আল কুরআন


সূরা আত-তাকাসুর (আয়াত: 7)

সূরা আত-তাকাসুর (আয়াত: 7)



হরকত ছাড়া:

ثم لترونها عين اليقين ﴿٧﴾




হরকত সহ:

ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَیْنَ الْیَقِیْنِ ۙ﴿۷﴾




উচ্চারণ: ছু ম্মা লাতারাউন্নাহা-‘আইনাল ইয়াকীন।




আল বায়ান: তারপর তোমরা তা নিশ্চিত চাক্ষুষ দেখবে।




আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া: ৭. তারপর অবশ্যই তোমরা তা দেখবে চাক্ষুষ প্রত্যয়ে(১),




তাইসীরুল ক্বুরআন: আবার বলি, তোমরা তা অবশ্য অবশ্যই দিব্য দৃষ্টিতে দেখতে পাবে,




আহসানুল বায়ান: ৭। আবার বলি, তোমরা তো ওটা দেখবেই চাক্ষুষ প্রত্যয়ে। [1]



মুজিবুর রহমান: আবার বলি, তোমরাতো ওটা দেখবেই চাক্ষুষ প্রত্যয়ে।



ফযলুর রহমান: অতঃপর তোমরা তা অবশ্যই নিশ্চয়তার চোখে (নিশ্চিত দৃষ্টিতে) দেখবে।



মুহিউদ্দিন খান: অতঃপর তোমরা তা অবশ্যই দেখবে দিব্য প্রত্যয়ে,



জহুরুল হক: আবার বলি, তোমরা অবশ্যই এটি দেখবে নিশ্চিত দৃষ্টিতে।



Sahih International: Then you will surely see it with the eye of certainty.



তাফসীরে যাকারিয়া

অনুবাদ: ৭. তারপর অবশ্যই তোমরা তা দেখবে চাক্ষুষ প্রত্যয়ে(১),


তাফসীর:

(১) উপরে বলা হয়েছে (عَيْنَ الْيَقِينِ) এর অর্থ সে প্রত্যয়, যা চাক্ষুষ দর্শন থেকে অর্জিত হয়। [আদওয়াউল বায়ান} ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, খবর কোনদিন চাক্ষুষ দেখার মত নয়। মূসা আলাইহিস সালাম যখন তুর পর্বতে অবস্থান করছিলেন এবং তার অনুপস্থিতিতে তার সম্প্রদায় গোবৎসের পূজা করতে শুরু করেছিল, তখন আল্লাহ তা'আলা তুর পর্বতেই তাকে অবহিত করেছিলেন যে, বনী-ইসরাঈলরা গোবৎসের পূজায় লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু মূসা আলাইহিস সালাম এর মধ্যে এর তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি, যেমন ফিরে আসার পর স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার ফলে দেখা দিয়েছিল; তিনি ক্ৰোধে আত্মহারা হয়ে তাওরাতের তক্তিগুলো হাত থেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, ফলে সেগুলো ভেঙ্গে যায়। [মুসনাদে আহমাদ: ১/২৭১]


তাফসীরে আহসানুল বায়ান

অনুবাদ: ৭। আবার বলি, তোমরা তো ওটা দেখবেই চাক্ষুষ প্রত্যয়ে। [1]


তাফসীর:

[1] জাহান্নামের প্রথম দর্শন হবে দূর থেকে। আর এ চাক্ষুষ দর্শন হবে নিকট থেকে। এই জন্য এখানে عَين اليَقِين (চাক্ষুষ প্রত্যয়) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।


তাফসীরে ফাতহুল মাজীদ


তাফসীর: নামকরণ:



التَّكَاثُرُ শব্দটি باب تفاعل এর ক্রিয়ামূল (مصدر), অর্থ আধিক্যতার প্রতিযোগিতা করা, বেশি কামনা করা। এখানে কথাটি ব্যাপক : প্রাচুর্যে ধন-মাল, সন্তান-সন্ততি, সহযোগী, বংশ-গোত্র প্রভৃতি সবই শামিল। প্রত্যেক ঐ বস্তু যার প্রাচুর্য ও আধিক্য মানুষের প্রিয় এবং যা অধিক পাওয়ার প্রচেষ্টা ও কামনা মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার দীন ও আখেরাত হতে উদাসীন করে দেয় তাই এখানে উদ্দেশ্য।



التَّكَاثُرُ শব্দটি এ সূরার প্রথম আয়াতে উল্লেখ আছে, এ থেকেই উক্ত নামে সূরার নামকরণ করা হয়েছে। প্রাচুর্যের লালসা মানুষকে আখিরাত বিমুখ করে রেখেছে, অথচ তাকে অবশ্যই সব কিছু ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমাতে হবে, অতঃপর তাকে দেওয়া সব নেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবেÑএ সম্পর্কে সূরায় আলোচনা করা হয়েছে।



يلهي -ألهي অর্থ : গাফেল বা উদাসীন করে দেয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন : দুনিয়ার ভালবাসা ও তার সুখ-সাচ্ছন্দ্য তোমাদেরকে আখিরাতের ব্যাপারে উদাসীন করে ফেলেছে। এমনকি তোমরা মুমূর্ষু অবস্থাতেও দুনিয়ার প্রতি এ লালসায় পড়ে আছো। উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) বলেছেন: আমরা-



