেমন রাসূলুল্লাহ (সঃ) হুনায়েনের যুদ্ধের শেষে (যুদ্ধলব্ধ মাল বন্টনের ক্ষেত্রে) আনসারদেরকে বলেছিলেনঃ “আমি কি তোমাদেরকে পথভ্রষ্ট অবস্থায় পেয়েছিলাম না? অতঃপর আল্লাহ তা'আলা আমার কারণে তোমাদেরকে সুপথ প্রদর্শন করেছেন? তোমরা তো পৃথক পৃথক হয়েছিলে? অতঃপর আমার কারণে আল্লাহ তোমাদেরকে একত্রিত করেছেন এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যে প্রেম-প্রীতি সৃষ্টি করেছেন? তোমরা তো দরিদ্র ছিলে? অতঃপর আল্লাহ আমার কারণে তোমাদেরকে সম্পদশালী করেছেন?” তারা তার প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তরে সমস্বরে বলতে থাকেনঃ “আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ)-এর চেয়েও বেশী আমাদের উপর অনুগ্রহকারী।”
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, বানু আসাদ গোত্র রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করে এবং বলেঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা মুসলমান হয়েছি এবং আরবরা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু আমরা আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিনি।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের সম্পর্কে বলেনঃ “এদের বোধশক্তি কম এবং তাদের মুখ দ্বারা শয়তানরা কথা বলছে।” তখন (আরবী)-এই আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। পুনরায় আল্লাহ তা'আলা তাঁর প্রশস্ত ও ব্যাপক জ্ঞান এবং বান্দাদের সমস্ত আমল সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিফহাল হওয়ার বর্ণনা দিচ্ছেন যে, আল্লাহ আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবগত আছেন। তাঁর বান্দাদের সমস্ত আমলের তিনি পূর্ণ খবর রাখেন।
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।