সূরা আল-বাকারা (আয়াত: 7)
হরকত ছাড়া:
ختم الله على قلوبهم وعلى سمعهم وعلى أبصارهم غشاوة ولهم عذاب عظيم ﴿٧﴾
হরকত সহ:
خَتَمَ اللّٰهُ عَلٰی قُلُوْبِهِمْ وَ عَلٰی سَمْعِهِمْ ؕ وَ عَلٰۤی اَبْصَارِهِمْ غِشَاوَۃٌ ۫ وَّ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِیْمٌ ﴿۷﴾
উচ্চারণ: খাতামাল্লা-হু ‘আলা- কুলূবিহিম ওয়া ‘আলা-ছাম‘ইহিম ওয়া‘আলা আবসা-রিহিম গিশা-ওয়াতুও ওয়ালাহুম ‘আযা-বুন ‘আজীম।
আল বায়ান: আল্লাহ তাদের অন্তরে এবং তাদের কানে মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের চোখসমূহে রয়েছে পর্দা। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাআযাব।
আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ৭. আল্লাহ তাদের হৃদয়সমূহ ও তাদের শ্রবনশক্তির উপর মোহর করে দিয়েছেন (১), এবং তাদের দৃষ্টির উপর রয়েছে আবরণ। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।
তাইসীরুল ক্বুরআন: আল্লাহ তাদের অন্তর ও কানের উপর মোহর করে দিয়েছেন, আর তাদের চোখে আছে আবরণ আর তাদের জন্য আছে মহা শাস্তি।
আহসানুল বায়ান: ৭। আল্লাহ তাদের হৃদয় ও কানে মোহর মেরে দিয়েছেন, তাদের চোখের উপর আবরণ রয়েছে এবং তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।
মুজিবুর রহমান: আল্লাহ তাদের অন্তরসমূহের উপর ও তাদের কর্ণসমূহের উপর মোহরাংকিত করে দিয়েছেন এবং তাদের চক্ষুসমূহের উপর আবরণ পড়ে আছে এবং তাদের জন্য রয়েছে ভয়ানক শাস্তি।
ফযলুর রহমান: আল্লাহ তাদের অন্তর ও কান সীল করে দিয়েছেন এবং তাদের চোখের ওপর একপ্রকার আবরণ পড়েছে। ওদের জন্য বড়রকম শাস্তি নির্ধারিত আছে।
মুহিউদ্দিন খান: আল্লাহ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানসমূহ বন্ধ করে দিয়েছেন, আর তাদের চোখসমূহ পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।
জহুরুল হক: আল্লাহ্ তাদের হৃদয়ে সীল মেরে দিয়েছেন, এবং তাদের কানেও, আর তাদের চোখের উপরে পর্দা। আর তাদের জন্য আছে কঠোর শাস্তি।
Sahih International: Allah has set a seal upon their hearts and upon their hearing, and over their vision is a veil. And for them is a great punishment.