لو كان لإبن أدم واد من ذهب أحب أن يكون له واديان



অর্থাৎ আদম সন্তানের একটি স্বর্ণের উপত্যকা থাকলে আরেকটি কামনা করবে। এটাকে কুরআনের আয়াত মনে করতাম এমনবস্থায় (أَلْهٰكُمُ التَّكَاثُرُ) সূরাটি অবতীর্ণ হয়। (সহীহ বুখারী, কিতাবুর রিকাক)



আব্দুল্লাহ বিন শিখ্খির (রাঃ) তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, আমরা নাবী (সাঃ)-এর নিকট হাজির হলাম। এমন সময় তিনি বললেন :



(أَلْهٰكُمُ التَّكَاثُرُ)



আদম সন্তান বলে : আমার সম্পদ-আমার সম্পদ, অথচ তোমার সম্পদ তো সেটুকুই যা তুমি খেয়েছো এবং পরিধান করে ছিড়ে ফেলেছো অথবা সাদকা করে অবশিষ্ট রেখেছো। (সহীহ মুসলিম হা. ২৯৫৮)



রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : মৃত ব্যক্তির সাথে তিনটি জিনিস যায়, তার মধ্যে দু’টি ফিরে আসে, শুধু একটি সাথে থেকে যায়। (যে দু’টি জিনিস ফিরে আসে) আত্মীয়-স্বজন ও ধন-সম্পদ। (একটি জিনিস সাথে যায় তা হলো) আমল। (সহীহ বুখারী হা. ৬৫১৪)



বস্তুত অধিক ধনলিপ্সা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির আকাক্সক্ষা মানুষকে আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য এবং আখেরাতের চিন্তা হতে গাফেল রাখে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ আকাক্সক্ষার শেষ হয় না। আর এটি মানুষের একটি স্বভাবগত প্রবণতা। কাফির-মুশরিকরা এতে ডুবে থাকে। কিন্তু মু’মিন এ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখে এবং সর্বদা আখেরাতের জন্য প্রস্তুত থাকে।



(حَتّٰي زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ)



অর্থাৎ যতক্ষণ না তোমাদের মৃত্যু এসে যায়। অতঃপর তোমরা কবরস্থানে পৌঁছে যাও ও তার বাসিন্দা হয়ে যাও। কবরে যাওয়া পর্যন্ত তোমরা দুনিয়াবী প্রাচুর্যের লালসায় লিপ্ত থাক। মানুষের জীবন আনুমানিক ৬০ থেকে ৭০ বছর। অধিকাংশ মান্ষুই এ সময়ের মাঝেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : আমার উম্মাতের আয়ু ৬০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে হবে। খুব কম সংখ্যকই তা অতিক্রম করবে। (তিরমিযী হা. ৩৫৫০, মিশকাত হা. ৫২৮০, সহীহ) এ অল্প সময়ের জীবনের মাঝে শৈশবের দুর্বলতায় চলে যায় ১৫-১৬ বছর, যৌবন কাল মাত্র ১৬-৪০ বছর তারপর আবার বার্ধ্যকের দুর্বলতা চলে আসে। অতঃপর চলে যেতে হয় অনন্ত কালের জন্য আখিরাতে। সুতরাং এ ক্ষণিক সময়ের জন্য মানুষের এত ব্যস্ততা যে, সে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করার সময়ও পায় না।



রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : তুমি দুনিয়াতে এমনভাবে বসবাস কর যেন তুমি একজন আগন্তুক অথবা মুসাফীর। (অর্থাৎ মুসাফীর যেমন পথিমধ্যে রাত্রি যাপন করার জন্য কোনরকম একটি তাঁবু তৈরি করে রাত অতিক্রম করেÑ ঠিক সেভাবেই তোমরা দুনিয়াকে মূল্যায়ন কর) (সহীহ বুখারী হা. ৬৪১৬)। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, তুমি নিজেকে সর্বদা কবরবাসীদের মধ্যে গণ্য কর। (তিরমিযী হা. ২৩৩৩, মিশকাত হা. ৫২৭৪, সহীহ)। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আখিরাতমুখী হয়ে দুনিয়াতে সচ্ছল জীবন যাপন করার তাওফীক দান করুন।



(كَلَّا سَوْفَ تَعْلَمُوْنَ)



হাসান বাসরী (রহঃ) বলেছেন : এটা ধমকের পর ধমক। অর্থাৎ তোমরা যা করছো তা আদৌ ঠিক নয়। যদি তোমরা জানতে তোমাদের সামনে কী কঠিন অবস্থা অপেক্ষা করছে আর আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া কত নগণ্য তাহলে সৎ কাজের প্রতি ধাবিত হতে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন : জান্নাতের একটি চাবুক রাখার স্থান দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছুর চাইতে উত্তম। (সহীহ বুখারী হা. ৩২৫০) অন্যত্র তিনি বলেন : সর্বশেষ যে ব্যক্তি জান্নাতে যাবে তার জন্য দুনিয়া ও তার সমপরিমাণ দশটি দুনিয়ার মত জায়গা জান্নাতে রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান না থাকার কারণে মানুষ দুনিয়ার বাহ্যিক চাকচিক্যের প্রতি ধাবিত হচ্ছো।



