আল কুরআন


সূরা আল-হজ্জ (আয়াত: 27)

সূরা আল-হজ্জ (আয়াত: 27)



হরকত ছাড়া:

وأذن في الناس بالحج يأتوك رجالا وعلى كل ضامر يأتين من كل فج عميق ﴿٢٧﴾




হরকত সহ:

وَ اَذِّنْ فِی النَّاسِ بِالْحَجِّ یَاْتُوْکَ رِجَالًا وَّ عَلٰی کُلِّ ضَامِرٍ یَّاْتِیْنَ مِنْ کُلِّ فَجٍّ عَمِیْقٍ ﴿ۙ۲۷﴾




উচ্চারণ: ওয়া আযযিনফিন্না-ছি বিলহাজ্জি ইয়া’তূকা রিজা-লাওঁ ওয়া ‘আলা-কুল্লি দামিরিইঁ ইয়া’তীনা মিন কুল্লি ফাজজিন ‘আমীক।




আল বায়ান: ‘আর মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা দাও; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং কৃশকায় উটে চড়ে দূর পথ পাড়ি দিয়ে’।




আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ২৭. আর মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দিন(১), তারা আপনার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সব ধরনের কৃশকায় উটের পিঠে করে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে(২);




তাইসীরুল ক্বুরআন: আর মানুষের মাঝে হাজ্জের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে, আর সব (পথক্লান্ত) শীর্ণ উটের পিঠে, বহু দূরের গভীর পর্বত সংকুল পথ বেয়ে




আহসানুল বায়ান: (২৭) এবং মানুষের মাঝে হজ্জের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটসমূহের পিঠে (সওয়ার হয়ে), [1] তারা আসবে দূর-দূরান্তর পথ অতিক্রম করে। [2]



মুজিবুর রহমান: এবং মানুষের কাছে হাজ্জের ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পদব্রজে ও সর্ব প্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রসমূহের পিঠে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে –



ফযলুর রহমান: আর মানুষের মধ্যে হজ্জের ঘোষণা প্রচার করো; তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে ও প্রতিটি আরোহণের পশুতে চড়ে, যারা গভীর গিরিপথ ধরে (দূর-দূরান্ত থেকে) চলে আসবে;



মুহিউদ্দিন খান: এবং মানুষের মধ্যে হজ্বের জন্যে ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে।



জহুরুল হক: আর লোকদের মধ্যে হজের কথা ঘোষণা ক’রে দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে আর প্রত্যেক শীর্ণ উটের উপরে, প্রত্যেক দূর-দুরান্ত দেশ থেকে, --



Sahih International: And proclaim to the people the Hajj [pilgrimage]; they will come to you on foot and on every lean camel; they will come from every distant pass -



তাফসীরে যাকারিয়া

অনুবাদ: ২৭. আর মানুষের কাছে হজের ঘোষণা করে দিন(১), তারা আপনার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সব ধরনের কৃশকায় উটের পিঠে করে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে(২);


তাফসীর:

(১) ইবরাহীম 'আলাইহিস সালাম-এর প্রতি তৃতীয় আদেশ এই যে, মানুষের মধ্যে ঘোষণা করে দিন যে, বায়তুল্লাহর হজ্জ তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে। ইবনে আবী হাতেম ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন যে, যখন ইবরাহীম 'আলাইহিস সালাম-কে হজ্জ ফরয হওয়ার কথা ঘোষণা করার আদেশ দেয়া হয়, তখন তিনি আল্লাহর কাছে আরয করলেনঃ এখানে তো জনমানবহীন প্রান্তর। ঘোষণা শোনার মত কেউ নেই; যেখানে জনবসতি আছে। সেখানে আমার আওয়াজ কিভাবে পৌছবে? জবাবে আল্লাহ তা'আলা বললেনঃ আপনার দায়িত্ব শুধু ঘোষণা করা। বিশ্বে পৌছানোর দায়িত্ব আমার। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মাকামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলে আল্লাহ তা'আলা তা উচ্চ করে দেন।

