সূরা আল-আহকাফ (আয়াত: 32)
হরকত ছাড়া:
ومن لا يجب داعي الله فليس بمعجز في الأرض وليس له من دونه أولياء أولئك في ضلال مبين ﴿٣٢﴾
হরকত সহ:
وَ مَنْ لَّا یُجِبْ دَاعِیَ اللّٰهِ فَلَیْسَ بِمُعْجِزٍ فِی الْاَرْضِ وَ لَیْسَ لَهٗ مِنْ دُوْنِهٖۤ اَوْلِیَآءُ ؕ اُولٰٓئِکَ فِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍ ﴿۳۲﴾
উচ্চারণ: ওয়া মাল লা-ইউজিব দা-‘ইয়াল্লা-হি ফালাইছা বিমু‘জিযিন ফিল আরদিওয়া লাইছা লাহূমিন দূ নিহীআওলিূআউ উলাইকা ফী দালা-লিমমুবীন।
আল বায়ান: আর যে আল্লাহর দিকে আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেবে না সে যমীনে তাকে অপারগকারী নয়। আর আল্লাহ ছাড়া তার কোন অভিভাবক নেই। এরাই স্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ৩২. আর যে আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া না দেয় তবে সে যমীনে আল্লাহকে অপারগকারী নয়। আর আল্লাহ্ ছাড়া তার কোন অভিভাবক নেই। তারাই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।
তাইসীরুল ক্বুরআন: আর যে আল্লাহর দিকে আহবানকারীর প্রতি সাড়া দিবে না, দুনিয়াতে সে আল্লাহকে ব্যর্থ করতে পারবে না, আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে নেই তার কোন সাহায্যকারী, পৃষ্ঠপোষক। তারা আছে সুস্পষ্ট গুমরাহীতে।
আহসানুল বায়ান: (৩২) কেউ যদি আল্লাহর দিকে আহবানকারীর আহবানে সাড়া না দেয়, তাহলে সে পৃথিবীতে আল্লাহর অভিপ্রায় ব্যর্থ করতে পারবে না[1] এবং আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না।[2] তারাই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।’
মুজিবুর রহমান: যদি কেহ আল্লাহর দিকে আহবানকারীর ডাকে সাড়া না দেয় তাহলে সে পৃথিবীতে আল্লাহর অভিপ্রায় ব্যর্থ করতে পারবেনা এবং আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবেনা। তারাতো সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।
ফযলুর রহমান: আর যারা আল্লাহর দিকে আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেবে না, তারা পৃথিবীতে (আল্লাহকে) অক্ষম করতে (অর্থাৎ আল্লাহর শাস্তি থেকে রেহাই পেতে) পারবে না এবং তিনি ছাড়া তাদের সাহায্যকারীও থাকবে না। তারা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে।
মুহিউদ্দিন খান: আর যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে আহবানকারীর কথা মানবে না, সে পৃথিবীতে আল্লাহকে অপারক করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত তার কোন সাহায্যকারী থাকবে না। এ ধরনের লোকই প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় লিপ্ত।
জহুরুল হক: আর যে আল্লাহ্র আহবায়কের প্রতি সাড়া দেয় না, সে তবে পৃথিবীতে কিছুতেই এড়িয়ে যাবার পাত্র নয়, আর তাঁকে বাদ দিয়ে তার জন্য কোনো বন্ধুবান্ধবও থাকবে না। এরাই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।
Sahih International: But he who does not respond to the Caller of Allah will not cause failure [to Him] upon earth, and he will not have besides Him any protectors. Those are in manifest error."
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ৩২. আর যে আল্লাহর দিকে আহ্বানকারীর প্রতি সাড়া না দেয় তবে সে যমীনে আল্লাহকে অপারগকারী নয়। আর আল্লাহ্– ছাড়া তার কোন অভিভাবক নেই। তারাই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।
তাফসীর:
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: (৩২) কেউ যদি আল্লাহর দিকে আহবানকারীর আহবানে সাড়া না দেয়, তাহলে সে পৃথিবীতে আল্লাহর অভিপ্রায় ব্যর্থ করতে পারবে না[1] এবং আল্লাহ ছাড়া তাদের কোন সাহায্যকারী থাকবে না।[2] তারাই সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে।”
তাফসীর:
[1] অর্থাৎ, এমন হতেই পারে না যে, সে সুবিশাল ও সুপ্রসারিত পৃথিবীর কোথাও এমনভাবে আত্মগোপন করে নেবে যে, আল্লাহর পাকড়াও থেকে বেঁচে যাবে।
[2] যে তাকে আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচিয়ে নেবে। অর্থাৎ, না সে নিজে আল্লাহর পাকড়াও থেকে বাঁচতে পারবে, আর না অন্য কারো সাহায্যে তা সম্ভব হবে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: ২৯-৩২ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
একদল জিন নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মুখে কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ করে মুসলিম হয়েছিল এবং তাদের সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে গিয়ে ঈমান আনার প্রতি আহ্বান জানায় আর যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করে। কারণ জিন জাতিও মানুষের মত আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ও নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শরীয়ত মেনে নিতে বাধ্য। এতে মক্কার মুশরিকদেরকে তিরস্কারও করা হল যে, জিন জাতি কুরআন শুনে ঈমান নিয়ে আসলো আর তোমরা ঈমান আনলে না!