তাফসীরে যাকারিয়া
অনুবাদ: ৭. আল্লাহ তাদের হৃদয়সমূহ ও তাদের শ্রবনশক্তির উপর মোহর করে দিয়েছেন (১), এবং তাদের দৃষ্টির উপর রয়েছে আবরণ। আর তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি।
তাফসীর:
১. এ আয়াতে ‘সীলমোহর’ বা আবরণ শব্দের দ্বারা এরূপ সংশয় সৃষ্ট হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, যখন আল্লাহ্ই তাদের অন্তরে সীলমোহর এঁটে দিয়েছেন এবং গ্রহণ-ক্ষমতাকে রহিত করেছেন, তখন তারা কুফরী করতে বাধ্য। কাজেই তাদের শাস্তি হবে কেন? এর জবাব হচ্ছে যে, তারা নিজেরাই অহংকার ও বিরুদ্ধাচরণ করে নিজেদের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে, তাই এজন্য তারাই দায়ী। যেহেতু বান্দাদের সকল কাজের সৃষ্টি আল্লাহ্ই করেছেন, তিনি এস্থলে সীলমোহরের কথা বলে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা নিজেরাই যখন সত্য গ্রহণের ক্ষমতাকে রহিত করতে উদ্যত হয়েছে, তখন আমি আমার কর্ম-পদ্ধতি অনুযায়ী তাদের এ খারাপ যোগ্যতার পরিবেশ তাদের অন্তরে সৃষ্টি করে দিয়েছি। কোন কোন মুফাসসির বলেন, এখানে সীলমোহর মারার অর্থ হচ্ছে, যখন তারা উপরের বর্ণিত মৌলিক বিষয়গুলো প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং নিজেদের জন্য কুরআনের উপস্থাপিত পথের পরিবর্তে অন্য পথ বেছে নিয়েছিল, তখন আল্লাহ তাদের হৃদয়ে ও কানে সীলমোহর মেরে দিয়েছিলেন।
এতে বুঝা যাচ্ছে যে, তাদের কর্ম-কাণ্ডই তাদের হৃদয়সমূহকে সীলমোহর মারার উপযুক্ত করে দিয়েছে। আর এ অর্থই কুরআনের অন্য এক আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে, যথাঃ “কখনো নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের হৃদয়ে জঙ ধরিয়েছে”। [সূরা আল-মুতাফফিফীনঃ ১৪] তাতে বোঝানো হয়েছে যে, তাদের মন্দকাজ ও অহংকারই তাদের অন্তরে মরিচা আকার ধারণ করেছে। ইমাম তাবারী বলেন, গোনাহ যখন কোন মনের উপর অনবরত আঘাত করতে থাকে তখন সেটা মনকে বন্ধ করে দেয়। আর যখন সেটা বন্ধ হয়ে যায় তখন সেটার উপর সীলমোহর ও টিকেট এঁটে দেয়া হয়। ফলে তাতে আর ঈমান ঢোকার কোন পথ পায় না। যেমনিভাবে কুফরী থেকে মুক্তিরও কোন সুযোগ থাকে না। আর এটাই হচ্ছে এ আয়াতে বর্ণিত خَتَمَ আর অন্য আয়াতে বর্ণিত طَبَعَ। [ত্বাবারী]
হাদীসে এসেছে, মানুষ যখন কোন একটি গোনাহর কাজ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। সাদা কাপড়ে হঠাৎ কালো দাগ পড়ার পর যেমন তা খারাপ লাগে, তেমনি প্রথম অবস্থায় অন্তরে পাপের দাগও অস্বস্তির সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় যদি সে ব্যক্তি তাওবা না করে, আরও পাপ করতে থাকে, তবে পর পর দাগ পড়তে পড়তে অন্তঃকরণ দাগে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এমতবস্থায় তার অন্তর থেকে ভাল-মন্দের পার্থক্য সম্পর্কিত অনুভূতি পর্যন্ত লুপ্ত হয়ে যায়। [তিরমিযি: ৩৩৩৪, ইবনে মাজাহঃ ৪২৪৪]
অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ফেতনা মনের ওপর বেড়াজালের কাজ করে। ফলে তা অন্তরকে ধাপে ধাপে বিন্দু বিন্দু কালো আস্তরে আবৃত করে দেয়। যে অন্তর ফেতনার প্রভাব অস্বীকার করে, তা অন্তরকে শুভ্র সমুজ্জ্বল করে দেয়। ফলে কোন দিনই ফেতনা তার ক্ষতি করতে পারে না। ও গ্রহণের সম্পূর্ণ অযোগ্য হয়ে পড়ে। [মুসলিম: ২৩১]
কাতাদাহ (রহঃ) বলেন, তাদের উপর শয়তান ভর করেছে ফলে তারা তার অনুসরণ থেকে পিছপা হয় না। আর একারণেই আল্লাহ তাদের অন্তর, শ্রবণেন্দ্রিয় ও চোখের উপর পর্দা এঁটে দিয়েছেন। সুতরাং তারা হেদায়াত দেখবে না, শুনবে না, বুঝবে না এবং উপলব্ধি করতে পারবে না। [ইবনে কাসীর] যে ব্যক্তি কখনো দাওয়াতী কাজ করেছেন, তিনি অবশ্যই এ সীলমোহর লাগার অবস্থার ব্যাপারে বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকবেন। আপনার উপস্থাপিত পথ যাচাই করার পর কোন ব্যক্তি একবার যখন তাকে প্রত্যাখ্যান করে তখন উল্টোপথে তার মনমানস এমনভাবে দৌড়াতে থাকে যার ফলে আপনার কোন কথা তার আর বোধগম্য হয় না। আপনার দাওয়াতের জন্য তার কান হয়ে যায় বধির। আপনার কার্যপদ্ধতির গুণাবলী দেখার ব্যাপারে তার চোখ হয়ে যায় অন্ধ তখন সুস্পষ্টভাবে অনুভূত হয় যে, সত্যিই তার হৃদয়ের দুয়ারে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান
অনুবাদ: ৭। আল্লাহ তাদের হৃদয় ও কানে মোহর মেরে দিয়েছেন, তাদের চোখের উপর আবরণ রয়েছে এবং তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।
তাফসীর:
এখানে তাদের ঈমান না আনার কারণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু অব্যাহতভাবে কুফরী ও পাপের কাজ সম্পাদন করার কারণে তাদের অন্তঃকরণ থেকে সত্য গ্রহণ করার যোগ্যতা শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাদের কান হক কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না এবং তাদের দৃষ্টি সারা বিশ্বের ছড়িয়ে থাকা মহান প্রতিপালকের নিদর্শনাবলী দেখা থেকে বঞ্চিত ছিল, তাই এখন তারা ঈমান কিভাবে আনতে পারে? ঈমান তো তাদেরই ভাগ্যে জোটে, যারা আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত যোগ্যতাকে সঠিকরূপে ব্যবহার করে এবং তার দ্বারা স্রষ্টার পরিচয় লাভ করে। এর বিপরীত লোকেরা তো সেই হাদীসের অর্থের আওতাভুক্ত, যাতে বলা হয়েছে যে, মু’মিন যখন কোন পাপ করে বসে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। তারপর যখন সে তাওবা ক’রে পাপ থেকে ফিরে আসে, তখন তার অন্তর আগের মত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। কিন্তু সে যদি তাওবা করার পরিবর্তে গুনাহের পর গুনাহ করতে থাকে, তাহলে সেই কালো দাগ ছড়িয়ে গিয়ে তার পুরো অন্তরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।’’ নবী করীম (সাঃ) বলেন, ‘‘এটাই হল সেই মরিচা যা মহান আল্লাহ ক্বুরআনে উল্লেখ করেছেন। {كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ} ‘‘কখনোও না, বরং তারা যা করে, তাই তাদের হৃদয়ে মরিচা ধরিয়ে দিয়েছে।’’ (তিরমিযী, তাফসীর সূরা মুত্বাফফিফীন ১৪ আয়াত) এই অবস্থাকেই ক্বুরআনে ‘খাতম’ (মোহর মারা) বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে; যা তাদের অব্যাহত মন্দ কাজসমূহের যুক্তিসংগত প্রতিফল।
তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ
তাফসীর: ৭ নং আয়াতের তাফসীর:
অর্থাৎ সত্য গ্রহণে কাফিরদের অন্তঃকরণ, শ্রবণশক্তি ও দর্শনশক্তি আচ্ছাদিত করে দেয়া হয়েছে। ফলে তারা সত্য অনুধাবন করতে পারে না, শুনতে পায় না এবং দেখতেও পায় না।
ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেন: এ ব্যাপারে উম্মাত ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, অন্তর মোহরাঙ্কিত করাও আল্লাহ তা‘আলা নিজের একটি বিশেষ গুণরূপে উল্লেখ করেছেন। মূলত কাফিরদের অন্তর ঈমান আনা থেকে মোহরাঙ্কিত হয়ে যায় তাদের কুফরীর প্রতিদানস্বরূপ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(بَلْ طَبَعَ اللّٰهُ عَلَيْهَا بِكُفْرِهِمْ)
“বরং তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহ তাদের হৃদয়সমূহে মোহর মেরে দিয়েছেন।”(সূরা নিসা ৪:১৫৫)
হাদীসেও এসেছে আল্লাহ তা‘আলা অন্তরের পরিবর্তনকারী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু‘আ করতেন:
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوْبِ ثَبِّتْ قَلْبِيْ عَلَي دِيْنِكَ
হে অন্তরের পরিবর্তন আনয়নকারী আমাদের অন্তরকে তোমার দীনের ওপর অটল রাখুন। (তিরমিযী হা: ২১৪০, ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান।)
সাহাবী হুযাইফা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, অন্তরে ফেতনা এমনভাবে উপস্থিত হয় যেমন একটি মাদুর। একটি একটি পাতা যুক্ত করে যেমন মাদুর তৈরি করা হয় ঠিক তেমনভাবে অন্তরে একটি একটি করে ফেতনা আসে। যে অন্তর তা গ্রহণ করে নেয় তাতে একটা কালোদাগ পড়ে যায়। সে অন্তরে কালো দাগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষে সবটাই কালো করে দেয়। তখন তা উল্টানো কলসের মত হয়ে যায়; ভাল কথাও তার ভাল লাগে না এবং মন্দ কথাও খারাপ লাগে না। (সহীহ মুসলিম হা: ১৪৪)
হাদীসে এসেছে- মু’মিন যখন পাপ কাজ করে তখন তার অন্তরে একটা কালো দাগ পড়ে যায়। যদি সে পাপ কাজ থেকে ফিরে আসে ও বিরত থাকে তবে দাগটি মুছে যায় এবং অন্তর পরিস্কার হয়ে যায়। আর যখন গুনাহ করতেই থাকে তখন সে কালো দাগ আরো ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত সমস্ত অন্তরকে ছেয়ে ফেলে। এটাই সে মরিচা যার বর্ণনা এ আয়াতে রয়েছে-
(كَلَّا بَلْ ﺒ رَانَ عَلٰي قُلُوْبِهِمْ مَا كَانُوْا يَكْسِبُوْنَ)
“কখনও নয়; বরং তাদের কৃতকর্মই তাদের মনের ওপর মরিচারূপে জমে গেছে।”(সূরা মুতাফফিফীন ৮৩:১৪)। (তিরমিযী হা: ৩৩৩৪, ইবনু মাযাহ হা: ৪২৪৪, ইমাম তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ।)
সুতরাং আমাদের উচিত সর্বদা সত্য গ্রহণে সচেষ্ট থাকা। আর বেশি বেশি আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করা:
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلٰي دِينِكَ
“হে অন্তরের পরিবর্তনকারী আমার অন্তরকে তোমার দীনের ওপর অটল রাখ”। (তিরমিযী হা: ২১৪০, সিলসিলা সহীহাহ হা: ২০৯১)
আয়াত থেকে শিক্ষণীয় বিষয়:
