সূরা আয-যুখরুফ (আয়াত: 86)
হরকত ছাড়া:
ولا يملك الذين يدعون من دونه الشفاعة إلا من شهد بالحق وهم يعلمون ﴿٨٦﴾
হরকত সহ:
وَ لَا یَمْلِکُ الَّذِیْنَ یَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ الشَّفَاعَۃَ اِلَّا مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ ﴿۸۶﴾
উচ্চারণ: ওয়ালা-ইয়ামলিকুল্লাযীনা ইয়াদ‘ঊনা মিন দূনিহিশশাফা-‘আতা ইল্লা-মান শাহিদা বিলহাক্কি ওয়া হুম ইয়া‘লামূন।
আল বায়ান: আর তিনি ছাড়া যাদেরকে তারা আহবান করে তারা সুপারিশের মালিক হবে না; তবে তারা ছাড়া যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয় ।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ৮৬. আর তিনি ছাড়া তারা যাদেরকে ডাকে, তারা সুপারিশের মালিক হবে না, তবে তারা ছাড়া, যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয়।
তাইসীরুল ক্বুরআন: আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে তারা ডাকে তারা সুপারিশের অধিকারী নয়, তবে যে জ্ঞানের ভিত্তিতে সত্যের সাক্ষ্য দেয় সে ছাড়া।
আহসানুল বায়ান: (৮৬) আল্লাহর পরিবর্তে ওরা যাদেরকে ডাকে, সুপারিশের অধিকার তাদের নেই।[1] তবে যারা সত্য উপলব্ধি করে ওর (সত্যের) সাক্ষ্য দেয় তাদের কথা স্বতন্ত্র। [2]
মুজিবুর রহমান: আল্লাহর পরিবর্তে তারা যাদেরকে ডাকে, সুপারিশের ক্ষমতা তাদের নেই, তবে যারা সত্য উপলব্ধি করে ওর সাক্ষ্য দেয় তারা ব্যতীত।
ফযলুর রহমান: তারা আল্লাহকে ছাড়া যাদেরকে ডাকে তাদের সুপারিশের ক্ষমতা নেই। তবে যারা জেনে সত্য সাক্ষ্য দেয় তাদের কথা আলাদা।
মুহিউদ্দিন খান: তিনি ব্যতীত তারা যাদের পুজা করে, তারা সুপারিশের অধিকারী হবে না, তবে যারা সত্য স্বীকার করত ও বিশ্বাস করত।
জহুরুল হক: আর তাঁকে বাদ দিয়ে তারা যাদের ডাকে তাদের কোনো ক্ষমতা নেই সুপারিশ করার, তিনি ব্যতীত যিনি সত্যের সাথে সাক্ষ্য দেন, আর তারা জানে।
Sahih International: And those they invoke besides Him do not possess [power of] intercession; but only those who testify to the truth [can benefit], and they know.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ৮৬. আর তিনি ছাড়া তারা যাদেরকে ডাকে, তারা সুপারিশের মালিক হবে না, তবে তারা ছাড়া, যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয়।
তাফসীর:
-
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: (৮৬) আল্লাহর পরিবর্তে ওরা যাদেরকে ডাকে, সুপারিশের অধিকার তাদের নেই।[1] তবে যারা সত্য উপলব্ধি করে ওর (সত্যের) সাক্ষ্য দেয় তাদের কথা স্বতন্ত্র। [2]
তাফসীর:
[1] অর্থাৎ, দুনিয়াতে যে বাতিল উপাস্যগুলোর এরা পূজা-অর্চনা করে এই মনে করে যে, এরা আল্লাহর নিকট আমাদের জন্য সুপারিশ করবে। তাদের সুপারিশ করার মোটেই কোন এখতিয়ার ও যোগ্যতা নেই।
