সূরা আশ-শূরা (আয়াত: 14)
হরকত ছাড়া:
وما تفرقوا إلا من بعد ما جاءهم العلم بغيا بينهم ولولا كلمة سبقت من ربك إلى أجل مسمى لقضي بينهم وإن الذين أورثوا الكتاب من بعدهم لفي شك منه مريب ﴿١٤﴾
হরকত সহ:
وَ مَا تَفَرَّقُوْۤا اِلَّا مِنْۢ بَعْدِ مَا جَآءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْیًۢا بَیْنَهُمْ ؕ وَ لَوْ لَا کَلِمَۃٌ سَبَقَتْ مِنْ رَّبِّکَ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی لَّقُضِیَ بَیْنَهُمْ ؕ وَ اِنَّ الَّذِیْنَ اُوْرِثُوا الْکِتٰبَ مِنْۢ بَعْدِهِمْ لَفِیْ شَکٍّ مِّنْهُ مُرِیْبٍ ﴿۱۴﴾
উচ্চারণ: ওয়ামা-তাফাররাকূইল্লা-মিম বা‘দি মা-জাআহুমুল ‘ইলমুবাগইয়াম বাইনাহুম ওয়া লাওলা-কালিমাতুন ছাবাকাত মির রাব্বিকা ইলাআজালিম মুছাম্মাল লাকুদিয়া বাইনাহুম ওয়া ইন্নাল্লাযীনা ঊরিছুল কিতা-বা মিম বা‘দিহিম লাফী শাক্কিম মিনহু মুরীব।
আল বায়ান: আর তাদের কাছে জ্ঞান আসার পরও তারা কেবল নিজদের মধ্যকার বিদ্বেষের কারণে মতভেদ করেছে; একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত অবকাশ সম্পর্কে তোমার রবের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকলে তাদের বিষয়ে ফয়সালা হয়ে যেত। আর তাদের পরে যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছিল, তারা সে সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ১৪. আর তাদের কাছে জ্ঞান আসার পর শুধুমাত্র পারস্পারিক বিদ্বেষবশত(১) তারা নিজেদের মধ্যে মতভেদ ঘটায়। আর এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অবকাশ সম্পর্কে আপনার রবের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকলে তাদের বিষয় ফয়সালা হয়ে যেত। আর তাদের পর নিশ্চয় তারা সে সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে।
তাইসীরুল ক্বুরআন: মানুষের কাছে ইলম আসার পর (বিভিন্ন অংশে) বিভক্ত হয়ে গেল নিজেদের মধ্যে বাড়াবাড়ি করার কারণে। পূর্বেই যদি তোমার প্রতিপালকের পক্ষ হতে একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ফয়সালা মূলতবী রাখার কথা ঘোষিত না হত, তাহলে তাদের মধ্যে (পূর্বেই) ফয়সালা করে দেয়া হত। আগেকার লোকেদের পরে যারা (তাওরাত ও ইঞ্জিল এ দু’) কিতাব উত্তরাধিকার সূত্রে পাপ্ত হয়েছে, তারা অস্বস্তিকর সন্দেহে পতিত হয়েছে।
আহসানুল বায়ান: (১৪) ওদের নিকট জ্ঞান আসার পরই পারস্পরিক বিদ্বেষবশতঃ ওরা নিজেদের মধ্যে মতভেদ ঘটায়।[1] এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অব্যাহতি সম্পর্কে তোমার প্রতিপালকের পূর্ব ঘোষণা না থাকলে ওদের বিষয়ে ফায়সালা হয়েই যেত।[2] ওদের পর যারা গ্রন্থের উত্তরাধিকারী হয়েছে, নিশ্চয় তারা এ (কুরআন) সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে। [3]
মুজিবুর রহমান: তাদের নিকট জ্ঞান আসার পর শুধুমাত্র পারস্পরিক বিদ্বেষ বশতঃ তারা নিজেদের মধ্যে মতভেদ ঘটায়। এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অবকাশ সম্পর্কে তোমার রবের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকলে তাদের বিষয়ে ফাইসালা হয়ে যেত। তাদের পর যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়েছে তারা কুরআন সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে।