১. জান্নাত পেতে হলে আমাদেরকে মু’মিন-মুত্তাকীদের গুণাবলী অর্জন করতে হবে, শুধু মৌখিক দাবি করে বসে থাকলে হবে না।
২. হিদায়াত দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, আমাদের দায়িত্ব মানুষকে সঠিকভাবে দাওয়াত দেয়া এবং আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করা।
৩. মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হয় তার কর্মের কারণে। কাফিররা তাদের কর্মের কারণে ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
৪. আল্লাহ তা‘আলা অন্তরের মালিক, যেভাবে ইচ্ছা পরিবর্তন করেন। তাই আমাদের বেশি বেশি দু‘আ করা দরকার যেন তিনি আমাদের অন্তর দীনের ওপর অটল রাখেন।
তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)
তাফসীর: মুফাসসির হযরত সুদ্দী (রঃ) বলেছেন যে, (আরবি)-এর অর্থ মোহর করে দেয়া। হযরত কাতাদাহ (রঃ) বলেনঃ ‘অর্থাৎ শয়তান তাদের উপর বিপুলভাবে জয়লাভ করেছে এবং তারা তারই আজ্ঞাবহ দাসে পরিণত হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত তাদের অন্তরে ও কানে আল্লাহর মোহর লেগে গেছে এবং চোখের উপর পর্দা পড়ে গেছে। সুতরাং তারা হিদায়াতকে দেখতেও পাচ্ছে না, শুনতেও পাচ্ছে না। এবং তা বুঝতেও পারছে না!' হযরত মুজাহিদ (রঃ) বলেনঃ ‘পাপ মানুষের অন্তরে চড়ে বসে এবং তাকে চারদিক থেকে ঘিরে নেয়। এটাই হচ্ছে মোহর। অন্তর ও কানের জন্যে প্রচলিত অর্থে মোহর ব্যবহৃত হয়।' মুজাহিদ (রঃ) বলেনঃ “পবিত্র কুরআনে (আরবি) এবং (আরবি) এই তিন প্রকারের শব্দ এসেছে (আরবি) শব্দটি (আরবি) হতে কম এবং (আরবি) (আরবি) শব্দটি হতে কম (আরবি) সবচেয়ে বেশী।' মুজাহিদ (রঃ তাঁর হাতটি দেখিয়ে বললেনঃ ‘অন্তর হাতের তালুর মত। বান্দার পাপের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। বান্দা একটা পাপ করলে তখন তার কনিষ্ঠ অঙ্গুলিটি বন্ধ হয়ে গেল। দুটো পাপ করল তখন তার দ্বিতীয় অঙ্গুলিও বন্ধ হয়ে গেল। এভাবে সমস্ত অঙ্গুলি বন্ধ হয়ে গেল। এখন মুষ্টি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেল এবং ওর ভিতরে কোন জিনিস অনুপ্রবেশ করতে পারবে না। এভাবেই নিরন্তর পাপের ফলে অন্তরের উপর কালো পর্দা পড়ে যায় এবং মোহর লেগে যায়। তখন আর সত্য তার মধ্যে ক্রিয়াশীল হয় না। একে ও (আরবি) বলা হয়। ভাবার্থ হলো এই যে, তার অহমিকা, এবং সত্য হতে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার বর্ণনা দেয়া হচ্ছে। যেমন বলা হয় যে, অমুক ব্যক্তি এ কথা শুনা হতে বধির হয়ে গেছে। উদ্দেশ্য হয় এই যে, অহংকার করে সে এ কথার দিকে কান দেয়নি।
ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেছেন যে, এ অর্থ ঠিক হতে পারে না। কেননা, এখানে তো স্বয়ং আল্লাহ তা'আলা বলছেন যে, তিনি তাদের অন্তরে মোহর করে দিয়েছেন। যামাখশারী (রঃ) এ খণ্ডনের অনেক কিছু খণ্ডন করেছেন এবং পাঁচটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কিন্তু সবগুলোই নিরর্থক, বাজে এবং মু'তাযেলী হওয়ার ফলে তাকে কল্পনার আশ্রয়ে এগুলো বানিয়ে নিতে হয়েছে। কেননা তার কাছে এটা খুবই খারাপ কথা যে, মহান আল্লাহ কারও অন্তরে মোহর করে দেবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, তিনি অন্যান্য পরিষ্কার ও স্পষ্ট আয়াতগুলির উপর আদৌ কোন চিন্তা গবেষণা করেননি। পবিত্র কুরআনের এক জায়গায় আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ যখন তারা বক্রই রইলো তখন আল্লাহ তাদের অন্তরকে আরও বক্র করে দিলেন। তিনি আরও বলেছেনঃ “আমি তাদের অন্তর ও চক্ষুকে এমনভাবে ফিরিয়ে দেই, যেন তারা প্রথম থেকেই ঈমান আনেনি এবং তাদেরকে এমন অবস্থায় ছেড়ে দেই যে, তারা অবাধ্যতার মধ্যে উদ্ভ্রান্ত হয়ে ফিরতে থাকে। এ ধরনের আরও আয়াত রয়েছে যা স্পষ্টভাবে বলে দেয় যে, তাদের সত্যকে পরিত্যাগ ও মিথ্যাকে আঁকড়ে ধরে থাকার কারণে আল্লাহ তা'আলা তাদের অন্তরের উপর মোহর করে দিয়েছেন এবং তাদের অন্তর থেকে হিদায়াত বিদূরিত করেছেন। এটা একটা সরাসরি ও প্রত্যক্ষ সুবিচার আর সুবিচার ভাল বই কোন দিন মন্দ হয় না। যদি যামাখশারীও চিন্তাদৃষ্টি দ্বারা এ আয়াতগুলির প্রতি লক্ষ্য করতেন তবে তিনি ঐ ব্যাখ্যা দিতেন না। আল্লাহ তা'আলাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী জানেন।
ইমাম কুরতুবী (রঃ) বলেনঃ “উম্মতের ইজমা আছে যে, মহান আল্লাহ মোহর করাকেও নিজের একটি বিশেষ গুণ রূপে বর্ণনা করেছেন যে, মোহর কাফিরদের কুফরীর প্রতিদান স্বরূপ হয়ে থাকে। যেমন তিনি বলেছেনঃ বরং তাদের কুফরীর কারণে আল্লাহ তার উপর মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন। হাদীসেও আছে। যে, আল্লাহ তা'আলা অন্তরকে পরিবর্তন করে থাকেন। প্রার্থনায় আছেঃ “হে অন্তরের পরিবর্তন আনয়নকারী! আমাদের অন্তরকে আপনার ধর্মের উপর অটল রাখুন।' হযরত হুজাইফা (রাঃ) হতে ফিত্রার অধ্যায়ে, একটি সহীহ হাদীস বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘অন্তরের মধ্যে ফিত্না এমনভাবে উপস্থিত হয় যেমন ছেড়া মাদুরের একটা খড়কুটা। যে অন্তর তা গ্রহণ করে নেয় তাতে একটা কালো দাগ পড়ে যায় এবং যে অন্তরের মধ্যে এই ফিৎনা ক্রিয়াশীল হয় না তাতে একটা সাদা দাগ পড়ে যায়, আর সেই শুভ্রতা বাড়তে বাড়তে সম্পূর্ণ সাদা হয়ে গিয়ে সমস্ত অন্তরকে আলোকে উদ্ভাসিত করে দেয়। অতঃপর ফিৎনা এই অন্তরের কোন ক্ষতি করতে পারে না। পক্ষান্তরে, অন্য অন্তরে কৃষ্ণতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায় এবং শেষে সমস্ত অন্তরকে কালো মসিময় করে দেয়। তখন তা উল্টানো কলসের মত হয়ে যায়, ভাল কথাও তার ভাল লাগে না এবং মন্দ কথাও খারাপ লাগে না।
ইমাম ইবনে জারীরের (রঃ) ফায়সালা এই যে, হাদীসে এসেছেঃ মুমিন যখন পাপ করে তখন তার অন্তরে একটা কালো দাগ হয়ে যায়। যদি সে পাপ কার্য হতে ফিরে আসে ও বিরত হয়, তবে ঐ দাগটি আপনি সরে যায় এবং তার অন্তর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে যায়। আর যদি সে গুনাহ করতেই থাকে তবে সেই পাপও ছড়িয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত তার সমস্ত অন্তরকে ছেয়ে ফেলে। এটাই সেই মরিচা যার বর্ণনা এই আয়াতে রয়েছেঃ “নিশ্চয় তাদের খারাপ কাজের কারণে তাদের অন্তরে মরিচা পড়ে গেছে' (সুনান-ই-নাসাঈ, জামেউত তিরমিযী, তাফসীর-ই-ইবেন জারীর)। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটিকে হাসান সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাহলে জানা গেল যে, পাপের প্রাচুর্য অন্তরের উপর পর্দা ফেলে দেয় এবং এর পরে আল্লাহর মোহর হয়ে যায়। একেই বলে খাম এবং তবা'। এরূপ অন্তরের মধ্যে ঈমান প্রবেশ করার ও কুফর বের হওয়ার আর কোন পথ থাকে না। এই মোহরের বর্ণনাই এই আলোচ্য আয়াতে করা হয়েছে। আর এটা আমাদের চোখের দেখা যে, যখন। কোন জিনিসের মুখে মোহর লাগিয়ে দেয়া হয়, তখন যে পর্যন্ত মোহর ভেঙ্গে না যায় সে পর্যন্ত তার ভিতরে কিছু যেতেও পারে না এবং তা থেকে কিছু বেরও হতে পারে না। এ রকমই কাফিরদের অন্তরে ও কানে আল্লাহর মোহর লেগে গেছে, সেই মোহর না সরা পর্যন্ত তার ভিতরে হিদায়াত প্রবেশ করতে পারবে এবং তা থেকে কুফরও বেরিয়ে আসতে পারবে না। (আরবি)-এর উপর পূর্ণ বিরতি আছে এবং (আরবি) পৃথক পৃথক বাক্য (আরবি) ও (আরবি) অন্তর ও কানের উপর হয় এবং (আরবি) অর্থাৎ পর্দা চোখের উপর পড়ে। যেমন এটা হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ গণ্যমান্য সাহাবা-ই-কিরাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে। পবিত্র কুরআনে আছেঃ (৪২:২৪) (আরবি)
অন্য স্থানে আছেঃ (৪৫:২৩) (আরবি) এই আয়াতগুলোতে অন্তরের ও কানের উপর (আরবি)-এর উল্লেখ আছে এবং চোখের উপর আছে পর্দার উল্লেখ। তাহলে সম্ভবতঃ তাদের নিকট (আরবি) ক্রিয়াপদ উহ্য আছে এবং (আরবি)-এর অনুসরণে (আরবি) শব্দটিকে (আরবি) হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। কুরআন কারীমের আয়াত (আরবি)-এর মধ্যেও তাই এসেছে। প্রসঙ্গক্রমে আরব কবির একটি কবিতা নিম্নরূপঃ (আরবি) এখানে (আরবি) উহ্য থেকে শব্দকে (আরবি) দিয়েছে। অনুরূপভাবে আরও একটি কবিতার চরণঃ (আরবি) অর্থাৎ ‘আমি তোমার স্বামীকে রণপ্রান্তরে দেখেছি গলায় তলোয়ার লটকানো অবস্থায় এবং কটি দেশে বর্শা বাঁধা অবস্থায়। এখানেও (আরবি) শব্দটি উহ্য থেকে (আরবি) শব্দকে (আরবি) দিয়েছে।
সূরার প্রথম চারটি আয়াতে মুমিনদের বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে, অতঃপর এই দু’টি আয়াতে কাফিরদের বর্ণনা দেয়া হলো। এখন কপটাচারী মুনাফিকদের বিস্তারিত আলোচনা হতে যাচ্ছে যারা বাহ্যতঃ ঈমানদাররূপে প্রকাশ পায়, কিন্তু প্রকতপক্ষে ও গোপনে গোপনে তারা কাফির। সাধারণতঃ তাদের চতুরতা গোপন থেকে যায় বলে তাদের আলোচনা কিছুটা বিস্তারিতভাবে হয়েছে এবং তাদের অনেক কিছু নিদর্শনও বর্ণনা করা হয়েছে। তাদেরই সম্বন্ধে সূরা-ইবারাআত অবতীর্ণ হয়েছে এবং সূরা-ই-নূর প্রভৃতিতে তাদের সম্বন্ধেই আলোচনা রয়েছে যাতে তাদের থেকে পূর্ণভাবে রক্ষা পাওয়া যায় এবং মুসলমানেরা তাদের জঘন্য ও নিন্দনীয় স্বভাব থেকে দূরে সরে থাকতে পারে। তাই মহান আল্লাহ বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেনঃ
সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।