ইলম বা ইয়াকিন (يقين) তিন প্রকার:



(১) حق اليقين এটি তিন প্রকারের সর্বোচ্চ প্রকার। এটা হলো প্রগাঢ় জ্ঞান যা দোদুল্যমান হয়না এবং দূরীভূত হয় না। অথবা এমন জ্ঞান যা আস্বাদন ও সংস্পর্শতার মাধ্যমে অর্জিত হয়।

(২) علم اليقين যে জ্ঞান কোন সংবাদের মাধ্যমে অর্জিত হয়।

(৩) عين اليقين যে জ্ঞান দর্শনের মাধ্যম অর্জিত হয়। (তাফসীর সা‘দী)



এখানে আল্লাহ তা‘আলা علم اليقين ও عين اليقين দুই প্রকার উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ অবশ্য অবশ্যই তোমরা জাহান্নাম স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করবে। এখানে সাধারণভাবে প্রত্যেক আদম সন্তানকে বুঝানো হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন :



(وَإِنْ مِّنْكُمْ إِلَّا وَارِدُهَا ج كَانَ عَلٰي رَبِّكَ حَتْمًا مَّقْضِيًّا) ‏



“এবং তোমাদের প্রত্যেকেই তা (পুলসিরাত) অতিক্রম করবে; এটা তোমার প্রতিপালকের অনিবার্য সিদ্ধান্ত‎।” (সূরা মারইয়াম ১৯: ৭১) এখানে পৌঁছানোর অর্থ প্রবেশ করা নয়, বরং অতিক্রম করা। একে পুলসিরাত বলা হয়। হাদীসে এসেছে, মু’মিনগণ পুলসিরাত পার হয়ে জান্নাতে চলে যাবে বিদ্যুতের বেগে, জাহান্নামের কোন উত্তাপ তারা অনুভব করবে না। কিন্তু কাফির-মুশরিকরা তাতে আটকে যাবে এবং জাহান্নামে পতিত হবে। (আহমাদ হা. ২৪৪৭, মিশকাত হা. ৫৭৩৮, সহদ সহীহ) যেমন পরের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :



(ثُمَّ نُنَجِّي الَّذِيْنَ اتَّقَوْا وَنَذَرُ الظَّالِمِيْنَ فِيْهَا جِثِيًّا)



“অতঃপর আমি মুত্তাকীদেরকে রক্ষা করব এবং জালিমদেরকে সেথায় নতজানু অবস্থায় রেখে দেব।” (সূরা মারইয়াম ১৯: ৭২)



অতএব মু’মিন-কাফির সবাই জাহান্নামকে প্রত্যক্ষ করবে। মু’মিনগণ সহজে পার হয়ে যাবে। কিন্তু কাফিররা জাহান্নামে পতিত হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সেদিনের কঠিন পাকড়াও থেকে রক্ষা করুন। আমীন!





(لَتُسْأَلُنَّ يَوْمَئِذٍ عَنِ النَّعِيْمِ)



অর্থাৎ দুনিয়াতে যত নেয়ামত প্রদান করা হয়েছে সকল নেয়ামত সম্পর্কে আখিরাতে জিজ্ঞাসা করা হবে। আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন : একদা আবূ বকর (রাঃ) ও উসমান (রাঃ) বসেছিলেন। এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের কাছে এসে বললেন : এখানে বসে আছো কেন? উত্তরে তারা বললেন : যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! ক্ষুধা আমাদেরকে ঘর হতে বের করে এনেছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন বললেন : যিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! ক্ষুধা আমাকেও বের করে এনেছে। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে এক আনসারীর বাড়িতে গেলেন। আনসারী বাড়িতে ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আনসারীর স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার স্বামী কোথায়? মহিলা বলল : তিনি আমাদের জন্য মিষ্টি পানি আনার জন্য বাইরে গেছেন। ইতোমধ্যে ঐ আনসারী পানির মশক নিয়ে চলে আসল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবীদের দেখে আনসারী আনন্দে আটখানা হয়ে গেলেন। তিনি বললেন : আমার বাড়িতে আজ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাশরীফ এনেছেন, সুতরাং আমার মত ভাগ্যবান আর কেউ নেই। পানির মশক ঝুলিয়ে রেখে আনসারী বাগানে গিয়ে তাজাতাজা খেজুরের কাঁদি নিয়ে আসলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : বেছে বেছে আনলেই তো হতো। আনসারী বললেন : ভাবলাম যে, আপনি পছন্দ মত বাছাই করে গ্রহণ করবেন। তারপর আনসারী একটি ছুরি হাতে নিলেন (মেষ যবাই করার জন্য)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন : দেখো, দুগ্ধবতী মেষ জবাই করো না। অতঃপর আনসারী তাদের জন্য একটি মেষ জবাই করলেন এবং তাঁরা সেখানে আহার করলেন। তারপর সাহাবীদের লক্ষ্য করে বললেন : দেখো তোমরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় তোমাদের ঘর থেকে বেরিয়েছিলে অথচ এখন পেট পূর্ণ করে ফিরে যাচ্ছো। এ নেয়ামত সম্পর্কে তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে। (সহীহ মুসলিম, পানি অধ্যায়, হা. ১৪০)