সহীহ মুসলিমের বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ ঘটনা মক্কার নিকটস্থ “নাখলা” নামক উপত্যকায় সংঘটিত হয়। সেখানে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করছিলেন। জীনেরা এ অনুসন্ধানে ছিল যে, আসমানে আমাদের ওপর অত্যাধিক কড়াকড়ি করে দেয়া হয়েছে এবং এখন সেখানে আমাদের যাওয়া প্রায় অসম্ভব করে দেয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে যার কারণে এ রকম হয়েছে। তাই পূর্ব ও পশ্চিমের বিভিন্ন দিকে জীনদের দল ঘটনার অনুসন্ধানে ছড়িয়ে পড়ল। তাদেরই একটি অনুসন্ধানী দল এ কুরআন শুনে বুঝে নেয় যে, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর প্রেরণের এ ঘটনাই হল আমাদের আসমানে প্রবেশের প্রতিবন্ধকতার একমাত্র কারণ। জীনদের এ দলটি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর ঈমান আনে এবং ফিরে গিয়ে তাদের জাতিকে এ কথা জানায়। সহীহ বুখারীতে এ ঘটনা বিদ্যমান। (সহীহ বুখারী হা. ৩৮৫৯, সহীহ মুসলিম হা. ৪৪৯) এ সম্পর্কে সূরা জিনে আরো আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ।
(أُنْزِلَ مِنْۭ بَعْدِ مُوْسٰي)
‘যা মূসা এর পর নাযিল করা হয়েছে’ ইবনু আব্বাস (আঃ) বলেন : জিনেরা ঈসা (আঃ)-এর কথা শোনেনি, তাই তারা বলেছে :
(أُنْزِلَ مِنْۭ بَعْدِ مُوْسٰي)।
কেননা কুরআন তো ইঞ্জিলের পর নাযিল হয়েছে যা ঈসা (আঃ)-এর ওপর নাযিল হয়েছে। বিশিষ্ট তাবেয়ী আতা বলেন : তারা ইয়াহূদী ছিল, তাই তারা উক্ত কথা বলেছে।
(يَغْفِرْ لَكُمْ مِّنْ ذُنُوْبِكُمْ)
‘আল্লাহ তোমাদের গুনাহ মাফ করবেন’ আয়াতের ভাষ্যমতে আল্লাহ তা‘আলার দিকে আহ্বানকারী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ডাকে যে ব্যক্তি সাড়া দেবে, তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং তিনি যে সত্য নিয়ে এসেছেন তার প্রতিও বিশ্বাস রাখবে তাকে ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা করা হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সাড়া দেবে না এবং ঈমান আনবে না তাকে ক্ষমাও করা হবে না, শাস্তি থেকেও রক্ষা করা হবে না। বরং তাকে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
قَالَ ادْخُلُوْا فِيْٓ أُمَمٍ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِكُمْ مِّنَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ فِي النَّارِ
“আল্লাহ বলবেন, ‘তোমাদের পূর্বে যে জিন ও মানব দল গত হয়েছে তাদের সাথে তোমরা জাহান্নামে প্রবেশ কর’।” (সূরা আ‘রাফ ৭ : ৩৪)
সুতরাং জিন হোক আর মানব হোক নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নবুওয়াতের কথা জানার পর তাঁর প্রতি ঈমান না আনলে সে জাহান্নামে যাবে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَا يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ يَهُودِيٌّ، وَلَا نَصْرَانِيٌّ، ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ، إِلَّا كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
সে সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! এ জাতির ইয়াহূদ ও খ্রিস্টান যে-ই হোক আমার কথা শোনার পর আমার প্রতি ঈমান না এনে মারা গেলে সে জাহান্নামবাসী হবে। (সহীহ মুসলিম হা. ১৫৩)
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. মানব জাতির মত জিনদের মধ্যে ভাল-মন্দ উভয় শ্রেণিই রয়েছে।
২. ইসলামী শরীয়ত মানুষ ও জিন উভয় জাতির জন্য।
৩. ইসলামের দাওয়াত যার কাছে পৌঁছবে তারও সেই দাওয়াত কবূল করত অন্যকে সেদিকে দাওয়াত দেয়া আবশ্যক।
৪. ইসলাম সত্য ও সঠিক পথের দিক-নিদের্শনা দেয়।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: ২৯-৩২ নং আয়াতের তাফসীর:
মুসনাদে আহমাদে হযরত যুবায়ের (রাঃ) হতে এই আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত আছে যে, এটা নাখলা নামক স্থানের ঘটনা। রাসূলুল্লাহ (সঃ) ঐ সময় ইশার নামায আদায় করছিলেন। এসব জ্বিন তার আশে-পাশে একত্রিতভাবে দাড়িয়ে যায়। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, ওগুলো নাসীবাইনের জ্বিন ছিল। তারা সাতজন ছিল।
প্রসিদ্ধ ইমাম হাফিয আবু বকর বায়হাকী (রঃ) তাঁর দালাইলুন নবুওয়াত নামক গ্রন্থে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে একটি রিওয়াইয়াত লিপিবদ্ধ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) জ্বিনদেরকে শুনাবার উদ্দেশ্যেও কুরআন পাঠ করেননি এবং তাদেরকে তিনি দেখেননি। তিনি তো স্বীয় সাহাবীদের সাথে উকাযের বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। এদিকে ব্যাপার এই ঘটেছিল যে, শয়তানদেরও আকাশের খবরের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের উপর উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হওয়া শুরু হয়েছিল। শয়তানরা এসে তাদের কওমকে এ খবর দিলে তারা বলেঃ “অবশ্যই নতুন কিছু একটা ঘটেছে। সুতরাং তোমরা অনুসন্ধান করে দেখো।” একথা শুনে তারা বেরিয়ে পড়লো। তাদের বিভিন্ন দল বিভিন্ন দিকে গেল। যে দলটি আরব অভিমুখে গেল, তারা যখন তথায় পৌঁছলো তখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উকাযের দিকে যাওয়ার পথে, নাখলায় স্বীয় সাহাবীদেরকে (রাঃ) ফজরের নামায পড়াচ্ছিলেন। ঐ জ্বিনদের কানে যখন তাঁর তিলাওয়াতের শব্দ পৌঁছলো তখন তারা তথায় থেমে গেল এবং কান লাগিয়ে মনোযোগের সাথে কুরআন পাঠ শুনতে লাগলো। এরপরে তারা পরস্পর বলাবলি করলোঃ এটাই ঐ জিনিস, যার কারণে আমাদের আকাশ পর্যন্ত পৌঁছার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এখান হতে ফিরে তারা সরাসরি তাদের কওমের নিকট পৌঁছে যায় এবং তাদেরকে বলেঃ “আমরা তো এক বিস্ময়কর কিতাব শ্রবণ করেছি, যা সঠিক পথ-নির্দেশ করে, ফলে আমরা এতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের প্রতিপালকের কোন শরীক স্থির করবো না।” এই ঘটনারই সংবাদ আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-কে সূরায়ে জ্বিনে দিয়েছেন।” (এ হাদীসটি ইমাম বুখারী (রঃ), ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