[2] হক বা সত্য বলতে বুঝানো হয়েছে, তাওহীদের কালেমা ‘লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ’কে। এর স্বীকৃতি ও সাক্ষ্য জ্ঞান ও উপলব্ধির ভিত্তিতে হবে। (এর অর্থ না বুঝে) কেবল প্রথাগত ও (অন্যের) দেখাদেখির ভিত্তিতে যেন না হয়। অর্থাৎ, মৌখিকভাবে কালেমা তাওহীদের ঘোষণাদাতাকে জেনে রাখতে হবে যে, এতে কেবল এককভাবে আল্লাহর উপাস্যত্বকেই সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং অন্যান্য সমস্ত উপাস্যের উপাস্যত্ব নাকচ করা হয়েছে। অতঃপর (আন্তরিকভাবে) এই অনুযায়ী হবে তার আমল। এ রকম লোকের ব্যাপারে সুপারিশকারীদের সুপারিশ ফলপ্রসূ হবে। অথবা অর্থ হল, সুপারিশ করার অধিকার কেবল তাঁরাই লাভ করবেন, যাঁরা সত্যকে স্বীকার করবেন। অর্থাৎ, আম্বিয়া, নেকলোক এবং ফিরিশতাগণ এই অধিকার লাভ করবেন। সেই বাতিল উপাস্যরা নয়, যাদেরকে মুশরিকরা মনগড়াভাবে নিজেদের সুপারিশকারী মনে করে থাকে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: ৮১-৮৯ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
إِنْ শর্তমূলক, নাকি না-বোধক এ নিয়ে দুধরনের উক্তি রয়েছে; কেউ বলেছেন তা শর্তমূলক, সে হিসেবে অর্থ হল, যদি আল্লাহ তা‘আলার কোন সন্তান থাকত তাহলে আমিই হতাম সে সন্তানের প্রথম ইবাদতকারী। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলার কোন সন্তান নেই তাই একমাত্র তাঁরই ইবাদত করি। কেউ বলেছেন, إِنْ না-বোধক, সুতরাং অর্থ হল আল্লাহ তা‘আলার কোন সন্তান নেই, অতএব এক আল্লাহ তা‘আলার ইবদাতকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম (তোমাদের মধ্যে)। তাঁর সন্তান হবে এমন কথা থেকে পবিত্রতা বর্ণনা করছি এবং প্রত্যেক ঐসব থেকেও পবিত্রতা বর্ণনা করছি যা তাঁর শানে উপযোগী নয়। এটাই সঠিক কথা, কেননা এ অর্থেই কুরআনের অনেক আয়াত এসেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَّيُنْذِرَ الَّذِيْنَ قَالُوا اتَّخَذَ اللّٰهُ وَلَدًا ق مَا لَهُمْ بِه۪ مِنْ عِلْمٍ وَّلَا لِآبَا۬ئِهِمْ)
“এবং সতর্ক করার জন্য তাদেরকে যারা বলে যে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন, এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান নেই এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরও ছিল না।” (সূরা কাহ্ফ ১৮ : ৪-৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন :
وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمٰنُ وَلَدًا لَقَدْ جِئْتُمْ شَيْئًا إِدًّا
“তারা বলে, ‘দয়াময় সন্তান গ্রহণ করেছেন।’ তোমরা এক বীভৎস বিষয়ের অবতারণা করেছ” (সূরা মারাইয়াম ১৯ : ৮৮-৮৯, আযওয়াউল বায়ান, অত্র আয়াতের তাফসীর)
তাই মুশরিকরা আল্লাহ তা‘আলার সন্তান থাকার ব্যাপারে যে সকল কথা-বার্তা বলাবলি করে তিনি তা হতে সম্পূর্ণ পবিত্র ও মহান। তিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অধিপতি এবং আরশের অধিকারী। তিনি এক, অভাবমুক্ত, সমকক্ষ ও সন্তান নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(سُبْحٰنَه۫ أَنْ يَّكُوْنَ لَه۫ وَلَدٌ ﻣ لَه۫ مَا فِي السَّمٰوٰتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ط وَكَفٰي بِاللّٰهِ وَكِيْلًا)
“তাঁর সন্তান হবে- তিনি এটা হতে পবিত্র। আসমানে যা কিছু আছে ও জমিনে যা কিছু আছে সব আল্লাহরই; কর্ম-বিধানে আল্লাহই যথেষ্ট।” (সূরা নিসা ৪ : ১৭১)
সুতরাং সত্য সুস্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পরেও যারা আল্লাহ তা‘আলার শানে এরূপ কথা-বার্তা বলে তাদেরকে ঐ দিনের সাক্ষাত করার পূর্ব পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হবে যেদিনের প্রতিশ্রুতি তাদেরকে দেয়া হয়েছে, তারা ক্রীড়া-কৌতুক ও হাসি-তামাশা করুক। যখন ঐদিন এসে যাবে তখন তারা তাদের পরিণাম সম্পর্কে জানতে পারবে।