কোন কোন বর্ণনায় আছে, তিনি আবু কুবাইস পাহাড়ে আরোহণ করে দুই কানে আঙ্গুলি রেখে ডানে-বামে এবং পূর্বপশ্চিমে মুখ করে বললেনঃ “লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তা গৃহ নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের উপর এই গৃহের হজ ফরয করেছেন। তোমরা সবাই পালনকর্তার আদেশ পালন কর।” এই বর্ণনায় আরো বলা হয়েছে যে, ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম-এর এই আওয়াজ আল্লাহ তা’আলা বিশ্বের কোণে কোণে পৌছে দেন এবং শুধু তখনকার জীবিত মানুষ পর্যন্তই নয়; বরং ভবিষ্যতে কেয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আগমনকারী ছিল, তাদের প্রত্যেকের কান পর্যন্ত এ আওয়াজ পৌছে দেয়া হয়। যার যার ভাগ্যে আল্লাহ্ তা'আলা হজ লিখে দিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেই এই আওয়াজের জবাবে (لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ) এ বলেছে। অর্থাৎ হাজির হওয়ার কথা স্বীকার করেছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ ইবরাহিমী আওয়াজের জবাবই হচ্ছে হজ্জে ‘লাব্বাইকা’ বলার আসল ভিত্তি। [দেখুন: তাবারীঃ ১৪/১৪৪, হাকীম মুস্তাদরাকঃ ২/৩৮৮]


(২) এ আয়াতে সেই প্রতিক্রিয়া বর্ণনা করা হয়েছে, যা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর ঘোষণাকে সব মানবমণ্ডলী পর্যন্ত পৌছানোর কারণে কেয়ামত পর্যন্তের জন্য কায়েম হয়ে গেছে। তা এই যে, বিশ্বের প্রতিটি প্রত্যন্ত এলাকা থেকেও মানুষ বায়তুল্লাহর দিকে চলে আসবে; কেউ পদব্রজে, কেউ সওয়ার হয়ে। যারা সওয়ার হয়ে আসবে, তারাও দূর-দূরান্ত দেশ থেকে আগমন করবে। ফলে তাদের সওয়ারীর জন্তুগুলো কৃশকায় হয়ে যাবে। পরবর্তী নবীগণ এবং তাদের উম্মতগণও এই আদেশের অনুসারী ছিলেন। ঈসা আলাইহিস সালাম-এর পর যে সুদীর্ঘ জাহেলিয়াতের যুগ অতিবাহিত হয়েছে, তাতেও আরবের বাসিন্দারা মূর্তিপূজায় লিপ্ত থাকা সত্বেও হজ্জের বিধান তেমনিভাবে পালন করেছে, যেমন ইবরাহীম ‘আলাইহিস সালাম থেকে বর্ণিত ছিল। যদিও পরবর্তীতে আরবরা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থায় হজ্জের সঠিক পদ্ধতি পরিবর্তন করে নিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সে সমস্ত ভুলের সংশোধন করে দিয়েছিলেন।


তাফসীরে আহসানুল বায়ান

অনুবাদ: (২৭) এবং মানুষের মাঝে হজ্জের ঘোষণা দাও, তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উটসমূহের পিঠে (সওয়ার হয়ে), [1] তারা আসবে দূর-দূরান্তর পথ অতিক্রম করে। [2]


তাফসীর:

[1] যা খাবারের অভাব, সফরের দূরত্ব ও ক্লান্তির জন্য ক্ষীণ ও দুর্বল হয়ে পড়ে।

[2] এটি আল্লাহর কুদরতের মহিমা যে, মক্কার পাহাড়-চূড়া হতে উচ্চারিত সেই অনুচ্চ আহবান পৃথিবীর কোণায় কোণায় পৌঁছে গেছে; প্রত্যেক হজ্জ ও উমরাহ সম্পাদনকারী হজ্জ ও উমরার সময় সেই আহবানে ‘লাব্বাইক’ বলে সাড়া দিয়ে থাকেন।


তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ


তাফসীর: ২৬-৩৬ নং আয়াতের তাফসীর:



(وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيْمَ):



আল্লাহ তা‘আলা অত্র আয়াতে যারা কাবা ঘরে মূর্তি পূজা করত তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেন, তোমরা কাবাগৃহে মূর্তিপূজা করছ, যারা ঐ গৃহে আল্লাহ তা‘আলার সাথে অংশী স্থাপন করছ, তোমরা জেনে রাখ! আমি ইবরাহীম (عليه السلام) -কে নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম কাবাগৃহের স্থান আর সেখানে তার বংশধরের জন্য বসতি স্থাপন করলাম। তখন তাকে এ নির্দেশ দিলাম, তুমি এ ঘর তাক্বওয়া ও আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যের ভিত্তির ওপর নির্মাণ কর। ফলে ইবরাহীম (عليه السلام) ও তাঁর সন্তান নাবী ইসমাঈল তা নির্মাণ করেছিলেন। এ থেকে বুঝা যায়, নূহ (عليه السلام)-এর প্লাবনে কাবা ঘরের ভিত্তি ভেঙ্গে গিয়েছিল। আরো নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তিনি যেন এ গৃহকে তাওয়াফকারী, সালাত আদায়কারী, রুকু ও সাজদাকারীদের জন্য শিরক, অপবিত্রতা, বিদ‘আত থেকে মুক্ত রাখেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:



(وَعَهِدْنَآ إِلٰٓي إِبْرَاهِيْمَ وَإِسْمَاعِيْلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّا۬ئِفِيْنَ وَالْعٰكِفِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُوْدِ)



“আর আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলের নিকট এ অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ই‘তিক্বাফকারী, রুকূকারী এবং সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রেখ।” (সূরা বাক্বারাহ ২:১২৫)



অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি তাকে আরো নির্দেশ দিলাম যে, তুমি হজ্জের ঘোষণা মানুষের মধ্যে দিয়ে দাও যে, তারা যেন দূর-দূরান্ত থেকে এসে এ ঘরের তাওয়াফ করে। আর তারা তথায় আসবে পায়ে হেঁটে অথবা সাওয়ারীর ওপর আরোহণ করে। এর সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা এ কথাও বলেছেন যে, এ স্থানে উপস্থিত হওয়াতে তাদের কোন ক্ষতি নেই বরং এতে রয়েছে তাদের জন্য কল্যাণ। এ কল্যাণ দীনি হতে পারে। যেমন সেখানে গিয়ে মানুষ সালাত, তাওয়াফ ও হজ্জ-উমরার কার্যাবলী দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন করবে। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে:



ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলার নিকট এমন কোন দিনের আমল নেই যা অতি মহত্ত্বপূর্ণ এবং অধিক প্রিয় (হাজ্জের) দশ দিনের আমলের চেয়ে। সুতরাং তোমরা বেশি বেশি করে



اَللّٰهُ أَكْبَرُ ، لَا إِلٰهَ إِلَّا اللّٰهُ এবং اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ



পাঠ কর। (মুসানাদ আহমাদ হা: ৫৪৪৬)



আবার এ কল্যাণ দুনিয়াবীও হতে পারে। যেমন হাজ্জের মৌসুমে হজ্জ করতে গিয়ে তার পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্য করে অর্থ উপার্জন করা। কেননা হাজ্জের মৌসুমে ব্যবসা করা বৈধ।



(أَيَّامٍ مَّعْلُوْمٰتٍ)



দ্বারা মূলত যিলহজ্জ মাসের দশ তারিখ এবং পরবর্তী তিন দিনকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ এগুলো হল: কুরবানীর দিন এবং পরবর্তী তিন দিন। (তাফসীর মুয়াস্সার)



(بَهِيْمَةِ الْأَنْعَامِ)