হযরত সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেনঃ জ্বিনেরা অহী শুনতে থাকতো। একটা কথা যখন তাদের কানে যেতো তখন তারা ওর সাথে আরো দশটি কথা মিলিয়ে দিতো। সুতরাং একটি সত্য হতো এবং বাকী সবই মিথ্যা হয়ে যেতো। ইতিপূর্বে তাদের উপর তারকা নিক্ষেপ করা হতো না। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) প্রেরিত হলেন তখন তাদের উপর উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হতে লাগলো। তারা তাদের বসার জায়গায় যখন পৌছতো তখন তাদের উপর উল্কাপিণ্ড নিক্ষিপ্ত হতো। ফলে তারা সেখানে আর থাকতে পারতো না। তারা তখন এসে ইবলীসের নিকট এর অভিযোগ করলো। ইবলীস তখন বললো, অবশ্যই নতুন ব্যাপার কিছু ঘটেছে। তাই সে তার সেনাবাহিনীকে এই তথ্য উদঘাটনের জন্যে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিলো। একটি দল রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে নালার দুটি পাহাড়ের মাঝে নামায রত অবস্থায় পেলো। অতঃপর তারা গিয়ে ইবলীসকে এ খবর দিয়ে দিলো। ইবলীস তখন বললোঃ “এ কারণেই আকাশ রক্ষিত হয়েছে এবং তোমাদের তথায় যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে।” (এটা ইমাম আহমাদ (রঃ) বর্ণনা করেছেন এবং ইমাম তিরমিযী (রঃ) ও ইমাম নাসাঈ (রঃ)-ও এ রিওয়াইয়াতটি এনেছেন)
হযরত হাসান বসরী (রঃ)-ও এ কথাই বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এ ঘটনার খবর রাখতেন না। যখন তার উপর অহী অবতীর্ণ হয় তখন তিনি তা জানতে পারেন। সীরাতে ইবনে ইসহাকে মুহাম্মাদ ইবনে কা'ব (রঃ)-এর একটি দীর্ঘ রিওয়াইয়াত বর্ণিত আছে, যাতে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর তায়েফ গমন, তায়েফবাসীকে ইসলামের দাওয়াত প্রদান এবং তাদের তা প্রত্যাখ্যান করণ ইত্যাদি পূর্ণ ঘটনা বর্ণিত আছে। ঐ শোচনীয় অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে দুআটি করেছিলেন সেটাও হযরত হাসান বসরী (রঃ) বর্ণনা করেছেন। দু'আটি নিম্নরূপঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! আমি মানুষের উপর আমার শক্তির দুর্বলতা, আমার কৌশলের স্বল্পতা এবং আমার অসহায়তার অভিযোগ আপনার নিকট করছি। হে দয়ালুদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় দয়ালু! আপনিই দয়ালুদের মধ্যে পরম দয়ালু। যাদেরকে দুর্বল মনে করা হয় আপনি তাদের প্রতিপালক। আপনি আমারও প্রতিপালক। আপনি আমাকে কার কাছে সমর্পণ করছেন? কোন দূরবর্তী শত্রুর কাছে কি, যে আমাকে অপারগ করবে? না কোন নিকটবর্তী বন্ধুর কাছে, যার কাছে আপনি আমার ব্যাপারে অধিকার দিয়ে রেখেছেন? যদি আমার প্রতি আপনার অসন্তোষ না থাকে তবে আমি আমার এ দুঃখ ও বেদনার জন্যে কোন পরোয়া করি না, তবে যদি আপনি আমাকে নিরাপদে রাখেন তাহলে এটা হবে আমার জন্যে সুখ-শান্তির ব্যাপার। আমি আপনার চেহারার ঔজ্জ্বল্যের মাধ্যমে, যার কারণে সমস্ত অন্ধকার আলোকিত হয়ে উঠেছে এবং যার উপর দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত কাজের কল্যাণ নির্ভরশীল, আমার উপর আপনার ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি নাযিল হোক এর থেকে আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি আপনার সন্তুষ্টিই কামনা করি এবং পুণ্য কাজ করা ও পাপ কাজ হতে বিরত থাকার ক্ষমতা একমাত্র আপনার সাহায্যের মাধ্যমেই লাভ করা সম্ভব।” এই সফর হতে প্রত্যাবর্তনের পথেই তিনি নাখলায় রাত্রি যাপন করেন এবং ঐ রাত্রেই নাসীবাইনের জ্বিনেরা তাঁর কুরআন-তিলাওয়াত শ্রবণ করে। এটা সঠিক তো বটে, কিন্তু এতে এই উক্তিটির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। কেননা, জ্বিনদের আল্লাহর কালাম শ্রবণ করা হচ্ছে অহী শুরু হওয়ার সময়ের ঘটনা। যেমন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উপরে বর্ণিত হাদীস হতে এটা প্রমাণিত হয়। আর তার তায়েফে গমন হচ্ছে তাঁর চাচা আবূ তালিবের মৃত্যুর পরের ঘটনা, যা হিজরতের এক বছর অথবা খুব বেশী হলে দু’বছর পূর্বের ঘটনা। যেমন এটা সীরাতে ইবনে ইসহাক প্রভৃতি গ্রন্থে রয়েছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
আবু বকর ইবনে শায়বা (রঃ)-এর বর্ণনামতে ঐ জ্বিনদের সংখ্যা ছিল নয়। তাদের একজনের নাম ছিল যাভীআহ্। তাদের ব্যাপারেই (আরবী) পর্যন্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। সুতরাং এই রিওয়াইয়াত এবং এর পূর্ববর্তী হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর রিওয়াইয়াতের চাহিদা এটাই যে, ঐ সময় যে জ্বিনগুলো এসেছিল তাদের উপস্থিতির খবর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর জানা ছিল না। তারা তো তার অজান্তে তার মুখে আল্লাহর বাণী শুনে ফিরে গিয়েছিল। এরপরে প্রতিনিধি হিসেবে জ্বিনেরা দলে দলে তাঁর খিদমতে উপস্থিত হয়েছিল। যেমন এই অলোচনা সম্বলিত হাদীস ও আসারগুলো নিজ নিজ স্থানে আসছে ইনশা আল্লাহ।