এরপর মহান আল্লাহর মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, আসমান ও জমিনের সমস্ত মাখলূক তাঁর ইবাদতে লিপ্ত রয়েছে এবং সবাই তাঁর সামনে অপারগ ও শক্তিহীন। তিনিই প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَهُوَ اللّٰهُ فِي السَّمٰوٰتِ وَفِي الْأَرْضِ ط يَعْلَمُ سِرَّكُمْ وَجَهْرَكُمْ وَيَعْلَمُ مَا تَكْسِبُوْنَ)
“আসমানসমূহ ও জমিনে তিনিই আল্লাহ, তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছু তিনি জানেন এবং তোমরা যা অর্জন কর তাও তিনি অবগত আছেন।” (সূরা আন‘আম ৬ : ৩) এ সম্পর্কে সূরা আন‘আমের ৩ নম্বর আয়াতেও আলোচনা করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা আকাশসমূহ ও পৃথিবী এবং এর মধ্যবর্তী যা কিছু রয়েছে সকল কিছুর মালিক। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ নন। আর একমাত্র তিনিই কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সময়কাল সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখেন। এ সম্পর্কে সূরা আল আন‘আমের ৫৯ নম্বর আয়াতে ও সূরা লুক্বমানের শেষ আয়াতে আলোচনা করা হয়েছে।
(وَلَا يَمْلِكُ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِهِ الشَّفَاعَةَ)
অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য যাদের ইবাদত করা হয় এ আশায় যে, তারা আমাদের জন্য শাফায়াত করবে। যেমন ফেরেশতা, নাবী, ওলী-আওলিয়া ও কবরে শায়িত ব্যক্তি ইত্যাদি; এরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে কোন শাফায়াত করতে পারবে না। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন :
(إِلَّا مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ)
অর্থ হল- যে সাক্ষ্য দেয় আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাসূলুল্লাহ। অন্তরে বিশ্বাস, মুখে স্বীকার ও যে ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছে সে ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান রাখে। সত্যের প্রতি সাক্ষ্য দেয়ার জন্য শর্ত হল- আল্লাহ তা‘আলার এককত্বের সাক্ষ্য দেবে, সাক্ষ্য দেবে রাসূলগণের নবুওয়াতের ও তারা যা নিয়ে এসেছেন তা সঠিক। এসব ব্যক্তিরা আল্লাহ তা‘আলার অনুমতি সাপেক্ষে যার জন্য শাফায়াত করার অনুমতি দেয়া হবে তার জন্য শাফায়াত করতে পারবে। এ সম্পর্কে সূরা বাকারাতে আলোচনা করা হয়েছে।
অতঃপর মুশরিকরাও আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়্যাহ তথা সকল কিছুর মালিক ও সৃষ্টিকর্তা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা তা স্বীকার করত কিন্তু ইবাদত করত বিভিন্ন প্রতিমা ও দেব-দেবীর। সে জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলছেন : অর্থাৎ তারা সব কিছুর মালিক ও সৃষ্টিকর্তা হিসেবে আল্লাহ তা‘আলাকে এক মেনে নিয়েও কিভাবে অন্যের ইবাদত করে? কেননা তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ তাওহীদে উলুহিয়্যাহ আবশ্যক করে। অর্থাৎ যিনি সব কিছুর মালিক তিনি ইবাদত পাওয়ার হকদার।