নাবী (সাঃ) বলেন : কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন : হে আদম সন্তান! আমি তোমাকে ঘোড়ায় ও উটে আরোহণ করিয়েছিলাম, নারীদের সাথে বিয়ে দিয়েছি, তোমাকে হাসি-খুশিভাবে আনন্দ-উজ্জ্বল জীবন যাপনের সুযোগ দিয়েছি। এবার বল : এগুলোর শুকরিয়া কোথায়? (আহমাদ ২/৪৯২, সনদ সহীহ)



এছাড়াও এ ব্যাপারে অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে। সুতরাং আমরা আল্লাহ তা‘আলা প্রদত্ত প্রত্যেক নেয়ামতের যথার্থ ব্যবহার করব এবং তাঁর শুকরিয়া আদায় করব।



সূরা হতে শিক্ষণীয় বিষয়:



১. আখিরাতকে ভুলে দুনিয়া ও তার চাকচিক্য নিয়ে ব্যস্ত থাকা নিন্দনীয়।

২. কবর জীবনের প্রমাণ পেলাম।

৩. মানুষ বৃদ্ধ হয়ে যায় কিন্তু দুনিয়ার প্রতি তার আশা ও লালসা থেকে যায়।

৪. يقين এর প্রকারভেদ জানা গেল।

৫. প্রত্যেক নেয়ামত সম্পর্কে আখিরাতে প্রশ্ন করা হবে।


তাফসীরে ইবনে কাসীর (তাহক্বীক ছাড়া)


তাফসীর: ১-৮ নং আয়াতের তাফসীর

আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা, দুনিয়া পাওয়ার প্রচেষ্টা তোমাদেরকে আখেরাতের প্রত্যাশা এবং সৎকাজ থেকে বেপরোয়া করে দিয়েছে। তোমরা এ দুনিয়ার ঝামেলাতেই লিপ্ত থাকবে, হঠাৎ মৃত্যু এসে তোমাদেরকে কবরে পৌঁছিয়ে দিবে।

হযরত যায়েদ ইবনে আসলাম (রঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “দুনিয়ার সন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে তোমরা আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়েছে। এবং মৃত্যুর সময় পর্যন্ত এ উদাসীনতা অক্ষুন্ন থেকেছে!”

হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন যে, মানুষের ধন সম্পদ ও সন্তান সংখ্যা বৃদ্ধির লালসা তার মৃত্যুর চিন্তাকে দূরে নিক্ষেপ করেছে।

সহীহ বুখারী শরীফের কিতাবুর রিকাকে আছে যে, হযরত উবাই ইবনে কাব (রাঃ) বলেনঃ আমরা এটাকে কুরআনের আয়াত মনে করতাম,(আরবি) (অর্থাৎ বানী আদমের যদি এক উপত্যকা ভর্তি সোনা থাকে) এটাকে কুরআনের আয়াত মনে করতাম, এমতাবস্থায় (আরবি) এ সূরাটি অবতীর্ণ হয়।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে শুখায়ের (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ আমি যখন নবী করীম (সঃ)-এর দরবারে হাজির হই তখন তিনি এ আয়াত পাঠ করছিলেন। তিনি বলছিলেনঃ “বানী আদম বলছেঃ আমার, মাল, আমার মাল। অথচ তোমার মাল শুধু সেগুলো যেগুলো তুমি খেয়ে শেষ করেছে এবং পরিধান করে ছিড়ে ফেলেছে। অথবা সাদকা করে অবশিষ্ট রেখেছো।” [এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমাদ (রঃ)]

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে অতিরিক্ত এ কথাও রয়েছেঃ “এ ছাড়া অন্য যা কিছু রয়েছে সেগুলো তুমি মানুষের জন্যে রেখে চলে যাবে।” (এ হাদীসটি ইমাম মুসলিম (রঃ), ইমাম তিরমিযী (রঃ) এবং ইমাম নাসাঈও (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

সহীহ বুখারীতে হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “মৃত ব্যক্তির সাথে তিনটি জিনিষ যায়, তার মধ্যে দুটি ফিরে আসে, শুধু একটি সাথে থেকে যায়। (ওগুলো হলো) আত্মীয়-স্বজন, ধন-সম্পদ এবং আমল। প্রথমোক্ত দুটি ফিরে আসে শুধু আমল সাথে থেকে যায়।”

মুসনাদে আহমাদে হযরত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ “আদম সন্তান বৃদ্ধ হয়ে যায়, কিন্তু দুটি জিনিস তার সাথে অবশিষ্ট থেকে যায়, লোভ ও আকাঙখা।” (ইমাম বুখারী (রঃ) ও ইমাম মুসলিম (রঃ) এ হাদীসটি তাখরীজ করেছেন)

হযরত যহহাক (রঃ) একটি লোকের হাতে একটি দিরহাম দেখে তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ “এ দিরহাম কার?” উত্তরে লোকটি বললোঃ “আমার।” তখন হযরত যহহাক (রঃ)তাকে বললেনঃ “এটা তোমার তখনই হবে যখন তুমি এটাকে সকাজে অথবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনার্থে (আল্লাহর পথে) খরচ করবে।” অতঃপর তিনি দৃষ্টান্ত স্বরূপ নিম্নের কবিতাংশটি পাঠ করেন। (আরবি)