হযরত আব্দুর রহমান (রঃ) হযরত মাসরূক (রঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “যেই। রাত্রে জ্বিনেরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হতে কুরআন শুনেছিল ঐ রাত্রে কে তাঁকে এ খবর অবহিত করে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমাকে তোমার পিতা হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-কে জ্বিনদের আগমনের খবর একটি গাছ অবহিত করেছিল। তাহলে খুব সম্ভব এটা প্রথমবারের খবর হবে এবং হাঁ বাচককে আমরা না বাচকের উপর অগ্রগণ্য মনে করবো। এও হতে পারে যে, যখন জুিনেরা তাঁর কুরআন পাঠ শুনছিল তখন তো তিনি এ খবর জানতেন না, কিন্তু ঐ গাছটি তাঁকে তাদের উপস্থিতির খবর প্রদান করে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ্ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। আবার এও হওয়া সম্ভব যে, এ ঘটনাটি এর পরবর্তী ঘটনাবলীর একটি হবে। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ্।
ইমাম হাফিয বায়হাকী (রঃ) বলেন যে, প্রথমবারে তো রাসূলুল্লাহ (সঃ) জ্বিনদেরকে দেখেননি এবং বিশেষভাবে তাদেরকে শুনাবার জন্যে কুরআন পাঠও করেননি। হ্যা, তবে এর পরে জ্বিনেরা তাঁর কাছে আসে এবং তিনি তাদেরকে কুরআন পাঠ করে শুনিয়ে দেন এবং তাদেরকে তিনি মহামহিমান্বিত আল্লাহর দিকে আহ্বান জানান।
এ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীস সমূহঃ
হযরত আলকামা (রঃ) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেনঃ “জ্বিনদের আগমনের রাত্রিতে আপনাদের মধ্যে কেউ কি রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর সাথে ছিলেন?” উত্তরে তিনি বলেন, তাঁর সাথে কেউই ছিলেন না। তিনি সারা রাত আমাদের হতে অনুপস্থিত থাকেন এবং আমরা থেকে থেকে বারবার এই ধারণাই করি যে, সম্ভবতঃ কোন শত্রু তার সাথে প্রতারণা করেছে। ঐ রাত্রি আমাদের খুব খারাপভাবে কাটে। সুবহে সাদেকের কিছু পূর্বে আমরা দেখি যে, তিনি হেরা পর্বতের গুহা হতে প্রত্যাবর্তন করছেন। আমরা তখন তার কাছে আমাদের সারা রাত্রির অবস্থা বর্ণনা করি। তখন তিনি বলেনঃ “আমার কাছে জ্বিনদের প্রতিনিধি এসেছিল, যাদের সঙ্গে গিয়ে আমি তাদেরকে কুরআন শুনিয়েছি।” অতঃপর তিনি আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে যান এবং তাদের নিদর্শনাবলী ও তাদের আগুনের নিদর্শনাবলী আমাদেরকে প্রদর্শন করেন।”
শা'বী (রঃ) বলেন যে, জ্বিনেরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট খাদ্যের আবেদন জানায়। আমির (রঃ) বলেন যে, তারা তাঁর নিকট মক্কায় এ আবেদন জানিয়েছিল। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে বলেনঃ “প্রত্যেক হাড়, যার উপর আল্লাহর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তা তোমাদের হাতে পূর্বের চেয়ে গোশত বিশিষ্ট হয়ে পতিত হবে। আর জন্তুর মল ও গোবর তোমাদের জন্তুগুলোর খাদ্য হবে। সুতরাং হে মুসলিমবৃন্দ! তোমরা এ দুটো জিনিস দ্বারা ইতিনজা করো না। এগুলো তোমাদের জ্বিন ভাইদের খাদ্য।” | অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “ঐ রাত্রে আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে না পেয়ে খুবই বিচলিত হয়ে পড়ি এবং তাঁকে আমরা সমস্ত উপত্যকা ও ঘাঁটিতে অনুসন্ধান করি।” অন্য একটি হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আজ রাত্রে আমি জ্বিনদেরকে কুরআন শুনিয়েছি এবং তাদেরই মধ্যে এ কাজে রাত্রি কাটিয়েছি।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “আজ রাত্রে তোমাদের মধ্যে কেউ ইচ্ছা করলে জ্বিনদের কাজে আমার সাথে থাকতে পারে।” তখন আমি ছাড়া আর কেউই এ কাজে তার কাছে হাযির হলো না। তিনি আমাকে সাথে নিয়ে চললেন। মক্কা শরীফের উঁচু অংশে পৌঁছে তিনি স্বীয় পা মুবারক দ্বারা একটি রেখা টানলেন এবং আমাকে বললেনঃ “তুমি এখানেই বসে থাকো।” অতঃপর তিনি সামনে অগ্রসর হন এবং এক জায়গায় দাঁড়িয়ে তিনি কিরআত পাঠ শুরু করেন। তারপর তার চতুর্দিকে এমন সব দল জমায়েত হয় যে, তাঁর মধ্যে ও আমার মধ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে যায় এবং তার কিরআত আর আমার কানে আসেনি। এরপর আমি দেখি যে, মেঘখণ্ড যেভাবে ভেঙ্গে যায় সেই ভাবে তারা এদিক ওদিক যেতে লাগলো এবং খুব অল্প সংখ্যকই অবশিষ্ট থাকলো। তারপর ফজরের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) অবসর লাভ করলেন এবং সেখান হতে দূরে চলে গেলেন। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পুরো করে তিনি আমার নিকট আসলেন এবং আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “বাকীগুলো কোথায়?” আমি জবাবে বললামঃ এই যে তারা। অতঃপর তিনি তাদেরকে হাড় ও জন্তুর মল বা গোবর দিলেন। তারপর তিনি মুসলমানদেরকে এ দুটি জিনিস দ্বারা ইসতিনজা করতে নিষেধ করলেন। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বর্ণনা করেছেন)
এই রিওয়াইয়াতের দ্বিতীয় সনদে আছে যে, যেখানে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে বসিয়েছিলেন, বসাবার পর তিনি তাঁকে বলেছিলেনঃ “সাবধান! এখান হতে সরবে না, অন্যথায় তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে।” অন্য একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, ফজরের সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-এর নিকট এসে তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?” উত্তরে তিনি বললেনঃ না; না। আল্লাহর কসম! আমি জনগণের কাছে ফরিয়াদ করার ইচ্ছা করেছিলাম। কিন্তু আমি শুনতে পাই যে, আপনি লাঠি দ্বারা তাদেরকে ধমকাচ্ছেন এবং বলছেনঃ “তোমরা বসে পড়।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁকে বললেনঃ “তুমি যদি এখান হতে বের হতে তবে ভয় ছিল যে, তাদের কেউ হয়তো তোমাকে ছোঁ মেরে নিয়ে চলে যেতো।” তারপর তিনি তাঁকে বললেনঃ “আচ্ছা, তুমি কিছু দেখেছিলে কি?” জবাবে তিনি বলেনঃ “হ্যা, লোকগুলো ছিল কালো, অপরিচিত, ভয়াবহ এবং সাদা কাপড় পরিহিত।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “এগুলো ছিল নাসীবাইনের জ্বিন। তারা আমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল।
