সূরা আলে-ইমরান (আয়াত: 145)
হরকত ছাড়া:
وما كان لنفس أن تموت إلا بإذن الله كتابا مؤجلا ومن يرد ثواب الدنيا نؤته منها ومن يرد ثواب الآخرة نؤته منها وسنجزي الشاكرين ﴿١٤٥﴾
হরকত সহ:
وَ مَا کَانَ لِنَفْسٍ اَنْ تَمُوْتَ اِلَّا بِاِذْنِ اللّٰهِ کِتٰبًا مُّؤَجَّلًا ؕ وَ مَنْ یُّرِدْ ثَوَابَ الدُّنْیَا نُؤْتِهٖ مِنْهَا ۚ وَ مَنْ یُّرِدْ ثَوَابَ الْاٰخِرَۃِ نُؤْتِهٖ مِنْهَا ؕ وَ سَنَجْزِی الشّٰکِرِیْنَ ﴿۱۴۵﴾
উচ্চারণ: ওয়ামা-কা-না লিনাফছিন আন তামূতা ইল্লা-বিইযনিল্লা-হি কিতা-বাম মুআজ্জালাওঁ ওয়া মাইঁ ইউরিদ ছাওয়া-বাদ্দুনইয়া-নু’তিহী মিনহা- ওয়া মাইঁ ইউরিদ ছাওয়া-বাল আখিরাতি নু’তিহী মিনহা-ওয়া ছানাজযিশশা-কিরীন।
আল বায়ান: আর কোন প্রাণী আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মারা যায় না, তা নির্দিষ্টভাবে লিখিত আছে। আর যে দুনিয়ার প্রতিদান চায়, আমি তা থেকে তাকে দিয়ে দেই, আর যে আখিরাতের বিনিময় চায়, আমি তা থেকে তাকেও দেই এবং আমি অচিরেই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান দেব।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ১৪৫. আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো মৃত্যু হতে পারে না, যেহেতু সেটার মেয়াদ সুনির্ধারিত(১)। কেউ পার্থিব পুরস্কার চাইলে আমরা তাকে তার কিছু দিয়ে থাকি(২) এবং কেউ আখেরাতের পুরস্কার চাইলে আমরা তাকে তার কিছু দিয়ে থাকি এবং শীঘ্রই আমরা কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবো।
তাইসীরুল ক্বুরআন: কোন জীবই আল্লাহর অনুমতি ছাড়া মরতে পারে না, তার মেয়াদ নির্ধারিত। যে ব্যক্তি পার্থিব ফল চায়, আমি তাত্থেকে তাকে দেই, আর যে ব্যক্তি আখেরাতের ফল চায়, আমি তাকে তাত্থেকে দেই এবং কৃতজ্ঞদেরকে আমি শীঘ্রই বিনিময় প্রদান করব।
আহসানুল বায়ান: (১৪৫) আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো মৃত্যু হবে না। কেননা, তার (মৃত্যুর) অবধারিত মিয়াদ লিখিত আছে। আর যে কেউ পার্থিব পুরস্কার চাইবে, আমি তাকে তা হতে (কিছু) প্রদান করব এবং যে কেউ পারলৌকিক পুরস্কার চাইবে, আমি তাকে তা হতে প্রদান করব। [1] আর শীঘ্রই আমি কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করব।
মুজিবুর রহমান: আর আল্লাহর আদেশে লিপিবদ্ধ নির্দিষ্ট সময় ব্যতীত কেহই মৃত্যুমুখে পতিত হয়না; এবং যে কেহ ইহলোকের প্রতিদান কামনা করে, আমি তাকে তা দুনিয়ায় প্রদান করে থাকি; পক্ষান্তরে যে লোক আখিরাতে বিনিময় কামনা করে আমি তাকে তা প্রদান করব এবং আমি কৃতজ্ঞগণকে অচিরেই পুরস্কার প্রদান করব।
ফযলুর রহমান: আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ মরতে পারে না; (মৃত্যু হয়) নির্ধারিত সময়ে। যে দুনিয়ার পুরস্কার চায় আমি তাকে দুনিয়ার জিনিস দেব এবং যে আখেরাতের পুরস্কার চায় আমি তাকে আখেরাতের শান্তি দেব। আর শিগগিরই আমি কৃতজ্ঞদের পুরস্কার দেব।
মুহিউদ্দিন খান: আর আল্লাহর হুকুম ছাড়া কেউ মরতে পারে না-সেজন্য একটা সময় নির্ধারিত রয়েছে। বস্তুতঃ যে লোক দুনিয়ায় বিনিময় কামনা করবে, আমি তাকে তা দুনিয়াতেই দান করব। পক্ষান্তরে-যে লোক আখেরাতে বিনিময় কামনা করবে, তা থেকে আমি তাকে তাই দেবো। আর যারা কৃতজ্ঞ তাদেরকে আমি প্রতিদান দেবো
জহুরুল হক: আর কোনো লোকের পক্ষে তার মরে যাওয়া চলে না আল্লাহ্র অনুমতি ব্যতীত, লিপিবদ্ধ থাকা নির্ধারিত সময় অনুসারে। আর যে কেউ ইহজীবনের পুরস্কার কামনা করে আমরা তাকে তা’ থেকে আদায় করি, আর যে কেউ চায় পরলোকের পুরস্কার আমরা তাকেও তা থেকে প্রদান করি। আর আমরা অচিরেই পুরস্কৃত করবো কৃতজ্ঞদের।