অর্থাৎ “যখন তুমি মাল (আল্লাহর পথে খরচ না করে) রুকে রাখবে তখন তুমি হবে তার মালিকানাধীন। আর যখন তুমি তা খরচ করবে তখন ঐমাল তোমার মালিকানাধীন হয়ে যবে।” (এটা ইবনে আসাকির (রঃ) বর্ণনা করেছেন)

মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত ইবনে বুরাইদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, এই সূরাটি আনসারের দুটি গোত্র বানূ হারিসাহ্ এবং বানূ হারিসের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়। তারা একে অপরের উপর গর্ব প্রকাশ করতে থাকে। তারা বলেঃ দেখো, আমাদের মধ্যে অমুক ব্যক্তি এ রকম বাহাদুর, এ রকম অর্থ-সম্পদের অধিকারী ইত্যাদি। জীবিত ব্যক্তিদের ব্যাপারে এ রকম গর্ব প্রকাশ করার পর বলেঃ চলো, কবরস্থানে যাই। সেখানে তারা নিজ নিজ সর্দারের কবরের প্রতি ইশারা করে বলতে শুরু করেঃ বলতো, এর মত তোমাদের মধ্যে কেউ কি ছিল? মৃত ব্যক্তিদের নাম নিয়ে নিয়ে তারা নানা অপবাদ দিতে থাকে এবং তাদেরকে ভৎর্সনা করে। আল্লাহ তায়ালা তখন এ সূরার প্রথম দু’টি আয়াত অবতীর্ণ করেন। আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন রাখে, এমন কি তোমরা কবরে উপনীত হও। অর্থাৎ কবরে উপনীত হয়ে নিজেদের সর্দারদের ব্যাপারেও গর্ব করতে থাকো। অথচ তোমাদের উচিত ছিল সেখানে গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করা। পূর্ব পুরুষদের মরে যাওয়া ও পচে গলে যাওয়ার কথা চিন্তা করে নিজেদের পরিণতি চিন্তা করা উচিত ছিল।

হযরত কাতাদা (রঃ) বলেনঃ মানুষ নিজের প্রাচুর্যের ব্যাপারে অহংকার করছে আর একে একে কবরে গিয়ে প্রবেশ করছে। অর্থাৎ প্রাচুর্যের আকাক্ষা তাকে উদাসীনতায় নিমজ্জিত রেখেছে এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে এবং সমাধিস্থ হয়েছে।

সহীহ্ হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এক বেদুইনের মৃত্যুকালে তার পরিচর্যার জন্যে হাজির হলেন এবং যথা অভ্যাস বললেনঃ “কোন ভয় নেই, ইনশাআল্লাহ তুমি গুনাহ থেকে পবিত্রতা লাভ করবে।” লোকটি তখন বললোঃ আপনি পবিত্রতা লাভ করার কথা বলছেন, কিন্তু এটা এমন জ্বর যার প্রকোপ বড়দেরকেও ঘায়েল করে ফেলে এবং কবরে পৌছিয়ে দেয়।” তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বললেনঃ “আচ্ছা, তাহলে তোমার কথাই ঠিক।” এ হাদীসেও (আরবি) শব্দ রয়েছে। আলোচ্য সূরাতেও (আরবি) রয়েছে। এর অর্থ হলো মৃত্যুবরণ করে কবরে উপনীত হওয়া।

জামে তিরমিযীতে হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “এ আয়াত অবতীর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কবরের আযাব সম্পর্কে সন্ধিহানই ছিলাম।” (এ হাদীসটি উসূলে হাদীসের পরিভাষায় গারীব বা দুর্বল)

মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে মায়মূন ইবনে মিহরান (রঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি একদা হযরত উমর ইবনে আবদিল আযীয (রঃ)-এর নিকট উপবিষ্ট ছিলেন। ঐ সময় তিনি (আরবি)
এই আয়াত পাঠ করেন। তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেনঃ “হে মায়মূন (রঃ)! কবরসমূহ দেখার উদ্দেশ্য হলো যিয়ারত করা, প্রত্যেক যিয়ারতকারী নিজের জায়গায় ফিরে যায়। অর্থাৎ হয়তো জাহান্নামের দিকে যায়, না হয় জান্নাতের দিকে যায়।”

একজন বেদুইন এক ব্যক্তির মুখে এ আয়াত দু’টি শুনে বলেছিলঃ “আসল বাসস্থান তো অন্যত্রই বটে।”

এরপর আল্লাহ্ তা'আলা হুমকির সুরে দু'দুবার বলেনঃ কখনো নয়, শ্রীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। আবারও বলিঃ কখনো নয়, অচিরেই তোমরা জানতে পারবে। এ অর্থও করা হয়েছে যে, প্রথমবার কাফিরদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। এবং দ্বিতীয়বার মু'মিনদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে।