আমি তাদেরকে হাড় ও গোবর দিয়েছিলাম।” হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! এগুলোতে তাদের উপকার কি?” উত্তরে তিনি বললেনঃ “প্রত্যেক হাড় তাদের হাতে আসামাত্রই ঐরূপ হয়ে যাবে ওটা খাওয়ার সময় যেরূপ ছিল অর্থাৎ গোশত বিশিষ্ট হয়ে যাবে। গোবরেও তারা ঐ দানা পাবে যা ঐদিনে ছিল যেই দিন ওটা খাওয়া হয়েছিল। সুতরাং তোমাদের মধ্যে কেউ যেন পায়খানা হতে বের হয়ে হাড় অথবা গোবর দ্বারা। ইসতিনজা না করে।”
এই রিওয়াইয়াতের অন্য সনদে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আজ রাত্রে পনেরোজন জ্বিন, যারা পরস্পর চাচাতো ও ফুফাতো ভাই, কুরআন শুনার জন্যে আমার নিকট আসবে।` তাতে হাড় ও গোবরের সাথে কয়লার কথাও রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “সকাল হলে আমি ঐ জায়গায় গমন করে দেখি যে, ওটা ষাটটি উটের বসার সমান জায়গা।`
অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, যখন জ্বিনদের ভিড় হয়ে গেল তখন তাদের সরদার ওয়াযদান বললোঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি এদেরকে এদিক ওদিক করে দিয়ে আপনাকে এই কষ্ট হতে রক্ষা করছি।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আমার আল্লাহ তা'আলা হতে বড় রক্ষক আর কেউই নেই।” নবী (সঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তোমার নিকট পানি আছে কি?” তিনি উত্তরে বললেনঃ “আমার নিকট পানি নেই বটে, তবে একটি পাত্রে খেজুর ভিজানো পানি (নবীয়) রয়েছে।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “উত্তম খেজুর ও পবিত্র পানি।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রঃ), ইমাম আবু দাউদ (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেছেন) মুসনাদে আহমাদের এ হাদীসে এও আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে বলেনঃ “আমাকে তুমি এই পানি দ্বারা অযু করিয়ে দাও।” অতঃপর তিনি অযু করেন এবং বলেনঃ “হে আল্লাহর বান্দা! এটা তো পবিত্র পানীয়।”
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে যে, যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) জ্বিনদের নিকট হতে ফিরে আসেন তখন তিনি ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছিলেন। সুতরাং হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! ব্যাপার কি?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “আমার কাছে আমার মৃত্যুর খবর পৌঁছে গেছে।” এই হাদীসটিই কিছুটা বৃদ্ধির সাথে হাফিয আবু নঈম (রঃ)-এর কিতাবু দালাইলিন নবুওয়াতের মধ্যে বর্ণিত হয়েছে। তাতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মুখে এ কথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাঁকে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার পরে খলীফা হবেন এমন ব্যক্তির নাম করুন।” তিনি বললেনঃ ‘কার নাম করবো?” হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) জবাবে বললেনঃ “হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে মনোনীত করুন।” একথা শুনে তিনি নীরব থাকলেন। কিছু দূর চলার পর পুনরায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ঐ অবস্থা হলো। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) পূর্বের ন্যায় প্রশ্ন করলেন এবং তিনি পূর্বের মতই উত্তর দিলেন। হযরত ইবনে মাসউদ খলীফা নির্বাচনের কথা বললে তিনি প্রশ্ন করেনঃ “কাকে?” হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) উমার (রাঃ)-এর নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু এবারও রাসূলুল্লাহ (সঃ) নীরব থাকেন। আবার কিছু দূর যাওয়ার পর তার ঐ একই অবস্থা দেখা দিলে ঐ একই প্রশ্ন ও উত্তরের আদান প্রদান হয়। এবার হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হযরত আলী ইবনে আবি তালিব। (রাঃ)-এর নাম প্রস্তাব করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তার সত্তার শপথ! যদি মানুষ তার আনুগত্য স্বীকার করে তবে তারা জান্নাতে চলে যাবে। কিন্তু এটা খুবই গারীব হাদীস এবং খুব সম্ভব এটা রক্ষিত নয়। আর যদি এর বিশুদ্ধতা মেনে নেয়া হয় তবে এ ঘটনাকে মদীনার ঘটনা স্বীকার করতে হবে। সেখানেও রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে জ্বিনদের প্রতিনিধি দল এসেছিল, যেমন সত্বরই আমরা বর্ণনা করছি ইনশাআল্লাহ। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জীবনের শেষ সময় ছিল মক্কা বিজয়ের পরবর্তী সময়। যখন মানব ও দানব দলে দলে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল এবং অবতীর্ণ হয়েছিল নিম্নের সূরাটিঃ (আরবী) অর্থাৎ “যখন আসবে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় এবং তুমি মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবে। তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসাসহ তার প্রবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করো এবং তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো, তিনি তো তাওবা কবুলকারী।”(১১১:১-৩) এতে তাঁকে তাঁর মৃত্যুর সংবাদ দেয়া হয়, যেমন এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ)-এর উক্তি এবং আমীরুল মুমিনীন হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) এর আনুকূল্য করেছেন।
এই হাদীসগুলো আমরা ইনশাআল্লাহ এই সূরার তাফসীরে আনয়ন করবো। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