ফযলুর রহমান: তাদের কাছে জ্ঞান আসার পরই তারা পারস্পরিক জিদবশত বিভেদ সৃষ্টি করেছে। যদি তোমার প্রভুর পক্ষ থেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকত তাহলে বিষয়টি তাদের মধ্যে (আগেই) ফয়সালা হয়ে যেত। তাদের পরে যারা কিতাবের উত্তরাধিকার লাভ করেছে তারা সে সম্পর্কে এক বিভ্রান্তিকর সন্দেহের মধ্যে রয়েছে।
মুহিউদ্দিন খান: তাদের কাছে জ্ঞান আসার পরই তারা পারস্পরিক বিভেদের কারণে মতভেদ করেছে। যদি আপনার পালনকর্তার পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকত, তবে তাদের ফয়সালা হয়ে যেত। তাদের পর যারা কিতাব প্রাপ্ত হয়েছে, তারা অস্বস্তিকর সন্দেহে পতিত রয়েছে।
জহুরুল হক: আর তারা নিজেদের কাছে জ্ঞান আসার পরেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত না যদি-না নিজেদের মধ্যে ঈর্ষা-বিদ্বেষ থাকত। আর যদি তোমার প্রভুর কাছ থেকে একটি নির্ধারিত কাল পর্যন্ত একটি বাণী ইতিপূর্বে ধার্য হয়ে না থাকত তাহলে নিশ্চয়ই তাদের মধ্যে হেস্তনেস্ত হয়ে যেত। আর তাঁদের পরে যারা ধর্মগ্রন্থ উত্তরাধিকার করেছিল তারা তো এটি সন্বন্ধে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে।
Sahih International: And they did not become divided until after knowledge had come to them - out of jealous animosity between themselves. And if not for a word that preceded from your Lord [postponing the penalty] until a specified time, it would have been concluded between them. And indeed, those who were granted inheritance of the Scripture after them are, concerning it, in disquieting doubt.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ১৪. আর তাদের কাছে জ্ঞান আসার পর শুধুমাত্র পারস্পারিক বিদ্বেষবশত(১) তারা নিজেদের মধ্যে মতভেদ ঘটায়। আর এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অবকাশ সম্পর্কে আপনার রবের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকলে তাদের বিষয় ফয়সালা হয়ে যেত। আর তাদের পর নিশ্চয় তারা সে সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে।
তাফসীর:
(১) এই মতভেদ সৃষ্টির চালিকা শক্তি ছিল নিজের নাম ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চিন্তা, পারস্পরিক জিদ ও একগুয়েমি, একে অপরকে পরাস্ত করার প্রচেষ্টা এবং সম্পদ ও মর্যাদা অর্জন প্রচেষ্টার ফল। [কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: (১৪) ওদের নিকট জ্ঞান আসার পরই পারস্পরিক বিদ্বেষবশতঃ ওরা নিজেদের মধ্যে মতভেদ ঘটায়।[1] এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অব্যাহতি সম্পর্কে তোমার প্রতিপালকের পূর্ব ঘোষণা না থাকলে ওদের বিষয়ে ফায়সালা হয়েই যেত।[2] ওদের পর যারা গ্রন্থের উত্তরাধিকারী হয়েছে, নিশ্চয় তারা এ (কুরআন) সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে। [3]
তাফসীর:
[1] অর্থাৎ, জ্ঞান অর্থাৎ হিদায়াত আসার এবং হুজ্জত কায়েম হওয়ার পর তারা মতবিরোধ ও অনৈক্যের পথ অবলম্বন করেছে। অথচ তখন মতবিরোধ করার কোনই বৈধতা অবশিষ্ট থাকে না। কিন্তু কেবল বিদ্বেষ, শত্রুতা এবং জিদ ও হিংসাবশতঃ তারা এ কাজ করেছে। এ থেকে কেউ কেউ ইয়াহুদী এবং কেউ কেউ মক্কার কুরাইশদেরকে বুঝিয়েছেন।
[2] অর্থাৎ, তাদের শাস্তি দানের ব্যাপারে বিলম্ব করার ফায়সালা যদি পূর্বে থেকেই হয়ে না থাকত, তবে সত্বর আযাব প্রেরণ করে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হত।
[3] এ থেকে ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদেরকে বুঝানো হয়েছে, যাদেরকে তাদের পূর্বেকার ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের পর তাওরাত ও ইঞ্জীলের উত্তরাধিকারী বানানো হয়। অথবা আরবদেরকে বুঝানো হয়েছে; যাদের মাঝে আল্লাহ কুরআন অবতীর্ণ করেন এবং তাদেরকে কুরআনের উত্তরাধিকারী বানান। প্রথম অর্থের দিক দিয়ে, الكتاب (গ্রন্থ) বলতে, তাওরাত ও ইঞ্জীল এবং দ্বিতীয় অর্থের দিক দিয়ে তা হবে, কুরআন।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: ১৩-১৪ নম্বর আয়াতের তাফসীর :
পূর্বের আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা বাহ্যিক ও দৈহিক নেয়ামত উল্লেখ করার পর এখানে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ একটি নেয়ামতের কথা উল্লেখ করছেন তা হল : যে আল্লাহ তা‘আলা আকাশ-জমিনের সবকিছুর মালিক সে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য এমন এক দীন শরীয়ত হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন যা সব ধর্মের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র। সে দীন হল ইসলাম, এ শ্রেষ্ঠ দীন দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার বুকে শ্রেষ্ঠ মানুষদের প্রেরণ করেছেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন হলেন ‘উলূল আযম’ রাসূল। যথা : নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা ও আমাদের নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। পৃথিবীর সূচনা লগ্ন থেকে শেষ নাবী মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পর্যন্ত যত নাবী-রাসূল পৃথিবীতে এসেছেন সকলের ধর্মের মূলনীতি ছিল একটি, তা হলো এক আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদত করতে হবে, যিনি ব্যতীত আর কোন সত্য মা‘বূদ নেই।
প্রশ্ন হতে পারে, সর্বপ্রথম নাবী আদম (আঃ)-এর কথা উল্লেখ না করে নূহ (আঃ) দ্বারা শুরু করা হল কেন? অথচ তিনি প্রথম নাবী! উত্তর : আদম (আঃ)-এর যুগে কোন কুফর ও শির্ক ছিল না; কারণ তিনি দীন নিয়েই পৃথিবীতে আসেন এবং তা পালন করেন। সর্বপ্রথম ধর্মের নামে সুধারণা নিয়ে শির্কের প্রর্বতন করা হয় নূহ (আঃ)-এর যুগে। তাই তাঁকে দিয়ে দীনের দাওয়াত শুরু করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّيْنَ مِيْثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُّوْحٍ وَّإِبْرَاهِيْمَ وَمُوْسٰي وَعِيْسَي ابْنِ مَرْيَمَ ص وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِّيْثَاقًا غَلِيْظًلا)