দ্বারা মূলত উট, গরু, ছাগল এবং ভেড়া বা দুম্বাকে বুঝানো হয়েছে। এদের ওপর আল্লাহ তা‘আলার নাম স্মরণ করা বলতে বুঝানো হয়েছে যে, তাদের জবাইকালে আল্লাহ তা‘আলার নাম নিয়ে জবাই করা। কেননা আল্লাহ তা‘আলার নাম ব্যতীত অন্যের নামে জবাই করলে তা হালাল হবে না।



এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,



(فَكُلُوْا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ)



“অতঃপর তোমরা তা হতে আহার কর‎ এবং আহার করাও ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্ত‎কে ও বিনয়ের সাথে ভিক্ষাকারীকে।” এখান থেকে অনেকে দলীল গ্রহণ করেন যে, কুরবানীর গোশত তিনভাগ করতে হবে। একভাগ নিজের জন্য, দ্বিতীয়ভাগ আত্মীয়-স্বজনের জন্য এবং তৃতীয়ভাগ ফকির-মিসকীনদের জন্য। অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এরূপ কোন নির্দেশই জারী করে দেননি। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে:



রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আমি তোমাদের তিন দিনের বেশি কুরবানীর গোশত রাখতে নিষেধ করেছিলাম, এখন তোমাদেরকে অনুমতি দিচ্ছি তোমরা খাও, প্রয়োজন মত জমা রাখ। অন্য বর্ণনায় এসেছেন খাও, সদাকা কর এবং জমা রাখ। অন্য আরেকটি বর্ণনায় বলা হয়েছেন খাও, খাওয়াও ও সদকা কর। (সহীহ বুখারী হা: ৫৫৬৯, সহীহ মুসলিম হা: ১৯৭১)



সঠিক মত এই যে, কোন আয়াত বা সহীহ হাদীসে এরূপ ভাগাভাগি করতেই হবে এমনটি প্রমাণ পাওয়া যায় না, তাই কেউ যদি ভাগ নাও করে তাতে সে গুনাহগার হবে না। মূলত দেখা হবে তার অন্তরে কী ছিল। তাই আমাদেরকে প্রথমত আমাদের নিয়ত ঠিক করা একান্ত কর্তব্য, তা না হলে কোন আমলই গ্রহণযোগ্য হবে না।



এরপর আল্লাহ তা‘আলা হাজীদেরকে অনুমতি দিলেন তারা যেন তাদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে। অর্থাৎ যিলহজ্জের ১০ তারিখে জামরাতুল কুবরায় পাথর মারার পর হাজীরা প্রাথমিকভাবে হালাল হয়ে যায়। তার পর ইহরাম খুলে ফেলে। এক কথায় স্ত্রী সহবাস ব্যতীত ঐ সব কাজ যা ইহরাম অবস্থায় হারাম ছিল তা হালাল হয়ে যায়। আর অপরচ্ছিন্নতা বলতে চুল, নখ কেটে নিয়ে তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার করা, সেলাই করা কাপড় পরিধান করা ইত্যাদি। আর যদি কেউ কোন মানত করে থাকে তাহলে সে যেন তা পূর্ণ করে। আর তারা যেন সর্বশেষ তাওয়াফ তাওয়াফে ইফাযাহ করে যাকে তাওয়াফে যিয়ারাহও বলা হয়। এটি হাজ্জের একটি রুকন যা আরাফায় অবস্থান ও জামরাতুল কুবরায় পাথর মারার পর করা হয়।



এরপর আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এগুলোই হল, (যা আলোচনা করা হয়েছে) আল্লাহ তা‘আলার বিধান। যে এগুলো পালন করবে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার জন্য সে দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহ তা‘আলার নিকট উত্তম ব্যক্তি বলে গণ্য হবে। হাজ্জের এ সকল বিধি-বিধান সূরা বাক্বারাহ ও সূরা আল ইমরানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।



এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তারা যেন চতুষ্পদ জন্তু যা হালাল করা হয়েছে তা ভক্ষণ করে আর যা হারাম তা থেকে বিরত থাকে। এ সম্পর্কে সূরা মায়িদায়ও আলোচনা করা হয়েছে এবং আল্লাহ তা‘আলা এ নির্দেশও দিয়েছেন, তারা যেন অপবিত্র জিনিস যেমন মূর্তিপূজো থেকে এবং মিথ্যা কথা থেকে বিরত থাকে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:



(قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّـيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوْا بِاللّٰهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِه۪ سُلْطٰنًا وَّأَنْ تَقُوْلُوْا عَلَي اللّٰهِ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ)



“বল:‎ নিশ্চয়ই আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা আর পাপ ও অন্যায় বিরোধিতা এবং কোন কিছুকে আল্লাহর সাথে শরীক করা যার কোন প্রমাণ তিনি প্রেরণ করেননি, এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না।’’ (সূরা আ‘রাফ ৭:৩৩)



হাদীসে বলা হয়েছে: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে বলেন: আমি কি তোমাদেরকে কবীরা গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করব না? সাহাবারা উত্তরে বললেন: হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: ১. আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করা, ২. পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া। ঐ সময় তিনি হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন। এ কথা বলার সময় তিনি সোজা হয়ে বসলেন: অতঃপর বললেন: জেনে রেখে যে, সেটি হল মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। তিনি এ কথা বারবার বলতে থাকেন শেষ পর্যন্ত সাহাবীরা বলেন, আমরা বলতে লাগলাম, যদি তিনি চুপ থাকতেন। (সহীহ বুখারী হা: ২৬৫৪, সহীহ মুসলিম হা: ৮৭)



এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সঙ্গে শির্ককারীর একটি উপমা পেশ করেছেন, তার দৃষ্টান্ত যে আমার সঙ্গে শরীক স্থাপন করে এমন যে, সে যেন আকাশ হতে পড়ল, অতঃপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল এক দূরবর্তী স্থানে।) উক্ত দুই অবস্থাতেই যেমন মৃত্যু বা ধ্বংস অবধারিত, ঠিক অনুরূপ যে ব্যক্তি শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করে সে সুস্থ প্রকৃতি ও আন্তরিক পবিত্রতার দিক দিয়ে পবিত্রতা ও নির্মলতার এক উচ্চাসনে আসীন হয়। কিন্তু যখনই সে শির্কের পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে তখনই সে নিজেকে উঁচু হতে একদম নীচে, পবিত্রতা হতে অপবিত্রতায় এবং নির্মলতা হতে কর্দমাতে নিক্ষেপ করে। যার ফলে সে ধ্বংস হয়।



شعائر এটি شعيرة এর বহুবচন। অর্থ বিশেষ চিহ্ন বা নিদর্শন। অর্থাৎ ইসলামের এমন কিছু বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আনুষ্ঠানিক বিধান যার দ্বারা প্রকাশ পায় এবং অন্য ধর্মাবলম্বী হতে তাকে সহজে পৃথকভাবে চেনা যায়।



এরপর আল্লাহ তা‘আলা চতুষ্পদ জন্তুর উপকারিতার কথা বর্ণনা করেছেন যা আমরা ইতোপর্বে সূরা নাহলে আলোচনা করেছি।



المخبتين অর্থ হল متواضنعين لله অর্থাৎ যারা আল্লাহ তা‘আলার জন্য বিনয়ী হয় তাদের مخبتين বলা হয়।



بدن শব্দটি بدنة এর বহুবচন, এর অর্থ হল: মোটা-তাজা দেহবিশিষ্ট পশুটা। এ উটগুলো হল আল্লাহ তা‘আলার দ্বীনের যে সকল নিদর্শন রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম নিদর্শন।



صواف শব্দটি مصفوفة অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায়। কেননা উটকে দাঁড়ানো অবস্থায় নহর করা হয়।



আয়াত হতে শিক্ষণীয় বিষয়:



১. আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না।

২. হাজ্জের কিছু বিধি-বিধান জানতে পারলাম।

৩. মিথ্যা কথা বলা এবং মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া হতে বিরত থাকতে হবে।

৪. মূর্তি বা এ জাতীয় কোন কিছুরই পূজা করা যাবে না।

৫. প্রত্যেক উম্মাতের জন্যই কুরবানীর বিধান ছিল।

৬. মু’মিনদের অন্তর আল্লাহ তা‘আলার স্মরণে প্রকম্পিত হয়।

৭. কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করা জরুরী নয়, তবে ভাগ করা উত্তম।

৮. যারা প্রকৃত অর্থে আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য জানতে পারলাম।

৯. শির্রকারীর অবস্থা কেমন হবে তা জানা গেল।


তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)


তাফসীর: ২৬-২৭ নং আয়াতের তাফসীর:

এখানে মুশরিকদেরকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে যে, যে ঘরটির ভিত্তি প্রথম দিন থেকেই তাওহীদের উপর স্থাপন করা হয়েছে ওর মধ্যে তারা শিরক চালু করে দিয়েছে। ঐ ঘরের ভিত্তি স্থাপনকারী হলেন হযরত ইবরাহীম খালীলুল্লাহ (আঃ)। সর্বপ্রথম তিনিই ওটা নির্মাণ করেন। হযরত আবূ যার (রাঃ) রাসূলুল্লাহকে (সঃ)! জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কোন মসজিদটি সর্বপ্রথম নির্মিত হয়?” উত্তরে তিনি বলেনঃ “মসজিদে হারাম” আবার তিনি জিজ্ঞেস করেনঃ “তারপর কোন্টি? তিনি জবাব দেনঃ “বায়তুল মুকাদ্দাস। তিনি বলেনঃ “এই দুটি মসজিদের মাঝে কত দিনের ব্যবধান রয়েছেঃ “ তিনি উত্তর দেনঃ “চল্লিশ বছরের ব্যবধান রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেনঃ (আরবী) হতে দুটি আয়াত (৩:৯৬-৯৭)। আর একটি আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ “আমি ইবরাহীম (আঃ) ও ইসমাঈলের (আঃ) কাছে ওয়াদা নিয়েছিলামঃ তোমরা দু'জন আমার ঘরকে পবিত্র রেখো তাওয়াফকারীদের জন্যে, ই'তেকাফকারীদের জন্যে এবং রুকু ও সিজুদাকারীদের জন্যে।” বায়তুল্লাহ শরীফের ভিত্তি স্থাপনের পূর্ণ বর্ণনা আমরা ইতিপূর্বে করেছি। সুতরাং এখানে পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন। এখানে মহান আল্লাহ বলেনঃ এটাকে শুধুমাত্র আমার নামে নির্মাণ করো এবং ওকে পবিত্র রাখো শিরক ইত্যাদি হতে এবং ওকে বিশিষ্ট কর ঐ লোকদের জন্যে যারা একত্ববাদী। তাওয়াফ এমন একটি ইবাদত যা সারা ভূ-পৃষ্ঠের উপর একমাত্র বায়তুল্লাহ ছাড়া আর কোথাও লভ্য নয় এবং জায়েযও নয়। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাওয়াফের সাথে নামাযকে মিলিয়ে দেন এবং কিয়াম, রুকু'ও সিজদার উল্লেখ করেন। কেননা, তাওয়াফ যেমন ওর সাথে বিশিষ্ট, অনুরূপভাবে নামাযের কিবলাও এটাই। তবে যখন মানুষ কিবলা কোন্ দিকে তা বুঝতে পারবে না বা জিহাদে থাকবে অথবা সফরে নফল নামায পড়তে থাকে তখন অবশ্যই কিবলার দিকে মুখ না করা অবস্থাতেও নামায হয়ে যাবে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে ভাল জানেন। অতঃপর নবীকে (সঃ) নির্দেশ দেয়া হয়ঃ মানুষের নিকট তুমি হজ্জের ঘোষণা করে দাও। সমস্ত মানুষকে হজ্জের জন্যে আহবান কর। বর্ণিত আছে যে, ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) আল্লাহ তাআলার নিকট আরয করেনঃ “হে আমার প্রতিপালক! তাদের সকলের কাছে আমার আওয়ায কি করে পৌঁছবে?” উত্তরে আল্লাহ তাআলা তাকে বলেনঃ “তোমার দায়িত্ব শুধু ডাক দেয়া। আওয়ায পৌঁছানোর দায়িত্ব আমার।” সুতরাং রাসূলুল্লাহ (সঃ) মাকামে ইবরাহীমের উপর বা সাফা পাহাড়ের উপর অথবা আবু কুবায়েস পাহাড়ের উপর দাড়িয়ে ডাক দেনঃ “হে লোক সকল! তোমাদের প্রতিপালক তাঁর একটা ঘর বানিয়েছেন। অতএব, তোমরা ঐ ঘরের হজ্জ কর।” তখন পাহাড় ঝুঁকে পড়ে এবং তার শব্দ সারা দুনিয়ায় গুঞ্জরিত হয়। এমনকি যে বাপের পিঠে ও মায়ের পেটে ছিল তার কানেও তাঁর শব্দ পৌঁছে যায়। প্রত্যেক পাথর, গাছ এবং প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যার ভাগ্যে হজ্জ লিখিত ছিল, সবাই সমস্বরে লাব্বায়েক বলে ওঠে। পূর্ব যুগীয় বহু গুরুজন হতে এটা বর্ণিত আছে। এ সব ব্যাপারে আল্লাহ তাআলাই সর্বাধিক সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।