উপরোক্ত হাদীসটি অন্য সনদেও বর্ণিত আছে। কিন্তু এর ইসনাদও গারীব বা দুর্বল এবং পূর্বাপর সম্পর্কও বিস্ময়কর।
হযরত ইকরামা (রাঃ) বলেন যে, এই জ্বিনগুলো জাযীরায়ে মুসিলের ছিল। তাদের সংখ্যা ছিল বারো হাজার। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) ঐ রেখা অংকিত জায়গায় বসেছিলেন। কিন্তু জ্বিনদের খেজুর বৃক্ষ বরাবর দেহ ইত্যাদি দেখে তিনি ভয় পান এবং পালিয়ে যাবার ইচ্ছা করেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিষেধাজ্ঞার কথা তার স্মরণ হয় যে, তিনি যেন ঐ অংকিত জায়গার বাইরে না। যান। যখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সামনে এটা বর্ণনা করেন তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ “তুমি যদি এর সীমা অতিক্রম করতে তবে কিয়ামত পর্যন্ত তোমার ও আমার মধ্যে সাক্ষাৎ লাভ সম্ভব হতো না।
অন্য এক রিওয়াইয়াতে আছে যে, .. (আরবী)-এই আয়াতে যে জ্বিনদের বর্ণনা রয়েছে তারা ছিল নীনওয়ার জ্বিন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে বলেনঃ “আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, আমি যেন তাদেরকে কুরআন শুনিয়ে দিই তোমাদের মধ্যে কে আমার সাথে গমন করবে? এতে সবাই নিরুত্তর থাকে। তিনি দ্বিতীয়বার এই প্রশ্ন করেন। এবারও সবাই নীরব থাকে। তার তৃতীয়বারের প্রশ্নের জবাবে হুযায়েল গোত্রের লোক হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার সাথে আমিই যাবো।” সুতরাং তাকে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) হাজুন ঘাঁটিতে গেলেন। একটি রেখা অংকন করে হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)-কে তথায় বসিয়ে দিলেন এবং তিনি সামনে অগ্রসর হলেন। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) দেখতে পেলেন যে, গৃধিনীর মত কতকগুলো জীব মাটির খুবই নিকট দিয়ে উড়ে আসছে। কিছুক্ষণ পর খুবই গোলমাল শুনা গেল। শেষ পর্যন্ত হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জীবনের ব্যাপারে আশংকা করলেন। অতঃপর যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁর কাছে আসলেন তখন তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! গোলমাল কিসের ছিল?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “তাদের একজন নিহতকে নিয়ে গণ্ডগোল ছিল। তার ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতানৈক্য ছিল। তাদের মধ্যে সঠিক ফায়সালা করে দেয়া হলো। এ ঘটনাগুলো পরিষ্কার যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইচ্ছাপূর্বক গিয়ে জ্বিনদেরকে কুরআন শুনিয়েছিলেন এবং তাদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান করেছিলেন। আর ঐ সময় তাদের যে মাসআলাগুলোর দরকার ছিল সেগুলো তাদেরকে বলে দেন। হ্যা, তবে প্রথমবার যখন জ্বিনেরা তার মুখে কুরআন শ্রবণ করে ঐ সময় না তিনি তাদেরকে শুনাবার উদ্দেশ্যে কুরআন পাঠ করেন, না তাদের আগমন ও উপস্থিতি তিনি অবগত ছিলেন। যেমন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ কথা বলেন। এর পরে তারা প্রতিনিধিরূপে আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর নিকট আগমন করে এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) ইচ্ছা করে তাদের কাছে আসেন এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেন তখন হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) তাঁর সাথে ছিলেন না। তবে অবশ্যই তিনি কিছু দূরে বসেছিলেন। এই ঘটনায় রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) ছাড়া আর কেউ ছিলেন না।
যে রিওয়াইয়াতগুলোতে আছে যে, হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে ছিলেন এবং যেগুলোতে তার না থাকার কথা রয়েছে, এ দু' এর মধ্যে সামঞ্জস্য এভাবেও হতে পারে যে, প্রথমবার তিনি সঙ্গে ছিলেন না এবং দ্বিতীয়বার ছিলেন। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।
এটাও বর্ণিত আছে যে, নাখলাতে যে জ্বিনগুলো রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেছিল ওগুলো ছিল নীনওয়ার জ্বিন। আর মক্কা শরীফে যেসব জ্বিন তার খিদমতে হাযির হয়েছিল ওগুলো নাসীবাইনের জ্বিন ছিল। যে। রিওয়াইয়াতগুলোতে রয়েছেঃ “আমরা ঐ রাত্রি মন্দভাবে অতিবাহিত করেছি’ এর দ্বারা হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) ছাড়া অন্যান্য সাহাবীদেরকে বুঝানো হয়েছে যেগুলোতে এটা জানা ছিল না যে, তিনি জ্বিনদেরকে কুরআন শুনাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এটা খুব দূরের ব্যাখ্যা। এসব ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ।
ইমাম হাফিয আবু বকর বায়হাকী (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রয়োজন ও অযুর জন্যে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) একটি পাত্রে পানি নিয়ে তার সাথে যেতেন। একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর পিছনে পিছনে গিয়ে তিনি পৌছেন, তখন তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “কে?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “আমি আবু হুরাইরা (রাঃ)।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন তাঁকে বললেনঃ “আমার ইসতিনজার জন্যে পাথর নিয়ে এসো, কিন্তু হাড় ও গোবর আনবে না।” হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেনঃ “আমি আমার ঝুলিতে পাথর ভরে নিয়ে আসলাম এবং তাঁর সামনে রেখেদিলাম। এর থেকে ফারেগ হয়ে যখন তিনি চলতে শুরু করলেন তখন আমিও তার পিছনে পিছনে চলতে লাগলাম। তাকে আমি জিজ্ঞেস করলামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হাড় ও গোবর আনতে নিষেধ করার কারণ কি? জবাবে তিনি বললেনঃ “আমার কাছে নাসীবাইনের জ্বিন প্রতিনিধিরা এসেছিল এবং তারা আমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল। আমি আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা জানিয়েছিলাম যে, তারা যে হাড় ও গোবরের উপর দিয়ে যাবে তা যেন তারা তাদের খাদ্য হিসেবে পায়।” (এ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে প্রায় এভাবেই বর্ণিত আছে)