“আর স্মরণ কর! যখন আমি শপথ গ্রহণ করেছিলাম নাবীদের কাছ থেকে এবং তোমার কাছ থেকে, নূহ, ইবরাহীম ও ঈসা ইবনু মারইয়ামের কাছ থেকে আর তাদের থেকে গ্রহণ করেছিলাম অতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি।” (সূরা আহ্যাব ৩৩ : ৭)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَمَآ أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَّسُوْلٍ إِلَّا نُوْحِيْٓ إِلَيْهِ أَنَّه۫ لَآ إِلٰهَ إِلَّآ أَنَا فَاعْبُدُوْنِ)
“আমি তোমার পূর্বে যখন কোন রাসূল প্রেরণ করেছি তার প্রতি এ ওয়াহী করেছি যে, ‘আমি ব্যতীত অন্য কোন সত্যিকার মা‘বূদ নেই; সুতরাং আমারই ‘ইবাদত কর।’ (সূরা আম্বিয়া- ২১ : ২৫)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : আমরা রাসূলগণ বৈমাত্রেয় ভাই। (পিতা একই মাতা ভিন্ন) কিন্তু আমাদের সকলের ধর্ম এক ও অভিন্ন।
(أَنْ أَقِيْمُوا الدِّيْنَ)
অর্থাৎ সকল নাবীদের প্রতি এ মর্মে ওয়াহী করেছেন যে, তোমরা দীন তথা আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান, রাসূলদের আনুগত্য ও তাওহীদের সাথে সকল ইবাদত সম্পাদন কর। এটাই সকল নাবীদের দীন, যদিও নিয়ম-পদ্ধতিতে কিছু পার্থক্য ছিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَّمِنْهَاجًا)
“আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছি একটি নির্দিষ্ট শারীয়ত ও একটি নির্দিষ্ট পথ।” ( সূরা মায়িদা ৫ : ৪৮)
(وَلَا تَتَفَرَّقُوْا فِيْهِ)
অর্থাৎ ধর্মের ভেতর দলাদলি ও মতানৈক্য সৃষ্টি করিও না। এ আয়াতে ধর্ম প্রতিষ্ঠিত রাখা ফরয ও বিভেদ সৃষ্টি করা হারাম বলা হয়েছে। ধর্ম বলে ইসলামকে বুঝানো হয়েছে যা সকল নাবীদের ধর্ম। সুতরাং ধর্মের ওপর ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে, বিভিন্ন দল ও মতে বিভক্ত হয়ে ফেরকা তৈরি করা যাবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(إِنَّ الَّذِيْنَ فَرَّقُوْا دِيْنَهُمْ وَكَانُوْا شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِيْ شَيْءٍ إِنَّمَآ أَمْرُهُمْ إِلَي اللّٰهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوْا يَفْعَلُوْنَ)
“নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দীনকে (বিভিন্ন মতে) খণ্ড বিখণ্ড করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের কোন দায়িত্ব তোমার নয়; তাদের বিষয় আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন।” (সূরা আনআম ৬ : ১৫৯)
জামা‘আতী জিন্দেগীর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :
জামা‘আতবদ্ধ হয়ে জীবন-যাপন করা প্রতিটি মুসলিম ব্যক্তির ওপর আবশ্যক, দলে দলে বিভক্ত হওয়া হারাম। মুসলিমদেরকে জামা‘আতবদ্ধ হয়ে বসবাস করার প্রতি ইসলাম যে গুরুত্ব দিয়েছে তা বর্ণনাতীত। পবিত্র কুরআনে সূরা আলি ইমরানের ১০৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
(وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللّٰهِ جَمِيْعًا وَّلَا تَفَرَّقُوْا)