তারপর মহা প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলেনঃ কখনো নয়, যদি তোমরা নিশ্চিতরূপে অবগত হতে তবে এরূপ দাম্ভিকতার মধ্যে পতিত থাকতে না। অর্থাৎ মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেদের শেষ মনযিল আখেরাত সম্পর্কে উদাসীন থাকতে না। এরপর প্রথমোক্ত বিষয়ের বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহ্ বলেছেনঃ তোমরা তো জাহান্নাম দেখবেই। সেই জাহান্নামের ভয়াবহতা এক নযর দেখেই ভয়ে-ভীতিতে অন্যেরা তো বটেই, আম্বিয়ায়ে কিরামও হাঁটুর ভরে পড়ে যাবেন। ওর কাঠিন্য ও ভীতি প্রত্যেকের অন্তরে ছেয়ে যাবে। এ সম্পর্কে বহু হাদীসে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

অতঃপর আল্লাহ্ তা'আলা বলেনঃ এরপর অবশ্যই সেইদিন তোমাদেরকে নিয়ামত সম্বন্ধে প্রশ্ন করা হবে। স্বাস্থ্য, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিরাপত্তা, রিহ্যাক ইত্যাদি সকল নিয়ামত সম্বন্ধেই প্রশ্ন করা হবে। এসব নিয়ামতের কতটুকু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে তা জিজ্ঞেস করা হবে।

মুসনাদে ইবনে আবী হাতিমে হযরত উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা ঠিক দুপুরে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) ঘর হতে বের হন। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখেন যে, হযরত আবু বকর (রাঃ)ও মসজিদের দিকে আসছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ এ সময়ে বের হলে কেন?” উত্তরে হযরত আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ “যে কারণ আপনাকে ঘর হতে বের করেছে ঐ একই কারণ আমাকেও ঘর হতে বের করেছে।” ঐ সময়ে হযরত উমর (রাঃ)ও এসে তাঁদের সাথে মিলিত হন। তাঁকে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) জিজ্ঞেস করলেনঃ “এই সময়ে বের হলে কেন?” তিনি জবাবে বললেনঃ “যে কারণ আপনাদের দুজনকে বের করেছে ঐ কারণই আমাকেও বের করেছে।” এরপর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) তাদের সাথে আলাপ শুরু করলেন। তিনি তাদেরকে বললেনঃ “সম্ভব হলে চলো, আমরা ঐ বাগান পর্যন্ত যাই। ওখানে আহারেরও ব্যবস্থা হবে এবং ছায়াদানকারী জায়গাও পাওয়া যাবে। তারা বললেন, “ঠিক আছে, চলুন।” অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে আবুল হায়সাম (রাঃ) নামক সাহাবীর বাগানের দরজায় উপনীত হলেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) দরজায় গিয়ে সালাম জানালেন এবং ভিতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। উম্মে হায়সাম দরজার ওপাশেই দাড়িয়ে সবকিছু শুনতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু উচ্চস্বরে জবাব দিচ্ছিলেন না। তিনি আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর নিকট থেকে শান্তির দু’আ বেশী পরিমানে পাওয়ার লোভেই এ নীরবতা পালন করছিলেন। তিনবার সালাম জানিয়েও কোন জবাব না পেয়ে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) সঙ্গীদ্বয়সহ ফিরে আসতে উদ্যত হলেন। এবার উম্মে হায়সাম (রাঃ) ছুটে গিয়ে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আপনার আওয়ায আমি শুনছিলাম, কিন্তু আপনার সালাম বেশী বেশী পাওয়ার লোভেই উচ্চস্বরে জবাব দেইনি। এখন আপনি চলুন।” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) হযরত উম্মে হায়সাম (রাঃ)-এর এ ব্যবহারে বিরক্ত হলেন না। জিজ্ঞেস করলেনঃ “আবু হায়সাম (রাঃ) কোথায়?” উম্মে হায়সাম (রাঃ) উত্তরে বললেনঃ “তিনি নিকটেই আছেন, পানি আনতে গেছেন। এক্ষুণি তিনি এসে পড়বেন, আপনি এসে বসুন!” রাসূলুল্লাহ্ (রাঃ) এবং তাঁর সঙ্গীদ্বয় বাগানে প্রবেশ করলেন। উম্মে হায়সাম (রাঃ) ছায়া দানকারী একটি গাছের তলায় কিছু বিছিয়ে দিলেন। রাসুলুল্লাহ (সঃ) স্বীয় সঙ্গীদ্বয়কে সেখানে উপবেশন করলেন। ইতিমধ্যে আবু হায়সামও (রাঃ) এসে পড়লেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এবং তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে দেখে তাঁর আনন্দের কোন সীমা থাকলো না। এতে তিনি মানসিক শান্তি লাভ করলেন। তাড়াতাড়ি একটা খেজুর গাছে উঠলেন এবং ভাল ভাল খেজুর পাড়তে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) নিষেধ করার পর থামলেন এবং নেমে এলেন। এসে বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কাঁচা, পাকা, শুকনো, সিক্ত ইত্যাদি সব রকম খেজুরই রয়েছে। যেটা ইচ্ছা ভক্ষণ করুন।” তারা ওগুলো ভক্ষণ করলেন। তারপর মিষ্টি ও ঠাণ্ডা পানি দেয়া হলো। তারা সবাই পান করলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ “এই নিয়ামত সম্পর্কে তোমাদেরকে আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞেস করা হবে।” এ ধারায় এ হাদীসটি গারীব বা দুর্বল।

ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) এ হাদীসটি নিম্নরূপে বর্ণনা করেছেনঃ

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু বকর (রাঃ) ও হযরত উমার (রাঃ) এসেছিলেন এমন সময় রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদের কাছে এলেন এবং বললেনঃ “এখানে বসে আছ কেন?” উত্তরে তাঁরা বললেনঃ “যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তার শপথ! ক্ষুধা আমাদেরকে ঘর হতে বের করে এনেছে।” রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন বললেনঃ “যিনি আমাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন তাঁর শপথ! ক্ষুধা আমাকেও বের করে এনেছে।” তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) ঐ দুই সাহাবী (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে এক আনসারীর বাড়িতে গেলেন। আনসারী বাড়িতে ছিলেন না। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) আনসারীর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেনঃ “তোমার স্বামী কোথায়?” মহিলা উত্তরে বললেনঃ “তিনি আমাদের জন্যে মিষ্টি পানি আনতে গেছেন। ইতিমধ্যে ঐ আনসারী পানির মশক নিয়ে এসেই পড়লেন। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এবং তাঁর সঙ্গীদ্বয়কে দেখে আনসারী আনন্দে আটখানা হয়ে গেলেন। তিনি বললেনঃ “আমার বাড়িতে আজ আল্লাহর রাসূল (সঃ) তাশরীফ এনেছেন, সুতরাং আমার মত ভাগ্যবান আর কেউ নেই।” পানির মশক ঝুলিয়ে রেখে আনসারী বাগানে গিয়ে তা তাযা খেজুরের কাদি নিয়ে আসলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) বললেনঃ বেছে বেছে আনলেই তো হতো?” আনসারী বললেনঃ “ভাবলাম যে, আপনি পছন্দ মত বাছাই করে গ্রহণ করবেন। তারপর (একটা বকরী বা মেষ যবাহ করার জন্যে) আনসারী একটি ছুরি হাতে নিলেন। রাসূলুল্লাহ্ বললেনঃ “দেখো, দুগ্ধবতী (কোন বকরী বা মেষ) যবাহ করো না।” অতঃপর আনসারী তাঁদের জন্যে (কিছু একটা) যবাহ করলেন এবং তারা সেখানে আহার করলেন। তারপর তিনি সাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ “দেখো, ক্ষুধার্ত অবস্থায় তোমরা ঘর থেকে বেরিয়েছিলে, অথচ এখন পেট পূর্ণ করে ফিরে যাচ্ছ। এই নিয়ামত সম্পর্কে তোমরা কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।”

রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর আযাদকৃত দাস হযরত আবূ উসায়েব (রাঃ) বলেনঃ “একদা রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) আমার পার্শ্ব দিয়ে গমন করে আমাকে ডাক দেন। তারপর হযরত আবূ বকর (রাঃ) ও হযরত উমার (রাঃ)-এর পার্শ্ব দিয়ে গমন করেন এবং তাদেরকেও ডেকে নেন। তারপর এক আনসারীর বাগানে গিয়ে বললেনঃ “দাও ভাই, খেতে দাও।” আনসারী তখন এক গুচ্ছ আঙ্গুর এনে দিলেন। রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এবং সঙ্গীরা তা ভক্ষণ করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) আনসারীকে বললেনঃ “ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এসো।” আনসারী পানি এনে দিলে রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) এবং তাঁর সঙ্গীরা তা পান করলেন। তারপর নবীকরীম (সঃ) বললেনঃ “কিয়ামতের দিন এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।”এ কথা শুনে হযরত উমার (রাঃ) খেজুর গুচ্ছ উঠিয়ে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে বললেনঃ “এ সম্পর্কেও জিজ্ঞাসিত হতে হবে?” রাসূলুল্লাহ্ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “হ্যা। তবে তিনটি জিনিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। তা হলো সম্ভ্রম রক্ষার উপযোগী পোশাক, ক্ষুধা নিবৃত্তির উপযোগী খাদ্য এবং শীত-গ্রীষ্ম থেকে রক্ষা পাওয়ার উপযোগী গৃহ।” (এ হাদীসটি ইমাম আহমাদ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন)

হযরত জাবির ইবনে আবদিল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উমার (রাঃ) খেজুর ভক্ষণ করেন ও পানি পান করেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ “এই নিয়ামত সম্বন্ধে তোমরা অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে।” (এ হাদীসটিও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে)

হযরত মাহমুদ ইবনে রাবী হতে বর্ণিত আছে যে, যখন (আরবি) এ সূরা অবতীর্ণ হয়, তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) সাহাবীদেরকে এটা পাঠ করে শুনান। যখন তিনি(আরবি) পর্যন্ত পৌঁছেন তখন সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! কোন নিয়ামত সম্বন্ধে আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে? খেজুর খাচ্ছি, পানি পান করছি, ঘাড়ের উপর তরবারী ঝুলছে, শত্রু শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে। সুতরাং আমরা কোন নিয়ামত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হববা?” রাসূলুল্লাহ (সঃ) উত্তরে বললেনঃ “ভয় করো না, শীঘ্রই নিয়ামত এসে পৌঁছবে।” (ইমাম আহমাদ (রঃ) এর হাদীসটি বর্ণনা করেছেন)

মুআয ইবনে আবদিল্লাহ ইবনে হাবীব (রঃ) হতে বর্ণিত, তিনি তাঁর পিতা হতে এবং তিনি তাঁর চাচা হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি (তাঁর চাচা) বলেনঃ

“আমরা এক মজলিসে বসেছিলাম এমন সময় নবী করীম (সঃ) আমাদের নিকট আগমন করলেন, তাঁর মাথায় পানির চিহ্ন পরিলক্ষিত হচ্ছিল (তিনি গোসল করে এসেছেন বলে মনে হচ্ছিল)। আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসুল (সঃ)! আপনাকে তো বেশ আনন্দিত চিত্ত মনে হচ্ছে? তিনি উত্তরে বললেনঃ “হ্যা, তাই।” তারপর “গিনা বা ধন ঐশ্বর্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “যার অন্তরে আল্লাহ ভীতি রয়েছে তার জন্যে “গিনা বা ধন সম্পদ খারাপ জিনিষ নয়। মনে রেখো, পরহেযগার ব্যক্তির জন্যে সুস্থতা গিনার চেয়েও উত্তম। আনন্দ চিত্ততাও আল্লাহ তা'আলার নিয়ামত।” (এ হাদীসটিও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে। সুনানে ইবনে মাজাহতেও রয়েছে)

হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ “নিয়ামতের প্রশ্নে কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথমে বলা হবেঃ “আমি কি তোমাকে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা দান করিনি? ঠাণ্ডা পানি দিয়ে তোমাকে কি পরিতৃপ্ত করিনি?”

হযরত ইকরামা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, যখন (আরবি) এ আয়াত অবতীর্ণ হলো তখন সাহাবীগণ বললেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমরা কি এমন নিয়ামত ভোগ করছি যে, সে সম্বন্ধে আমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে? আমরা তো যবের রুটি ভক্ষণ করছি, (তাও পেট পুরে নয়, বরং) অর্ধভুক্ত থেকে যাচ্ছি?” তখন আল্লাহ তা'আলা তাঁর নবী (সঃ) এর কাছে অহী পাঠালেনঃ তুমি তাদেরকে বলে দাওঃ তোমরা কি (পায়ের আরামের জন্যে) জুতা পরিধান কর না এবং (তৃষ্ণা নিবারণের জন্যে) ঠাণ্ডা পানি পান কর না? এই নিয়ামতগুলো সম্পর্কেই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে। (এ হাদীসটি ইমাম ইবনে আবী হাতিম (রঃ) করেছেন) অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে যে, শান্তি, নিরাপত্তা এবং সুস্থতা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।

পেট পুরে আহার করা, ঠাণ্ডা পানি পান করা ছায়াদানকারী ঘরে বাস করা, আরামদায়ক ঘুম যাওয়া, আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করা, এমনকি মধু পান করা, সকাল বিকাল আহার করা, ঘি, মধু, ময়দার রুটি ইত্যাদি সম্পর্কে আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে বলেনঃ শারীরিক সুস্থতা, কান চোখের সুস্থতা ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবেঃ তোমরা এ সবকে কি কাজে ব্যবহার করেছো? যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ (আরবি)

অর্থাৎ ‘কর্ণ, চক্ষু, হৃদয় ওগুলোর প্রত্যেকটির সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।” (১৭:৩৬)।

সহীহ বুখারী, সুনানে তিরমিযী, সুনানে নাসাঈ এবং সুনানে ইবনে মাজাহতে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ

“দু'টি নিয়ামত সম্পর্কে মানুষ খুবই উদাসীনতার মধ্যে রয়েছে। ও দু'টি নিয়ামত হলো স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছলতা।” অর্থাৎ মানুষ এ দুটোর পূর্ণ কৃতজ্ঞতা ও প্রকাশ করে না এবং এদুটোর শ্রেষ্ঠত্ব এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও অবগত নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে এ দুটি ব্যয় করে না। উল্লেখ্য যে, সম্ভ্রম রক্ষার উপযোগী পোশাক, ক্ষুধা নিবৃত্তির উপযোগী আহার এবং শীত গ্রীষ্ম হতে রক্ষা পাওয়ার গহ ছাড়া অন্য সবকিছু সম্পর্কেই কিয়ামতের দিন হিসাব দিতে হবে।

মুসনাদে আহমাদে হযরত আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সঃ) বলেছেনঃ মহামহিমান্বিত আল্লাহ কিয়ামতের দিন বলবেনঃ “হে আদম সন্তান! আমি তোমাকে ঘোড়ায় ও উষ্ট্রে আরোহণ করিয়েছি, নারীদের সাথে বিয়ে দিয়েছি। তোমাকে হাসি খুশীভাবে আনন্দ উজ্জ্বল জীবন যাপনের। সুযোগ দিয়েছি। এবার বল তো, এগুলোর জন্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কোথায়?”





সতর্কবার্তা
কুরআনের কো্নো অনুবাদ ১০০% নির্ভুল হতে পারে না এবং এটি কুরআন পাঠের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় না। আমরা এখানে বাংলা ভাষায় অনূদিত প্রায় ৮ জন অনুবাদকের অনুবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আমরা তাদের নির্ভুলতার গ্যারান্টি দিতে পারি না।