وَقِيْلِه এখানে তিন ধরনের কিরাত রয়েছে। কেউ যবর দিয়ে পড়েছেন, কেউ পেশ দিয়ে পড়েছেন, কেউ যের দিয়ে পড়েছেন। যের দিয়ে পড়লে এর সম্পর্ক হল এর পূর্ব আয়াতের عِلْمُ السَّاعَةِ শব্দের সাথে। সর্বনাম দ্বারা উদ্দেশ্য হল নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। অর্থ হল- আল্লাহ তা‘আলার নিকট রয়েছে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কথার জ্ঞান। অর্থাৎ নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ তা‘আলার কাছে অভিযোগ করে বলেছিলেন- হে আল্লাহ! যাদের কাছে আমাকে প্রেরণ করেছেন তারা আমাকে অস্বীকার করছে, তারা ঈমান আনছে না।
আল্লাহ তা‘আলা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর অভিযোগ শুনে তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বললেন এবং সুন্দর করে বিদায় নিয়ে চলে আসতে বললেন। এখানে সালাম অর্থ ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলা নয়, বরং এটা এক প্রকার বাক্যপদ্ধতি। কারো সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হলে বলা হয়। আমরাও বাংলা ভাষায় ব্যবহার করে থাকি। যেমন কারো সাথে তর্কবিতর্কের ক্ষেত্রে সঠিক দলীল-প্রমাণ তুলে ধরলেও যদি মেনে না নেয় তাহলে সুন্দর করে বিদায় দিয়ে বলি, ভাই! ‘সালাম’। অর্থাৎ আপনি আপনার মত নিয়ে থাকেন, আমি চললাম।
সুতরাং দীনের দিকে দাওয়াত দিলে কেউ সে দাওয়াতে সাড়া না দিলে মন খারাপ হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহ তা‘আলা যাকে ইচ্ছা হিদায়াত দান করেন, যাকে ইচ্ছা গোমরাহ করেন। বান্দার কাজ তার জ্ঞানানুপাতে দাওয়াতী কাজ করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহ তা‘আলারই নিকট রয়েছে। অন্য কারো নিকট এ ব্যাপারে কোনই জ্ঞান নেই।
২. আল্লাহ তা‘আলার কোন স্ত্রী-সন্তান নেই, তিনি এক অদ্বিতীয়, তাঁর সকতুল্য কেউ নেই।
৩. যারা সত্য গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে তাদের থেকে সদ্ভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে আসতে হবে, তাদের দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলার ওপর।
৪. আল্লাহ তা‘আলা যাকে অনুমতি দেবেন সে ব্যতীত অন্য কেউ তাঁর সম্মুখে কোন কথা-বার্তা বলতে পারবে না ও শাফায়াতও করতে পারবে না।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: ৮১-৮৯ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ হে মুহাম্মাদ (সঃ)! তুমি ঘোষণা করে দাও- যদি এটা মেনে নেয়া হয় যে, আল্লাহর সন্তান রয়েছে তবে আমার মাথা নোয়াতে চিন্তা কি? না আমি তার কোন আদেশ অমান্য করি এবং না তার হুকুম হতে বিমুখ হই। যদি এরূপই হতো তবে আমি তো সর্বপ্রথম এটা স্বীকার করে নিতাম। কিন্তু মহান আল্লাহর সত্তা এরূপ নয় যে, কেউ তার সমান ও সমকক্ষ হতে পারে। এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, শর্তরূপে যে বাক্য আনয়ন করা হয় তা পূর্ণ হয়ে যাওয়া জরুরী নয়। এমন কি ওর সম্ভাবনাও জরুরী নয়। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করার ইচ্ছা করলে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে যাকে ইচ্ছা মনোনীত করতে পারতেন। পবিত্র ও মহান তিনি। তিনি আল্লাহ, এক, প্রবল পরাক্রমশালী।”(৩৯:৪)।