“আর তোমরা সকলে মিলে আল্লাহর রশিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন : এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের নির্দেশ করেছেন এবং দল-উপদলে বিভক্ত হতে নিষেধ করা হয়েছে। (ইবনু কাসীর) ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন : নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলা সম্প্রীতির আদেশ করেন এবং দল-উপদলে বিভক্তি হতে নিষেধ করেন। কেননা, দলাদলিতেই ধ্বংস, আর জামা‘আতবদ্ধ জীবন-যাপনেই নাজাত। (কুরতুবী)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের তিনটি বিষয়ে সন্তুষ্ট, আর তিনটি বিষয়ে অসন্তুষ্ট হন। তিনি তোমাদের জন্য সন্তুষ্ট হন যে, তোমরা তাঁরই ইবাদত করবে, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না। আর তোমরা আল্লাহ তা‘আলার রজ্জুকে সৃদৃঢ় ও সম্মিলিতভাবে ধারণ করবে, দলে দলে বিভক্ত হবে না। আর তোমাদের জন্য অপছন্দ করেন- মানুষের কথা নিয়ে টানা-হেঁচড়া করা, অযথা বেশি বেশি প্রশ্ন করা এবং সম্পদ নষ্ট করা। (সহীহ মুসলিম হা. ১৭১৫)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ شِبْرًا فَقَدْ خَلَعَ رِبْقَةَ الْإِسْلَامِ مِنْ عُنُقِهِ
যে ব্যক্তি মুসলিমদের জামা‘আত থেকে অর্ধ-হাত পরিমাণও দূরে সরে গেল সে ইসলামের বন্ধন তার কাঁধ থেকে সরিয়ে নিল। (আবূ দাঊদ হা. ৪৭৫৮, সহীহ)
তিনি আরো বলেন :
يَدُ اللّٰهِ مَعَ الجَمَاعَةِ
জামা‘আতীদের সাথেই আল্লাহ তা‘আলার হাত। (তিরমিযী হা. ২১৬৬, সহীহ)
সুতরাং মুসলিমরা যতদিন জামা‘আতবদ্ধ হয়ে জীবন-যাপন করেছে ততদিন তারা পৃথিবী শাসন করেছে, কিন্তু যখনই তারা জামা‘আত ভঙ্গ করে দলাদলি সৃষ্টি করল তখনই তাদের ওপর নেমে আসল লাঞ্ছনা ও অপমান।
কোন ভেড়ার পাল থেকে একটি ভেড়া আলাদা হয়ে গেলে যেমন নেকড়ে সহজেই তাকে আক্রমন করতে পারে ঠিক জামা‘আত থেকে আলাদা হয়ে গেলে অবস্থা তাই-ই হবে। ইসলামের মূল ভিত্তিই হল ঐক্য, একথাটি বুঝতে পেরেছিল ইংরেজরা, তারা বুঝতে পেরেছিল সাত সাগর তের নদী পাড়ি দিয়ে ভারতবর্ষ শাসন করা সম্ভব নয়। তাই তারা নীতি গ্রহণ করল মুসলিমরা এক থাকলে তাদের ওপর শাসন কায়েম করা যাবে না, সুতরাং এদেরকে শাসন করতে হলে প্রয়োজন (ডিভাইডেড এন্ড রোল) অর্থাৎ ‘বিভাজন কর এবং শাসন কর’ নীতি। আজও আমরা সে বিভাজনে পড়ে রইলাম। সুতরাং মুসলিমদের উচিত হবে তাদের সে পুরোনো গৌরবগাঁথা ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সকলে এক হয়ে ইসলামের জন্য কাজ করা।
আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয় :
১. সকল নাবীদের দীনের মূলনীতি ছিল একই- এক আল্লাহ তা‘আলার ‘ইবাদত করতে হবে এবং দলবদ্ধভাবে জীবন-যাপন করতে হবে, পৃথক হওয়া যাবে না।
২. সত্যের দা‘ওয়াত মুশরিকদের নিকট বড়ই রাগের একটি বিষয়।
৩. মানুষের ব্যাপারে পূর্ব থেকেই সিদ্ধান্ত করে রাখা হয়েছে।
৪. সকল মুসলিমকে জামা‘আত বদ্ধ হয়ে আমীরের নেতৃত্বে জীবন-যাপন করা আবশ্যক।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: ১৩-১৪ নং আয়াতের তাফসীর:
আল্লাহ তা'আলা এই উম্মতের উপর যে নিয়ামত দান করেছেন, এখানে মহান আল্লাহ তারই বর্ণনা দিচ্ছেন। মহান আল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ তোমাদের জন্যে যে দ্বীন ও শরীয়ত নির্ধারণ করেছেন তা ওটাই যা হযরত আদম (আঃ)-এর পরে দুনিয়ার সর্বপ্রথম রাসূল হযরত নূহ (আঃ) এবং সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর মধ্যবর্তী স্থির প্রতিজ্ঞ নবীদের (আঃ) ছিল। এখানে যে পাঁচজন নবী (আঃ)-এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদেরই নাম উল্লেখ করা হয়েছে সূরায়ে আহযাবেও। সেখানে রয়েছেঃ (আরবী) অর্থাৎ “স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের নিকট হতে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম এবং তোমার নিকট হতেও এবং নূহ (আঃ), ইবরাহীম (আঃ), মূসা (আঃ) মরিয়ম তনয় ঈসা (আঃ)-এর নিকট হতে, তাদের নিকট হতে গ্রহণ করেছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার।”(৩৩:৭) ঐ দ্বীন, যা সমস্ত নবীর মধ্যে মিলিতভাবে ছিল তা হলো এক আল্লাহর ইবাদত। যেমন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমার পূর্বে আমি যতজন রাসূল পাঠিয়েছিলাম তাদের সবারই কাছে এই অহী করেছিলামঃ আমি ছাড়া কোন মা'বুদ নেই, সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর।`(২১:২৫) হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আমরা নবীরা পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাই-এর মত। আমাদের সবারই একই দ্বীন।” যেমন বৈমাত্রেয় ভাইদের পিতা একজনই। মোটকথা, শরীয়তের আহকামে যদিও আংশিক পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু মৌলিক নীতি হিসেবে দ্বীন একই। আর তা হলো মহামহিমান্বিত আল্লাহর একত্ববাদ। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “তোমাদের প্রত্যেকের জন্যে আমি শরীয়ত ও পথ করে দিয়েছি।”(৫:৪৮)।
এখানে এই অহীর ব্যাখ্যা এভাবে দেয়া হয়েছেঃ “তোমরা দ্বীনকে কায়েম রেখো, দলবদ্ধ হয়ে একত্রিতভাবে বাস কর এবং মতানৈক্য সৃষ্টি করে পৃথক পৃথক হয়ে যেয়ো না। তাওহীদের এই ডাক মুশরিকদের নিকট অপছন্দনীয়। সত্য কথা এই যে, হিদায়াত আল্লাহর হাতে। যে হিদায়াত লাভের যোগ্য হয় সে তার প্রতিপালকের দিকে ফিরে যায় এবং মহান আল্লাহ তার হাত ধরে তাকে হিদায়াতের পথে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়ে দেন। পক্ষান্তরে যে নিজেই মন্দ পথ অবলম্বন করে এবং সঠিক ও সরল পথকে ছেড়ে দেয়, আল্লাহও তখন তার মাথায় পথভ্রষ্টতা লিখে দেন। যখন তার কাছে সত্য এসে যায়, হুজ্জত কায়েম হয়ে যায়, তখন পারস্পরিক হঠকারিতার ভিত্তিতে পরস্পরের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়।
মহান আল্লাহ বলেনঃ হে নবী (সঃ)! যদি এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত অবকাশ সম্পর্কে তোমার প্রতিপালকের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থাকতো তবে তাদের বিষয়ে এখনই ফায়সালা হয়ে যেতো এবং তাদের উপর এই দুনিয়াতেই শাস্তি আপতিত হতো।
এরপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ তাদের পর যারা কিতাবের উত্তরাধিকারী। হয়েছে তারা কুরআন সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর সন্দেহে রয়েছে। তারা তাদের পূর্ববর্তীদের অন্ধ অনুসারী। দলীল প্রমাণাদির ভিত্তিতে তাদের ঈমান নেই। বরং তারা অন্ধভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের অনুসরণ করছে যারা সত্যের প্রতি অবিশ্বাসী ছিল।
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।