সুতরাং এ হাদীসটি এবং এর পূর্ববর্তী হাদীসগুলো এ ইঙ্গিতই বহন করে যে, জ্বিনদের প্রতিনিধিরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এর পরেও এসেছিল। এখন আমরা ঐ হাদীসগুলো বর্ণনা করছি যেগুলো দ্বারা এটা প্রমাণিত হয় যে, জ্বিনেরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট কয়েকবার এসেছিল। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে যে রিওয়াইয়াত ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে ওটা ছাড়াও অন্য সনদে তার হতে আরো রিওয়াইয়াত বর্ণিত আছে। তাফসীরে ইবনে জারীরে হযরত ইবনে। আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি ... (আরবী) আয়াতের তাফসীরে বলেনঃ “তারা ছিল সাতজন জ্বিন। তারা নাসীবাইনে বসবাস করতো। তাদেরকে রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজের পক্ষ হতে দূত হিসেবে জ্বিনদের নিকট পাঠিয়েছিলেন।”
হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, ঐ জ্বিনদের সংখ্যা ছিল সাত। রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদের তিনজনকে হিরানের অধিবাসী ও চারজনকে নাসীবাইনের অধিবাসী বলেছেন। তাদের নামগুলো হলো হিসসী, হিসসা, মিনসী, সা’সির, নাসির, আরদূবিয়া, আখতাম।
আবূ হামযা শিমালী (রঃ) বলেন যে, জ্বিনদের এই গোত্রটিকে বানু শীসবান বলা হতো। এ গোত্রটি জ্বিনদের অন্যান্য গোত্রগুলো হতে সংখ্যায় বেশী ছিল এবং তাদেরকে সম্ভান্ত বংশীয় হিসেবে মান্য করা হতো। সাধারণতঃ এরা। ইবলীসের সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ছিল।
হযরত সুফিয়ান সাওরী (রঃ) হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, এরা ছিল নয়জন, যাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল যাভীআহ। তারা আসলে নাখলা হতে এসেছিল। কোন কোন গুরুজন হতে বর্ণিত আছে যে, তারা ছিল পনেরোজন, যেমন এ বর্ণনা পূর্বে গত হয়েছে।
একটি রিওয়াইয়াতে আছে যে, তারা ষাটটি সওয়ারীর উপর সওয়ার হয়ে এসেছিল। তাদের নেতার নাম ছিল ওয়ারদান। এটাও বর্ণিত আছে যে, তারা ছিল তিনশজন এবং এক রিওয়াইয়াতে তাদের সংখ্যা বারো হাজারও রয়েছে। এসবের মধ্যে সামঞ্জস্য এভাবে হতে পারে যে, প্রতিনিধিরা যেহেতু কয়েকবার এসেছিল, সেহেতু হতে পারে যে, কোনবার ছিল ছয়, সাত বা নয় জন, কোনবার এর চেয়ে বেশী ছিল এবং কোনবার এর চেয়েও বেশী ছিল। এর দলীল হিসেবে সহীহ বুখারীর এ রিওয়াইয়াতটিও গ্রহণ করা যেতে পারে যে, হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) যখন কোন বিষয় সম্পর্কে বলতেনঃ ‘আমার ধারণায় এটা এইরূপ হবে তখন তা প্রায় ঐরূপই হতো। একদা তিনি বসেছিলেন, এমন সময় একজন সুশ্রী লোক তার পার্শ্ব দিয়ে গমন করে। তাকে দেখে তিনি মন্তব্য করেনঃ “যদি আমার ধারণা ভুল না হয় তবে আমি বলতে পারি যে, এ লোকটি অজ্ঞতার যুগে লোকদের গণক বা যাদুকর ছিল। যাও, তাকে এখানে নিয়ে এসো।” লোকটি তার কাছে আসলে তিনি তার নিকট নিজের ধারণা প্রকাশ করলেন। সে তখন বললোঃ “আমি মুসলমানদের মধ্যে এমন বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান লোক আর দেখিনি।” হযরত উমার (রাঃ) তখন তাকে বললেনঃ “এখন আমার কথা এই যে, তুমি তোমার জানা কোন সঠিক ও সত্য খবর আমাদেরকে শুনিয়ে দাও।” সে বললোঃ “আচ্ছা, তাহলে শুনুন। আমি জাহিলিয়াতের যুগে লোকদের গণক ছিলাম। আমার কাছে আমার সাথী এক জ্বিন, যে সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর খবর আমার নিকট এনেছিল তা হচ্ছে এই যে, একদা আমি বাজারে ছিলাম, এমন সময় সে অত্যন্ত ভীত-বিহ্বল অবস্থায় আমার কাছে এসে বললোঃ (আরবী) অর্থাৎ “তুমি কি জ্বিনদের ধ্বংস, নৈরাশ্য এবং তাদের ছড়িয়ে পড়ার পর সংকুচিত হয়ে যাওয়া লক্ষ্য করনি এবং তাদের দুর্গতি দেখোনি?” এ কথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) বলেনঃ “সে সত্য কথা বলেছে। একদা আমি তাদের মা’ৰূদদের (মূর্তিগুলোর) পার্শ্বে ঘুমিয়েছিলাম, এমন সময় একটি লোক এসে তথায় একটি গোবৎস (বাছুর) যবেহ করলো। অকস্মাৎ এমন একটি ভীষণ শব্দ হলো এরূপ উচ্চ ও বিকট শব্দ আমি ইতিপূর্বে কখনো শুনিনি। সে বললোঃ “হে জালীজ! পরিত্রাণকারী বিষয় এসে গেছে। একজন বাকপটু ব্যক্তি বাক চাতুর্যের সাথে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ' বলছেন।” শব্দ শুনে সবাই তো ভয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু আমি ওখানেই বসে থাকলাম যে, দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি ঘটে? দ্বিতীয়বার ওভাবেই ঐ শব্দই শুনা গেল এবং সে ঐ কথাই বললো। অতঃপর কিছুদিন পরেই নবী (সঃ)-এর নবুওয়াতের আওয়ায় আমাদের কানে আসতে শুরু হলো। এই রিওয়াইয়াতের বাহ্যিক শব্দ দ্বারা তো এটাই জানা যাচ্ছে যে, হযরত উমার ফারূক (রাঃ) স্বয়ং যবেহকৃত বাছুর হতে এই শব্দ শুনেছিলেন। আর একটি দুর্বল রিওয়াইয়াতে স্পষ্টভাবে এটা এসেও গেছে। কিন্তু বাকী অন্যান্য রিওয়াইয়াতগুলো এটা বলে দেয় যে, ঐ যাদুকরই নিজের দেখা-শুনার একটি ঘটনা এটাও বর্ণনা করেছে। এসব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। ইমাম বায়হাকী (রঃ) এটাই বলেছেন এবং এটাই ভাল বলে মনে হচ্ছে। ঐ ব্যক্তির নাম ছিল সাওয়াদ ইবনে কারিব। যে ব্যক্তি এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানতে চায় তিনি যেন আমার ‘সীরাতে উমার' নামক কিতাবটি দেখে নেন। সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহর জন্যে।