কোন কোন তাফসীরকার (আরবী)-এর অর্থ ‘অস্বীকারকারী’ও করেছেন। যেমন হযরত সুফিয়ান সাওরী (রঃ) তাঁদের মধ্যে একজন। সহীহ বুখারী শরীফে রয়েছে যে, এখানে (আরবী)-এর অর্থ হচ্ছে (আরবী) অর্থাৎ অস্বীকারকারীদের অগ্রণী। আর এটা (আরবী) হবে, এবং যেটা ইবাদতের অর্থে হবে সেটা (আরবী) হবে। এর প্রমাণ হিসেবে এই ঘটনাটি রয়েছে যে, একটি মহিলা বিবাহের ছয় মাস পরেই সন্তান প্রসব করে। তখন হযরত উসমান (রাঃ) মহিলাটিকে রজম করার বা প্রস্তরাঘাতে হত্যা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু হযরত আলী (রাঃ) প্রতিবাদ করে বলেন যে, আল্লাহ তা'আলার কিতাবে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “সন্তানের গর্ভধারণ ও দুধ ছাড়ানোর সময়কাল হচ্ছে ত্রিশ মাস।”(৪৬:১৫) আর অন্য জায়গায় রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “তার (সন্তানের) দুই বছরে দুধ ছাড়ানো হয়। বর্ণনাকারী বলেন যে, হযরত আলী (রাঃ) যখন এই দলীল পেশ করলেন, (আরবী) অর্থাৎ “তখন হযরত উসমান (রাঃ) এটা অস্বীকার করতে পারলেন না। সুতরাং তিনি মহিলাটিকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন। এখানেও (আরবী) শব্দ রয়েছে। কিন্তু এই উক্তির ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে। কেননা, শর্তের জবাবে এ অর্থ ঠিকভাবে বসে না। এটা মেনে নিলে অর্থ দাঁড়াবে ? যদি রহমানের (আল্লাহর) সন্তান থাকে তবে আমিই হলাম প্রথম অস্বীকারকারী। কিন্তু এই কালামে কোন সৌন্দর্য থাকছে না। হ্যা, তবে শুধু এটুকু বলা যেতে পারে যে, এখানে (আরবী) শব্দটি শর্তের জন্যে নয়, বরং নাফী বা নেতিবাচক হিসেবে এসেছে। যেমন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। তখন বাক্যটির অর্থ হবেঃ রহমান বা দয়াময় আল্লাহর কোন সন্তান নেই এবং আমিই তার প্রথম সাক্ষী।' হযরত কাতাদা (রঃ) বলেন যে, এটা হলো এমন কালাম যা আরবদের পরিভাষায় রয়েছে। অর্থাৎ না আল্লাহর সন্তান আছে এবং না আমি তার উক্তিকারী। আবু সাখর (রঃ) বলেন যে, উক্তিটির ভাবার্থ হচ্ছেঃ ‘আমি তো প্রথম হতেই তাঁর ইবাদতকারী এবং এটা ঘোষণাকারী যে, তাঁর কোন সন্তান নেই এবং আমি তার তাওহীদকে স্বীকার করে নেয়ার ব্যাপারেও অগ্রণী। মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, এর অর্থ হচ্ছেঃ ‘আমিই তাঁর প্রথম ইবাদতকারী এবং একত্ববাদী, আর তোমাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্নকারী। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেন, এর অর্থ হলোঃ ‘আমিই প্রথম অস্বীকারকারী। অভিধানে এ দুটিই রয়েছে, অর্থাৎ (আরবী), তবে প্রথমটিই নিকটতর। কেননা, এটা শর্ত ও জাযা হয়েছে। কিন্তু এটা অসম্ভব।
সুদ্দী (রঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হলোঃ যদি তাঁর সন্তান হতো তবে আমিই সর্বপ্রথম তা স্বীকার করে নিতাম। কিন্তু তা হতে তিনি পবিত্র ও মুক্ত। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এ উক্তিটিই পছন্দ করেছেন এবং যারা (আরবী) শব্দটিকে (আরবী) বা নেতিবাচক বলেছেন তিনি তাঁদের এ উক্তি খণ্ডন করেছেন। আর এজন্যে আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ তারা যা আরোপ করে তা হতে পবিত্র ও মহান, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর অধিপতি এবং আরশের অধিকারী। তিনি তো এক, অভাবমুক্ত। তাঁর কোন নীর, সমকক্ষ ও সন্তান নেই।
মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! তাদেরকে যে দিবসের কথা বলা হয়েছে তার সম্মুখীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তাদেরকে তুমি বাক-বিতণ্ডা ও ক্রীড়া-কৌতুক করতে দাও। তারা এসব খেল-তামাশা ও ক্রীড়া-কৌতুকে লিপ্ত থাকবে এমতাবস্থায়ই তাদের উপর কিয়ামত এসে পড়বে। ঐ সময় তারা তাদের পরিণাম জানতে পারবে।
এরপর মহান আল্লাহর মাহাত্ম্য, শ্রেষ্ঠত্ব ও বুযুর্গীর আরো বর্ণনা দেয়া হচ্ছে যে, যমীন ও আসমানের সমস্ত মাখলুক তার ইবাদতে লিপ্ত রয়েছে এবং সবাই তাঁর সামনে অপারগ ও শক্তিহীন। তিনিই প্রজ্ঞাময় ও সর্বজ্ঞ। যেমন আল্লাহ তা'আলা অন্য জায়গায় বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তিনিই আল্লাহ আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে, তিনি তোমাদের গোপনীয় ও প্রকাশ্য বিষয় জানেন এবং তোমরা যা উপার্জন কর সেটাও তিনি জানেন।”(৬:৩) কত মহান তিনি যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এগুলোর মধ্যস্থিত সবকিছুর সার্বভৌম অধিপতি! তিনি সর্বপ্রকারের দোষ হতে পবিত্র ও মুক্ত। তিনি সবারই অধিকর্তা। তিনি সর্বোচ্চ, সমুন্নত ও মহান। এমন কেউ নেই যে তার কোন হুকুম টলাতে পারে। কেউ এমন নেই যে তাঁর মজীর পরিবর্তন ঘটাতে পারে। সবকিছুই তার অধিকারভুক্ত। সবকিছুই তার ক্ষমতাধীন। কিয়ামতের জ্ঞান শুধু তারই আছে। তিনি ছাড়া কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার সঠিক সময়ের জ্ঞান কারো নেই। তাঁর নিকট সবাই প্রত্যাবর্তিত হবে। প্রত্যেককেই তিনি তার কৃতকর্মের প্রতিফল প্রদান করবেন।
অতঃপর আল্লাহ পাক বলেনঃ আল্লাহর পরিবর্তে তারা যাদেরকে ডাকে, সুপারিশের ক্ষমতা তাদের নেই। অর্থাৎ কাফিররা তাদের যেসব বাতিল মাবুদকে তাদের সুপারিশকারী মনে করে রেখেছে, তাদের কেউই সুপারিশের জন্যে সামনে এগিয়ে যেতে পারে না। কারো সুপারিশে তাদের কোন উপকার হবে না। এরপরে ইসতিসনা মুনকাতা রয়েছে অর্থাৎ তবে তারা ব্যতীত যারা সত্য উপলব্ধি করে ওর সাক্ষ্য দেয়। আর তারা নিজেরাও অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন। আল্লাহ তা'আলা সৎ লোকদেরকে তাদের জন্যে সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন এবং সেই সুপারিশ তিনি কবুল করবেন।
এরপর মহান আল্লাহ বলেনঃ “হে নবী (সঃ)! তুমি যদি এই কাফিরদেরকে জিজ্ঞেস কর যে, কে তাদেরকে সৃষ্টি করেছে? তবে তারা জবাবে অবশ্যই বলবেঃ আল্লাহ। তবুও তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে?' অর্থাৎ এটা বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, তারা আল্লাহ তা'আলাকে এককভাবে সৃষ্টিকর্তা মেনে নেয়ার পরেও অন্যদেরও তারা উপাসনা করছে যারা সম্পূর্ণরূপে শক্তিহীন! তারা একটুও চিন্তা করে দেখে না যে, সৃষ্টি যখন একজনই করেছেন তখন অন্যদের ইবাদত করা যায় কি করে? তাদের অজ্ঞতা ও নির্বুদ্ধিতা এতো বেশী বেড়ে গেছে যে, এই সহজ সরল কথাটি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্তও তারা বুঝতে পারে না। আর বুঝালেও তারা বুঝে না। তাই তো মহান আল্লাহ বিস্ময় প্রকাশ পূর্বক বলেনঃ ‘তবুও তারা কোথায় ফিরে যাচ্ছে!