Sahih International: And it is not [possible] for one to die except by permission of Allah at a decree determined. And whoever desires the reward of this world - We will give him thereof; and whoever desires the reward of the Hereafter - We will give him thereof. And we will reward the grateful.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ১৪৫. আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো মৃত্যু হতে পারে না, যেহেতু সেটার মেয়াদ সুনির্ধারিত(১)। কেউ পার্থিব পুরস্কার চাইলে আমরা তাকে তার কিছু দিয়ে থাকি(২) এবং কেউ আখেরাতের পুরস্কার চাইলে আমরা তাকে তার কিছু দিয়ে থাকি এবং শীঘ্রই আমরা কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করবো।
তাফসীর:
(১) এ আয়াতেও বিপদাপদের সময় অটল থাকার শিক্ষা দিয়ে বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষের মৃত্যুর সময় আল্লাহ্ তা'আলার কাছে লিপিবদ্ধ রয়েছে। মৃত্যুর দিন, তারিখ, সময় সবই নির্ধারিত, নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে কারো মৃত্যু হবে না এবং নির্দিষ্ট সময়ের পরও কেউ জীবিত থাকবে না। এমতাবস্থায় কারো মৃত্যুতে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ার কোন অর্থ নেই।
(২) এ আয়াত থেকে এটা বুঝার সুযোগ নেই যে, দুনিয়া চাইলেই তাকে তা দেয়া হবে। কারণ, অন্য আয়াতে এটা শর্তসাপেক্ষে দেয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সে শর্ত হচ্ছে, সেটা দেয়ার জন্য আল্লাহর ইচ্ছা থাকতে হবে। যেমন বলা হয়েছে, “কেউ আশু সুখ-সম্ভোগ কামনা করলে আমি যাকে যা ইচ্ছে এখানেই সত্বর দিয়ে থাকি। [সূরা আল-ইসরা: ১৮]
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: (১৪৫) আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো মৃত্যু হবে না। কেননা, তার (মৃত্যুর) অবধারিত মিয়াদ লিখিত আছে। আর যে কেউ পার্থিব পুরস্কার চাইবে, আমি তাকে তা হতে (কিছু) প্রদান করব এবং যে কেউ পারলৌকিক পুরস্কার চাইবে, আমি তাকে তা হতে প্রদান করব। [1] আর শীঘ্রই আমি কৃতজ্ঞদেরকে পুরস্কৃত করব।
তাফসীর:
[1] দুর্বল ও ভীতু লোকদের উৎসাহ বাড়ানোর জন্য বলা হচ্ছে যে, মৃত্যু তো তার নির্দিষ্ট সময়ে আসবেই। অতএব পালিয়ে যাওয়ার ও ভীরুতা দেখানোর লাভ কি? অনুরূপ কেবল দুনিয়া চাইলে তা হয়ত পাওয়া যাবে, কিন্তু আখেরাতে কিছুই পাওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে যারা আখেরাত কামনা করে, তারা তো আখেরাতের নিয়ামত পাবেই, সেই সাথে তাদেরকে মহান আল্লাহ দুনিয়াও দান করেন। আরো বেশী উৎসাহিত করার এবং সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য পরের আয়াতে পূর্বের নবীগণ এবং তাদের অনুসারীদের ধৈর্য ধরার এবং সুদৃঢ় থাকার দৃষ্টান্ত পেশ করা হচ্ছে।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: ১৪৪-১৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:
শানে নুযূল:
সাহাবী উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, উহুদের দিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি পাহাড়ের ওপর উঠে শুনতে পেলাম একজন ইয়াহূদী বলছে, মুহাম্মাদ মারা গেছে। আমি বললাম, যে ব্যক্তিকে বলতে শুনব মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারা গেছে তার গর্দান উড়িয়ে দেব। হঠাৎ তাকিয়ে দেখতে পেলাম রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীরা পশ্চাদ্ধাবন করছে। তখন নাযিল হয়
(وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُوْلٌ... )।
(লুবাবুন নুকূল ফী আসবাবে নুযূল, পৃঃ ৬৯)
ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, (রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)) এর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে আবূ বাকর (রাঃ) বের হয়ে আসলেন, তখন উমার (রাঃ) লোকজনের সাথে কথা বলছিলেন। আবূ বাকর (রাঃ) তাঁকে বললেন, হে উমার (রাঃ) বসে পড়। উমার (রাঃ) বসতে অস্বীকার করলেন। তখন সাহাবীগণ উমার (রাঃ)-কে ছেড়ে আবূ বাকর (রাঃ)-এর দিকে গেলেন। তখন আবূ বাকর (রাঃ) আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করে বললেন, অতঃপর তোমাদের মধ্যে যারা মুহাম্মাদের ইবাদত করে (তারা জেনে রাখুক), মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারা গেছেন। আর যারা আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে (তারা জেনে রাখুক) আল্লাহ তা‘আলা চিরঞ্জীব কখনো মৃত্যুবরণ করেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا مُحَمَّدٌ إِلَّا رَسُوْلٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ)
“এবং মুহাম্মাদ রাসূল ব্যতীত কিছুই নয়, বস্তুত তার পূর্বে অনেক রাসূল বিগত হয়েছে।” ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলার শপথ আবূ বাকর (রাঃ)-এর এ আয়াত পাঠ করার আগে লোকেরা যেন জানত না যে, এরূপ আয়াত আল্লাহ তা‘আলা নাযিল করেছেন। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৫৩, ৪৪৫২)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর মৃত্যুবরণের ব্যাপারে উমার (রাঃ) প্রাথমিকভাবে ভিন্ন মত পোষণ করলেও আবূ বাকর (রাঃ)-এর বক্তব্যের পর উমার (রাঃ)-সহ সকল সাহাবী ঐকমত্য পোষণ করেন যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আর বেঁচে নেই, তিনি মারা গেছেন। কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে এটাই সঠিক মত।
(وَمَا كَانَ لِنَفْسٍ)
প্রত্যেক আত্মাই তার সঠিক সময়ে ইন্তেকাল করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَا يُعَمَّرُ مِنْ مُّعَمَّرٍ وَّلَا يُنْقَصُ مِنْ عُمُرِه۪ٓ إِلَّا فِيْ كِتٰبٍ)
“কোন দীর্ঘায়ুর আয়ু দীর্ঘ করা হয় না আর না তার আয়ু কমানো হয়, কিন্তু তা লিপিবদ্ধ রয়েছে এক কিতাবে (লাওহে মাহফুযে)।” (সূরা ফাতির ৩৫:১১)
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(إِذَا جَا۬ءَ أَجَلُهُمْ فَلَا يَسْتَأْخِرُوْنَ سَاعَةً وَّلَا يَسْتَقْدِمُوْنَ)
“যখন তাদের সময় আসবে তখন তারা মুহূর্তকালও আগপিছ করতে পারবে না।” (সূরা ইউনুস ১০:৪৯)
(وَمَنْ يُّرِدْ ثَوَابَ الدُّنْيَا)
এ সম্পর্কে সূরা হূদের ১৬ নং আয়াতে আলোচনা আসবে ইনশা-আল্লাহ।
(وَكَأَيِّنْ مِّنْ نَّبِيٍّ قٰتَلَ)
অর্থাৎ কত নাবী ও তাঁর সহচর জিহাদ করে মারা গেছেন এতদসত্ত্বেও তারা পিছপা হয়নি এবং মনোবল হারায়নি। তারা নিজেদের অপরাধের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হয়েছে, যুদ্ধের ময়দানে অটল থাকার প্রার্থনা করেছে। অতএব মুুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মারা গেলে তোমরা কি দীন ছেড়ে মুরতাদ হয়ে যাবে?
মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একজন নাবী মাত্র। আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে প্রেরণ করেছেন দীনের দাওয়াত প্রদান করার জন্য। তাঁর দাওয়াতী মিশন শেষ হলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে মৃত্যু দেবেন। তাই বলে তাঁর মৃত্যু বরণ করার কারণে আমরা দীন থেকে সরে যাব না; বরং তিনি যে দীন রেখে গেছেন তদনুযায়ী আমরা চলব।
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. আল্লাহ তা‘আলা শরীয়তের বিধি-বিধান দ্বারা বান্দাদের পরীক্ষা করেন।
২. মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদমসন্তান মাটির তৈরি, নূরের তৈরি নন, তিনি হায়াতুন্নাবীও নন বরং তিনি মারা গেছেন। তাকে কবরস্থ করা হয়েছে, তিনি কবরে জীবনে রয়েছেন।
৩. নেতা মারা গেলে সত্য সঠিক পথ বর্জন করা উচিত নয়।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: ১৪৪-১৪৮ নং আয়াতের তাফসীর:
উহুদ প্রান্তরে মুসলমানগণ পরাজিতও হয়েছিলেন এবং তাদের কিছু সংখ্যক লোক শহীদও হয়েছিলেন। সেদিন শয়তান এও প্রচার করেছিল যে, মুহাম্মাদও (সঃ) শহীদ হয়েছেন। আর এদিকে ইবনে কামিআ' নামক একজন কাফির মুশরিকদের মধ্যে প্রচার করে-‘আমি মুহাম্মাদ (সঃ)-কে হত্যা করে আসছি। প্রকৃতপক্ষে শয়তানের কথা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও গুজব এবং ঐ উক্তিও মিথ্যা ছিল। সে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে আক্রমণ করেছিল বটে কিন্তু তাতে শুধুমাত্র তাঁর চেহারা মুবারক কিছুটা আহত হয়েছিল, তাছাড়া আর কিছুই নয়। এ মিথ্যা সংবাদে মুসলমানদের মন ভেঙ্গে যায়, তাঁদের পা টলে যায় এবং তারা হতবুদ্ধি হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পলায়নে উদ্যত হন। তখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয়। এতে বলা হয় যে, পূর্বের নবীদের মত মুহাম্মাদ (সঃ) একজন নবী। হতে পারে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হবেন কিন্তু আল্লাহ পাকের দ্বীন দুনিয়া হতে বিদায় গ্রহণ করবে না। একটি বর্ণনায় রয়েছে, একজন মুহাজির একজন আনসারীকে উহুদের যুদ্ধে দেখেন যে, তিনি আহত হয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছেন এবং রক্ত ও মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছেন। তিনি উক্ত আনসারী (রাঃ)-কে বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) যে শহীদ হয়েছেন তা কি আপনি জানেন? তিনি উত্তরে বলেনঃ 'যদি এ সংবাদ সত্য হয় তবে তিনি তার কাজ করে গেছেন। এখন আপনারা সবাই তাঁর ধর্মের উপর নিজেদের জীবন কুরবান করুন। ঐ সমন্ধেই এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
অতঃপর আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর শাহাদাত বা মৃত্যু এমন কিছু নয় যে, তোমরা আল্লাহ পাকের ধর্ম হতে পশ্চাদপদে ফিরে যাবে এবং যে এভাবে ফিরে যাবে সে মহান আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারেব না। আল্লাহ তা'আলা ঐ লোকদেরকেই উত্তম প্রতিদান প্রদান করবেন যারা তার আনুগত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং তাঁর ধর্মের সাহায্যের কার্যে লেগে পড়ে ও তাঁর রাসূল (সঃ)-এর অনুসরণে সুদৃঢ় থাকে-রাসূলুল্লাহ (সঃ) জীবিত থাকুন আর নাই থাকুন। সহীহ বুখারী শরীফে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর ইন্তেকালের সংবাদ শুনে হযরত আবু বকর (রাঃ) ঘোড়ায় চড়ে আগমন করেন এবং মসজিদের মধ্যে প্রবেশ করতঃ জনগণের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। অতঃপর কোন কিছু জিজ্ঞাসাবাদ না করে হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরে প্রবেশ করেন। এখানে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-কে হিবরার চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল। তিনি পবিত্র মুখমণ্ডল হতে চাদর সরিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চুম্বন দান করেন এবং কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলেনঃ “আমার পিতা-মাতা তার প্রতি উৎসর্গ হোক। আল্লাহ তাআলার শপথ! তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর দু’বার মৃত্যু দিতে পারেন না। যে মৃত্যু তাঁর জন্যে নির্ধারিত ছিল তার উপর এসে গেছে।' এরপর তিনি পুনরায় মসজিদে আগমন করেন এবং দেখেন যে, হযরত উমার (রাঃ) ভাষণ দিচ্ছেন। তিনি তাঁকে বলেনঃ ‘নীরবতা অলম্বন করুন। তাকে নীরব করে দিয়ে তিনি জনগণকে সম্বোধন করে বলেনঃ “যে ব্যক্তি হযরত মুহাম্মাদ (সঃ)-এর উপাসনা করতা সে যেন জেনে নেয় যে, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যে আল্লাহ তা'আলার ইবাদত করতে সে যেন সন্তুষ্ট থাকে যে, আল্লাহ পাক জীবিত আছেন। মৃত্যু তার উপর পতিত হয় না।' অতঃপর তিনি উপরোক্ত আয়াতটি পাঠ করেন। জনগণের অনুভূতি এই হয় যে, আয়াতটি যেন তখনই অবতীর্ণ হলো। তখন তো প্রত্যেকের মুখেই আয়াতটি উচ্চারিত হলো এবং তাদের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিল যে, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) আর এ জগতে নেই। হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর মুখে এ আয়াতটির পাঠ শ্রবণ করে হযরত উমার (রাঃ)-এর চরণযুগল যেন ভেঙ্গে পড়লো। তারও পূর্ণ বিশ্বাস হলো যে, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এ নশ্বর জগত হতে বিদায় গ্রহণ করেছেন। হযরত আলী (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর জীবদ্দশাতেই বলতেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) মৃত্যুবরণ করলে বা শহীদ হলে আমরা ধর্মত্যাগী হবো না। আল্লাহর শপথ! যদি রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিহত হন তবুও আমরা তাঁর ধর্মের উপরেই আমরণ প্রতিষ্ঠিত থাকবো। আল্লাহর কসম! আমি তো তাঁর বন্ধু ও চাচাতো ভাই এবং তার উত্তরাধিকারী, তার আমার চেয়ে বড় হকদার আর কে হবে’?
অতঃপর আল্লাহ পাক বলেনঃ “প্রত্যেক ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক তার উপর নির্ধারিত সময় পূর্ণ করার পরেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে থাকে। যেমন অন্য জায়গায় রয়েছে- কারও বয়স বৃদ্ধি করা হয় না বা কারও বয়স হ্রাস করা হয় না, বরং সব কিছুই আল্লাহর কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে। অন্য স্থানে রয়েছে-তিনিই আল্লাহ যিনি তোমাদেরকে মৃত্তিকা দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তিনি সময় পূর্ণ করেছেন এবং মৃত্যু নির্ধারিত করেছেন। উপরোক্ত আয়াতে কাপুরুষ লোকদেরকে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্যে উৎসাহ দেয়া হয়েছে যে, বীরত্ব প্রকাশের কারণে বয়স হ্রাস পায় না, আর কাপুরুষতা প্রদর্শন করতঃ জিহাদ হতে সৱে থাকার ফলে বয়স বৃদ্ধি প্রাপ্তও হয় না। মৃত্যু তো নির্ধারিত সময়ে আসবে, মানুষ হয় বীরত্বের সাথে জিহাদে যোগদান করুক বা ভীরুতা প্রদর্শন করে জিহাদ হতে সরেই থাকুক। হযরত হাজার ইবনে উদ্দী (রাঃ) ধর্মীয় শত্রুদের সম্মুখীন হতে গিয়ে টাইগ্রীস নদীর তীরে উপস্থিত হন। সেনাবাহিনী হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে যান। সে সময় তিনি উপরোক্ত আয়াতটি পাঠ করে বলেনঃ নির্ধারিত সময়ের পূর্বে কেউই মারা যায় না। এসো, এ টাইগ্রীস নদীতেই ঘোড়া নিক্ষেপ কর।' একথা বলেই তিনি টাইগ্রীস নদীর মধ্যে ঘোড়া নিক্ষেপ করেন। তার দেখাদেখি অন্যেরাও নিজ নিজ ঘোড়া নদীতে নামিয়ে দেন। এ দৃশ্য দেখে ভয়ে শত্রুদের রক্ত শুকিয়ে যায় এবং তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। তারা পরস্পর বলাবলি করে- এরা তো পাগল। এরা সমুদ্রের তরঙ্গকেও ভয় করে না। কাজেই চল আমরা পলায়ন করি। অতএব তারা সবাই পালিয়ে যায়।
এর পরে ইরশাদ হচ্ছে-‘যার কার্য শুধুমাত্র দুনিয়া লাভের উদ্দেশ্যেই সাধিত হয়ে থাকে সে তার ভাগ্যের নির্ধারিত অংশ পেয়ে যায় বটে, কিন্তু পরকালে সে একেবারে শূন্য হস্ত হয়ে যায়। আর পরকাল লাভের যার উদ্দেশ্য থাকে সে পরকাল তো পায়ই, এমনকি দুনিয়াতেও সে তার ভাগ্যের নির্ধারিত অংশ প্রাপ্ত হয়ে থাকে। যেমন অন্য স্থানে রয়েছে-‘পরকালের ক্ষেত্র যাাকারীকে আমি আরও বেশী দিয়ে থাকি। আর ইহকালের ক্ষেত্র যাঞ্চাকারীকে আমি তা প্রদান করি বটে, কিন্তু পরকালে তার জন্যে কোনই অংশ নেই। আর এক জায়গায় রয়েছে-‘যে ব্যক্তি শুধুমাত্র দুনিয়াই চায়, আমি তাদের মধ্যে যাকে চাই এবং যে পরিমাণ চাই দুনিয়া প্রদান করি; অতঃপর সে জাহান্নামী হয়ে যায় এবং লাঞ্ছনা ও অপমানের সঙ্গে তথায় গমন করে; আর যে পরকাল চায় এবং ঈমানদার হয়, তাদের চেষ্টা আল্লাহ তাআলার নিকট প্রশংসনীয় হবে। এজন্যেই এখানেও আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “আমি কৃতজ্ঞদেরকে উত্তম প্রতিদান দিয়ে থাকি।' এরপর আল্লাহ তা'আলা উহুদ যুদ্ধের মুজাহিদগণকে সম্বোধন করে বলেনইতিপূর্বেও বহু নবী তাদের দলবল নিয়ে ধর্মদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন এবং তোমাদের মতই তাদেরকেও বহু বিপদাপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, কিন্তু তথাপি তাঁরা দৃঢ়চিত্ত, ধৈর্যশীল এবং কৃতজ্ঞই রয়েছিলেন। তাঁরা অলস ও দুর্বল হননি এবং ঐ ধৈর্যের বিনিময়ে তারা আল্লাহ পাকের ভালবাসা ক্রয় করে নিয়েছিলেন। একটি অর্থ এও বর্ণনা করা হয়েছে, “হে উহুদের যোদ্ধাগণ! মুহাম্মাদ (সঃ) শহীদ হয়েছেন, এ সংবাদ শুনে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলছ কেন? অথচ তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের নবীগণের (আঃ) শাহাদাত। লক্ষ্য করেও সাহস হারাও হয়নি বা পিছনে সরেও যায়নি, বরং তারা আরও বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে। এত বড় বিপদেও তাদের পা টলমলিয়ে যায়নি এবং তারা দুঃখের ভারে ভেঙ্গেও পড়েনি। অতএব রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর শাহাদাতের সংবাদ শুনে তোমাদের এত মুষড়ে পড়া মোটেই উচিত হয়নি।' (আরবী) শব্দটির বহু অর্থ এসেছে-যেমন জ্ঞানবান, সৎ ধর্মভীরু, সাধক, নির্দেশ পালনকারী ইত্যাদি। কুরআন কারীম সেই বিপদের সময় তাদের প্রার্থনা নকল করেছেন। এরপর আল্লাহ পাক বলেছেন যে, তাদেরকে পার্থিব পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে এবং এর সাথে সাথে তাদের জন্যে পারলৌকিক পুরস্কারও বিদ্যমান রয়েছে, আর পরকালের পুরস্কার দুনিয়ার পুরস্কার অপেক্ষা বহুগুণে শ্রেয়। এ সৎ কর্মশীল লোকেরা আল্লাহ তা'আলার প্রিয় বান্দা।
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।