এরপর মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলেনঃ তারা তোমার কাছে আসবে পব্রজে ও সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রসমূহের পিঠে সওয়ার হয়ে। তারা আসবে দর-দূরান্তর পথ অতিক্রম করে। এর দ্বারা কোন মনীষী দলীল গ্রহণ করেছেন যে, যার ক্ষমতা রয়েছে তার জন্যে পদব্রজে হজ্জ করা সওয়ারীর উপর চড়ে হজ্জ করা অপেক্ষা উত্তম। কেননা, কুরআন কারীমে প্রথমে পদব্রজীদের উল্লেখ রয়েছে। তারপর সওয়ারীর কথা আছে। কাজেই পদব্রজের দিকে আকর্ষণ বেশী হলো এবং তাদের সাহসিকতার মর্যাদা দেয়া হলো।

হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “আমার এ আকাংখ্য থেকে গেল যে, যদি আমি পব্রজে হজ্জ করতাম! কেননা, আল্লাহ পাকের ঘোষণায় প্রথমে পব্ৰজীদের উল্লেখ আছে। কিন্তু অধিকাংশ বুযুর্গদের উক্তি এই যে, সওয়ারীর উপর হজ্জ করাই উত্তম। কেননা, রাসূলুল্লাহ পূর্ণ ক্ষমতা সত্ত্বেও পজে হজ্জ করেন নাই। সুতরাং সওয়ারীর উপর হজ্জ করলেই রাসূলুল্লাহর (সঃ) পূর্ণ অনুসরণ করা হবে।

অতঃপর মহান আল্লাহ বলেনঃ তারা আসবে দূর-দূরান্তর পথ অতিক্রম করে। আল্লাহর আলীলের (আঃ) প্রার্থনাও এটাই ছিল। তিনি প্রার্থনায় বলেছিলেনঃ (আরবী) অর্থাৎ “হে আল্লাহ! মানুষের অন্তর তাদের দিকে আকৃষ্ট করে দিন!” (১৪:৩৭)

সত্যিই অজি দেখা যায় যে, দুনিয়ায় এমন কোন মুসলমান নেই যার অন্তর কা'বা গৃহের যিয়ারতের জন্যে আকৃষ্ট নয়। আর যার অন্তরে তাওয়াফের আকাংখা জাগে না!





সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।