ইরশাদ হচ্ছেঃ মুহাম্মাদ (সঃ) নিজের এ বক্তব্য বললেন অর্থাৎ স্বীয় প্রতিপালকের নিকট স্বীয় কওমের অবিশ্বাসকরণের অভিযোগ করলেন এবং বললেন যে, তারা ঈমান আনবে না। যেমন অন্য আয়াতে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “রাসূল বললো- হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয়ই আমার কওম এই কুরআনকে পরিত্যাগ করেছে।”(২৫:৩০) ইমাম ইবনে জারীরও (রাঃ) এই তাফসীরই করেছেন। ইমাম বুখারী (রঃ) বলেন যে, ইবনে মাসউদ (রঃ)-এর কিরআত (আরবী) (৪৩:৮৮) এই রূপ রয়েছে। হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবী (সঃ)-এর উক্তির উদ্ধৃতি দিয়েছেন। হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ “এটা তোমাদের নবী (সঃ)-এর উক্তি, তিনি স্বীয় প্রতিপালকের সামনে স্বীয় কওমের অভিযোগ করেন।” ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) (আরবী)-এর দ্বিতীয় কিরআত (আরবী)-এর উপর যবর দিয়েও বর্ণনা করেছেন। আর তিনি এর দু'টি তালিকা বর্ণনা করেছেন। একটি এই যে, এটা (আরবী)-এর উপর হয়েছে। দ্বিতীয় এই যে, এখানে। ক্রিয়া পদটি উহ্য মেনে নেয়া হবে। আর যখন (আরবী)-এর নীচে (আরবী) দিয়ে পড়া হবে তখন এটা (আরবী)-এর উপর (আরবী) হবে। তখন অর্থ হবেঃ কিয়ামতের জ্ঞান এবং এই উক্তির জ্ঞান তাঁরই রয়েছে।
সূরার শেষে ইরশাদ হচ্ছেঃ “(হে নবী সঃ)! সুতরাং তুমি তাদেরকে উপেক্ষা কর এবং বলঃ সালাম; শীঘ্রই তারা জানতে পারবে।' অর্থাৎ নবী (সঃ) যেন এ কাফিরদের মন্দ কথার জবাব মন্দ কথা দ্বারা না দেন, বরং তাদের মন জয়ের জন্যে কথায় ও কাজে উভয় ক্ষেত্রেই যেন নম্রতা ও কোমলতা অবলম্বন করেন এবং 'সালাম' (শান্তি) একথা বলেন। সত্বরই তারা প্রকৃত অবস্থা জানতে পারবে। এর দ্বারা মহান আল্লাহর পক্ষ হতে মুশরিকদেরকে কঠিনভাবে ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। আর এটা হয়েও গেল যে, তাদের উপর এমন শাস্তি আপতিত হলো যা টলবার নয়। আল্লাহ তা'আলা স্বীয় দ্বীনকে সমুন্নত করলেন এবং স্বীয় কালেমাকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিলেন। তিনি তার মুমিন ও মুসলিম বান্দাদেরকে শক্তিশালী করলেন। অতঃপর তাদেরকে জিহাদ ও নির্বাসনের হুকুম দিয়ে দুনিয়ায় এমনভাবে জয়যুক্ত করলেন যে, আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে অসংখ্য লোক প্রবেশ করলো এবং প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে ইসলাম ছড়িয়ে পড়লো। সুতরাং প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য। আর তিনিই সর্বাপেক্ষা ভাল জ্ঞান রাখেন।
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।