ইমাম বায়হাকী (রঃ) বলেনঃ খুব সম্ভব এটা ঐ যাদুকর বা গণক যার বর্ণনা নাম ছাড়াই সহীহ হাদীসে রয়েছে। হযরত উমার ইবনে খাত্তাব (রাঃ) একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর মিম্বরে উঠে ভাষণ দিচ্ছিলেন। ঐ অবস্থাতেই তিনি জনগণকে জিজ্ঞেস করেনঃ “সাওয়াদ ইবনে কারিব এখানে আছে কি?” কিন্তু ঐ পূর্ণ এক বছরের মধ্যে কেউ হ্যা’ বললো না। পরের বছর আবার তিনি এটা জিজ্ঞেস করলেন। তখন হযরত বারা’ (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ “সাওয়াদ ইবনে কারিব কে? এর দ্বারা উদ্দেশ্য কি?” জবাবে হযরত উমার (রাঃ) বললেনঃ “তার ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারটা খুবই বিস্ময়কর।” এভাবে তাদের মধ্যে আলোচনা চলছিল এমতাবস্থায় হযরত সাওয়াদ ইবনে কারিব (রাঃ) তথায় অকস্মাৎ হাযির হয়ে যান। হযরত উমার (রাঃ) তখন তাকে বলেনঃ “হে সাওয়াদ (রাঃ)! তোমার ইসলাম গ্রহণের প্রাথমিক ঘটনাটি বর্ণনা কর ।” তিনি তখন বললেনঃ “হ্যা, তাহলে শুনুন। আমি ভারতবর্ষে গমন করেছিলাম এবং তথায় অবস্থান করছিলাম। একদা রাত্রে আমার সাথী জ্বিনটি আমার কাছে আসে। ঐ সময় আমি ঘুমিয়েছিলাম। সে আমাকে জাগ্রত করে এবং বলেঃ “উঠো এবং জ্ঞান-বিবেক থাকলে শুনে ও বুঝে নাও যে, লুওয়াই ইবনে গালিব গোত্রের মধ্য হতে আল্লাহর রাসূল (সঃ) প্রেরিত হয়েছেন।” অতঃপর সে কবিতায় বললোঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি জ্বিনদের অনুভূতি এবং তাদের বস্তা ও বিছানা-পত্র বাঁধা দেখে বিস্ময়বোধ করছি। তুমি যদি হিদায়াত লাভ করতে চাও তবে এখনই মক্কার পথে যাত্রা শুরু কর। তুমি বুঝে নাও যে, ভাল ও মন্দ জ্বিন সমান নয়। অতি সত্বর গমন কর এবং বানু হাশিমের ঐ প্রিয় ব্যক্তির সুন্দর চেহারা দর্শনের মাধ্যমে স্বীয় চক্ষুদ্বয় ঠাণ্ডা কর।”
আমাকে পুনরায় তন্ত্রায় চেপে ধরে এবং সে আবার আমাকে জাগিয়ে তোলে। অতঃপর বলেঃ “হে সাওয়াদ ইবনে কারিব (রাঃ)! মহামহিমান্বিত আল্লাহ নবী (সঃ)-কে পাঠিয়েছেন, সুতরাং তুমি তাড়াতাড়ি তাঁর নিকট গিয়ে হিদায়াত লাভে ধন্য হও।” দ্বিতীয় রাত্রে আবার সে আমার নিকট আসে এবং আমাকে জাগিয়ে দিয়ে কবিতার মাধ্যমে বলেঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি জ্বিনদের অনুসন্ধান এবং তাদের বস্তা ও থলে কষা দেখে বিস্মিত হচ্ছি, তুমিও যদি সুপথ পেতে চাও তবে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যাও। জেনে রেখো যে, ওদের দুই পা ওদের লেজের মত নয়। তুমি তাড়াতাড়ি উঠো এবং বানু হাশিমের ঐ পছন্দনীয় ব্যক্তির নিকট পৌঁছে যাও এবং তাঁকে দর্শন করে স্বীয় চক্ষুদ্বয়কে জ্যোতির্ময় কর।”
তৃতীয় রাত্রে সে আবার আসলো এবং আমাকে জাগ্রত করে কবিতার ভাষায় বললোঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমি জ্বিনদের খবর জেনে নেয়া এবং তাদের যাত্রীদের যাত্রার প্রস্তুতি গ্রহণ দেখে আশ্চর্যান্বিত হচ্ছি। তারা সব হিদায়াত লাভের উদ্দেশ্যে তাড়াতাড়ি মক্কার পথে যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। তাদের মন্দরা ভালোদের মত নয়। তুমিও উঠো এবং বানু হাশিমের এই মহান ব্যক্তির খিদমতে হাযির হয়ে যাও। জেনে রেখো যে, মুমিন জ্বিনেরা কাফির জ্বিনদের মত নয়।”
পর্যায়ক্রমে তিন রাত্রি ধরে তার এসব কথা শুনে আমার হৃদয়ে ইসলামের প্রেম জেগে ওঠে এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর প্রতি সম্মান ও ভালবাসায় আমার অন্তর পূর্ণ হয়ে যায়। সুতরাং আমি আমার স্ত্রীর পিঠে হাওদা কষে অন্য কোন জায়গায় অবস্থান না করে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে গেলাম। ঐ সময় তিনি মক্কা শহরে ছিলেন এবং জনগণ তার চতুম্পার্শ্বে এমনভাবে বসেছিলেন যেমন ঘোড়ার উপর কেশর থাকে। নবী (সঃ) আমাকে দেখেই বলে উঠলেনঃ “হে সাওয়াদ ইবনে কারিব (রাঃ)! তোমার আগমন শুভ হোক! তুমি আমার কাছে কি করে, কি উদ্দেশ্যে এবং কার কথায় এসেছে তা আমি জানি।” আমি তখন বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি কিছু কবিতা বলতে চাই, অনুমতি দিলে বলি। তিনি বললেনঃ “হে সাওয়াদ (রাঃ)! ঠিক আছে, তুমি বল।” তখন আমি বলতে শুরু করলামঃ (আরবী) অর্থাৎ “আমার নিকট আমার জ্বিন রাত্রে আমার ঘুমিয়ে পড়ার পর আসলো এবং আমাকে একটি সঠিক ও সত্য খবর দিলো। পর্যায়ক্রমে তিন রাত্রি সে আমার কাছে আসতে থাকলো এবং প্রতি রাত্রে আমাকে বলতে তাকলোঃ লুওয়াই ইবনে গালিবের মধ্যে আল্লাহর রাসূল (সঃ) প্রেরিত হয়েছেন। আমিও। তখন সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম এবং তাড়াতাড়ি পথ অতিক্রম করে এখানে পৌঁছলাম। এখন আমি সাক্ষ্য দান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন প্রতিপালক নেই এবং আপনি আল্লাহর বিশ্বস্ত রাসূল। আপনার শাফাআতের উপর আমার আস্থা রয়েছে। হে সর্বাপেক্ষা মহান ও পবিত্র লোকদের সন্তান! হে সমস্ত রাসূলের চেয়ে উত্তম রাসূল (সঃ)! আপনি যে আসমানী হুকুম আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন তা যতই কঠিন ও স্বভাব বিরুদ্ধ হোক না কেন, এটা সম্ভব নয় যে, আমরা তা। পরিহার করি। আপনি অবশ্যই কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশকারী হবেন। কেননা, সেই দিন সেখানে আপনি ছাড়া সাওয়
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।